জন্মদিন, জনারণ্য ও নিভৃতি

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মাহফুজ পারভেজ: কবি, কথাশিল্পী,  লেখক ও শিক্ষাবিদ

মাহফুজ পারভেজ: কবি, কথাশিল্পী,  লেখক ও শিক্ষাবিদ

ঘটনাচক্রে ৮ মার্চ জন্মদিন হওয়ায়, আমি নিশ্চুপ থাকলেও দিনটি সোৎসাহে পালিত হয়। বিশ্ব নারী দিবসে জন্মগ্রহণকারী পুরুষ হিসাবে এ দিনের যাবতীয় আয়োজনের কিছুটা প্রাপ্তি আমাকেও আচ্ছন্ন করে বৈকি।

করোনাকালের আগে, অতীতের জন্মদিনগুলোতে কিশোরগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, যেখানেই অবস্থান করেছি, সেখানে কিছু সুহৃদ ও শুভার্থীর সঙ্গে অবধারিতভাবে মিলন ঘটেছে। কমবেশি আয়োজনের ঘনঘটাও ছিল। এবার, করোনা প্রবাহের মধ্যে নিজের এবং স্বজনদের উপস্থিতি বাতিল করেছি সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধির প্রতি মান্যতায় এবং কাউকে বিপদগ্রস্ত না করার মানসে। তথাপি, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যখন কিছুই লুক্কায়িত থাকেনা, তখন সামাজিক পরিসরের ভার্চুয়াল-সাইবার ক্ষেত্রে জন্মদিনের খবরটি চাউর হতে বিলম্ব হয়নি। ফলে, যাদের ভালেবাসায় সিক্ত হয়েছি, তাদেরকে অন্তহীন ভালোবাসা।

বিজ্ঞাপন

ষাটস্পর্শী জীবনে জনারণ্যে অনেক জন্মদিন পালনের অভিজ্ঞতায় এবার নিভৃতিকে বেছে নিতে ইচ্ছে হলো। আত্মউপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসার জন্য এমন ব্যক্তিগত ও একেলা ক্ষেত্র নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অতএব, আমি চলে আসি হালিশহরের শেষ প্রান্তে চট্টগ্রামের স্থলভাগের সমাপ্তি আর সমুদ্রের জলরাশির শুরুর জায়গাটিতে। 'আর্টিলারি সেন্টারের পেছনে এমন সন্ধিক্ষণের ভূগোলে প্রসারিত বেলাভূমি, ঝাউবন, বসন্তের দখিনা বাতাস, ঢেউয়ের কল্লোল।

প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিজেকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের কথা। পঞ্চাশতম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব করছ তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, তাহলেই এই উৎসব সার্থক। তোমাদের জীবনের সঙ্গে আমার জীবন যদি বিশেষ ভাবে মিলে থাকে, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনও গভীরতর সম্বন্ধ স্থাপিত হয়ে থাকে তবে যথার্থভাবে এই উৎসবের প্রয়োজন আছে। তার মূল্য আছে।' (জন্মোৎসব, দ্রষ্টব্য, ভারতী, ভাদ্র ১৩১৭ পৃ. ৩৯৪-৩৯৯)

সত্যিই তো, বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন গভীর ভাবে মিলাতে পারেন কয়জন? সমাজ ও ব্যক্তির পারস্পরিক তাৎপর্যের মধ্যে স্থাপিত জীবনের গভীরতর সম্পর্ক উপভোগের সামর্থ্য থাকে কয়জনের? আত্মউপলব্ধি, আত্মপর্যালোচনা এবং আত্মপরিক্রমায় এসব প্রশ্ন চৈতন্যে নাড়া দিয়ে যায়। নিজেকে নিয়ে পেছন ফিরে ভাবতে গেলে দেখি, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির অমীমাংসিত সমীকরণে দুলছে পুরোটা যাপিত জীবন।

৮ মার্চ ১৯৬৬ সালের কিশোরগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলের গৌরাঙ্গ বাজারে জন্ম নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুধ্যানে কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি, প্রেসক্লাবকে নিবিড় নৈকট্যে অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ করেছি। আজকের কাব্য ও সাহিত্যচর্চা, লেখক, অধ্যাপক ও গবেষক রূপে মানসজগৎ বিকাশের ক্ষেত্রে এমনই বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবদান অপরিসীম। কিশোরগঞ্জে সাংবাদিকা ও সাহিত্য তৎপরতার সূচনা করে উচ্চতর পড়াশোনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (স্নাতকোত্তর) ও  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও (পিএইচ,ডি) নিত্য প্রাণিত হচ্ছি।

পেশায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ছাড়াও বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর, কিশোরগঞ্জ নিউজ'র উপদেষ্টা সম্পাদক, 'মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন'-এর নির্বাহী পরিচালক, 'মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন' সম্মাননা বক্তৃতার প্রবর্তকরূপে লেখালেখি ও বলার মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গুণীজনের স্পর্শে হয়েছি ধন্য। আত্মজীবনী কখনও রচিত হলে তার পাতাগুলো আলোকিত করবেন অনেক উজ্জ্বল মুখ, অনিন্দ্য ব্যক্তিত্ব এবং বহুমাত্রিকতায় দুত্যিময় প্রতিষ্ঠানগুলো।

লেখালেখি, গবেষণা ও সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হওয়ায় প্রকাশিত গ্রন্থ কুড়িটি।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: গবেষণা-প্রবন্ধ: বিদ্রোহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিচুক্তি; দারাশিকোহ: মুঘল ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো; আনারকলি: মুঘল হেরেমের রহস্যময়ী নারী; দ্বিশত জন্মবর্ষে বিদ্যাসাগর; প্রকাশনা শিল্প, স্টুডেন্ট ওয়েজ, মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ; শান্তিচুক্তির দুইযুগ: শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের পথে পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিদ্যমান সমস্যা ও সমাধানের রূপরেখা। উপন্যাস: পার্টিশনস; নীল উড়াল। ভ্রমণ: রক্তাক্ত নৈসর্গিক নেপালে। কবিতা: আমার সামনে নেই মহুয়ার বন, মানব বংশের অলংকার, গন্ধর্বের অভিশাপ। এখন কাজ করছি গবেষণালব্ধ গ্রন্থ 'নিমগ্ন পাঠচর্চার সন্ধানে: বাংলাদেশের গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার সমীক্ষায় কিশোরগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি' নিয়ে।

সমকালে কিংবা অনাগতকালে এসবের কেমন মূল্যায়ন হবে, তা নির্ভর করছে ভবিতব্যের উপর। সমকাল সবসময়ই কণ্টকময়। হিংসায় আকীর্ণ কিংবা দল ও গোত্রগত কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত।  উচ্চতর কৌশলী হলেই কেবল এমন দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে একই সঙ্গে 'সাপ ও বাঘকে সন্তুষ্ট' করে সফল হওয়ার জাদুকরী প্রতিভা দেখানো সম্ভব। অনেকে সেটা করছেনও বটে। হাতিয়ে নিচ্ছেন তাৎক্ষণিক পদক, পুরস্কার ও আনুকূল্য। সমাজের সংশ্লেষ ও মহাকালের দাবিকে অবজ্ঞা করে এইসব সস্তা প্রাপ্তির মচ্ছবে যখন দূষিত হচ্ছে সামগ্রিক পরিবেশ, তখন এইসব তথাকথিত সফলদের কাছ থেকে শতহস্ত দূরে অবস্থান করে আমার ইচ্ছে করে নিভৃতিকে বেছে নিতে। সমাজ ও কালের প্রতি আস্থা রেখে অপেক্ষা করতেই বরং আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানের ঝলক ঢের টের পাওয়া যায়।

জন্মদিনের নিভৃততম প্রহরে আমি সমূহ অপ্রাপ্তিকে নস্যাৎ করে ভালোবাসার সজল উচ্চারণে  আবৃতি করি শঙ্খ ঘোষের 'জন্মদিন' শিরোনামের কবিতাটি:

তোমার জন্মদিনে কী আর দেব এই কথাটুকু ছাড়া
আবার আমাদের দেখা হবে কখনো
দেখা হবে তুলসীতলায় দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয়
দেখা হবে সুপুরি বনের কিনারে
আমরা ঘুরে বেড়াবো শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে
গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে
কিন্তু আমাদের ঘিরে থাকবে অদৃশ্য কত সুতনুকা হাওয়া
ওই তুলসী কিংবা সাঁকোর কিংবা সুপুরির
হাত তুলে নিয়ে বলব, এই তো, এইরকমই, শুধু
দু-একটা ব্যথা বাকি রয়ে গেল আজও
যাবার সময় হলে চোখের চাওয়ায় ভিজিয়ে নেবো চোখ
বুকের ওপর ছুঁয়ে যাবো আঙুলের একটি পালক
যেন আমাদের সামনে কোথাও কোনো অপঘাত নেই আর
মৃত্যু নেই দিগন্ত অবধি
তোমার জন্মদিনে কী আর দেবো শুধু এই কথাটুকু ছাড়া যে
কাল থেকে রোজই আমার জন্মদিন।