এডওয়ার্ড হিথের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

  • সাঈদ চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এডওয়ার্ড হিথের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

এডওয়ার্ড হিথের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ যে স্বাধীনতার দিকে এগুচ্ছে, ব্রিটেন তা যুদ্ধের আগেই অনুধাবন করেছে। দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাই মনে করতেন। এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এ কথা বলেছেন।

এডওয়ার্ড হিথ বলছিলেন, আইয়ুব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বহু বছর কারাগারে ছিলেন। তখনই নিপীড়িত মানুষের সমর্থন নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা পরিস্ফুটিত হয়েছে। তবে পরিস্থিতি বিশ্লেষনে পাকিস্তান ভেঙ্গে যেতে পারে বলে মনে হয়েছে। বাঙ্গালী অধ্যষিত ইস্ট পাকিস্তান অংশে শেখ মুজিব স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে পারেন বলে প্রতিয়মান হয়েছে। অল্পদিনের ব্যবধানে যা বাস্তবে রূপ নিয়েছে।     

বিজ্ঞাপন

কমনওয়েলথের একটি দেশ ভেঙে গেলে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করণীয় তা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন বলেও এডওয়ার্ড হিথ উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয় মন্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামগ্রীক বিবেচনায় বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা তখন সময়ের ব্যাপার ছিল। ১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক নিয়ে সবাই উৎসুক ছিলেন। এর আগে ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষনা না দিয়ে শেখ মুজিব কৌশলী ভূমিকা পালন করেছেন। 

এডওয়ার্ড হিথ

১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন আসেন। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের মিয়ানওয়াল কারাগারে আটক ছিলেন। ততক্ষণে মিত্র বাহিনীর কাছে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বিশ্বনেতাদের চাপে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সেদেশের উড়োজাহাজ তখনো ভারতের আকাশ সীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। তাই ইরান, তুরস্ক বা লন্ডন হয়ে দেশে ফেরার প্রস্তাব পেলে বঙ্গবন্ধু লন্ডনকে বেছে নেন। 

পাকিস্তানি সামরিক বিমানে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পাঠানো হয়। ব্রিটিশ ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ান সাদারল্যান্ড লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় স্বাগত জানান। লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থও সেখানে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু ৮ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৬টায় হিথ্রো এসে নামেন। বিবিসি ওয়ার্ড সার্ভিসের মর্ণিং নিউজে এখবর প্রচারিত হয়। ব্রিটিশ সরকার এব্যাপারে অবহিত ছিল। স্যার এডওয়ার্ড হিথ ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর তখনো রাষ্ট্রীয় কোন পদবি ঘোষনা হয়নি। তবুও বিমান বন্দরে বিশেষ মর্যাদায় তাঁকে বরণ করা হয়েছে।  


হিথ্রো থেকে সকাল ৮টার মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সেন্ট্রেল লন্ডনের হোটেল ক্লারিজে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হোটেলে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে দ্রুত পৌঁছেন। সন্ধ্যায় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি নিজ কার্যালয়ের বাইরে এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ করেন। কোন প্রটকলের ধার ধারেননি। পরদিন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে করে তাঁকে দেশে পাঠিয়েছেন।

২০০১ সালের ২১ আগস্ট ইউরো বাংলা নামে বাইলিঙ্গুয়াল (বাংলা-ইংলিশ) সাপ্তাহিকী প্রকাশের পর সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথকে আমরা তা উপহার দেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক, ড. কিম হাওলস, প্রিন্স চার্লস সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথেও এই প্রতিবেদকের মিলিত হবার সুযোগ হয়েছে। সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা বিশেষ করে ইংলিশ সেকশন দেখে মূলধারার সকলেই আমাদের অগ্রসর চিন্তার প্রশংসা করেছেন।

আমরা যখন এডওয়ার্ড হিথের সাথে মিলিত হই তখন তিনি মুগ্ধ চিত্তে আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রোমন্থন করেন। এই স্মরণীয় মুহূর্তের ছবিতে স্যার এডওয়ার্ড হিথের সাথে ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়েছেন, অনুষ্ঠানের সমন্বয়কারী ইস্ট লন্ডন টয়েনবি হলের প্রেসিডেন্ট জন প্রোফোমো, টয়েনবি এডুকেশনের ডেপুটি ওয়ার্ডেন রহমান জিলানী, আমি (সাঈদ চৌধুরী), বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ হাসান এমবিই, ব্যারিস্টার আনিস রহমান, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক মেয়র সয়ফুল আলম, সলিসিটর এম এ মালেক, ড. বেলাল জয় প্রমুখ।


তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বললেন, আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ব্রিটেন তাকে সরকার প্রধানের প্রটোকল দিয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ সহ পার্লামেন্ট সদস্যরা আমার ভাবনার সাথে সহমত ছিলেন।

এডওয়ার্ড হিথ স্মৃতিচারণ করে বললেন, ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিব লন্ডন ঘুরে গেছেন। তখন ব্রিটেনে বসবাসরত ইস্ট পাকিস্তানের অধিবাসীরা তাকে যে সম্মান দেখিয়েছে, তাতে আমরা শেখ মুজিবকে সে দেশের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে অনুমান করতে পেরেছি। সামান্য ব্যবধানে জুলফিকার আলী ভুট্টোও ব্রিটেন সফর করেছেন। তখন নিজ দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যন করছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে। 

এডওয়ার্ড হিথ ১৯৬৯ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় ব্রিফিংয়ের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হোমসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিস্থারিত অবহিত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের কর্মকর্তা ডি ও লেরি এ বিষয়ে নিয়মিত নোট দিতেন।

এদিকে ৮ জানুয়ারি হোটেল ক্লারিজে বঙ্গবন্ধু প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে ব্রিটেনের শীর্ষ সাংবাদিক সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারের কনডেম সেলে তাঁর ফাঁসির প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম।

সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের প্রশংসা করেন। সেই সাথে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে এবং জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন জানানোর জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। অল্প সময়ের এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রবাসী বাঙ্গালিদের ভূমিকারও ভূয়সী প্রশংসা করেন।


উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার এবং তহবিল সংগ্রহ ছাড়াও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে লড়ার জন্য আইরিশ ব্যারিস্টার শন ম্যাক ব্রাইটকে লন্ডন থেকে পাঠানো হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের ব্রিটেন ও ইউরোপের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসিদের সহায়তায় সে ব্যবস্থা করেছিলেন।

৯ জানুয়ারি লন্ডন সময় সকাল সাড়ে ৮টায় বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ফ্লাইট আকাশে ওড়ে। নয়াদিল্লিতে তিনি সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানান। সেখান থেকে ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পৌছেন। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডন সফরের সময় তার সাথে আলোচনার কথা উল্লেখ করে এডওয়ার্ড হিথ জানালেন, শেখ মুজিব স্বাধীন রাষ্টের স্বীকৃতি চাইলে, ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যরা স্বদেশে ফিলে গেলেই ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃতি প্রদান করতে প্রস্তুত বলে আশ্বস্ত করেছি এবং যথা নিয়মে তা কার্যকর করেছি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরবর্তী বৈঠকের কথাও স্মরণ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে আসলে ১৯৭২ সালের ১৮ আগস্ট তাদের সাক্ষাৎ হয়। এডওয়ার্ড হিথ ও বঙ্গবন্ধু লন্ডনের একটি হোটেলে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন।পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রশ্নে তাঁরা মতবিনিময় করেন। তিনি তখন বাংলাদেশকে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এআইডির সদস্যপদ লাভে ব্রিটেনের ইতিবাচক ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন।

এডওয়ার্ড হিথের সাথে বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখার জন্য এবার লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ব্রিটেন সফরের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ‘ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধু: দ্য হিস্টোরিক ৮ জানুয়ারি’ শীর্ষক এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ব্রিটিশ মিনিস্টার, বিভিন্ন দলের পার্লামেন্ট মেম্বার, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ গ্রহন করেন।

ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং গেস্ট অব অনার ছিলেন ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী অলিভার ডাউডেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন মিনিস্টার অব স্টেট এন্ড ইকোনমিক সেক্রেটারি টু ট্রেজারি জন গ্লেন। অতিথি হিসেবে আলোচনায় অংশ গ্রহন করেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান অ্যানেলিজ ডডস, হাউস অফ লর্ডসে লিবারেল ডেমোক্র্যাট গ্রুপের নেতা লর্ড নিউবি, অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের ভাইস-চেয়ার বব ব্ল্যাকম্যান, হাউস অব কমন্স ফরেন অ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির চেয়ার টম টুগেনহাট, কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান ওসান অধিদফতরের পরিচালক বেন মেলর, ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার গাইত্রী ইসরার কুমার, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনীতিক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই ঐতিহাসিক সফরের কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের সাথে ব্রিটেনের এই বন্ধনকে সম্মান জানাতে বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু-এডওয়ার্ড হিথ ফ্রেন্ডশিপ এওয়ার্ড’ চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের বন্ধুত্ব আরও গভীর ও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে যারা অসাধারণ অবদান রাখবেন, তাদের এই এওয়ার্ড প্রদান করা হবে। লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম এওয়ার্ড ঘোষণার পাশাপাশি স্মৃতিময় এই ঐতিহাসিক দিনের তাৎপর্য তরুণদের মধ্যে আরও জনপ্রিয় করতে একটি ফাউন্ডেশন গঠনেরও ঘোষণা দেন।

লেখক: লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক, কবি কথাসাহিত্যিক।