মধ্যপ্রদেশের পাথুরে দুর্গ নগরী 'মান্ডু'



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মধ্যপ্রদেশের পাথুরে দুর্গ নগরী 'মান্ডু'

মধ্যপ্রদেশের পাথুরে দুর্গ নগরী 'মান্ডু'

  • Font increase
  • Font Decrease

রূপমতী-বাজ বাহাদুরের প্রেমোপাখ্যান ভারতের মধ্যপ্রদেশের পাথুরে দুর্গবেষ্টিত অধুনা লুপ্ত 'মান্ডু' নগরের ধ্বনি মেখে নিত্য প্রতিধ্বনি করে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। মান্ডু বা মান্ডবগড় ধর জেলার মান্ডব নগর পঞ্চায়েতে অবস্থিত এক প্রাচীন জনপদের ধ্বংসাবশেষ। এটি ভারতবর্ষের পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ অন্তর্ভুক্ত মালয়া অঞ্চলের ধর শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। একাদশ শতাব্দীতে মান্ডু তরঙ্গগড় বা তরঙ্গ রাজত্বের অংশ ছিল। ঐতিহাসিকভাবেই

শৌর্য, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং নানা ধর্মমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের  উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মান্ডু।

মধ্য প্রদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী ইন্দোর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পাথুরে দুর্গ নগরী অসাধারণ স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। একটি শিলালিপি তালানপুর (ধরজেলায় অবস্থিত) থেকে আবিষ্কৃত হয়, যার থেকে জানা যায় যে, একজন বণিক যার নাম চন্দ্র সিমহা, তিনি একটি মূর্তি মান্ডভ দুর্গে অবস্থিত একটি পার্শ্বনাথ মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন। এটিও বিশ্বাস করা হয় যে, প্রাকৃত ভাষার 'মান্ডভ দুর্গা' শব্দের অপভ্রংশ থেকে 'মান্ডু' শব্দের উৎপত্তি। শিলালিপিতে যে তারিখের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা ইঙ্গিত করে, মান্ডু ষষ্ঠ শতকের একটি উদীয়মান শহর ছিল। দশম ও একদশ শতকে পরমারস্ রাজবংশের অধীনে মান্ডুর লক্ষণীয় উন্নতি সাধন হয়।


মান্ডু শহরটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৬৩৩ মিটার (২০৭৯ ফুট) উপরে এবং বিন্ধ্য পর্বতমালার ১৩ কিলোমিটার (৮.১ মাইল) বর্ধিতাংশের মালওয়া মালভূমির উত্তরে অবস্থিত এবং নর্মদা নদীর দক্ষিণ উপত্যকা পরমারস্ রাজবংশের রাজধানীর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা হিসেবে কাজ করত, যা বর্তমানে অতীত-ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময়তায় সবাইকে আকৃষ্ট করছে।

মান্ডু ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হলো শরতকাল, যখন প্রকৃতি থাকে ঝকঝকে আর আকাশ সাদা মেঘের পাড় বসানো নীল শাড়িতে বিম্বিত। চারপাশের বাতাসে থাকে শিউলির সুগন্ধ আর মান্ডুর সমৃদ্ধ ইতিহাসের সৌরভযুক্ত প্রত্নঐতিহ্যের ধূসরিত মুগ্ধতা।

মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল হয়ে বাণিজ্যনগরী ইন্দোর দিয়ে মান্ডু পৌঁছানো সহজতর। ইন্দোর থেকে ভারতের ৫৯ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সোজা বেতমা, ঘাটবিলোড়, ধার হয়ে মান্ডু চলে যাওয়া যায়। পথ পেরিয়ে মান্ডুর কাছাকাছি আসতেই প্রকৃতির রূপ বদলের অপরূপ ছবি দৃশ্যমান হয়। আধুনিক নগরের স্থলে তখন চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় দিগন্তবিস্তৃত মালভূমি, পাহাড় এবং জঙ্গলাকীর্ণ সবুজ উপত্যকা। দূরে দেখা যায় সবুজ মোড়কে আচ্ছাদিত দুর্গ ও প্রত্নঐতিহ্যের মান্ডুকে।


বিন্ধ্য পর্বতের পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝে ২,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দুর্গনগরী মান্ডু। মান্ডু বিখ্যাত তার শৌর্য ও স্থাপত্যকীর্তির জন্য। ইতিহাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমন্বয় ঘটেছে মান্ডুতে। ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মান্ডুর ইতিহাস বৈচিত্রপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে পালাবদল ঘটেছে একাধিক বার। ৪৫ কিমি প্রাচীরবেষ্টিত ১২টি ‘দরওয়াজা’-বিশিষ্ট একদা জমজমাট শহর মান্ডু এখন এক প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদ ছাড়া আর কিছুই নয়। তথাপি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে ভগ্নপ্রায় সৌধ, দুর্গ আর দরওয়াজা।

দুর্গনগরী মান্ডু মূলত ছিল মালবের পারমার রাজাদের রাজধানী। পরে মান্ডুকে স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন আফগান শাসক দিলাওয়ার খান। এই সময় থেকেই মান্ডুর সৌধে লাগে আফগান স্থাপত্যের ছোঁয়া। তার পুত্র হোশঙ্গ শাহের সময়কালে একের পর এক শিল্পস্থাপত্যের পত্তন হয় মান্ডুতে। ১৫৫৪ সালে ক্ষমতায় বসেন সুজাত খানের পুত্র সঙ্গীতজ্ঞ বায়াজিদ বাজ বাহাদুর। তিনি ছিলেন অন্যন্যসাধারণ রবাব-বাদক। তার রবাবের সুরে মুগ্ধ হয়ে যেত অগণিত শ্রোতা। এই সঙ্গীতপ্রিয় বাজ বাহাদুরের সঙ্গে তার রূপসী পত্নী রূপমতীর প্রেমোপাখ্যান ও ট্র্যাজেডি মান্ডুর ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ ও করুণ আখ্যান।


মান্ডুর 'ট্র্যাজিডি ভবন' রূপে প্রসিদ্ধ রূপমতী প্যালেসের দোরগোড়ায় সব সময়ই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। জনপ্রতি পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পাহাড়ের অপর দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় প্যালেসে। রাজবংশের শুরুতে মান্ডুর রূপমতী প্যালেসের স্থানটি রাজসেনাদের ওয়াচটাওয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে রূপমতীর নর্মদা দর্শনের সুবিধার জন্য এখানে প্রাসাদ তৈরি করা হয়। এখান থেকে রোদ-ঝলমলে দিনে নর্মদাকে ভালভাবে দর্শন করা যায়। প্রাসাদের ছাদ থেকে পার্বত্য পটভূমিতে নর্মদা দর্শনের অনিন্দিত সৌন্দর্য তুলনাহীন। একই সঙ্গে অবলোকন করা যায় নীচের সবুজে মোড়া নিমার উপত্যকাকেও।

রূপমতী প্যালেস থেকে নীচে 'রেওয়া রূপকুণ্ড', যে-কুণ্ডের জলকে রূপমতী নর্মদার সমতুল্য হিসাবে গণ্য করতেন। কুণ্ডের লাগোয়া ঘরগুলো আগে ভোজনশালা হিসেবে ব্যবহৃত হত। কালের বিবর্তনে বর্তমানে সেগুলো শ্মশানযাত্রীদের আশ্রয়স্থল। কারণ এখন রেওয়া কুণ্ডকে ঘিরে রয়েছে শ্মশান। কুণ্ডের পিছনে বাজ বাহাদুর প্যালেস। কুণ্ড থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি সিঁড়ি উঠে গেছে প্যালেসের অন্দরে।

ষোলো শতকে নির্মিত বাজ বাহাদুর প্রাসাদ এখন ভগ্নপ্রায়। বড় বড় হলঘর আর মাঝে ফাঁকা উঠোন ছাড়া কিছুই নেই। অনেকের মতে, পারমার রাজাদের হাতে গড়া প্রাসাদই পরবর্তী কালে বাজ বাহাদুর সংস্কার করেছিলেন মাত্র। এখানেই সঙ্গীতমহলে রূপমতী ও বাজ বাহাদুরের গানের মজলিশ বসত। অতিথি শিল্পী হিসেবে তানসেনও নাকি এখানে গান গাইতে আসতেন। সঙ্গীতমহলের ভিতরে তৎকালীন সময়ে শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা এতই উন্নত ছিল যে পরস্পর-বিপরীত দুটো ঘরের যে-কোনও একটিতে স্বাভাবিক গলায় গান গাইলেও, তা শোনা যেত অন্য প্রান্তের ঘর থেকে।  নিজে গান গেয়ে শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা এখন পরখ করতে পারেন ভ্রমণকারীগণ।

সঙ্গীতমহলের পিছনের দিকে আরও একটি ঐতিহাসিক জায়গা রয়েছে। সে অংশে আছে বাজ বাহাদুরের শয়নকক্ষ, শৌচালয়, শিকারে যাওয়ার দরওয়াজা ইত্যাদি। রূপমতী ও বাজ বাহাদুরের বহু স্মৃতি ও কাহিনীর মতোই চারপাশে মিশে আছে করুণ আখ্যান। এখানেই তাদের প্রেমকাহিনির বিয়োগান্তক যবনিকাপাত ঘটে।

কথিত আছে যে, রূপমতীর রূপ দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরকে প্রলুব্ধ করে। আকবর নাকি রূপমতী সম্বন্ধে অবগত হয়ে অস্থিরমতি হয়েছিলেন। তার আদেশে সেনাপতি আদম খান রূপমতীকে দিল্লিতে নিয়ে যেতে আসেন। রাজপ্রাসাদ মুঘলদের দ্বারা অবরূদ্ধ, এই খবর জানতে পেরে রূপমতী বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আনন্দময় প্রেমনগরীতে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। কিছু দিন পর বাজ বাহাদুরের বন্দিদশায় মৃত্যু হয়।

লোকবিশ্বাস যে, এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকার অশরীরী আত্মার নীরব উপস্থিতি আজও নাকি অনুভব করা যায়। তাদের অতৃপ্ত আত্মা নাকি গুমরে মরে প্রাসাদের কোণায় কোণায়, অলিন্দে ও চত্বরে। জ্যোৎস্নারাতে এখানে আজও সেই সুরের ঝঙ্কার শোনা যায়, যে জলসায় একদা গাইতেন রূপমতী আর বাজ বাহাদুর।

মান্ডু এলাকা মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে আসার পর এখানে জলমহল গড়ে তোলা হয়েছিল মূলত তার হিন্দু মহিষীদের ব্যবহারের জন্য। পেশোয়া প্রথম বাজিরাওয়ের আমলে এখানে 'নীলকণ্ঠ শিবমন্দির' প্রতিষ্ঠিত হয়। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে তবে বিগ্রহ দর্শন করা যায়। জায়গাটা খুবই পিচ্ছিল। কারণ, অপর দিকের কুণ্ড থেকে অবিরাম জল ঝরে পড়েছে। বিগ্রহকে সিক্ত করে আবার পাহাড়ের ফাটল দিয়ে আরও নীচে ঝরে পড়ছে ছোট-ছোট ঝোরার মতো করে। মূল বিগ্রহ ছাড়াও চত্বরের এ-দিক ও-দিক গণেশ, হনুমান, বিষ্ণুর বিগ্রহও রয়েছে। জলের অবিরাম ঝরে পড়া, গাছপালায় ঘেরা পোড়োবাড়ির মধ্যে এমন দেবালয় বিরল আবহ নির্মাণ করে।

মান্ডুর আরেক দর্শনীয় স্থান 'জাহাজ মহল', সেখানে প্রবেশমূল্য পাঁচ টাকা। মঞ্জু তালাও এবং কাপুর তালাওয়ের মাঝে ইন্দো-পারসিক স্থাপত্যরীতিতে এক আশ্চর্য কীর্তি এই জাহাজ মহল। সম্ভবত গিয়াসউদ্দিন খিলজির হাত ধরেই এই স্থাপত্যের বাস্তুবায়ন হয়েছিল বলে প্রত্নগবেষকদের ধারণা। তবে ভিন্ন মতে, মালোয়ারাজ মঞ্জুদেবই ছিলেন এর প্রকৃত রূপকার। তার গ্রীষ্মাবাস হিসেবে এই প্যালেস ব্যবহৃত বলে মনে করা হয়। বর্ষার দু’টি তালাও জলে পরিপূর্ণ হলে এই প্রাসাদকে ভাসমান জাহাজ বলে মনে হয়। এর আকর্ষণেই অনেকে বর্ষায় মান্ডু আসেন। পাশেই বেলেপাথরে নির্মিত হিন্দোলা মহল। মহলটি দেখতে একটি দোলনার মতো, যা চারদিক থেকে প্রেক্ষাগৃহের রূপ লাভ করে। হিন্দোলা মহলের ভিতরেই হেরেম ও হামাম। যেখানে অত্যাধুনিক যুগের মতো ঠান্ডা ও গরম জলের জোগানের পাশাপাশি স্টিম বাথের ব্যবস্থাও ছিল। এখানে দুটি তালাওয়ের জলকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ওপরে তুলে প্রতি ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা দেখলে সত্যিই বিস্ময়ে অবাক হতে হয়।

মঞ্জু তালাওয়ের অপর পাড়ে বিধ্বস্ত নাহার ঝরোখা আর জলমহলের খন্ডহরের দিকে তাকালে যেকোনো দর্শনার্থীর ঘোর লেগে যায়। সেই ৬০০ বছরের ইতিহাসের ঘোর থেকে কিছুতেই বেরোতে পারেনা একালের মানুষও। আধুনিককালের মানুষেরা পরম বিস্ময় ও আবেগে শিহরিত হয় অতীতের অতল স্পর্শে।

মান্ডুর মূল বাজারের সামনে রয়েছে ভগ্নপ্রায় একটি জেলখানা, যা ‘চোর কুঠরি’ নামে পরিচিত। বাজারের সামনেই সেন্ট্রাল গ্রুপের মসজিদসমূহ। এই গ্রুপের সৌধে আছে জামে মসজিদ, হোশঙ্গ শাহের সমাধি এবং আশরফি মহল। প্রবেশমূল্য পাঁচ টাকা। চারপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে হাট। প্রতি শনিবারের সাপ্তাহিক হাটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি হয়। দূর দূর গ্রাম থেকে মানুষ আসে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী নিয়ে। পুরুষদের মাথায় মধ্যপ্রদেশের ঐতিহ্যের বিভিন্ন রঙের পাগড়ির বাহার।

মান্ডুর জামে মসজিদ অনেক ছোট ছোট গম্বুজের সমন্বয়ে গঠিত আর মসজিদের পুরোটাই গোলাপিরঙা বেলেপাথরে নির্মিত। এই মসজিদকে দামাস্কাসের উমাইয়াদ মসজিদের রেপ্লিকা বলা যায়। সুলতান হোশঙ্গ শাহ এর প্রতিষ্ঠাতা। জামে মসজিদের পিছনের দিকে আছে হোশঙ্গ শাহের সমাধি। শুধু হোশঙ্গ শাহ নয়, রাজপরিবারের অন্যদেরও সমাধি আছে সেখানে। হোশঙ্গ শাহের সমাধি ভারতের সর্বপ্রথম মার্বল পাথরের তৈরি স্থাপত্য। এমনকি, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরির আগে চার জন স্থপতিকে পাঠান এই সৌধের নির্মাণশৈলী পর্যবেক্ষণের জন্য।

জামে মসজিদের বাইরে রাস্তার বিপরীতে আশরফি মহল, যা মুসলিম শাসনকালে সমৃদ্ধ মাদ্রাসা রূপে পরিচিত ছিল। বর্তমানে ভগ্নপ্রায় আশরফি মহলে ভাঙা দেয়াল, সিঁড়ি ছাড়া আর প্রায় নেই। এই মহল নিয়ে রয়েছে এক মজার গল্প শুনলাম। মাহমুদ শাহ খিলজি তার অসংখ্য বেগমের মধ্যে স্থুলকায়াদের মেদবর্জনের জন্য এক অভিনব পন্থা বার করেছিলেন। আশরফি মহলের দীর্ঘ সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ চড়ার জন্য তিনি সেই বেগমদের প্রত্যেককে একটি করে আশরফি (মোহর) দিতেন। পরে বেগমদের অর্জিত সেই সব আশরফি গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হত।

আরও কথিত আছে যে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির নাকি নূরজাহানকে আশরফি মহলের সিঁড়ি ভাঙিয়ে আশরফি দিয়েছিলেন। তাই আশরফি মহলের ইংরেজি নাম ‘গোল্ড কয়েন প্যালেস’। অনতিদূরে রয়েছে মেওয়ারের রাজা কুম্ভের সঙ্গে যুদ্ধ জেতার গর্বে মাহমুদ শাহ খিলজি নির্মিত সাত তলা বিজয়স্তম্ভ, যার কয়েকটি তলা ভেঙে পড়েছে। এখন সেই বিজয়স্তম্ভের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে একটা মাত্র তলা।

মান্ডুতে রয়েছে চমৎকার সানসেট পয়েন্ট, যা আসলে পাহাড়ের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার দারুণ ব্যবস্থা। নীচে সবুজ গাছপালা, পাহাড়ি খাদ আর ছোট-বড় পাহাড় নিয়ে এক দুর্দান্ত ভিউপয়েন্ট। আকাশের চওড়া বুকে ক্লান্ত সূর্য যখন দূরের পাহাড় আর অরণ্যের আড়ালে নেমে যায়, তখন সামনে থেকে বয়ে আসা বাতাসের ঠান্ডার আমেজ মনে জাগায় এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

মান্ডুর পাহাড়ে প্রদোষের প্রাক্কালে দুর্গ ও প্রত্ন ঐতিহ্যের পটভূমিতে দেখা যায় আবছা অরণ্য, জঙ্গলের রাস্তা। দেখা যায় একদল জংলি টিয়া কিংবা নামনাজানা পাখির ঝাঁক ডাকতে ডাকতে বাসায় ফিরছে। রাতের পদধ্বনিতে ঝাপসা হয়ে আসে প্রকৃতি। মনে হয় জীবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে 'ম্যাজিক মুহূর্ত', 'অদ্ভুত নিস্তব্ধতা'।

অরণ্যে, পাহাড়ে, প্রত্নস্থলে নীরবতা ভাঙে দূরের আজানের ধ্বনিতে। অন্ধকার জমাট বাঁধার আগে সরব হয় জৈন ধর্মশালা বর্ধমান মহাবীরের সন্ধ্যারতিতে। শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি-সহ মন্ত্রপাঠ কানে আসে রামমন্দির থেকে। সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি আবিষ্ট করে প্রেম ও প্রত্ননগরী মান্ডুকে।

[মান্ডুতে আহার ও আবাসের জন্য রয়েছে অনেক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট।  যার মধ্যে এমটিডিসি পরিচালিত মালওয়া রিসোর্ট উল্লেখ্যযোগ্য।]

   

শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না কবি হেলাল হাফিজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

 

‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর…’

‘হৃদয়ের ঋণ’ কবিতার কবি হেলাল হাফিজ এখন নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন-যাপন করছেন সবার চোখের আড়ালে।

এখন মোটেও ভালো নেই কবি! সুস্থও নন! কথা বলতে গেলে তাঁর খবু কষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না তিনি! নেত্রকোনা থেকে কবি হেলাল হাফিজকে দেখতে আসা সাংবাদিক আলপনা বেগম বার্তা২৪.কমকে কবির এ অসুস্থতার কথা নিশ্চিত করেন।

আলপনা বলেন, কবিকে দেখার কেউ নেই! ভীষণরকম একাকী আর সবার চোখের আড়ালে বাস করছেন তিনি। রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকার হোটেল সুপার হোম নামে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে থাকেন কবি হেলাল হাফিজ। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিনা ভাড়ায় তাঁকে একটি ভিআইপি কক্ষ বরাদ্দ করেছে। সেখানেই অনেকদিন ধরে নিঃসঙ্গে সময় কাটছে তাঁর।

আলপনা জানান, কবি হেলাল হাফিজ একা একা গোসল করতে পারেন না। তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে হয়। হোটেলের এক বয় কবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দেন।

কবি বাম চোখে কম দেখতে পান বলে জানান আলপনা। তিনি জানান, কবি বয়সজনিত কারণে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বাংলা ভাষার এই কবি গ্লুকোমায় আক্রান্ত। এর পাশাপাশি কিডনি, ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগেও ভুগছেন তিনি।

রোমান্টিক ও প্রেমের কবিতা লিখেও কবি নিজে সারাজীবন থেকেছেন চিরকুমার!

নেত্রকোনায় বাড়ি কবি হেলাল হাফিজের। সে সূত্রে নেত্রকোনা থেকে আসা সাংবাদিক আলপনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, একবার ইচ্ছে আছে, নেত্রকোনায় যাওয়ার। শরীর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি সেখানে একবারের জন্যও হলে যেতে চান। দেখতে চান নিজের জন্মভিটা! সবাইকে একনজরও দেখে আসবেন তিনি।

নিজের চিকিৎসার বিষয়ে ভীষণরকম উদাসীন কবি হেলাল হাফিজ। ইতোপূর্বে, বার বার চেষ্টা করেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি।

২০২২ সালে শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলে কবি হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিনি। খানিকটা সুস্থ হলে ফের হোটেলে ফিরে আসেন কবি। এর ৪/৫ দিন পর ফের অসুস্থতাবোধ করলে হোটেলের লোকজন তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে আজও শাহবাগের হোটেল কক্ষে একাকী জীবন-যাপন করছেন কবি হেলাল হাফিজ।

বাংলা ভাষার ভীষণ জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর কবি প্রতিভার পরিচিতি লাভ করে। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

কর্মজীবনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পাদনাও করেছেন কবি হেলাল হাফিজ।

;

চুরুলিয়ার স্মৃতি ও নজরুলের অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের অধরা স্বপ্ন



অঞ্জনা দত্ত
নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) উপাচার্যের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে, যেখানে বেশ কয়েকটি আলমারিতে নজরুলের সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে। রয়েছে প্রায় চার হাজার গানের স্ক্রিপ্ট। এছাড়া দুটো কলের গান দেখতে পেলাম, যেগুলোতে নজরুল একসময় গান শুনতেন। দু’একটা বাদ্যযন্ত্রও ছিল মনে হয়। কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম কবিতীর্থ চুরুলিয়ার পথে। এর মধ্যে ভদ্রলোক জানিয়ে রাখলেন তিনি চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমিতে বলে রেখেছেন আমাদের কথা, ‘অতএব আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না’।

একাডেমির দেখভাল বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। চুরুলিয়ায় পৌঁছে অবাক হলাম নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র একজন এখনো জীবিত আছেন, যে কথাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ বলেননি। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখানে আমাদের লোক আছে, নজরুল একাডেমি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ইত্যাদি অনেক কথাই জানালেন। অথচ ওখানে যে নজরুল পরিবারের একান্ত আপনজন রয়েছেন সেটি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গেলেন! এটি জানা থাকলে কুড়ি কিলোমিটারের পথ আমাদের নিকট হয়তোবা দুই কিলোমিটারে দাঁড়াত!

আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার পথে একধরনের উত্তেজনা নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত নজরুলের স্ট্যাচ্যুর সাথে ছবি নিতে ভুল হলো না। কুড়ি কিলোমিটার খুব বেশি দূর তো নয়। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম। দু’জন সাধারণ চেহারা ও বেশভূষার মানুষ আমাদের দেখা মাত্র সাথে নিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপারে বসে আছেন শ্যামল বরণ, বলিরেখামণ্ডিত চেহারা, চশমা পরিহিত প্রায় আশির অধিক বয়েসি এক ভদ্রলোক। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ওটা ঠিক সাদা ছিল না, বহুল ব্যবহারে মলিন হয়ে পড়েছে আসল রঙ। আর চশমার ওপারে চোখ দু’টি কি ঘোলাটে ছিল ? আমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তিনি, কাজী রেজাউল করিম, নজরুলের কনিষ্ঠ ভাই আলী হোসেনের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কাজী রেজাউল করিমের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এঁর কথা কেন কিছু বলা হয়নি। আশ্চর্য!

রেজাউল করিমের সাথে গল্পে জমে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথাবার্তায় সাবলীল ছিলেন। বয়স তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর এখনো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই বৎসর ত্রিপুরায় নজরুলের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। স্মরণিকার জন্য আয়োজকরা পি কে ডি’কে লেখা দিতে বলেছিলেন। ওর লেখা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

রেজাউল করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পি কে ডি জানালেন আজকে চুরুলিয়ায় এসে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সে ভাবছে তাঁকে আবার নতুন করে লিখতে হবে নজরুলকে নিয়ে। রেজাউল সাহেব জানালেন, আগরতলা থেকে তাঁকেও লিখতে বলা হয়েছে। সুস্থ থাকলে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ঐ অনুষ্ঠানে। তাঁর নিজের পরিবারের কথা জানালেন। নজরুলের নাতি নাতনিদের কথা বললেন। বলা বাহুল্য সেগুলো খুব প্রীতিকর কিছু নয়। তাঁর নিজের কষ্টের কথা জানালেন। সুবর্ণ কাজী, রেজাউল করিমের তিন পুত্রের একজন, যার মধ্যে তিনি কিছু সম্ভাবনা দেখেছিলেন সংগীতে , তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন হলেন সোনালী কাজী। বাকি এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের কেউই নজরুলের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সংসারের নিয়মই মনে হয় এমন। একজন আয় (সেটি যে কোনোকিছুই হতে পারে) করেন। পরের প্রজন্ম সেটি এনক্যাশ করে চলেন (তবে এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না কেননা কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ নিজগুণে গুণান্বিত ছিলেন)। আর তৃতীয় প্রজন্ম দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এই ফর্মুলা পুরোপুরি কাজে না লাগলেও নজরুলের আদর্শ থেকে এরা অনেক দূরে। আপাদমস্তক মার্ক্সিস্ট কাজী রেজাউল করিমের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।

এবারে রেজাউল সাহেব আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পাকা একতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ওপর পুরনো বাড়ির অনুকরণে খড় দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হলো। যে দুজন আমাদের প্রথমেই তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন তারাই রেজাউল সাহেবের দেখাশোনা করেন। পরিবারটি, অন্তত রেজাউল সাহেব, তাঁর চাচার মতো অসাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলেন। আমি বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাইলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর এবং বাসনপত্র দেখে অবাক হলাম। কেননা ছেলেরা এল্যুমিনিয়ামের ডেকচি কড়াই এমন পরিষ্কার রাখতে পারার কথা নয়। জানালেন রান্নার জন্য অন্য মহিলা আছে। আর তাঁর স্ত্রী যে ঘরে রাঁধতেন, সে ঘরটিও অবহেলায়, অযত্নে পড়ে নেই।

হঠাৎ রেজাউল করিম সাহেব আমাদের এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানতে চাইলেন এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পর আমাদের দেশে কীভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়? উত্তর দেবার বিশেষ কিছু ছিল না। অথবা বলা ভালো সংক্ষেপে বলার মতো নয় বিষয়টি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি তাঁর সহচরদের বললেন, আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সব বলতে নজরুল একাডেমি, লাইব্রেরি, নজরুল যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ভগ্নাবশেষ, পারিবারিক গোরস্থান ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিতে। তিনি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। ও হ্যাঁ, নজরুল একাডেমি-যেটি রেজাউল করিমের বড়ো ভাই প্রয়াত মোফাজ্জল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন।

‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি...’ কবির বিখ্যাত সেই ছবিতে সাজানো অফিস কক্ষ..

কেননা এটি চালিয়ে নেয়ার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর সন্তানদের এবং নজরুলের নাতি নাতনিদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নেই। আমার মনে হয়েছিল কাজী রেজাউল করিম সাহেব স্বস্তিতে আছেন এই ভেবে যে নজরুল যথার্থভাবে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একটি ব্যাপার অনেকক্ষণ থেকে আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল নজরুলের বাড়ির সীমানা, একাডেমি, বিশাল লাইব্রেরি (যেখানে সতের হাজার বই রয়েছে, এটা পরে হয়েছে), কবরস্থান ইত্যাদি দেখে ভাবছিলাম কেন নজরুলকে বালক বয়েসে বাবাকে হারানোর পরে সংসার প্রতিপালনের জন্য রোজগার করতে যেতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কবিতীর্থে একদিন

নয় বছর বয়েসে মক্তব শেষ করার পর ঐ মক্তবে ছোটো শিশুদের তিনি পড়াতেন। মসজিদে আযান দিতেন। যোগ দিলেন লেটো দলে। এটি অবশ্য একেবারে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল না আমার দৃষ্টিতে। কেননা ঐ সময়ে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা স্ফুরিত হয়। নজরুল নিজেই সংস্কৃত এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেন। স্কুলে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। শিক্ষকরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর থেকে ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজায় নজরুল যুদ্ধ করতে চলে যান। আর স্কুলে ফিরে আসেননি।

আমার মনে হয় প্রকৃতিগত ভাবে নজরুল ছিলেন অতি চঞ্চল। ধরাবাঁধা জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না। সৃষ্টির নেশা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত। সংসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর পরে (প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের মাস কয়েক পরে মারা যান) তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বুলবুল কচিকন্ঠে অপূর্ব সুন্দর গাইতেন। নজরুলের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন স্বয়ং ঈশ্বর।১৯৩০ সালের মে মাসে বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। বারো বছর পরে ১৯৪২ সাল হতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। লেখালেখি করার ক্ষমতা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল ! বুলবুল মারা যাওয়ার পর কবি ছেলের স্মৃতিতে লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি …’!

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের নজরুল ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন। কবি বুঝতে পারেননি তিনিও ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কবি তাঁর ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছিলেন-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

চিরকালের অসাম্প্রদায়িক নজরুল, যিনি সবসময় লড়াই করেছিলেন মানব ধর্মের জন্য; তিনি জানলেন না তাঁর দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়ের লোক। এই বিভাজন নজরুল মেনে নিতে পারতেন না জেনেই বিধাতা হয়তো বা তাঁকে বহু আগে থেকেই বাকশক্তি রহিত করে রেখেছিলেন। কে জানে!

নজরুলের এই কথাগুলো আজকের বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, সেটি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক, যাঁর এক ডাকে মুক্তিকামী বাঙালি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। তবে এই দেশের মাটিতে মীরজাফরদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষাধিক মা-বোনের নৃশংস অত্যাচার নির্যাতন ঘটিয়েছিল এই দেশের মীরজাফররা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। আর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশের এই অপশক্তিরা ঝাড়েবংশে বেড়ে চলেছে। একজন নজরুলের আবির্ভাব কী তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নকে, লড়াইকে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে? (সমাপ্ত) 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

ফিউচার প্ল্যান



শরীফুল আলম। নিউইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিউচার প্ল্যান

ফিউচার প্ল্যান

  • Font increase
  • Font Decrease

কখনো কখনো সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমি হারিয়ে যাই
কখনো শিল্পীর আঁকা ছবির কাছে
আমি স্নিগ্ধ আকাশের কাছে গিয়ে উড়িয়ে দেই
আমার সমস্ত বিষণ্ণতা
আমি মেঘের আস্তরে ঢেকে রাখি আমার সুখ , আমার মুখ
আমার সজিবতা ।

ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আস তুমি শেষ বিকেলে
অদ্ভুত সুখ তখনও বিরাজ করে এই আত্মায়
পলাতক শব্দ গুলো শিশিরের ন্যায়
আধো আধো প্রেমের ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ।

একটা সুদীর্ঘ সময়ের সমাপ্তি করলে তুমি ,
সেই পুরনো রাত , পুরনো দিন
মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আস তুমি
অনেকটা জোনাকির ছলে ।

তুমি এক আলৌকিক আগুণ
তুমুল পোড়াও তুমি আমাকে
কখনো স্বপ্নের ভিতর
কখনো পিয়ানোর সানাই হয়ে
তুমি নিত্য পরিক্রমা এই মনে ,
তোমার ঠোসকা পড়া তেরছা কথা
"ডাকলেও আর আসবো না "
শুনতে বড় বেখাপ্পা লাগে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা তখন মনে পড়ে যায়
ঝড় , ঝঞ্ঝার কথা তখন মনে পড়ে যায়
প্রকৃত প্রস্তাবে তখন তোমার বিবর্তনের কথাই মনে পড়ে যায়
আর বিবর্তন মানে - আড়াল রাখতেই সে পছন্দ করে
ফাগুনে আগুণ লাগাতেই সে পছন্দ করে
তার সানগ্লাস তখন যেন থেমে যায় গ্ল্যালাক্সি ক্রসিংয়ে
আড়চোখ দেখে নেয় সব
বিলম্বিত লাবণি , ফিউচার প্ল্যান ।

;

কবিতীর্থে একদিন



অঞ্জনা দত্ত  
-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধূর ধূপ!’’

অনেক ছোটোবেলায় যখন এই কবিতাটি পড়ি তখন কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও মনে আছে। কেননা কবি তখন বাকরহিত ছিলেন। সেই ছোটো বয়েসেও অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, তিনি কীভাবে বুঝেছিলেন একদিন তাঁর এমন পরিণতি হবে? সত্যি বলতে আজও এর উত্তর খুঁজে পাইনি। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ দু’জনের ওপরেই ছিল সরস্বতীর আশীর্বাদ। সেই অর্থে তাঁদের ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। তবে ছিলেন স্বশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহ ছিল সংস্কৃতি চর্চায় পরিপূর্ণ। নজরুলও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর চাচা বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল অপরিসীম। চাচার প্রভাবে নজরুল লেটো দলে যোগ দেন এবং অতি স্বল্প সময়ে তিনি নিজের প্রতিভায় অন্যদের মুগ্ধ করেন। কবিতীর্থ সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে জানাতে চাই কীভাবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার প্রোগ্রাম হলো ?

এই বছর জানুয়ারি মাসের শেষদিকে কলকাতায় এক বিয়ের প্রোগ্রামে যেতে হচ্ছিল। সবসময়কার মতো কোথাও যাওয়ার নামে ঢোলে বাড়ি বাজলে আমার মন নেচে উঠে। কিন্তু যতই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে ততই মনে হয়, ধুর না গেলেই ভালো হতো। কিন্তু ততদিনে ‘পি কে ডি’র প্ল্যান পেকে টসটসে হয়ে উঠে। অর্থাৎ টিকেট কাটা, থাকা, গাড়ির ব্যবস্থা করা সব কমপ্লিট। অতএব ব্যাগ গোছাতে হয় হাঁড়িমুখে। তবে যখন চাকরিতে ছিলাম তখন বেড়ানোর কথা হলে মন ময়ূরের মতো নেচে উঠত। সেই সময়টায় ছুটি পেতে নানারকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হতো। আদম সন্তান! সহজলভ্য জিনিসের চেয়ে যেটি পেতে অসুবিধে হবে সেদিক পানে মন ছুটে যেত। ‘পি কে ডি’ দেখল কলকাতায় শুধু বিয়ে খেতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এরসাথে আর কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে বেশ হতো। আমার তো কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছেই নেই। তাই আর কোথায় যেতে চায় সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল ছিল না। জানি মোগলের হাতে যখন বাবা সঁপে দিয়েছেন, তখন খানাটা তার সাথেই খেতে হবে।

অন্য কথা শুরু করার আগে ‘পি কে ডি’র নামের অর্থটা জানিয়ে দেয়া উচিৎ বলে মনে করি। কেননা লেখালেখির প্রথম জীবনে পাঠকদের মধ্যে একধরনের ঔৎসুক্য থাকত এই নাম নিয়ে। পি কে ডি, প্রদীপ কুমার দত্ত, যার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি (‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’… তবে জানিয়ে রাখি এই গাঁটছড়ায় অন্য অনেক কিছুই আছে, সুর ছাড়া। কখন আপনারা আবার গান শোনার আবদার করে বসেন!)

তাঁর অন্যতম নেশা হলো বেড়ানো। অন্য স্ত্রীরা আনন্দে বাক বাকুম করত, সেখানে আমি মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখি, ঐ যে বললাম না সহজে পাওয়া জিনিসের কোনো মর্যাদা থাকে না! আর বাংলা পাঁচের সাথে অপ্রসন্ন চেহারার তুলনা যে কোন পণ্ডিত করেছেন জানি না। মানুষের চেহারা কখনও বাংলা পাঁচের মতো দেখাতে পারে, বলুন?

পি কে ডি ঠিক করলেন কলকাতার বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে দেওঘর, রামপুরহাট আর আসানসোল যাবে। দেওঘরের নাম আপনারা পড়েছেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, যিনি তাঁর গল্পের কোনো চরিত্রের অসুখ করলেই হাওয়া বদলের জন্য দেওঘরে  পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যখনই শুনলাম ঐ সময়ে দেওঘরে ভালোই শীত থাকবে, মেজাজ সপ্তমে পৌঁছাতে মোটেই সময় নিল না। এর মাস দুয়েক পূর্বে নৈনিতাল এবং আশেপাশের হিমালয়ের অঞ্চলসমূহে বেড়িয়ে এমন ঠাণ্ডায় ভুগেছিলাম, এরপরেও শীতের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে! মেজাজ কেন খারাপ হবে না বলুন? কে জানে পি কে ডির মনে কী আছে? সাধারণত বলা হয়ে থাকে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। নারীদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তাঁরা বলতেন পুরুষাণাং চরিত্রম দেবী ন জানন্তি, কুতো মনুষ্য! তবে আপনারা এইটি কোথাও ব্যবহার করবেন না। ইহা অধমার মস্তিষ্কপ্রসূত! দেওঘর হাওয়া বদল ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য তীর্থস্থানও বটে। রামপুরহাটও তাই। আর আসানসোল? যখন জানাল চুরুলিয়ায় যাবে, অমনি মেজাজ পঞ্চমে নেমে এলো। আর দেওঘরের শীতের হাওয়া নাচতে শুরু করল আমলকির ডালে ডালে।

কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম, লেখক ও পি কে ডি (প্রদীপ কুমার দত্ত)। ছবি: লেখক

সত্যি বলতে কি চুরুলিয়ায় গিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পাবো সেটি ভাবিনি। ভেবেছিলাম আমাদের দুখু মিয়া তো সেই কবে থেকেই দুঃখের সাগরে ভাসছিলেন। তাঁর সাথে আমরাও ভাসছিলাম বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে। একজন মানুষ এক জীবনে এতটা কষ্ট পেতে পারেন? এমন একটা প্রতিভা এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল শুধুমাত্র সময় তাঁকে অবজ্ঞা করায়। তা না হলে আর কী বলা যেতে পারে? যদি নজরুল যুদ্ধের দামামার ভিতরে অসুস্থ না হয়ে আরও বছর কয়েক পরে অসুস্থ হতেন তাহলে হয়তো বা তাঁকে সুস্থ করা যেত। আর একেবারে তিনি যদি এই দুরারোগ্যে আক্রান্ত না হতেন, তা হলেই বা সংসারে কার কতটা ক্ষতি হতো? এই কথাগুলো অনেকের কাছে যেমন অর্থহীন মনে হবে, তেমনি অনেক নজরুলপ্রেমীর বুকের ভিতরটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ে!

দেওঘর রামপুরহাটে দেবী দর্শন করে মনে হয় ভালোরকমের পূণ্য সঞ্চয় করেছিলাম। কেননা আসানসোল স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর এক সুবেশধারী ভদ্রলোক আমাদের নিতে এলেন ততোধিক ঝকঝকে জীপ নিয়ে। এই লিঙ্কগুলো পি কে ডির রোটারির কানেকশনে। রোটারিয়ান হওয়ার এই এক সুবিধে।  পৃথিবীর যে কোনো দেশে রোটারিয়ানরা ফেলোশিপের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূর্ব পরিচিতির প্রয়োজন নেই। অভিষেক তেমন একজন রোটারিয়ান, যাকে তাঁর সিনিয়র একজন বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক রোটারিয়ান যাচ্ছেন তোমার শহরে। Help him with what he needs, ব্যস এটা তাঁর জন্য বেদবাক্য হয়ে গেল!

অভিষেক অবাঙালি। বাংলা বলতে পারেন। বয়েস বড়োজোর পয়ঁতাল্লিশ – পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাবা মা দু’জনেই আছেন। বহু বছর ধরে তাঁরা আসানসোলে বসবাস করছেন। কিন্তু পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল শহর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে চুরুলিয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না। তবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার জন্য নিজেদের একখানা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পরদিন সকালে। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি অভিষেক আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে আসানসোল ক্লাবে পৌঁছে দিল। নিজের কিছু কাজ সারতে চলে গেল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল ড্রাইভার এসে আমাদের নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে লাঞ্চ করার জন্য। তবে ঘন্টা দু’য়েক পরে নিজেই এসে হাজির ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। মা বাবা এবং অভিষেকের স্ত্রী সবাই অপরিচিত অতিথিদের সাথে বহুদিনের পরিচিতের ন্যায় আচরণ করলেন। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন।

লাঞ্চ সেরে পি কে ডি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন মাইথন বাঁধ (Maithon Dam) দেখতে যেতে চায়। আমার ভালো লাগত একটু যদি বিছানায় গড়িয়ে নেয়া যেত। কিন্তু বেড়াতে বের হলে এটি পি কে ডি’র অভিধানে থাকে না। তাঁর হলো কম সময়ে কত বেশি দেখা যায় অথবা কতবেশি জানা যায়? আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার রক্তমাংসের মানুষ। সকালবেলায় ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়েছিল। কাজেই রাতের ঘুমের কোটা যেটুকু অপূর্ণ ছিল, সেটুকু পুরিয়ে নিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এত বছরে এইটুকু বুঝেছি সব ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতে নেই। তাছাড়া অভিষেক ইতিমধ্যে ওদের ক্লাবের কয়েকজন রোটারিয়ানের সাথে কথা বলে সন্ধ্যেবেলায় একটা ফেলোশিপ মিটিং এর আয়োজন করেছে। রোটারিতে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা মিটিং হয়। অভিষেকদের মিটিং হয়ে গিয়েছিল। অভিষেক চাইছিল আমিও যেন মিটিং এ যাই। তাহলে ওর স্ত্রীও যাবে। অগত্যা।

অভিষেকদের একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম মাইথন বাঁধ দেখতে। কাপ্তাই বাঁধে যে স্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেটি দেখেও যখন পি কে ডির আশ মিটেনি তখন সাথে যেতেই হলো। তবে এই বাঁধটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র হলো মাটির নিচে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটিই প্রথম  ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ তৈরির স্থাপনা। এটি ষাট হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ১৯৫৭ সালে উদ্বোধন হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বিছানা তখন দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আয় আয় আমার কাছে আয়। সে ডাক কি উপেক্ষা করা যায় ? পাগল!

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য বিছানার সাথে মিতালি করা গেল না। মিটিং এ যাওয়ার জন্য উঠতে হলো। ড্রাইভার আমাদের সাথেই ছিল। হঠাৎ করে ডাকা মিটিং এ রোটারিয়ানদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। বেশি ছিল আন্তরিকতা আমাদের প্রতি তাঁদের। দুই ক্লাবের পতাকা বিনিময় হলো। পি কে ডি তাঁর নিজের ক্লাব নিয়ে এবং দেশ নিয়ে কথা বলল। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। ভারতের বাইরের দেশগুলোকেও অচ্ছ্যুত রাখল না। অনেক কথাই হয়েছিল। সাথে খাবার দাবার তো ছিলই। একসময় মিলনমেলা ভাঙলো। ফেরার পথে অভিষেক জানাল পরদিন সকালে আসানসোলে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। এতক্ষণ আপনারা ধান ভাঙতে শীবের গীত শুনেছেন। এবারে  মূল প্রসঙ্গে আসি। যে কারণে আসানসোল আসা।

কবির পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রের পাশে লেখক; যেখানে প্রমীলা নজরুলসহ স্বজনদের কবর রয়েছে।

লেখার শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি, দুঃখী মানুষদের কবি, ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এতদূর আসা। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। সড়কপথে বা রেলপথে যাওয়া যায়। আর আসানসোল থেকে চুরুলিয়া মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে। আমরা বাঙালিরা শান্তিনিকেতনে দৌড়ে যেতে (বারণ করছি না যেতে) যত পছন্দ করি, ততোটা কি চুরুলিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবি ? নজরুল জীবিত থাকা অবস্থায় ছিলেন অবহেলিত, অসুস্থ অবস্থায়, ঢাকায় আসার আগে কেমন ছিলেন জানা নেই, তবে মৃত্যুর পরে যে আমাদের স্মৃতিতে ধুলো বালি জমতে শুরু করেছে সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

অভিষেক জানিয়েছিল আসানসোল শহর থেকে অদূরে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওখনে হয়তো বা কোনো তথ্য পেতে পারি। রওনা দিলাম সেদিকে। যেহেতু পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে এসেছি উপাচার্য মহাশয়ের সাথে দেখা করতে তাই জায়গায় জায়গায় এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছিল। অবশেষে উপাচার্য মহাশয়ের কক্ষে ডাক পড়ল। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে  প্রীত হলেন মনে হলো। তাঁর মামাবাড়ি একসময় চট্টগ্রামে ছিল। তাঁকে চট্টগ্রামে  আমাদের অতিথি হয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানালাম। চুরুলিয়ায় যেতে চাই শুনে তিনি আরও উৎসাহিত বোধ করলেন। সাথে সাথে তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যিনি  নজরুল সক্রান্ত কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। জানা  গেল তিনি সেদিন , অন্তত তখনও এসে পৌঁছাননি। অন্য আর একজনকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। তাঁকে আমাদের পরিচয় জানিয়ে বললেন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁদের যে মিউজিয়াম রয়েছে তার কার্যক্রম দেখাতে। তবে নতুন একটি মিউজিয়াম নির্মাণের পথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল চুরুলিয়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্য সরকার (সি পি এম) এটি আসানসোলে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ভেবেছিলেন চুরুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওখানে ছাত্র সংখ্যা খুব বেশি হবে না। তাছাড়া ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ অনেক বেড়ে যাবে। এখনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন /চার সহস্রাধিক ছাত্র ছাত্রী পড়ছে। বাইশটি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। চুরুলিয়ায় গিয়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। উপাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার আগে তাঁর সাথে ছবি তুলে নিলাম। ঐ সময়ে তাঁর সেলফোনে রিং বেজে ওঠায় অভদ্রতা হলেও ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম ‘সোনালী কাজী ইজ কলিং’। কথা সেরে স্যার জানালেন নজরুলের নাতনি ফোন করেছিলেন। মনে মনে বললাম ও আমার দেখে নিয়েছি! যদিও সোনালীর নাম আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। (ক্রমশ…)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;