প্রকাশনা শিল্পের অনন্য ব্যক্তিত্ব

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রকাশক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ

প্রকাশক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ

২১ মার্চ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' এর সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ'র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গতবছর গুরুতর অসুস্থ হয়ে ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালে তার মৃত্যু হয়। জানাজা শেষে রাতে আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব আলহাজ মোহাম্মাদ হাবিবউল্লাহ ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'। পিতার মৃত্যুর পর পুত্র মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ প্রকাশনার হাল ধরেন এবং বাংলাদেশের শীর্ষ লেখকদের অনেকগুলো ধ্রুপদী গ্রন্থ প্রকাশের কৃতিত্ব দেখান। তিনি বহু নবীন লেখকের পৃষ্ঠপোষক রূপে সমধিক পরিচিত।

বিজ্ঞাপন

বৈশ্বিক মহামারি করোনার চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশ গ্রহণের জন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি অব্যাহত রাখেন। তিনি ছিলেন প্রকাশনা অন্তঃপ্রাণ মানুষ। জীবনভর তিনি বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ ও উন্নতিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সেটিই ছিল তার জীবদ্দশায় শেষ বইমেলা।

গবেষণা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত হয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প, পাঠাগার আন্দোলন সম্পর্কে কিছু মনোমুগ্ধকর  ঐতিহাসিক তথ্য আমার চোখে পড়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেলের অর্থায়নে পরিচালিত কাজটিতে বাংলাবাজার, চৌমুহনী, কোম্পানিগঞ্জের নোটবই বা অর্থ পুস্তকের গণ্ডি থেকে সৃজনশীল প্রকাশনার বিকাশের কিছু ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার সুযোগ ঘটে। এরই ভিত্তিতে আমার দুটু বই প্রকাশিত হয়। একটি 'নিমগ্ন পাঠচর্চার সন্ধানে' এবং আরেকটি 'প্রকাশনা শিল্প, স্টুডেন্ট ওয়েজ ও মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-পরবর্তীকালে ঢাকায় মননশীল ও সৃজনশীল লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন অগ্রণী প্রকাশক। যাদের মধ্যে 'আহমাদ পাবলিশিং হাউজ'র মহিউদ্দিন আহমাদ ও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র আলহাজ্ব মোঃ হাবিবুল্লাহ অগ্রগণ্য। পরে যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন 'মুক্তধারা'র চিত্তরঞ্জন সাহা ও 'ইউপিএল'র মহিউদ্দিন আহমদ এবং অবসর, প্রতীক, মাওলা ব্রাদার্স।

আরো পরে আরো অনেকেই প্রকাশনা শিল্পে এলেও বাংলাদেশের প্রকাশনার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বদের কৃতিত্ব ও অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে দেশভাগের ক্ষত নিয়ে একটি দেশের নতুন ও ছোট্ট প্রাদেশিক রাজধানীতে লেখকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও পাঠক সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশনা শিল্পের আধুনিক গোড়াপত্তনের কঠিন কাজটি তাদেরকেই করতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব আখ্যান মোটেও লিপিবদ্ধ হয়নি।

কলকাতায় যেমন প্রকাশনার স্মৃতিচারণমূলক ইতিহাস রচিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্সের বাদল বসু (পিয়ন থেকে প্রকাশক), মিত্র ও ঘোষের ভানু বাবু তথা সবিতেন্দ্রনাথ রায় (কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর) প্রমুখের দ্বারা, ঢাকার ক্ষেত্রে তেমন হয়নি।

ফলে এখানকার প্রকাশনা শিল্পের উত্থান ও বিকাশের নেপথ্য কাহিনী বলতে গেলে চাপা পড়ে আছে। প্রকাশকরা বহু লেখকের বই বের করলেও সেসবের পেছনের কথা ও প্রকাশনার ইতিবৃত্ত সংরক্ষণ করেননি। এই সীমাবদ্ধতা ভবিষ্যতে ইতিহাস নির্মাণের ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে।

‌‌বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র ৭০ বছর অতিক্রমের ঘটনা। একটানা প্রকাশনায় এতো দীর্ঘ সময় সুনামের সঙ্গে টিকে থাকাও একটি অনন্য রেকর্ড। ১৯৫০ সালে 'স্টুডেন্ট ওয়েজ' প্রতিষ্ঠা করেন  আলহাজ্ব মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। তখন প্রেস ও পাবলিশিং-এর দিক থেকে ছিল বিরূপ পরিস্থিতি । অনেক প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ী কলকাতায় পাড়ি দিয়েছেন। বই আনতে হতো সীমান্তের ওপার থেকে।  আলহাজ্ব হাবিবুল্লাহ সাহেব সেই সময় এদেশের প্রতিভাবান ভালো লেখকদের লেখা গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, শিশুসাহিত্যসহ নানা বিষয়ের বইপত্র এদেশে প্রকাশ করার চিন্তাভাবনা নিয়ে এই প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন।

নিজেদের প্রকাশিত বই ছাড়াও সারা বাংলাদেশের নবীন- প্রবীণ লেখকদের সব ভালো বইগুলো একই ছাদের নিচে বিক্রির ব্যবস্থা করেন তিনি। আমাদের অনেকেরই শৈশব ও কৈশোরের সঙ্গেও 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র নাম মিশে আছে। দূরের বাংলাবাজারে আধুনিক ঢাকা থেকে সব সময় যাওয়ার সুযোগ ছিলনা, যতটুকু কাছের ছিল স্টেডিয়াম ও নিউমার্কেটের বইপাড়া। সেখানে জ্বলজ্বল করতো    'স্টুডেন্ট ওয়েজ'র বইগুলো।

বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই বের করেছে 'স্টুডেন্ট ওয়েজ'। নতুন ও প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদেরও তুলে ধরেছে এই বনেদি প্রকাশনা  প্রতিষ্ঠান। সৃজনশীল, মননশীল, বিশ্বসাহিত্য, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রচর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুধু অগ্রগামীর ভূমিকাই পালন করেনি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকাও পালন করেছে।

বিপুল পাঠক গোষ্ঠীর পাশাপাশি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা তাঁদের স্মৃতিকথায় লিখেন 'স্টুডেন্ট ওয়েজ ' তাঁদের ' প্রিয় প্রকাশক'।

স্টুডেন্ট ওয়েজ'র সাত দশক পূর্তির ঘটনা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তরণের পথে অনন্য মাইলফলক।তবে,  বাংলাদেশ কেন্দ্রিক প্রকাশনার দুইশত বছরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় ইতিবৃত্ত নিয়ে তেমন কাজ হয় নি। মুঘল রাজধানী ঢাকার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চকবাজারের 'কিতাব পট্টি' থেকে বাংলাবাজারের উত্থানের শিহরণ জাগানো আখ্যান বলতে গেলে অন্ধকারে চাপা পড়ে রয়েছে। বিশেষত ঢাকার প্রকাশনার সুবৃহৎ কেন্দ্রস্থল বাংলাবাজার নিয়ে তেমন স্মৃতিচারণ ও ইতিহাসভিত্তিক সমীক্ষা নেই বললেই চলে।

অথচ পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরের বাংলাবাজার নামক এলাকাটি আশেপাশের ফরাশগঞ্জ, লালকুঠি, প্যারীদাশ রোড ছাড়িয়ে সদরঘাট পর্যন্ত প্রকাশনা ও বিপণনের এক অবারিত জগৎ উন্মোচিত করেছে। যেখানে ছাপা, বাধাই, ব্লক, টাইপ, ফাউন্ডি, ডিজাইনের আদি যুগ পেরিয়ে কম্পিউটার ও অফসেট প্রেসের রূপান্তরের মাধ্যমে আধুনিক প্রকাশনার মজবুত কাঠামো বিদ্যমান।

ঢাকার ল্যান্ডস্কেপ প্রসারিত হয়ে প্রকাশনার ক্ষেত্রও উত্তর থেকে দক্ষিণে আজিজ, শাহবাগ, আরামবাগ, ফকিরাপুলে সম্প্রসারিত। তথাপি, বাংলাদেশের প্রকাশনার নাভিমূল বাংলাবাজারে মোট ব্যবসার আশি শতাংশ আবর্তিত। সৃজনশীল, মননশীল প্রকাশনা, পাঠ্যপুস্তক ব্যবসা মিলিয়ে শত শত প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার মানুষের রুজিরোজগার নির্ভর করে এখানে এবং প্রতিদিন লেনদেন হয় কোটি কোটি টাকা আর প্রকাশ পায় শত শত বই।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনিবার্য অনুষঙ্গ বাংলাবাজার নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও সমীক্ষা না থাকাটা সত্যিই দুঃখজনক। জাতির মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়কে জানতে বাংলাবাজারের ঐতিহাসিক অনুধ্যান অপরিহার্য।

সাধারণার্থে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এবং বিশেষার্থে ৭০ বছরের প্রাচীন প্রতিষ্ঠান স্টুডেন্ট ওয়েজ এর প্রয়াত প্রধান নির্বাহী ও প্রকাশক মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ প্রসঙ্গে আলোচনায় বাংলাবাজার ও প্রকাশনা জগতের ক্রমিক-পালাবদল, সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি, ব্যক্তিগত-অভিজ্ঞতাবাদী-ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে গ্রন্থাকারে উপস্থাপন করেছি, যা হারিয়ে যাওয়া পরিবর্তমান পরিস্থিতির প্রতিচ্ছবি।

বস্তুতপক্ষে, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে একই সঙ্গে দশক, শতাব্দী ও সহস্রাব্দের পালাবদলের তোড়ে বদলেছে ঢাকার ল্যান্ডস্কেপ ও প্রকাশনা শিল্পের মানচিত্র। অনেক ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়েছে। নব্যরা দখল করেছে অনেক কিছু। বাংলাবাজার থেকে আজিজ, কনকর্ড হয়ে বাংলামোটর পেরিয়ে প্রসারিত আধুনিক ঢাকায় ও সারা বাংলাদেশে প্রলম্বিত হয়েছে লেখক, পাঠক ও প্রকাশনার দিগন্ত, যদিও প্রকাশনার আদিস্থল হিসেবে বাংলাবাজারের ঐতিহ্য, গৌরব ও গুরুত্ব অদ্যাবধি অটুট।

সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের যুগ-সন্ধিক্ষণের ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ এবং সঙ্কুলকালের সেনাপতি মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহকে আবর্তিত করে দুইশত বছরের প্রাচীন বাংলা প্রকাশনার ঢাকা ও কলকাতার সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সময়কালের ঘটমান প্রপঞ্চসমূহকে তুলনামূলক বীক্ষণে উপস্থাপন করার কথা আমার বিবেচনায় গুরুত্ব পায়। হারিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, প্রকাশনা সংস্থা, লেখক ও গ্রন্থের বিষয়েও আলোকসম্পাত করার চেষ্টা করি। গবেষণাকালে মোহাম্মদ লিয়াকতউল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। পিতার হাত ধরে যিনি একটি আস্ত জীবন বাংলা প্রকাশনা শিল্পের কল্যাণে ব্যয় করেছেন এবং পুত্রের হাতে দায়িত্ব দিয়ে তিন প্রজন্মে প্রসারিত করেছেন নিজের কর্ম ও স্বপ্বকে।

তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানাই এবং তার মাগফিরাত কামনা করি।