‘রাজবংশী জাতির জনক’ পঞ্চানন বর্মা



ড. রূপ কুমার বর্মণ
লেখক কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক

লেখক কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক

  • Font increase
  • Font Decrease

উপমহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল ধারক ও বাহক হিসাবে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মূলবাসিন্দাদের (indigenous) অবদান ও অবস্থান ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্ডিত ও গবেষকগণের আলোচনার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাশ্চাত্য ভাব ও চিন্তাধারার দ্বারা আচ্ছাদিত বিদ্বৎসমাজ (বা পণ্ডিতকূল) এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক অবদানকে তথাকথিত মূল সংস্কৃতির পরিধির বাইরে রাখার প্রয়াসে সবসময় যত্নশীল। তাই ঔপনিবেশিক আমলের প্রান্তিকায়িত জনগোষ্ঠীর কোন সুশিক্ষিত ব্যক্তির স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতিগঠনের অবদানকেও ঔপনিবেশিক শাসনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বাংলা (এমনকি ভারতের) পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করা প্রায় অসম্ভব।

উদাহরণ হিসাবে এখানে আমরা ঔপনিবেশিক বাংলা ও ঔপনিবেশিকোত্তর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কথা বলতে পারি। ঔপনিবেশিক সরকার ও তাঁদের সহযোগীদের (agent বা collaborators) বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকদের প্রথম  (রংপুর বিদ্রোহ, ১৭৮৩) ও শেষ (তেভাগা, ১৯৪৬) সংগ্রামে রাজবংশী কৃষকদের অংশ গ্রহণ সর্বজনবিদিত। আবার বাংলার সংস্কৃতির গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সঙ্গীতের উদাহরণ হিসাবে (আরোও কয়েকটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে) রাজবংশীদের ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের কথাও উঠে আসে।

বিশ শতকের গোড়ায় প্রথম যখন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের শুরু করেছিলেন বা মুসলমানগণ তাঁদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন সেই সময়ে রাজবংশীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে মূল ঋত্বিক ও অনুঘটক  ছিলেন পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৫-১৯৩৫)। তিনি শুধুমাত্র রাজবংশী জাতির জনকই হয়ে ওঠেন নি, তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন প্রান্তিক মানুষের প্রেরণাদাতা হিসাবে যিনি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

পঞ্চানন বর্মার পিতৃদত্ত পদবি ছিল ‘সরকার’। পিতা খোসাল চন্দ্র সরকার ও মাতা চম্পলদেবীর পুত্র পঞ্চাননের জন্ম হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের মাথাভাঙ্গা মহকুমার খলিসামারি গ্রামে। কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে পঞ্চানন সরকার সাফল্যের সঙ্গে এফ. এ., বি. এ., এম. এ. (সংস্কৃত) এবং বি. এল. শিক্ষা সমাপ্ত করেন। কিন্তু রাজানুগ্রহ না থাকায় কোচবিহার রাজ্যে তিনি কোন উপযুক্ত কাজ পাননি। তাই ব্রিটিশ বাংলার রংপুরে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন (১৯০১) একজন আইনজীবী হিসাবে। একই সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সুরেশচন্দ্র রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রংপুর শাখার সঙ্গে। এই শাখার সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সম্পাদক হিসাবে পঞ্চানন সরকার (বর্মা) তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে আবিস্কার করেছিলেন ‘গোবিন্দ মিশ্রের গীতার’ পুঁথি। এই পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্বিজকমল লোচনের চণ্ডিকাবিজয় কাব্যের টীকা' (১৯১৫), ‘কামতাবিহারী সাহিত্য’ শিরোনামের প্রবন্ধ (১৯১০) ও বেশ কয়েকটি কবিতা। অর্থাৎ ভারতের জাতীয় ইতিহাসের প্রেক্ষিতে পঞ্চাননের ‘কথা বলা’  ও ‘লেখার যোগ্যতা’ প্রমানের জন্য এই কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ঠ।

কিন্তু এই যোগ্যতা তাঁকে জাতপাতের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। পঞ্চাননকে তৎকালীন বাংলার উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের জাতিগত অহংকারের আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছিল রংপুরের আদালত চত্বরে। তাঁর উকিল সহকর্মী জনৈক মৈত্র সাহেব তাঁর রাজবংশী জাতি পরিচয়ের জন্য পঞ্চাননকে জনসমক্ষে অপমান করেছিল। তাই পঞ্চাননের পক্ষে সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় খোলা ছিল না।

পঞ্চাননের নেতৃত্বে রাজবংশীদের সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সূচিত হয়েছিল উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা আদমসুমারির প্রবর্তন (১৮৭২) ও ভারতের জনগণের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের পদক্ষেপের দ্বারা। একদিকে ইউরোপীয় চিন্তাজগতের Racial Superiority-র আমদানি ও অন্যদিকে ভারতীয় উচ্চবর্ণীয়দের সামাজিক প্রতিপত্তি,  এই দুয়ের তাত্ত্বিক চাপে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীগণ অত্যন্ত নিম্নমানের জীব হিসাবে সরকারি প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ হন (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে)। রংপুরের জেলাশাসক ‘কোচ’ ও ‘রাজবংশী’ উভয়কেই একই শ্রেণির মানুষ হিসাবে বর্ণনা করায় রংপুরের রাজবংশীদের প্রভাবশালী অংশ তা মেনে নিতে পারেননি।

কিন্তু ১৮৯১ ও ১৯০১ এর আদমসুমারিতে রাজবংশীদের ‘ক্ষত্রিয়’ জাতির দাবি স্বীকৃত হয়নি। ১৯১০ এ আদমসুমারির প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হলে পঞ্চানন তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজবংশীদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিতে অগ্রসর হন। ১৯০১ থেকে ১৯১০-এই দশ বছরে উচ্চবর্ণীয়দের দ্বারা রাজবংশীদের  (ও তাঁর নিজের) সামাজিক নিষ্পেষণের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা তাঁকে রাজবংশীদের ক্ষত্রিয়ত্ব প্রতিষ্ঠার পথে চালিত করেছিল। এটাকে তিনি বাস্তবে সামাজিক অন্যায়ের (Social Injustice) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সামাজিক মর্যাদা (Social Dignity) অর্জনের প্রতীক হিসাবেই  গ্রহণ করেছিলেন।

একথা আজ সকলেরই জানা যে (১৯১০ এ স্থাপিত) রংপুর ক্ষত্রিয় সমিতির তত্ত্বাবধানে ও পঞ্চাননের সুযোগ্য নেতৃত্বে শাস্ত্রীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজবংশীগণ ক্ষত্রিয় পরিচয় অর্জন করেছিল। ক্ষত্রিয়ত্বের পরিচায়ক হিসাবে রাজবংশীগণ বর্মণ, বর্মা, সিংহ, ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার শুরু করেন। আর পঞ্চানন সরকার তখন থেকেই পঞ্চানন বর্মায় উত্তীর্ণ হন।

ঔপনিবেশিক ভারতের সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় রাজবংশীদের ক্ষত্রিয় আন্দোলন সংকৃত্যায়নের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। মার্কসীয়, সাবলর্টান ও দলিত ইতিহাসে রাজবংশীসহ অন্যান্য নিম্নবর্গীয় জাতির ক্ষত্রিয় বা বর্ণ জাতির আন্দোলন সাধারণত M.N. Srinivas-এর চিন্তার আলোকে ক্ষত্রিয়করণ/ সংকৃত্যায়ন/ ‘সামাজিক উর্ধ্বগমন’ এর মতো ‘ভাবধারণা’ দ্বারা আলোচিত হয়। কিন্তু আমি মনে করি রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের এই পর্যায়টি ছিল প্রকৃতপক্ষে উচ্চবর্ণীয়দের সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সামাজিক উন্নয়নের সূচক হিসাবে নিজস্ব চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আবার এটা শুধুমাত্র সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজবংশীগণের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

পঞ্চাননের আরেকটি সদর্থক প্রয়াস হল রাজবংশীদের উন্নয়নের জন্য রাজানুগ্রহ লাভ করা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯০), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪), জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭-১৮৯০), স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮); প্রভৃতি সমাজ-সংস্কারকগণ রাজপৃষ্ঠপোষকতাতেই সমাজ-সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে অগ্রসর হয়েছিলেন। উনিশ শতকের উচ্চবর্গীয় সমাজ সংস্কারকগণ যে উদ্দেশ্য নিয়ে রাজানুগ্রহ প্রার্থনা করতেন বা সরকারের সহযোগী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিশ শতকের গোড়ায় পঞ্চাননও সরকারি সহযোগিতায় রাজবংশীদের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তাই পঞ্চাননের নেতৃত্বে ক্ষত্রিয়ত্বের আন্দোলন কেবলমাত্র ‘ক্ষত্রিয়করণের’ মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না ।

পঞ্চানন বর্মা তথা রাজবংশীদের অধিকার অর্জনের দ্বিতীয় পর্যায়টি শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পরবর্তীকালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করার বিনিময়ে পঞ্চাননের এম.বি.ই (MBE) উপাধি লাভ ছাড়াও ১৯১৯এর ভারতশাসন আইন ব্রিটিশ ভারতের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে রাজবংশীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেছিল। এই আইন অনুযায়ী বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচন ও দায়িত্বশীল সরকার গঠনের ব্যবস্থা হয়েছিল। এই নির্বাচনে অন্যান্য নিম্নবর্ণীয় সম্প্রদায় ও উচ্চবর্ণীয় জমিদারদের  মত পঞ্চানন বর্মা ও ক্ষত্রিয় সমিতি সমর্থিত আরেকজন প্রার্থী (যোগেশচন্দ্র সরকার) অ-মুসলমান আসনে জয়লাভ করেন। পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও ক্ষত্রিয় সমিতি তাঁর জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল। ক্ষত্রিয় সমিতি রংপুরের গণ্ডী অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর ও জলপাইগুড়িতেও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। কোনরকম সংরক্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র সাহসিকতা, উদ্যম ও আত্মচেতনার দ্বারা রাজবংশী জাতির তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় ও উচ্চবর্গীয়দের বিরুদ্ধে জয়লাভ ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়া নিঃসন্দেহে পঞ্চানন বর্মা ও তাঁর সহযোগীগণের দূরদর্শীতার পরিচায়ক।

পঞ্চানন বর্মার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৩০-র গোড়ায় বিশেষ করে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক (১৯৩০-৩২) ও তার ফল স্বরূপ সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ও নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের জন্য কয়েকটি পৃথক আসন সহ নির্বাচকগোষ্ঠীর ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা। জাতীয় কংগ্রেসসহ অন্যান্য উচ্চবর্ণীয় হিন্দু প্রভাবিত রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থাকে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজনের প্রক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার (Communal Award) বিরোধিতা করেছিল। অন্যদিকে বি. আর. আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) পৃথক নির্বাচনের স্বপক্ষে সওয়াল করায় এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত পুনা চুক্তির (১৯৩২) দ্বারা ১৯৩৫ এর ভারতশাসন আইনে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভায় (Legislative Assembly) তপশিলিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়।

বাংলায় তপশীলি জাতির জন্য যারা আইন পরিষদে সরব ছিলেন তাদের মধ্যে পঞ্চানন বর্মা ছিলেন অন্যতম। কিন্তু রাজবংশীদের অনেকের মধ্যেই তপশিলিজাতি পরিচিতি নিয়ে সন্দেহ ছিল। এমনকি বাংলার সরকারও প্রথমে রাজবংশীদের তপশিলি জাতির তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চানন বর্মা ও উপেন্দ্রনাথ বর্মণের প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত বাংলার রাজবংশীগণ তপশিলি জাতি হিসাবে সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হন।

তপশিলি জাতি হিসাবে বাংলার রাজবংশীগণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংরক্ষণের আওতাভুক্ত হন। ১৯৩৫ এর আইন অনুযায়ী প্রথম সংরক্ষণ ভিত্তিক প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। জলপাইগুড়ি, রংপুর ও দিনাজপুর মিলিয়ে ১০ জন রাজবংশী প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এদের মধ্যে দুজন বাদে বাকিরা জয়লাভও করেছিলেন। তবে সবাই রাজবংশী ক্ষত্রিয় সমিতির তত্ত্বাবধানে অংশ গ্রহণ করেননি। তা সত্ত্বেও বলা যায় যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় রাজবংশীগণ বাংলার রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকার গঠনে রাজবংশীগণ অপরিহার্য্য অঙ্গে পরিণত হন। আর এখানেই পঞ্চানন বর্মার দূরদৃষ্টির সার্থকতা।

পঞ্চানন বর্মার অভিজ্ঞতা ও কার্যাবলীকে বাংলাসহ ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারার মধ্যে আলাদা ভাবে আলোচনা করার প্রবণতা, পঞ্চানন বর্মাকে ‘ঠাকুর’, ‘মনীষী’, ‘মহাপুরুষ’, ‘রাজবংশী জাতির জনক’, ইত্যাদি; অভিধায় ভূষিত করেছে। ক্ষত্রিয় জাতির মানুষ হিসাবে যে কোন রাজবংশীই এর জন্য গর্ববোধ করতে পারেন। একই ভাবে তাঁর নামে সেতু, রাস্তা, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তাঁর নামে চেয়ার অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের বৈধতার স্বীকৃতি হিসাবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র রাজবংশী জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে কখনই তাঁর কার্যাবলীর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে না। আমরা তাঁকে দেখেছি সামাজিকভাবে নিপীড়িত জাতির আত্মমর্যাদা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামিল হতে। তাঁর হাত ধরেই অসংখ্য তথাকথিত পিছিয়ে পড়া মানুষের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল রংপুর সাহিত্য পরিষদের মূর্ত হয়ে ওঠা। তাই বলা যায় যে ‘পঞ্চানন বর্মার মত মানুষেরা কথা বলতে জানেন, শাসক ও শাসিতের ভাষায় লিখতে জানেন, ন্যায়বিচারের আন্দোলন করতে জানেন, অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে জানেন, জানেন নারীর সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নারীকেই প্রশিক্ষিত করতে’। তাই আমাদের মার্ক্সীয়, সাবলর্টানীয় ও দলিত ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গীর বাইরে বেড়িয়ে পঞ্চানন বর্মাকে বিচার করতে হবে। এর দ্বারাই আমরা তাঁর অবদানের প্রকৃত মূল্যায়নে সক্ষম হব।

লেখক: কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক

   

শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না কবি হেলাল হাফিজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

 

‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর…’

‘হৃদয়ের ঋণ’ কবিতার কবি হেলাল হাফিজ এখন নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন-যাপন করছেন সবার চোখের আড়ালে।

এখন মোটেও ভালো নেই কবি! সুস্থও নন! কথা বলতে গেলে তাঁর খবু কষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না তিনি! নেত্রকোনা থেকে কবি হেলাল হাফিজকে দেখতে আসা সাংবাদিক আলপনা বেগম বার্তা২৪.কমকে কবির এ অসুস্থতার কথা নিশ্চিত করেন।

আলপনা বলেন, কবিকে দেখার কেউ নেই! ভীষণরকম একাকী আর সবার চোখের আড়ালে বাস করছেন তিনি। রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকার হোটেল সুপার হোম নামে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে থাকেন কবি হেলাল হাফিজ। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিনা ভাড়ায় তাঁকে একটি ভিআইপি কক্ষ বরাদ্দ করেছে। সেখানেই অনেকদিন ধরে নিঃসঙ্গে সময় কাটছে তাঁর।

আলপনা জানান, কবি হেলাল হাফিজ একা একা গোসল করতে পারেন না। তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে হয়। হোটেলের এক বয় কবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দেন।

কবি বাম চোখে কম দেখতে পান বলে জানান আলপনা। তিনি জানান, কবি বয়সজনিত কারণে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বাংলা ভাষার এই কবি গ্লুকোমায় আক্রান্ত। এর পাশাপাশি কিডনি, ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগেও ভুগছেন তিনি।

রোমান্টিক ও প্রেমের কবিতা লিখেও কবি নিজে সারাজীবন থেকেছেন চিরকুমার!

নেত্রকোনায় বাড়ি কবি হেলাল হাফিজের। সে সূত্রে নেত্রকোনা থেকে আসা সাংবাদিক আলপনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, একবার ইচ্ছে আছে, নেত্রকোনায় যাওয়ার। শরীর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি সেখানে একবারের জন্যও হলে যেতে চান। দেখতে চান নিজের জন্মভিটা! সবাইকে একনজরও দেখে আসবেন তিনি।

নিজের চিকিৎসার বিষয়ে ভীষণরকম উদাসীন কবি হেলাল হাফিজ। ইতোপূর্বে, বার বার চেষ্টা করেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি।

২০২২ সালে শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলে কবি হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিনি। খানিকটা সুস্থ হলে ফের হোটেলে ফিরে আসেন কবি। এর ৪/৫ দিন পর ফের অসুস্থতাবোধ করলে হোটেলের লোকজন তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে আজও শাহবাগের হোটেল কক্ষে একাকী জীবন-যাপন করছেন কবি হেলাল হাফিজ।

বাংলা ভাষার ভীষণ জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর কবি প্রতিভার পরিচিতি লাভ করে। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

কর্মজীবনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পাদনাও করেছেন কবি হেলাল হাফিজ।

;

চুরুলিয়ার স্মৃতি ও নজরুলের অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের অধরা স্বপ্ন



অঞ্জনা দত্ত
নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) উপাচার্যের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে, যেখানে বেশ কয়েকটি আলমারিতে নজরুলের সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে। রয়েছে প্রায় চার হাজার গানের স্ক্রিপ্ট। এছাড়া দুটো কলের গান দেখতে পেলাম, যেগুলোতে নজরুল একসময় গান শুনতেন। দু’একটা বাদ্যযন্ত্রও ছিল মনে হয়। কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম কবিতীর্থ চুরুলিয়ার পথে। এর মধ্যে ভদ্রলোক জানিয়ে রাখলেন তিনি চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমিতে বলে রেখেছেন আমাদের কথা, ‘অতএব আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না’।

একাডেমির দেখভাল বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। চুরুলিয়ায় পৌঁছে অবাক হলাম নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র একজন এখনো জীবিত আছেন, যে কথাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ বলেননি। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখানে আমাদের লোক আছে, নজরুল একাডেমি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ইত্যাদি অনেক কথাই জানালেন। অথচ ওখানে যে নজরুল পরিবারের একান্ত আপনজন রয়েছেন সেটি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গেলেন! এটি জানা থাকলে কুড়ি কিলোমিটারের পথ আমাদের নিকট হয়তোবা দুই কিলোমিটারে দাঁড়াত!

আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার পথে একধরনের উত্তেজনা নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত নজরুলের স্ট্যাচ্যুর সাথে ছবি নিতে ভুল হলো না। কুড়ি কিলোমিটার খুব বেশি দূর তো নয়। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম। দু’জন সাধারণ চেহারা ও বেশভূষার মানুষ আমাদের দেখা মাত্র সাথে নিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপারে বসে আছেন শ্যামল বরণ, বলিরেখামণ্ডিত চেহারা, চশমা পরিহিত প্রায় আশির অধিক বয়েসি এক ভদ্রলোক। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ওটা ঠিক সাদা ছিল না, বহুল ব্যবহারে মলিন হয়ে পড়েছে আসল রঙ। আর চশমার ওপারে চোখ দু’টি কি ঘোলাটে ছিল ? আমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তিনি, কাজী রেজাউল করিম, নজরুলের কনিষ্ঠ ভাই আলী হোসেনের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কাজী রেজাউল করিমের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এঁর কথা কেন কিছু বলা হয়নি। আশ্চর্য!

রেজাউল করিমের সাথে গল্পে জমে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথাবার্তায় সাবলীল ছিলেন। বয়স তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর এখনো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই বৎসর ত্রিপুরায় নজরুলের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। স্মরণিকার জন্য আয়োজকরা পি কে ডি’কে লেখা দিতে বলেছিলেন। ওর লেখা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

রেজাউল করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পি কে ডি জানালেন আজকে চুরুলিয়ায় এসে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সে ভাবছে তাঁকে আবার নতুন করে লিখতে হবে নজরুলকে নিয়ে। রেজাউল সাহেব জানালেন, আগরতলা থেকে তাঁকেও লিখতে বলা হয়েছে। সুস্থ থাকলে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ঐ অনুষ্ঠানে। তাঁর নিজের পরিবারের কথা জানালেন। নজরুলের নাতি নাতনিদের কথা বললেন। বলা বাহুল্য সেগুলো খুব প্রীতিকর কিছু নয়। তাঁর নিজের কষ্টের কথা জানালেন। সুবর্ণ কাজী, রেজাউল করিমের তিন পুত্রের একজন, যার মধ্যে তিনি কিছু সম্ভাবনা দেখেছিলেন সংগীতে , তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন হলেন সোনালী কাজী। বাকি এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের কেউই নজরুলের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সংসারের নিয়মই মনে হয় এমন। একজন আয় (সেটি যে কোনোকিছুই হতে পারে) করেন। পরের প্রজন্ম সেটি এনক্যাশ করে চলেন (তবে এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না কেননা কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ নিজগুণে গুণান্বিত ছিলেন)। আর তৃতীয় প্রজন্ম দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এই ফর্মুলা পুরোপুরি কাজে না লাগলেও নজরুলের আদর্শ থেকে এরা অনেক দূরে। আপাদমস্তক মার্ক্সিস্ট কাজী রেজাউল করিমের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।

এবারে রেজাউল সাহেব আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পাকা একতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ওপর পুরনো বাড়ির অনুকরণে খড় দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হলো। যে দুজন আমাদের প্রথমেই তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন তারাই রেজাউল সাহেবের দেখাশোনা করেন। পরিবারটি, অন্তত রেজাউল সাহেব, তাঁর চাচার মতো অসাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলেন। আমি বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাইলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর এবং বাসনপত্র দেখে অবাক হলাম। কেননা ছেলেরা এল্যুমিনিয়ামের ডেকচি কড়াই এমন পরিষ্কার রাখতে পারার কথা নয়। জানালেন রান্নার জন্য অন্য মহিলা আছে। আর তাঁর স্ত্রী যে ঘরে রাঁধতেন, সে ঘরটিও অবহেলায়, অযত্নে পড়ে নেই।

হঠাৎ রেজাউল করিম সাহেব আমাদের এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানতে চাইলেন এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পর আমাদের দেশে কীভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়? উত্তর দেবার বিশেষ কিছু ছিল না। অথবা বলা ভালো সংক্ষেপে বলার মতো নয় বিষয়টি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি তাঁর সহচরদের বললেন, আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সব বলতে নজরুল একাডেমি, লাইব্রেরি, নজরুল যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ভগ্নাবশেষ, পারিবারিক গোরস্থান ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিতে। তিনি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। ও হ্যাঁ, নজরুল একাডেমি-যেটি রেজাউল করিমের বড়ো ভাই প্রয়াত মোফাজ্জল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন।

‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি...’ কবির বিখ্যাত সেই ছবিতে সাজানো অফিস কক্ষ..

কেননা এটি চালিয়ে নেয়ার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর সন্তানদের এবং নজরুলের নাতি নাতনিদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নেই। আমার মনে হয়েছিল কাজী রেজাউল করিম সাহেব স্বস্তিতে আছেন এই ভেবে যে নজরুল যথার্থভাবে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একটি ব্যাপার অনেকক্ষণ থেকে আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল নজরুলের বাড়ির সীমানা, একাডেমি, বিশাল লাইব্রেরি (যেখানে সতের হাজার বই রয়েছে, এটা পরে হয়েছে), কবরস্থান ইত্যাদি দেখে ভাবছিলাম কেন নজরুলকে বালক বয়েসে বাবাকে হারানোর পরে সংসার প্রতিপালনের জন্য রোজগার করতে যেতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কবিতীর্থে একদিন

নয় বছর বয়েসে মক্তব শেষ করার পর ঐ মক্তবে ছোটো শিশুদের তিনি পড়াতেন। মসজিদে আযান দিতেন। যোগ দিলেন লেটো দলে। এটি অবশ্য একেবারে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল না আমার দৃষ্টিতে। কেননা ঐ সময়ে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা স্ফুরিত হয়। নজরুল নিজেই সংস্কৃত এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেন। স্কুলে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। শিক্ষকরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর থেকে ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজায় নজরুল যুদ্ধ করতে চলে যান। আর স্কুলে ফিরে আসেননি।

আমার মনে হয় প্রকৃতিগত ভাবে নজরুল ছিলেন অতি চঞ্চল। ধরাবাঁধা জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না। সৃষ্টির নেশা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত। সংসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর পরে (প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের মাস কয়েক পরে মারা যান) তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বুলবুল কচিকন্ঠে অপূর্ব সুন্দর গাইতেন। নজরুলের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন স্বয়ং ঈশ্বর।১৯৩০ সালের মে মাসে বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। বারো বছর পরে ১৯৪২ সাল হতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। লেখালেখি করার ক্ষমতা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল ! বুলবুল মারা যাওয়ার পর কবি ছেলের স্মৃতিতে লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি …’!

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের নজরুল ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন। কবি বুঝতে পারেননি তিনিও ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কবি তাঁর ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছিলেন-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

চিরকালের অসাম্প্রদায়িক নজরুল, যিনি সবসময় লড়াই করেছিলেন মানব ধর্মের জন্য; তিনি জানলেন না তাঁর দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়ের লোক। এই বিভাজন নজরুল মেনে নিতে পারতেন না জেনেই বিধাতা হয়তো বা তাঁকে বহু আগে থেকেই বাকশক্তি রহিত করে রেখেছিলেন। কে জানে!

নজরুলের এই কথাগুলো আজকের বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, সেটি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক, যাঁর এক ডাকে মুক্তিকামী বাঙালি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। তবে এই দেশের মাটিতে মীরজাফরদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষাধিক মা-বোনের নৃশংস অত্যাচার নির্যাতন ঘটিয়েছিল এই দেশের মীরজাফররা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। আর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশের এই অপশক্তিরা ঝাড়েবংশে বেড়ে চলেছে। একজন নজরুলের আবির্ভাব কী তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নকে, লড়াইকে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে? (সমাপ্ত) 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

ফিউচার প্ল্যান



শরীফুল আলম। নিউইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিউচার প্ল্যান

ফিউচার প্ল্যান

  • Font increase
  • Font Decrease

কখনো কখনো সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমি হারিয়ে যাই
কখনো শিল্পীর আঁকা ছবির কাছে
আমি স্নিগ্ধ আকাশের কাছে গিয়ে উড়িয়ে দেই
আমার সমস্ত বিষণ্ণতা
আমি মেঘের আস্তরে ঢেকে রাখি আমার সুখ , আমার মুখ
আমার সজিবতা ।

ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আস তুমি শেষ বিকেলে
অদ্ভুত সুখ তখনও বিরাজ করে এই আত্মায়
পলাতক শব্দ গুলো শিশিরের ন্যায়
আধো আধো প্রেমের ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ।

একটা সুদীর্ঘ সময়ের সমাপ্তি করলে তুমি ,
সেই পুরনো রাত , পুরনো দিন
মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আস তুমি
অনেকটা জোনাকির ছলে ।

তুমি এক আলৌকিক আগুণ
তুমুল পোড়াও তুমি আমাকে
কখনো স্বপ্নের ভিতর
কখনো পিয়ানোর সানাই হয়ে
তুমি নিত্য পরিক্রমা এই মনে ,
তোমার ঠোসকা পড়া তেরছা কথা
"ডাকলেও আর আসবো না "
শুনতে বড় বেখাপ্পা লাগে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা তখন মনে পড়ে যায়
ঝড় , ঝঞ্ঝার কথা তখন মনে পড়ে যায়
প্রকৃত প্রস্তাবে তখন তোমার বিবর্তনের কথাই মনে পড়ে যায়
আর বিবর্তন মানে - আড়াল রাখতেই সে পছন্দ করে
ফাগুনে আগুণ লাগাতেই সে পছন্দ করে
তার সানগ্লাস তখন যেন থেমে যায় গ্ল্যালাক্সি ক্রসিংয়ে
আড়চোখ দেখে নেয় সব
বিলম্বিত লাবণি , ফিউচার প্ল্যান ।

;

কবিতীর্থে একদিন



অঞ্জনা দত্ত  
-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধূর ধূপ!’’

অনেক ছোটোবেলায় যখন এই কবিতাটি পড়ি তখন কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও মনে আছে। কেননা কবি তখন বাকরহিত ছিলেন। সেই ছোটো বয়েসেও অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, তিনি কীভাবে বুঝেছিলেন একদিন তাঁর এমন পরিণতি হবে? সত্যি বলতে আজও এর উত্তর খুঁজে পাইনি। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ দু’জনের ওপরেই ছিল সরস্বতীর আশীর্বাদ। সেই অর্থে তাঁদের ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। তবে ছিলেন স্বশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহ ছিল সংস্কৃতি চর্চায় পরিপূর্ণ। নজরুলও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর চাচা বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল অপরিসীম। চাচার প্রভাবে নজরুল লেটো দলে যোগ দেন এবং অতি স্বল্প সময়ে তিনি নিজের প্রতিভায় অন্যদের মুগ্ধ করেন। কবিতীর্থ সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে জানাতে চাই কীভাবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার প্রোগ্রাম হলো ?

এই বছর জানুয়ারি মাসের শেষদিকে কলকাতায় এক বিয়ের প্রোগ্রামে যেতে হচ্ছিল। সবসময়কার মতো কোথাও যাওয়ার নামে ঢোলে বাড়ি বাজলে আমার মন নেচে উঠে। কিন্তু যতই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে ততই মনে হয়, ধুর না গেলেই ভালো হতো। কিন্তু ততদিনে ‘পি কে ডি’র প্ল্যান পেকে টসটসে হয়ে উঠে। অর্থাৎ টিকেট কাটা, থাকা, গাড়ির ব্যবস্থা করা সব কমপ্লিট। অতএব ব্যাগ গোছাতে হয় হাঁড়িমুখে। তবে যখন চাকরিতে ছিলাম তখন বেড়ানোর কথা হলে মন ময়ূরের মতো নেচে উঠত। সেই সময়টায় ছুটি পেতে নানারকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হতো। আদম সন্তান! সহজলভ্য জিনিসের চেয়ে যেটি পেতে অসুবিধে হবে সেদিক পানে মন ছুটে যেত। ‘পি কে ডি’ দেখল কলকাতায় শুধু বিয়ে খেতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এরসাথে আর কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে বেশ হতো। আমার তো কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছেই নেই। তাই আর কোথায় যেতে চায় সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল ছিল না। জানি মোগলের হাতে যখন বাবা সঁপে দিয়েছেন, তখন খানাটা তার সাথেই খেতে হবে।

অন্য কথা শুরু করার আগে ‘পি কে ডি’র নামের অর্থটা জানিয়ে দেয়া উচিৎ বলে মনে করি। কেননা লেখালেখির প্রথম জীবনে পাঠকদের মধ্যে একধরনের ঔৎসুক্য থাকত এই নাম নিয়ে। পি কে ডি, প্রদীপ কুমার দত্ত, যার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি (‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’… তবে জানিয়ে রাখি এই গাঁটছড়ায় অন্য অনেক কিছুই আছে, সুর ছাড়া। কখন আপনারা আবার গান শোনার আবদার করে বসেন!)

তাঁর অন্যতম নেশা হলো বেড়ানো। অন্য স্ত্রীরা আনন্দে বাক বাকুম করত, সেখানে আমি মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখি, ঐ যে বললাম না সহজে পাওয়া জিনিসের কোনো মর্যাদা থাকে না! আর বাংলা পাঁচের সাথে অপ্রসন্ন চেহারার তুলনা যে কোন পণ্ডিত করেছেন জানি না। মানুষের চেহারা কখনও বাংলা পাঁচের মতো দেখাতে পারে, বলুন?

পি কে ডি ঠিক করলেন কলকাতার বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে দেওঘর, রামপুরহাট আর আসানসোল যাবে। দেওঘরের নাম আপনারা পড়েছেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, যিনি তাঁর গল্পের কোনো চরিত্রের অসুখ করলেই হাওয়া বদলের জন্য দেওঘরে  পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যখনই শুনলাম ঐ সময়ে দেওঘরে ভালোই শীত থাকবে, মেজাজ সপ্তমে পৌঁছাতে মোটেই সময় নিল না। এর মাস দুয়েক পূর্বে নৈনিতাল এবং আশেপাশের হিমালয়ের অঞ্চলসমূহে বেড়িয়ে এমন ঠাণ্ডায় ভুগেছিলাম, এরপরেও শীতের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে! মেজাজ কেন খারাপ হবে না বলুন? কে জানে পি কে ডির মনে কী আছে? সাধারণত বলা হয়ে থাকে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। নারীদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তাঁরা বলতেন পুরুষাণাং চরিত্রম দেবী ন জানন্তি, কুতো মনুষ্য! তবে আপনারা এইটি কোথাও ব্যবহার করবেন না। ইহা অধমার মস্তিষ্কপ্রসূত! দেওঘর হাওয়া বদল ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য তীর্থস্থানও বটে। রামপুরহাটও তাই। আর আসানসোল? যখন জানাল চুরুলিয়ায় যাবে, অমনি মেজাজ পঞ্চমে নেমে এলো। আর দেওঘরের শীতের হাওয়া নাচতে শুরু করল আমলকির ডালে ডালে।

কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম, লেখক ও পি কে ডি (প্রদীপ কুমার দত্ত)। ছবি: লেখক

সত্যি বলতে কি চুরুলিয়ায় গিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পাবো সেটি ভাবিনি। ভেবেছিলাম আমাদের দুখু মিয়া তো সেই কবে থেকেই দুঃখের সাগরে ভাসছিলেন। তাঁর সাথে আমরাও ভাসছিলাম বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে। একজন মানুষ এক জীবনে এতটা কষ্ট পেতে পারেন? এমন একটা প্রতিভা এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল শুধুমাত্র সময় তাঁকে অবজ্ঞা করায়। তা না হলে আর কী বলা যেতে পারে? যদি নজরুল যুদ্ধের দামামার ভিতরে অসুস্থ না হয়ে আরও বছর কয়েক পরে অসুস্থ হতেন তাহলে হয়তো বা তাঁকে সুস্থ করা যেত। আর একেবারে তিনি যদি এই দুরারোগ্যে আক্রান্ত না হতেন, তা হলেই বা সংসারে কার কতটা ক্ষতি হতো? এই কথাগুলো অনেকের কাছে যেমন অর্থহীন মনে হবে, তেমনি অনেক নজরুলপ্রেমীর বুকের ভিতরটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ে!

দেওঘর রামপুরহাটে দেবী দর্শন করে মনে হয় ভালোরকমের পূণ্য সঞ্চয় করেছিলাম। কেননা আসানসোল স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর এক সুবেশধারী ভদ্রলোক আমাদের নিতে এলেন ততোধিক ঝকঝকে জীপ নিয়ে। এই লিঙ্কগুলো পি কে ডির রোটারির কানেকশনে। রোটারিয়ান হওয়ার এই এক সুবিধে।  পৃথিবীর যে কোনো দেশে রোটারিয়ানরা ফেলোশিপের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূর্ব পরিচিতির প্রয়োজন নেই। অভিষেক তেমন একজন রোটারিয়ান, যাকে তাঁর সিনিয়র একজন বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক রোটারিয়ান যাচ্ছেন তোমার শহরে। Help him with what he needs, ব্যস এটা তাঁর জন্য বেদবাক্য হয়ে গেল!

অভিষেক অবাঙালি। বাংলা বলতে পারেন। বয়েস বড়োজোর পয়ঁতাল্লিশ – পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাবা মা দু’জনেই আছেন। বহু বছর ধরে তাঁরা আসানসোলে বসবাস করছেন। কিন্তু পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল শহর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে চুরুলিয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না। তবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার জন্য নিজেদের একখানা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পরদিন সকালে। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি অভিষেক আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে আসানসোল ক্লাবে পৌঁছে দিল। নিজের কিছু কাজ সারতে চলে গেল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল ড্রাইভার এসে আমাদের নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে লাঞ্চ করার জন্য। তবে ঘন্টা দু’য়েক পরে নিজেই এসে হাজির ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। মা বাবা এবং অভিষেকের স্ত্রী সবাই অপরিচিত অতিথিদের সাথে বহুদিনের পরিচিতের ন্যায় আচরণ করলেন। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন।

লাঞ্চ সেরে পি কে ডি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন মাইথন বাঁধ (Maithon Dam) দেখতে যেতে চায়। আমার ভালো লাগত একটু যদি বিছানায় গড়িয়ে নেয়া যেত। কিন্তু বেড়াতে বের হলে এটি পি কে ডি’র অভিধানে থাকে না। তাঁর হলো কম সময়ে কত বেশি দেখা যায় অথবা কতবেশি জানা যায়? আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার রক্তমাংসের মানুষ। সকালবেলায় ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়েছিল। কাজেই রাতের ঘুমের কোটা যেটুকু অপূর্ণ ছিল, সেটুকু পুরিয়ে নিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এত বছরে এইটুকু বুঝেছি সব ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতে নেই। তাছাড়া অভিষেক ইতিমধ্যে ওদের ক্লাবের কয়েকজন রোটারিয়ানের সাথে কথা বলে সন্ধ্যেবেলায় একটা ফেলোশিপ মিটিং এর আয়োজন করেছে। রোটারিতে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা মিটিং হয়। অভিষেকদের মিটিং হয়ে গিয়েছিল। অভিষেক চাইছিল আমিও যেন মিটিং এ যাই। তাহলে ওর স্ত্রীও যাবে। অগত্যা।

অভিষেকদের একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম মাইথন বাঁধ দেখতে। কাপ্তাই বাঁধে যে স্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেটি দেখেও যখন পি কে ডির আশ মিটেনি তখন সাথে যেতেই হলো। তবে এই বাঁধটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র হলো মাটির নিচে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটিই প্রথম  ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ তৈরির স্থাপনা। এটি ষাট হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ১৯৫৭ সালে উদ্বোধন হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বিছানা তখন দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আয় আয় আমার কাছে আয়। সে ডাক কি উপেক্ষা করা যায় ? পাগল!

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য বিছানার সাথে মিতালি করা গেল না। মিটিং এ যাওয়ার জন্য উঠতে হলো। ড্রাইভার আমাদের সাথেই ছিল। হঠাৎ করে ডাকা মিটিং এ রোটারিয়ানদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। বেশি ছিল আন্তরিকতা আমাদের প্রতি তাঁদের। দুই ক্লাবের পতাকা বিনিময় হলো। পি কে ডি তাঁর নিজের ক্লাব নিয়ে এবং দেশ নিয়ে কথা বলল। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। ভারতের বাইরের দেশগুলোকেও অচ্ছ্যুত রাখল না। অনেক কথাই হয়েছিল। সাথে খাবার দাবার তো ছিলই। একসময় মিলনমেলা ভাঙলো। ফেরার পথে অভিষেক জানাল পরদিন সকালে আসানসোলে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। এতক্ষণ আপনারা ধান ভাঙতে শীবের গীত শুনেছেন। এবারে  মূল প্রসঙ্গে আসি। যে কারণে আসানসোল আসা।

কবির পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রের পাশে লেখক; যেখানে প্রমীলা নজরুলসহ স্বজনদের কবর রয়েছে।

লেখার শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি, দুঃখী মানুষদের কবি, ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এতদূর আসা। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। সড়কপথে বা রেলপথে যাওয়া যায়। আর আসানসোল থেকে চুরুলিয়া মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে। আমরা বাঙালিরা শান্তিনিকেতনে দৌড়ে যেতে (বারণ করছি না যেতে) যত পছন্দ করি, ততোটা কি চুরুলিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবি ? নজরুল জীবিত থাকা অবস্থায় ছিলেন অবহেলিত, অসুস্থ অবস্থায়, ঢাকায় আসার আগে কেমন ছিলেন জানা নেই, তবে মৃত্যুর পরে যে আমাদের স্মৃতিতে ধুলো বালি জমতে শুরু করেছে সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

অভিষেক জানিয়েছিল আসানসোল শহর থেকে অদূরে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওখনে হয়তো বা কোনো তথ্য পেতে পারি। রওনা দিলাম সেদিকে। যেহেতু পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে এসেছি উপাচার্য মহাশয়ের সাথে দেখা করতে তাই জায়গায় জায়গায় এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছিল। অবশেষে উপাচার্য মহাশয়ের কক্ষে ডাক পড়ল। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে  প্রীত হলেন মনে হলো। তাঁর মামাবাড়ি একসময় চট্টগ্রামে ছিল। তাঁকে চট্টগ্রামে  আমাদের অতিথি হয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানালাম। চুরুলিয়ায় যেতে চাই শুনে তিনি আরও উৎসাহিত বোধ করলেন। সাথে সাথে তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যিনি  নজরুল সক্রান্ত কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। জানা  গেল তিনি সেদিন , অন্তত তখনও এসে পৌঁছাননি। অন্য আর একজনকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। তাঁকে আমাদের পরিচয় জানিয়ে বললেন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁদের যে মিউজিয়াম রয়েছে তার কার্যক্রম দেখাতে। তবে নতুন একটি মিউজিয়াম নির্মাণের পথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল চুরুলিয়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্য সরকার (সি পি এম) এটি আসানসোলে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ভেবেছিলেন চুরুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওখানে ছাত্র সংখ্যা খুব বেশি হবে না। তাছাড়া ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ অনেক বেড়ে যাবে। এখনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন /চার সহস্রাধিক ছাত্র ছাত্রী পড়ছে। বাইশটি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। চুরুলিয়ায় গিয়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। উপাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার আগে তাঁর সাথে ছবি তুলে নিলাম। ঐ সময়ে তাঁর সেলফোনে রিং বেজে ওঠায় অভদ্রতা হলেও ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম ‘সোনালী কাজী ইজ কলিং’। কথা সেরে স্যার জানালেন নজরুলের নাতনি ফোন করেছিলেন। মনে মনে বললাম ও আমার দেখে নিয়েছি! যদিও সোনালীর নাম আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। (ক্রমশ…)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;