আত্মজীবনীর খসড়া: মহীবুল আজিজ



ড. মহীবুল আজিজ
কবি, কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ মহীবুল আজিজ। বার্তা২৪.কম

কবি, কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ মহীবুল আজিজ। বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। পড়ি চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। প্রধান শিক্ষক ছিলেন সাদতউল্লা স্যার। মাঝে-মাঝে আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন, শেখাতেন কী করে ইংরেজি বাক্য গঠন করতে হয়। আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্যাহ’র মূল বিষয় ছিল অর্থনীতি, ১৯৫৬ সালে এম. এ. ডিগ্রি অর্জন কিরেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে আবার দ্বিতীয় ডিগ্রি নেন আইনশাস্ত্রে। অধিক কাজে লেগেছিল দ্বিতীয়টাই। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল পররাষ্ট্র কিন্তু তাঁর শিকি ছেঁড়ে ব্যাংকিংয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত কৃষি ব্যাংকে চাকুরি করে গেছেন। এরপর থেকে আইনজীবী পেশায় যোগ দেন যাতে ২০০৪-এ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি স্থিত ছিলেন।

১৯৭৩ সালে আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন সকালবেলা বাবা আমাকে দু’টো বই পড়তে দিলেন। বললেন, ইংরেজি’র জন্যে কাজে লাগবে যত্ন করে রেখে দাও। দু’টোর একটা ছিল নিউজিল্যান্ডের নেসফিল্ড্ রচিত ‘গ্রামার’ এবং অন্যটা রেন এ্যান্ড মার্টিন-এর ‘গ্রামার’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবা’র সাবসিডিয়ারি ছিল ‘স্পেশাল ইংলিশ’। এমনিতে তিনি একাধিক ভাষা জানতেন। প্রবেশিকায় তাঁর ছিল আরবি ও ফার্সি। রুমি’র ‘মসনবি’ তাঁর আলমারিতে থাকতো আইনের বইপত্র এবং ডিএলআরের সঙ্গে। আমরা দুই ভাই যে-শিক্ষকের নিকটে ছোটবেলায় আরবি পড়তাম তিনি আমাদের ফারসিও পড়াতেন, তাঁর নাম ছিল মওলানা ওবায়দুল্লাহ। রুমি, হাফিয এবং শেখ সাদি’র অনেক গল্প আমরা তাঁর কাছ থেকে শুনেছি।

সত্যি কথা বলতে কি নেসফিল্ড এবং রেন এ্যান্ড মার্টিন-এর বই আমার চিন্তারাজ্যে বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। ঐ বই থেকেই বুঝতে পারলাম, কেবল শুদ্ধভাবে ইংরেজি লিখতে পারাটাই আসল কথা নয়, পরিস্থিতিনির্ভর চমৎকার ইংরেজি’র ব্যবহারটাই আসল কথা। তাছাড়া দু’টো বইয়েতেই বিখ্যাত সব ইংরেজ লেখকদের বিভিন্ন রচনার উদ্ধৃতি ছিল যেগুলো আমি মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি। অজান্তেই সাহিত্যের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মাতে থাকে। তবে বাংলা ভাষায় লেখা গল্প উপন্যাস কবিতা‘র পাঠক আমি স্কুল থেকেই। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই ঢূকে পড়তাম চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পাঠ শেষ করি এখানেই ১৯৭৫ সালে যখন আমি নবম শেণির ছাত্র। যিনি এখানে লাইব্রেরিয়ান ছিলেন তাঁর নাম আজ আর মনে নেই তবে মনে আছে তিনি ঝুঁকে হাঁটতেন বাধ্য হয়ে। তাঁর বাম পা ডান পায়ের তুলনায় খাটো ছিল। কিন্তু মনের উদারতা ও বাৎসল্য দিয়ে তিনি তাঁর এই খাটোত্বকে সহজেই জয় করে নেন।

ঠিক দুপুর দু’টোয় লাইব্রেরির দরজা খুলতো। প্রায় রোজই আমি যেতাম সেখানে। একদিন লাইব্রেরিয়ান আমাকে জিজ্ঞ্যেস করেন, গতকাল তোমাকে দেখি নি। একটা দৃষ্টান্ত থেকেই বুঝতে পারি, ভদ্রলোক সত্যিই স্নেহপরায়ণ মানুষ।

এই লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসার সময়টাতে আমি খানিকটা প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম লাগোয়া ব্রিটিশ কাউন্সিলের দিকে। মাঝে-মাঝে দেখতাম বিদেশি লোকেদের আনাগোনা সেখানটায়। অনেকেই আসতো গাড়ি করে। মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরির পাঠক আর ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাঠকদের মধ্যে একটা পার্থক্য অনিবার্যভাবেই চোখে পড়তো। সেটা হলো পোশাক-আশাক আর আভিজাত্যের দিক। ভাবতাম ওখানে ঢুকতে হলে হয়তোবা আমারও দামি-দামি পোশাকের প্রয়োজন পড়বে কিংবা হয়তো বিশেষ ধরনের অনুমতিপত্র ছাড়া ওখানে ঢোকা অসম্ভব। একদিন সাহস করে ঢুকে পড়লাম ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে।  সেটা ১৯৭৮ সালের ঘটনা, আমি চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, প্রথম বর্ষের। ঢুকতেই ডেস্ক থেকে একজন জানতে চাইলেন আমি কার্ডধারী কিনা। বললাম, না, বইপত্র পড়তে এসেছি। লোকটা স্নেহসুলভ ভঙ্গিতে আমাকে বসবার টেবিল দেখিয়ে দিলেন এবং কোথায় বইপত্র এবং কোথায় পত্রিকা-ম্যাগাজিন রাখা থাকে সেসব ভালভাবে বুঝিয়ে দিলেন। ইংরেজি গার্ডিয়ান আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা আমি প্রথম পড়ি এখানেই। বিপুলাকার একেকটি পত্রিকা, সম্ভবত ৩২ পৃষ্ঠার ছিল, খেলাধূলা, রাজনীতি, সাহিত্য, বিনোদন সবই বিপুল আয়োজনের এবং চমৎকার সচিত্র প্রতিবেদনযুক্ত।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের বইগুলো ছিল স্বপ্নের বইয়ের মত। প্রায় সবই বিদেশে ছাপা ও বাঁধানো বই। বইও যে এত সুষমামণ্ডিত হতে পারে এসব বই দেখে জানা হলো। নানারকম বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা গেল। উইজডেন প্রকাশিত ক্রিকেট ম্যাগাজিন আর দ্য ক্রিকেটার-এর ঝকমকে রঙিন উপস্থিতি, মনোমুগ্ধকর একেকটা পৃষ্ঠা। যাহোক একদিন শুরু করে দিলাম ইংরেজি উপন্যাস পাঠ। সুইজারল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী জোহান্না স্পাইরি’র বই আমাকে দারুণভাবে টেনে নিতে থাকে। এর পেছনে দু’টো কারণ ছিল- প্রথমত তাঁর লেখা কিশোর কি সদ্য তরুণ-পাঠ্য এবং দ্বিতীয়ত তাঁর ভাষা তুলনামূলকভাবে সহজ। স্কুলে ক্লাস টেন পর্যন্ত বাংলা মিডিয়মে পড়বার পর এক লাফে আইএসসিতে ইংলিশ মিডিয়মে পড়াটা খুব যে সহজ ছিল তা নয় তবে আমার ক্ষেত্রে সেটা সহজ হয়েছিল আমার পিতৃদেবের কারণেই। সেই যে ১৯৭৩ সালের এক সকালবেলা তিনি আমাকে নেসফিল্ড্ আর রেন এ্যান্ড মার্টিন ধরিয়ে দিয়েছিলেন তারই কল্যাণে আমি জোহান্না স্পাইরির উপন্যাসে মগ্ন হয়ে থাকবার সুযোগ পাই। যদিও কলেজে যেসব বই পড়ছি এক ইংরেজি সাহিত্যকে বাদ দিলে পদার্থ রসায়ন উদ্ভিদ প্রাণি গণিত সবই বৈজ্ঞানিক ইংরেজি ভাষার। সেদিক থেকে গল্প-উপন্যাসের ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হেতা। মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। জোহান্নাকে ভালো লাগবার আরেকটা কারণ ছিল। জানি না দুইয়ের মধ্যে কি সম্পর্ক। টেলিভিশনে একটা সিরিয়াল আমরা নিয়মিত দেখতাম সপরিবারে—লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি। সেই যে স্বপ্নের রাস্তাঘাটের মতন অদ্ভুত সুন্দর লোকালয় ধরে হেঁটে দৌড়ে ফিরছে লোকজন আর তাদের সব গল্প। ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট সবই অচেনা কিন্তু কাহিনি কথা সবই মন ছুঁয়ে যায়। জোহান্নার গল্প-উপন্যাসেও ছিল গ্রামীণ পটভূমি: সুইজারল্যান্ডের জুরিখ অঞ্চলের গ্রামীণ জীবন তাঁর লেখালেখির কেন্দ্রে ছিল। মূলত শিশু-কিশোরদের রচনার জন্যেই ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর খ্যাতি।

জোহান্না’র যে উপন্যাস ‘হাইডি’ আমি পড়েছিলাম সেটার সবটা আর মনে নেই কিন্তু কেন সেটা ভালো লেগেছিল তা এতকাল পরে এসেও আমার মনে গেঁথে থাকে। হাইডি নামের চিরঅনাথ মেয়েটি বড় হয়েছিল ওর নানি আর খালার স্নেহে-ভালোবাসায়। মরে যায় নানিও, তারপর খালা তাকে নিয়ে যায় তার জীবনযুদ্ধের স্থলে। হাইডি এমনই একটা মেয়ে কেউ তাকে হিংসা বা ঘৃণা করতে পারতো না, সবাই তাকে ভালোবাসতো। ব্রিটিশ কাউন্সিলে বসে বসে পড়ি ‘হাইডি’। জানলা দিয়ে লালদীঘির টলটলে জলের স্তর চোখে পড়ে, মাঝে মাঝে সেই স্তর ছুঁয়ে আসা ঠাণ্ডা একটা আরাম গায়ে এসে লাগে। রাতে যখন ঘরে পড়ার টেবিলে বসি আমার মন খারাপ করতে থাকে হাইডি নামের মেয়েটির জন্যে। অথচ কতকাল আগেকার সেই মেয়েটির কথা, কারও মনে থাকবার কথাই নয়। হয়তো জোহান্নাই ছিলেন হাইডি। কিন্তু টিভিতে যখন লাফিয়ে লাফিয়ে তৃণের প্রান্তর মাড়িয়ে যেতে থাকে প্রেইরি’র সেই পরিবারটির মানুষজনেরা আমার তখন মনে হতে থাকে যে ওদেরই একজন নিশ্চয়ই হাইডি। মুহূর্তের জন্যে আমি ভুলে যাই হাইডি ছিল পিতৃমার্তৃহীন। হাইডি’র কাহিনি পড়তে পড়তে আমি আমারই নিজের জীবনের সঙ্গে তার জীবনের একটি সমান্তরাল রেখা এঁকে ফেলি। আমিও শৈশবে আমার মা’কে হারাই। মা যখন আমাদের দুই ভাই আর এক বোনকে চিরতরে বিদায় জানিয়ে চলে যান তখন আমার বয়স ছিল ৩ বছর ৪ মাস ২২ দিন ৪ ঘণ্টা (আমার মায়ের মৃত্যুদিবস ১৯৬৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টা)।

কিছুদিন কিশোরপাঠ্য গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে যখন পড়বার জগতে একটা সিঁড়ি মোটামুটি স্থাপন করা হয়ে গেল তখনই সাহসে ভর করে ঢুকে পড়লাম বড়দের উপন্যাসে। খুব পুরু নয়, দেখতে ক্ষীণকায়ই বলতে হবে—এমিলি ব্রন্টির লেখা ‘উদারিং হাইট্স্’। রচয়িতার নামের সঙ্গে আর দু’টো নাম খোদাই হয়ে রইলো মনের মধ্যে—হেথক্লিফ এবং ক্যাথরিন আরন্সশ’। অনেক বছর পরে উপন্যাসটা আবার পড়তে পারি ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে বসে। প্রথম পড়ায় সবটা বুঝি নি কিন্তু দ্বিতীয় পাঠে হৃদয়ঙ্গম করা গেল এবং ইংল্যান্ডে প্রত্যক্ষ বসবাস সেই বোধ্যতায় খানিকটা ভূমিকা নিশ্চয়ই রেখেছিল। ব্রিটিশ কাউন্সিলে আর কি বইপত্র পড়েছিলাম সেসব তেমন মনে পড়ে না কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি একটা অদম্য আকর্ষণ আমার মনে দৃঢ়মূল হয়ে রয়ে গেল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন আমি ইংরেজি না পড়ে বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করলাম সেটা একটা মজার ব্যাপারই বলতে হবে। স্কুলজীবনেই আমি মানবিক বিভাগে পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবা বলেন, তুমি অংক ইংরেজি এবং বিজ্ঞানে ভালো নম্বর পেয়েছো, তোমাকে কাজেই বিজ্ঞানই পড়তে হবে। যাহোক, আইএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পালা তখনই বাবা’র সঙ্গে শুরু হলো আমার ঠাণ্ডা লড়াই পর্ব। আমি ধনুর্ভাঙ্গা পণে স্থির, বিজ্ঞান আর পড়বোই না, সাহিত্য  পড়বো। ইংরেজি সাহিত্য পড়ি ভালোবেসে কিন্তু বাংলা সাহিত্যটা পড়লে আমি নিশ্চয়ই কর্মজীবনে ভালো করতে পারবো। তবু মনের মধ্যে ইংরেজিতে পড়বার আকাঙ্ক্ষাটাও সুপ্ত ছিল। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কিত আমার ধারণাটার পেছনে সঙ্গত কারণ ছিল। স্কুলে থাকাকালেই আমি লেখালেখি করতাম। কখনও কোথাও ছাপতাম না। তবে কী করে কী করে যেন আমার স্কুলের সহপাঠীরা ওয়াজিউল্লাহ্ স্যারের কানে এই সংবাদ পৌঁছালো যে আমি গল্প ও কবিতা লিখতে পারি। ব্যস্, আর যাই কোথায়। ফুল স্কেপ কাগজে অনেকটা সময় ব্যয় করে গল্প এবং প্রবন্ধ লিখে স্যারকে জমা দিলাম এবং স্কুল-ম্যাগাজিনে ছাপা হলো সেসব লেখা। কাজেই মনে হয়েছিল বাংলা ভাষার ওপর সহজাত দখল থাকলে সেটা পরীক্ষায় ভালো ফল দেবে। কিন্তু আমার ভাবনা যতটা সহজ ছিল তার বাস্তব প্রয়োগ ছিল ততটাই দুরূহ।

বিজ্ঞান আর পড়বো না, বাবা সেটা মেনে নিলেন এক শর্তে। আমাকে ইংরেজিতেই অনার্স পড়তে হবে। আমি বললাম, বাংলা পড়লে সমস্যা কী? বাবার স্পষ্ট উত্তর, বাংলা পড়লে ভাত জুটবে না কপালে। ভালো চাকরি পাবে না কোথাও, দুনিয়া চলে ইংরেজির চাকায় ভর করে! টগবগে তারুণ্য তখন দেহেমনে। বাবা’র কথাটা অপমানের মতন মনে হলো। বাংলা পড়ে যদি ভাতই না জোটে তাহলে বিষয়টা লোকে কেন পড়ে, প্রশ্নটা মনের মধ্যে খোঁচা দিতে লাগলো অহর্নিশ। বাবাকে বললাম, জীবনে চলতে হলে কী লাগে, দুইবেলা আহার সকালে বিকালে একটু চা-নাস্তা। শুনে আমার আইনজীবী বাবা হাসতে হাসতে বলেন, বুঝবে জীবনে চলতে হলে কী লাগে, কেবল চা-নাস্তা আর দুই বেলা ভাতই জীবন নয়, জীবনের চাহিদা আরও অনেক বেশি।

তখন বাবা’র সেসব কথা ভালো লাগে নি যদিও পরে বুঝেছি তাঁর সেই কথার ইঙ্গিতটা। বাবা আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠালেন অনার্সে ভর্তির ফরম আনতে এবং বাংলা থেকে ফরম নেওয়া তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন আমার জন্যে। শুধু তা-ই নয়, আমার সঙ্গে প্রহরী হিসেবে পাঠালেন আমারই মামা (আমার মায়ের খালাতো ভাই) রফিকুল ইসলাম শামীমকে যাতে আমি কেবল ইংরেজি থেকেই ফরম নিতে পারি। শামীম মামা তখন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মামার অনুরোধে আমি অবশ্য উদ্ভিদবিজ্ঞান থেকেও ফরম নেই কিন্তু ইংরেজি পরীক্ষা ভালো হওয়ার কারণে উদ্ভিদে আর পা মাড়াই না। ভর্তিপরীক্ষার ফল জানবার জন্যে আর মামাকে আমার সঙ্গে পাঠানো হয় না। দেখলাম মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছি এবং দিনকয়েকের মধ্যে ভর্তি হওয়া যায়। ঘরে ফিরে এসে বাবাকে বললাম, আমি ভর্তি-পরীক্ষায় কৃতকার্য হই নি। শুনে বাবা বললেন, আনবিলিভেবল্। বাবা’র ইচ্ছে ছিল ইংরেজি পড়ে পরবর্তীতে বিসিএস দিয়ে আমি তাঁরই মত বড় কোন পদে অধিষ্ঠিত হবো। কিন্তু আমি জীবনে কখনও বিসিএস পরীক্ষাতেই অবতীর্ণ হই নি। এসবের পেছনে কী কারণ সেসব প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিত করতে না পারলেও এটা অনুমান করতে পারি, বাবা’র সঙ্গে সব বিষয়ে দ্বিমত করবার আমার ‘ইগো’ কিংবা ‘সুপার ইগো’ই ছিল প্রধান কারণ। আমার ভর্তি হতে না পারাটা বাবা’র জন্যে ছিল এক দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা। আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই কিন্তু দেখতাম, বাবা’র মনে সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। এখানে বলে রাখা যায়, আমার চেয়ে বয়সে এক বছর তিন মাসের বড় আমার ভাই আর আমি সহপাঠী ছিলাম। সেই সহপাঠীত্বেরও রয়েছে এক মজার কাহিনি।

১৯৬৬ সালে আমার বাবা চট্টগ্রামের দোহাজারি কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে আসেন। এর আগে যশোর, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, মেহেরপুর এরকম নানা জায়গায় পোস্টিং ছিল তাঁর। তদ্দিনে আমরা আমাদের নতুন আম্মার (মা বললে আমি আমার জন্মদাত্রীকে বোঝাই আর আম্মা বললে আমাদের নতুন মাতা, দ্বিতীয় মাতা) সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দ্বিতীয় বিবাহ করবার পর বাবা যখন আমাকে এবং আমার বড় ভাইকে নিয়ে যান আম্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে আমার বড় ভাই, জানি না কেন, বেশ সহজেই মেনে নেয় যে ইনিই আমাদের জন্মদাত্রী মা। ১৯৬৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ঐ বছরেরই ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস আমাদের প্রকৃত মায়ের অনুপস্থিতি সম্পর্কে আমার বড় ভাইয়ের মধ্যে দেখি অদ্ভুত এক নির্বিকারত্ব।) আমার প্রথম ধাক্কাতেই মনে হয়েছিল ইনি আমার মা নন, অন্য মহিলা। সেটা আমি ফিসফিসিয়ে বড় ভাইকে বলিও কিন্তু দেখলাম তাঁর মধ্যে বিকার নেই। উল্টো ভাই আমাকে প্রশ্ন  করে, কেন তোর সেটা মনে হলো। উত্তরে আমি বলি, আমার মায়ের গায়ের যে-ঘ্রাণটা জন্মের পর থেকে পেয়ে আসছিলাম সেই ঘ্রাণটা পাই না কেন! উত্তর শুনে আমার বড় ভাই খানিকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে। যাহোক, মনে মনে একটা স্তোক দিলাম নিজেকে, তিনি হয়তো আমার মা নন, আম্মা কিন্তু আমরা অনাথ দুই ভাই এক বোন তো তাঁরই তদারকিতে রয়েছি। এই যে সকালে উঠে নাস্তা খাই, তারপর দুপুরে খাওয়া, বিকেলে আবার নাস্তা এবং রাতে খাওয়া আর সেসবের মাঝখানে দিনাদুনির কর্মযোগ সেসব তো রয়েছেই—আহার, নিদ্রা, স্নান, পোশাক-পরিচ্ছদ, লেখাপড়া, বাইরে বেরোনো, নিরাপদে কালযাপন সব কিন্তু এই নতুন অর্থাৎ দ্বিতীয় মায়েরই বদৌলতে। পরে অবশ্য এর জন্যে বাবা’র ওপর খানিকটা অভিমান-রাগও হয় আমার। হ্যাঁ, একদিক থেকে দেখলে নববিবাহের পরপরই আমাদের তিন-তিনটে অপোগেণ্ডের দেখভাল, লালনপালন সেসব তাঁর জন্যে যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল। মানে আমার বাবা’র দ্বিতীয় বিয়ে হলেও আম্মার সেটা প্রথম এবং বিয়ের পরে মেয়েদের যে-স্বপ্ন থাকে নতুন সংসার বিন্যাসের আশা-প্রত্যাশা থাকে এক্ষেত্রে সেই সমস্ত স্বপ্নই প্রথম ধাক্কায় ভেঙে চুরমার। একটি পুরনো সংসারকে সম্পূর্ণরূপে পরিচালনার কঠিন দায় বর্তালো তাঁর ওপর। বাবা সরকারি চাকুরে, সকালে বেরিয়ে যান, ফেরেন শেষ অপরাহ্নে। স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, আমাদের আম্মা যথেষ্ট ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা নিয়েই আমাদের সামলে যেতে থাকেন।

১৯৬৭ সালে আমার বড় ভাইকে বাবা দোহাজারি জামিজুরি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন প্রথম শ্রেণিতে। ১৯৬৮ সালে তিনি বার্ষিক পরীক্ষায় পাশ করে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেন। এবার আমার পালা, আমাকে ভর্তি করানো হবে প্রথম শ্রেণিতে। কিন্তু আমি খুব গোঁ ধরে বসি, বড় ভাই যে-বইপত্র পড়ছে আমারও সে-বইপত্র লাগবে অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান না আমি টু’তেই ভর্তি হবো। বাবা এবং আম্মা উভয়েই বোঝাতে থাকেন, তুমি যেহেতু তোমার ভাইয়ের চেয়ে ১ বছর ৩ মাসের ছোট, তাই তোমাকে এক ক্লাস নিচেই থাকতে হবে। কিন্তু আমি নাছোড় হয়ে থাকি। বাবা আমাদের দু’জনকেই স্কুলে নিয়ে যান। হেডমাস্টার শুনে খানিকটা অবাক হলেন কেননা এমন সমস্যার সম্মুখীন তাঁর কর্মজীবনে ছিল সেটাই প্রথম। শেষে তিনি আমাকে প্রথম শ্রেণির কয়েকটি ছড়া মুখস্ত বলতে বললেন। মজার কথা, বড়ভাই যখন তাঁর বইপত্র পড়তেন তখন আমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বলা যায় তাঁকে গভীরভাবে অনুকরণ করে তাঁর সমস্ত লেখাপড়া স্মৃতিতে সংরক্ষণ করে ফেলি। হেডমাস্টারের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমি বলে যেতে থাকি—আ. ন. ম. বজলুর রশীদ, জসীম উদ্দীন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সকলের কবিতা-ছড়া। হেডমাস্টার বললেন, ম্যানেজার সাহেব, দু’জনকেই ক্লাস টু’তে দেন, সমস্যা নেই। মজা করে তিনি বাবাকে এ-ও বলেন (এসব অবশ্য পরে বাবা’র কাছ থেকেই আমরা বিস্তারিত জানতে পারি।): ভালোই হলো আপনাকে এক সেট বই কিনলেই হবে। একই বই দু’জনে পড়বে। খরচ কমলো আপনার! হেডমাস্টারের এ-কৌতুকপ্রদ মন্তব্য প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। কেননা, তাঁর সেই কৌতুকটি পরবর্তীকালে আমাদের দুই ভাইয়ের ছাত্রজীবনে কিছুটা ‘কমেডি অব এর ‘-এর সৃষ্টি করেছিল। এটি সত্য আমরা দুই ভাই ক্লাস নাইনে ওঠার আগ পর্যন্ত এক সেট বই দিয়েই কাজ চালিয়ে যাই। আবার, নাইনে উঠলে বড় ভাই বাণিজ্য বিভাগে এবং আমি বিজ্ঞানে পড়বার কারণে আমাদের অধিকাংশ বই পৃথকতাচিহ্নিত হয়ে পড়ে—কেবল বাকি থাকে বাংলা ও ইংরেজি। সারা বছর নির্বিঘ্নে কাটলেও পরীক্ষার সময় সৃষ্টি হয় অনিবার্য জটিলতা। ধরা যাক, পরবর্তী দিন বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা এবং আমি বাংলা সাহিত্যের গদ্য-পদ্য সংবলিত টেক্সট বই-ই পড়তে চাই। ঠিক ঐ সময়টাতে বড় ভাইও টেক্সটই পড়বে। এই দ্বান্দ্বিকতায় যা হওয়ার তাই হয়। সমাধান নিয়ে তখন এগিয়ে আসেন বাবা। বাংষা সাহিত্য টেক্সট বইটা হাতে নিয়ে ঠিক মাঝ বরাবর হ্যাঁচকা টানে একটা বইকে মুহূর্তে বানিয়ে ফেলেন দু’টো। এক ভাগে গদ্য এবং অন্য ভাগে পদ্য। তারপর মোটা সুঁই আর মোটা সুতো দিয়ে নিখুঁত সেলাই করে ছোট্ট দু’টো বই টেবিলে রেখে বলেন, দু’টোই প্রথম পত্র, একজন পদ্য পড়ো, একজন গদ্য। এভাবে পালা করে পড়লে আর সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সমস্যা অবশ্য আর হয়ওনি।

যাহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়াটা আর আমার ভাগ্যে জোটে না। শেষে ডুবন্তের খড়কুটো’র মত ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম কলেজে : বিষয়—বাংলা সাহিত্য। শুরু হলো বাবা’র সঙ্গে এক দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব। ইংরেজি কিংবা বিজ্ঞানের কোনো বিষয়কে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বাংলাকে ভবিতব্যের সম্বল করে নেওয়াটাকে বাবা কোনোভাবেই অনুমোদনের দৃষ্টিতে নিলেন না। আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের বলে বেড়াতে লাগলেন, আমার দ্বিতীয় ছেলেটির মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলা বিষয়ে লেখাপড়াটা তাঁর নিকটে এক ধরনের অবিমৃষ্যকারিতাই মনে হতে লাগলো। ভর্তি-পরীক্ষায় প্রথম হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে এলে মনে হলো যেন নিজের বাড়িতেই এসে ঢুকেছি। কেননা, মাত্র কিছুকাল আগেই আমি একই কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে উত্তীর্ণ হয়ে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম কলেজেই আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল মূল্যবান সম্পদ। ইন্টারমিডিয়েটে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে বেশ খানিকটা সময় কেটে যেতো ল্যাবরেটরিতে। লাইব্রেরিতে কাটানোর মত সময় বের করা ছিল মুশকিল। এখন যখন সাহিত্যে লেখাপড়ার শুরু কাজেই লাইব্রেরিতে এসে ভালো ভালো বইয়ের সন্ধানে সময় কাটানোটা অধ্যয়নেরই অপরিহার্য অংশ হয়ে গেল। আমাদের একটা পেপার ছিল ‘বিশ্বসাহিত্য’। পাঠ্য ছিল গ্রিস, ইংল্যান্ড, ইরান, ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশের সাহিত্যকর্ম। বলা যায় পাঠ্য শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর সহায়ক গ্রন্থ খুঁজতে গিয়েই আমি আমার পুরনো ইংরেজিসাহিত্যপাঠ-প্রেমকে পুনরায় আবিষ্কার করলাম। মনে পড়ে, সহপাঠীরা সবাই তখন মোবাশ্বের আলী’র ‘বিশ্বসাহিত্য’ বইটি মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করছিল সর্বরোগহর ঔষধ হিসেবে। এমনিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে বইটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য কিন্তু আমার মনে হতে থাকে, ফার্স্ট ক্লাস নম্বরের জন্যে শেক্সপিয়রকে ইংরেজি রেফারেন্স বইয়ের মাধ্যমেই জানতে হবে। কলেজ লাইব্রেরিতে পাওয়া গেল উইলিয়ম হ্যাজলিট, ব্র্যাডলি এবং আরও অনেকের বই। একটা অসাধারণ বই খুঁজে পেয়েছিলাম। শেক্সপিয়রের সাহিত্য সম্পর্কে দুনিয়ার সেরা ১০০টি প্রবন্ধের সংগ্রহ একখানা গ্রন্থ। দেশবিদেশের বিভিন্ন সমালোচকের লেখার সঙ্গে দেখি বাঙালি সুবোধ চন্দ্র সেনগুপ্ত’র লেখা। মজার ব্যাপার তিনি একদা চট্টগ্রাম কলেজেরই শিক্ষক ছিলেন—ইংরেজি বিভাগের। রমা রঁল্যা’র ‘জঁ ক্রিস্তফ’ পেলাম বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, তাই বাংলা পঠনপাঠনে ছিলাম বাধ্য কিন্তু ইংরেজি সাহিত্য পাঠের নেশা আমাকে আরও আঁকড়ে ধরে। ফলে, আমার দিন কেটে যায় দুই ভাষার সাহিত্য পাঠ-পরিক্রমায়। আর চট্টগ্রাম কলেজ লাইব্রেরিটাও ছিল এমন সমৃদ্ধ যে একবার লাইব্রেরিকক্ষে প্রবেশ করলে ভুলে যেতাম নাওয়া-খাওয়া সব। হঠাৎ ক্ষুধার উদ্রেক হলেও লাগোয়া তালেবের ক্যান্টিন থেকে সিঙ্গারা কি সমুচা খেয়ে ফের দৌড়ে এসে ঢুকতাম লাইব্রেরিতে। কে জানতো সেদিনকার সেই ইংরেজি সাহিত্যের সমান্তরাল পাঠ-প্রক্রিয়া আমার মধ্যে কোথাও খুলে দেবে নতুন জানালা। কয়েক বছর আগে যখন ব্রিটিশ কাউন্সিলে ইংরেজি উপন্যাস পড়ি তখন মনে হতো ভাষাটাকে আরও আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে। এবারে মনে হতে থাকে যে হ্যাঁ, ইংরেজি ভাষাটা আসলে কঠিন নয় বরং সহজই। সঠিকভাবে ব্যাকরণটা রপ্ত করতে পারলে আর যাকে বলে ‘ভোকাবুল্যারি’ বা শব্দের সংগ্রহ সেইটিকে সমৃদ্ধ করতে পারলে ইংরেজি’র জগত এক অসাধারণ জগত। একজন মানুষের পক্ষে পৃথিবীর সব ভাষা একজীবনে শিখে ওঠা অসম্ভব কিন্তু চাইলে সে পৃথিবীর সর ভাষার সাহিত্যগ্রন্থ পাঠ করতে পারে একটিমাত্র অবলম্বন ইংরেজির মাধ্যমে।

শেক্সপিয়রের সমালোচনা-গ্রন্থ পড়তে পড়তে খুঁজে পেলাম উইলিয়ম ব্লেইকের কাব্যগ্রন্থ : ‘সংস্ অব্ ইনোসেন্স’ এবং ‘সংস্ অব্ এক্সপিরিয়েন্স’। বইদু’টো এত ভালো লাগলো যে আমি উইলিয়ম ব্লেইকের ওপর ছোটখাট একটা প্রবন্ধই লিখে ফেললাম। সেখানে সংযোজন করে দিলাম ব্লেইকের ‘দ্য সিক্ রোজ’ এবং ‘দ্য টাইগার’ কবিতাদু’টোর মৎকৃত অনুবাদও। মনের মধ্যে দোল খেতে থাকে কবির কবিতার ছন্দদোলা—টাইগার, টাইগার, বার্নিং ব্রাইট,/ ইন দি ফরেস্টস্ অব দ্য নাইট। ব্লেইক অনেককাল আগেকার কবি। ‘টাইগার’-এ ‘আই’-এর পরিবর্তে দেখতে পেলাম ‘ওয়াই’। ভেবেছিলাম মুদ্রণপ্রমাদ, পরে জানলাম, না, তখন অনেক ক্ষেত্রেই ‘ওয়াই’ ব্যবহৃত হতো যা পরে ‘আই’-এ রূপান্তরিত হয়। অল্প বয়সে যা হয়, লিখেই মনে হলো দারুণ একটা কাজ করে ফেললাম। সেই প্রবন্ধ নিয়ে ছুট দিলাম দৈনিক আজাদী’র সাহিত্য-সম্পাদক শ্রদ্ধেয় অরুণ দাশগুপ্ত’র নিকটে। ততদিনে আমার প্রচুর লেখা ‘দৈনিক আজাদী’তে ছাপা হয়ে গেছে। দেখে এবং পড়ে অরুণ দা বললেন আগামি সপ্তাহেই ছেপে দেবো (কলকাতার টানে দাদা বলতেন ‘দোবো’।) ব্লেইকের ওপর লেখা প্রবন্ধটা প্রকাশিত হলো। এখন মনে হয় সেটা আসলেই ছিল বয়োধর্মের প্রকাশ। তথাপি, এটিও সত্য, লেখাটার জন্যে আমার ধৃষ্ঠতা যতটা না দায়ী ছিল প্রায় ততটাই দায়ী ছিল আমার ব্লেইক-মুগ্ধতা।

চট্টগ্রাম কলেজ লাইব্রেরিতে পেলাম আরেকটি অসাধারণ গ্রন্থ—ডেভিড থরু’র ‘ওয়াল্ডেন অর লাইফ ইন দ্য উড্স্’। সেই আমার প্রথম থরু-পাঠ। এদিকে প্রায় একই সময়ে দিনকয়েকের ব্যবধানে পড়ার সৌভাগ্য হলো কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। প্রথম যখন থরু পড়ি তখন বেশ কঠিনই মনে হয়। এমনিতেই পুরনো দিনের ইংরেজি রচনা কঠিন বৈ সহজ নয়। ধরা যাক চার্লস্ ডিকেন্সের ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স’, ‘টেইল অব টু সিটিজ’ কিংবা ‘পিকউইক পেপার্স’ বেশ দ্রুতই পড়ে যাওয়া চলে কিন্তু একসময় তাঁরই অসাধারণ ছোটগল্প ‘দ্য বেগিং-লেটার রাইটার’, ‘আ চাইল্ডস্ ড্রিম্ অব আ স্টার’ কিংবা ‘ডক্টর ম্যারিগোল্ড্’ তত সহজ মনে হতো না। ‘আ চাইল্ডস্ ড্রিম্ অব্ আ স্টার’ পড়ে চাপা কেঁদেছিলাম। মাত্র সাড়ে তিন পৃষ্ঠার একখানা গল্পে জীবনের এত মায়া এত ভালোবাসা এত আনন্দ-বেদনার সঞ্চার ঘটানো যায় সেটা ডিকেন্সের সেই গল্প পড়ে অনুভব করেছিলাম। এরকমই অসাধারণ অভিজ্ঞতা হতে পারে ক্ষীণকায় কিন্তু জীবনগভীর গল্প পড়ে—যেমন, কমলকুমার মজুমদারের ‘লাল জুতো’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র ‘নয়নচারা’, ইটালো ক্যালভিনো’র ‘দ্য ব্ল্যাক শিপ’, আন্তন চেখভ-এর ‘ডেথ অব আ ক্লার্ক’ কিংবা ফিওদর দস্তয়ভস্কি’র ছোটগল্প ‘আ ক্রিসমাস ট্রি এ্যান্ড আ ওয়েডিং’। কোথায় যেন ডিকেন্সের গল্পের ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে দস্তয়ভস্কির গল্পের সেই ছোট্ট মেয়েটির মিল খুঁজে পাই। ডিকেন্সের গল্পের মেয়েটি তো অকালেই মৃত্যুবরণ করে আর দস্তয়ভস্কির সেই পরীর মত মেয়েটি গিয়ে পড়ে ক্ষমতাদর্পী এক দানবের খপ্পরে।

ফের ডেভিড থরু’তে (১৮১৭-১৮৬২) যাই। সেই সময়টাতেই আমাদের পড়তে হয় মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ-এর উপন্যাসগুলোও। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দারুণ সব উপন্যাস। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হতে থাকে, বিভূতিভূষণ অবশ্যই ডেভিড থরু পড়েছিলেন, এবং বেশ ভালভাবেই পড়েছিলেন। উভয়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা সান্দ্র সম্পর্ক ঝিলিক দেয় আমার চোখে। থরু পড়লে মনে হয় মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতিধ্বনি এবং প্রকৃতির মধ্যেও মানুষের প্রতিধ্বনি উভয়কে নিমগ্ন সত্তায় অনুভব করতে পারা যায় সাহিত্য দিয়ে। থরু’র নিকটে প্রকৃতি ছিল ধর্মের মতন। একবার ভাবুন ১৮৪৫ সারের দিকে ওয়াল্ডেন নামক একটা পুকুরের ধারে অরণ্যঘেরা পরিবেশে একটা কুটির বানিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন ডেভিড এবং সেখানে থেকে পর্যবেক্ষণ করলেন নিসর্গ, কাজ করলেন ক্ষেত-খামারের, নিজের হাতে বানালেন ঘরের চারদিকে সীমানাদেয়াল প্রকৃতিলব্ধ উপাদান দিয়ে। আর জীবনের সেসব অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে রাখতে লাগলেন তাঁর রোজনামচায়।

কত নবতর বিষয় নিয়ে যে লিখেছেন তিনি। বইপড়া, পাঠ, শব্দ, নির্জনতা, গ্রাম, পুকুর, খামার, প্রতিবেশি, শীত-বসন্ত এইসব। লিখেছিলেন তিনি, লিখিত হয়ে যাওয়া শব্দের এমনই ক্ষমতা যে তা নেপথ্যে থেকে, আড়ালে থেকে, নীরবে থেকে অত্যন্ত শক্তিমত্তা নিয়ে যুগিয়ে যায় অযুত অনুপ্রেরণা। একবার যখন মানুষ পাঠ-প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে তখন শব্দের সেই ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগ ঘটে তার স্নায়ুতন্ত্রের। তাঁর লেখা থেকে জানলাম, সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁর যুদ্ধাভিযানকালে একটা দামি বাক্সের মধ্যে সঙ্গে নিতেন হোমারের ‘ইলিয়াড’। তিনিই লিখেছেন, যাঁরা প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যকর্মগুলি পাঠ করে নি তাঁরা মানবজাতির উন্নতি-বিবর্তন এবং সভ্যতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হ’ন না। মজার কথা ঠিক তখনই আমরা ক্লাসে পড়ছিলাম আমাদের পাঠ্য হোমারের ‘ইলিয়াড’। আমার সহপাঠীদের অনেকেই আবুল কালাম শামসুদ্দিন অনূদিত গদ্য-‘ইলিয়াড’ সংগ্রহ করে নেয়। আমার মন ভরে না। আমি খুঁজতে থাকি এবং একপর্যায়ে লাইব্রেরি ঢুঁড়ে পেয়ে যাই আলেক্সান্ডার পোপ অনূদিত ‘ইলিয়াড’। আমি ভেবেছিলাম, আবুল কালাম শামসুদ্দিনের অনুবাদ গ্রিক ভাষা থেকে নয়, ইংরেজি থেকে আর পোপ-এরটা গ্রিক থেকে ইংরেজি। কাজেই পোপ অনেক বেশি মূলানুগ হবেন। ক্লাস টেন-এ পড়েছিলাম পোপ-এর ‘হ্যাপি দ্য ম্যান’ কবিতাটি। এবারে বাংলা সাহিত্য পড়তে এসে পড়া গেল তাঁর ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থ। সত্যি কথা বলতে কি পোপ-এর অনুবাদ অতি উচ্চাঙ্গের সাহিত্যকর্ম।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। কাজেই এর লাইব্রেরিটিও সে-অর্থে বহু পুরনো। বিশেষ করে দুর্লভ বইপত্রের সংগ্রহ কলেজ লাইব্রেরির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। যখন যে-বইয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছি তখনই সে-বই পেয়েছি সেখানে। মঙ্গলকাব্যের টেক্সট চণ্ডীমঙ্গল কাব্য মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কালকেতু উপাখ্যান’ পড়তে গিয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্যর ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’-এ একটা কথা পেলাম, মুকুন্দরামের সঙ্গে ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর তুলনামূলক আলোচনা চলতে পারে। কলেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে খুঁজে পেলাম চসার-এর ‘ক্যান্টারবারি টেইলস্’ এবং ‘দ্য নান্স প্রিস্টস্ টেইল্স্’। চসার নামটা ঢুকে করোটির আয়তনের মধ্যে রয়ে গেল। ১৯৯১ সালে যখন ইংল্যান্ডে গেলাম দেখি সেখানকার কেন্ট অঞ্চলে মামাবাড়ির রাস্তাটাই আমার মনের মধ্যে কলেজজীবনের স্মৃতি বয়ে আনছে। বাড়ির ঠিকানা ১ নম্বর পিলগ্রিম্স্ ওয়ে। এ হলো সেই তীর্থযাত্রার স্মৃতি যেটি চসার-এর ক্যান্টারবারি টেইল্স্-এর সূত্রে পাওয়া গিয়েছিল অনেকটা কাল আগে। এবং অল্প দূরেই বিরাট ক্যান্টারবারি চার্চও।

চট্টগ্রাম কলেজ লাইব্রেরিতে পড়া আরেকখানা বইয়ের কথা বলতে হয়—জি এম ট্রেভেলিয়্যান-এর ‘আ শর্টেন্ড হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’। এ বইটা পড়লে গোটা ইংল্যান্ডটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ নাটক পড়তে গিয়ে রাণি এলিজাবেথের প্রসঙ্গ আর রাণির প্রসঙ্গ থেকে তাঁর বাবা অষ্টম হেনরি, সেখান থেকে হেনরি’র দ্বিতীয় বিয়ে, বিয়ে’র প্রসঙ্গে টমাস মুর এবং তাঁর হত্যাকাণ্ড এবং সেইসঙ্গে এলিজাবেথের খ্রিস্টধর্ম’র মূলধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ভ্যাটিক্যানের সঙ্গে বিবাদ, সেই বিবাদ থেকে প্রোটেস্ট্যান্টানিজম্-এর সৃষ্টি—সব যেন সূত্রবদ্ধ একটা মালার মত সামনে এসে পড়ে। ট্রেভেলিয়্যান-এর বইয়ে রোমান, এ্যাংলো-স্যাক্সন, নর্ম্যান থেকে শুরু করে টিউডরদের কাহিনি, সামুদ্রিক শক্তি হিসেবে ইংল্যান্ডের অভ্যুদয়, রেস্টোরেশন যুগ, হ্যানোভারিয় আমল এমনভাবে লেখা যেন ইতিহাস নয় পড়ছি উপন্যাস। ইংল্যান্ডের ইতিহাস গ্রন্থটা আমার কাছে ততটাই আকর্ষণীয় মনে হয় যতটা আকর্ষণীয় ছিল জোনাথান সুইফ্ট্-এর উপন্যাস গালিভর এবং তার সফরনামাসমূহ।

ট্রেভেলিয়্যান-এর বই সবটা প্রথম পাঠে বুঝেছিলাম সেটা বলা অতিরিক্ত হয় কিন্তু ১৯৯১ সালে যখন আমি ইংল্যান্ডে গেলাম তখন যেন আমার পড়া সেই ইতিহাসটার মধ্যেই আমি ঢুকে পড়েছিলাম। উঁচু উঁচু সব দুর্গ, গির্জা, নদী, সেতু, সুড়ঙ্গ, জাদুঘরে রাখা প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী, যুদ্ধাস্ত্র, পেইন্টিং, মুদ্রা, প্রাচীন পোশাক-আশাক—ঠিক যেন পূর্বে পড়া ইতিহাসটার বাস্তব উপকরণগুলোই আমাকে একের পর এক মিলিয়ে নিতে হচ্ছিল। লাইব্রেরি যে ছাত্রজীবনেই মানুষের ভবিষ্যৎ ভিত্তি’র প্রয়োজনীয় পুঁজি’র যোগান দিতে পারে তার প্রমাণ আমি পেয়েছি আমার জীবনে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ লাইব্রেরির সূত্রে।

১৯৯১ সালে কমনওয়েল্থ্ স্কলারশিপ নিয়ে আমার স্ত্রীর ইংল্যান্ডে গিয়ে লেখাপড়া’র সুযোগ ঘটে এবং সেই সূত্রে আমারও ইংল্যান্ড-বাসের সূচনা। বিশ্ববিখ্যাত একাডেমিক সিটি কেম্ব্রিজ-এর হার্শেল রোডস্থ ক্লেয়ার হল-এ ঠাঁই হলো আমাদের। কেম্ব্রিজ শহরে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই আমাদের ঐতিহাসিক পরিবৃত্তে পা। যে-বাড়িতে আমরা থাকতাম সেটির নাম ছিল ‘কেইন্সাইড হাউজ’। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ জন ম্যায়নার্ড কেইন্স-এর বাড়ি ছিল এটি। তাঁদের পরিবার সেটি কলেজকে দান করে দেয়। জন কেইন্স-এর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য জেনারেল থিওরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট এ্যান্ড মানি’ বেরিয়েছিল ১৯৩৬ সালে। আমি এবং আমার স্ত্রী বাড়ির যে-কক্ষে (৪ নম্বর কক্ষ) উঠি সেটিই ছিল কেইন্স-এর বসতবাড়ির মূল কক্ষ। বর্তমানে সেই বাড়িটার লাগোয়া সীমানা-দেওয়ালের অন্য পারে আরেকটি বাড়িতে বসবাস করেন  কেইন্স-এর পরিবারের অপর সদস্যরা। কেইন্স সাহেবের ভাইপোকে দেখতাম তাঁদের বাড়ির এবং আমাদের কেইন্সাইড হাউজের পেছন দিকটাতে মাঠসংলগ্ন সরু রাস্তা ধরে নিয়মিত হাঁটছেন। দুয়েকবার কথাও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। কেইন্স মারা যান ১৯৪৬-এ। তাঁর ভাইপোটির মাথাভর্তি সব চুল সাদা, একটিও কালো চুল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। কেইন্স ছিলেন কিংস কলেজের ছাত্র। কিংস, সেইন্ট জন্স এবং নিউটনের ট্রিনিটি কলেজগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা পাশাপাশি সারিবদ্ধ। কেম্ব্রিজ কলেজ লাইব্রেরিকে তুলনা করা চলে একমাত্র মহাসাগরের সঙ্গে। চট্টগ্রাম কলেজের লাইব্রেরিটিকে যদি বলি নদী তাহলে আমি নদী ও সাগর পেরিয়ে এসে পড়েছিলাম মহাসাগরেই।

বহুকাল পরে এসে এখন ভাবছি কেম্ব্রিজ লাইব্রেরিতে কোন্ বইটি ছিল না যা আমার হাতের নাগালে আসে নি। একবার কৌতূহলের বশে দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহকক্ষে গিয়ে নির্ধারিত ফরমে একটা বইয়ের জন্যে আবেদন করলাম—ডাচ নাবিক উইলিয়ম গ্লেনিয়াসের লেখা ১৬৮২ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘এ রিলেশন অব এ্যান্ আনফরচুনেট ভয়েজ টু দি কিংডম অব বেঙ্গালা’। গ্লেনিয়াসের জাহাজডুবি হয় বঙ্গোপসাগরে। দুর্ভাগ্যগশত তাঁদেরকে বেঁচে থাকবার জন্যে নরমাংস পর্যন্ত খেতে হয়েছিল। পরে নিজেরা নিজেদের ভেলা বানিয়ে কোনোক্রমে রক্ষা পায় তারা মৃত্যুর হাত থেকে। এরাই একপর্যায়ে বাধ্য হয়েছিল আসামের বিরুদ্ধে মুঘলদের যুদ্ধে মুঘলবাহিনিকে সহায়তা করবার জন্যে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গেজেবের সময়ে (১৬৫৮-১৭০৭) ১৬৬২-৬৩ সালের দিকে মীর জুমলার নেতৃত্বে আসামের রাজা সুয়া-তাম-লা-এর বিরুদ্ধে যে-যুদ্ধ হয় তাতে ডাচ নাবিক ফ্রাঞ্জ জান্স ভ্যান্ ডার হাইডেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গ্লেনিয়াস ছিলেন তাঁরই বন্ধু। গ্লেনিয়াসের লেখা আরেকখানা বই পেয়ে যাই এটির সূত্রে—‘আ নিউ ভয়েজ টু দি ইস্ট ইন্ডিজ’। থাইল্যান্ড, জাপান, মাদাগাস্কার এবং বাংলা সম্পর্কে তাঁর সমুদ্রযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন গ্লেনিয়াস। মজার বিষয়, গ্লেনিয়াসের লেখায় বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা দ্বীপ হাতিয়া এবং সন্দ্বীপের বিবরণও রয়েছে গ্রন্থটিতে। বস্তুত মূল বইটি লেখা হয়েছিল ফরাসি বা ডাচ ভাষায় যেটি পরে অনূদিত হয় ইংরেজিতে। ভারতীয় বইয়ের সংগ্রহে পেলাম নীরদ সি চৌধুরীর লেখা লর্ড ক্লাইভের জীবনী। ইংরেজি এবং ল্যাটিন ভাষায় দক্ষ নীরদ চৌধুরীর রচনা কতটা উচ্চাঙ্গের হতে পারে সেটা বোঝা যায় তাঁর রচিত জীবনীগ্রন্থটি পাঠ করলে।

দেশের নাম ইংল্যান্ড ভাষার নাম ইংরেজি আর লাইব্রেরির নাম কেম্ব্রিজ—সেখানে যে ইংরেজি সাহিত্যের বইয়ের প্রাচুর্য থাকবে সে তো বলাই বাহুল্য। দেশে যেসব বই পড়বার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পাই নি, বিগত, সাম্প্রতিক ও সমকালের গদ্য কেমন কবিতা কেমন কিংবা লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট কাগজগুলোতে কী ধরনের লেখা ছাপা হয় এবারে সেসব পাঠ করবার দারুণ সুযোগ মিলে গেল। দেশে অবশ্য টাইমস্ লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট বা টিএলএস পড়া যেতো ব্রিটিশ কাউন্সিলেই। কেম্ব্রিজ লাইব্রেরিতে ইংরেজি কাব্যের সংগ্রহ সত্যিকার অর্থে ঈর্ষণীয়। শুরু হলো আবার নতুনভাবে নিয়মেএবং রুটিন করে আমার ইংরেজি কাব্য-পাঠ। এদিকে নিজের পিএইচডি থিসিস রচনার কাজও চালাতে হচ্ছিল সমান্তরালে। এমনকি পিএইচডি’র কাজটা কখনও কখনও ক্লান্তিকর মনে হতে থাকে। মনে পড়ে আমার গবেষণা নির্দেশক সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বিদেশ-যাত্রার প্রাক্কালে আমাকে বলেছিলেন, যারা সৃজনশীল চিন্তা ও কাজে অভ্যস্ত তাদের জন্যে পিএইচডি গবেষণার কাজটা বেশ ধকলের। স্যার আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলন, যখনই মনে হবে বিরক্তি হামলা করছে তখন বেড়াতে হবে। সুন্দর সুন্দর জায়গায় ভ্রমণ করতে হবে। সত্যিই আমরা অনেকগুলো জায়গা ঘুরেছি। শেক্সপিয়রের জন্মস্থান স্টার্টফোর্ড আপ-অন আভন, ওয়ারউইক ক্যাসল্, টেড গ্যালারি, ন্যাশনাল গ্যালারি, ওয়ার সিমেট্রি, অক্সফোর্ড, মাদাম তুসো’র মোমের মিউজিয়ম এরকম বহু জায়গায় বেড়ানো হয়েছিল সেই সময়টায়। তবে যেখানেই যাই না কেন সবখানেই মুদ্রার প্রয়োজন। টাওয়ার হ্যামলেটস্-এ বিশ্ববিখ্যাত কোহিনুর-মুক্তা দেখতে যাওয়ার স্মৃতি ভোলা যায় না। সারা পৃথিবী কেন এই কোহিনুরের জন্যে পাগল সেটা সামনে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। কেবল জাদুঘর, সুন্দর সুন্দর জায়গাই নয় ধরা যাক একেকটা জায়গায় গিয়ে বাস-ট্রেন থেকে নেমে এমনি হাঁটতে থাকাটাও অনিন্দ্য-সুন্দর অভিজ্ঞতাময়।

ইংরেজি সাহিত্য পাঠ এবং ইংরেজি ভাষার মহাসমুদ্রে অবস্থান এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অনুভূতির সঞ্চার ঘটায়। যে-বইপত্র দেশে থাকাকালে পড়েছি পূর্বে এবং যে-সাহিত্য পাঠ করছি খোদ ইংল্যান্ডে বসে সে-ভাষা এবং চারপাশে লোকেদের জীবনজঙ্গম ভাষার মধ্যে লক্ষ করি নানা মিল এবং অমিল। ধরা যাক ঘর থেকে বেরোলে সর্বক্ষণের সঙ্গী ইংরেজি-ই। সিটি সেন্টারে বাজার করছি—দোকানিদের সঙ্গে কথাবার্তা চলে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা একটু পরিচিত গোছের তাঁরাই হয়তো আগ বাড়িয়ে বাড়তি খোঁজখবর নেয়। কথা হয় পুরনো বইবিক্রেতা মাইকেলের সঙ্গে। মুচকি হেসে বলে, তোমার সিঙ্গার-এর বই আরও কয়েকখানা এসেছে। ও জানতো, সিঙ্গারের লেখার আমি একজন ভক্ত। গরম তেলে ডোনাট ভাজতে ভাজতে কথা বলে জেসিকা। মাঝে-মাঝে টি-টাইমে ওর থেকে ডোনাট এবং কফি নিয়ে খানিকটা সময় গল্প করতাম পাশে দাঁড়িয়ে। একজন ভিক্ষুকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল—বেচারা হয়তো নাচার হয়েই নেমেছিল ভিক্ষাবৃত্তিতে। দাঁড়িয়ে থাকতো সেনেট হাউজ আর মিডল্যান্ড ব্যাংকের মাঝখানকার রাস্তাটায়। দেখা হলেই করুণ দৃষ্টিতে বলতো, ক্যান্ আই ক্যাভ্ সাম চেঞ্জ প্লিজ! দশ-কুড়ি-পঁচিশ সেন্ট করে মাঝে-মাঝে ওকে দান করতাম আমি। আরও একজন ছিল, বেহালা বাজাতো সিটি সেন্টারের মাঝখানটায় বসে। রীতিমত সঙগীতজ্ঞ ভিক্ষুক। নোটেশন বিছানো থাকতো ওর সামনে। ব্রাম, সোস্তাকোভিচ, শোপ্যাঁ, সিবেলিয়াস এরকম সব ওস্তাদ শিল্পীর সুর তুলতো বেহালায়। আমার মনে হতে থাকে, ইংরেজি ভাষাটা আসলে মোটেও কঠিন নয়। বরং, পৃথিবীর অনেক ভাষার তুলনায় সহজই। একটা তুলনা করতে পারি। দেশে থাকাকালেই আমি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে ফরাসি ভাষা শিখেছিলাম—ফরাসি মহিলা মাদাম মঘ্ভ্যাঁ ফরাসি শিখিয়েছিলেন আমাদের। ইংরেজি ভাষাটাকে মনে হয় খুব আনুষ্ঠানিকতাযুক্ত আর অবশ্যই পরিমিতিসম্পন্ন। ফরাসি ভাষাও তাই, তবে ফরাসি ভাষার মধ্যে একটা সাংগীতিক ব্যঞ্জনা অনুভব করা যায়। কেম্ব্রিজ লাইব্রেরিতে বিদেশি ভাষার বইপত্রের সংগ্রহে ফরাসি কবিতাপত্র ‘লা পোয়েজি’ পেয়েছিলাম। ফরাসি ভাষায় খুব দক্ষতা না থাকলেও মূল ভাষায় বোদল্যার, ভের্লেন, মালার্মে এঁদের কবিতা পড়বার চেষ্টা করতাম। বোদল্যার পাঠে মনে হয়েছিল, ফেরদৌসি যেমন তাঁর ‘শাহনমেহ্’-কে ফারসি ভাষার একটা মিনিয়েচার-জাদুঘরে পরিণত করতে চেয়েছিলেন তেমনি বোদল্যার-ও তাঁর কবিতায় ফরাসি ভাষার যাবতীয় সুষমা ও সৌন্দর্যকে একটা জায়গায় সংরক্ষিত করে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। শব্দে-শব্দে মিল, অভ্যন্তরীন অলংকার, ভাবনা, দৃশ্য-চিত্রকল্প, ভাবসম্পদ সবই এত নিজস্বতামণ্ডিত আর ঐশ্বর্যময় যে বিশ্বের যে-কোনো ভাষায় অনুবাদ হোক না কেন পাঠককে মুগ্ধ করবে।

কেম্ব্রিজের নির্জনতায় জ্ঞান-সৃজন আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমার ইংরেজি সাহিত্যের পাঠমুগ্ধতার অনুভূতি ছিল আমার জন্যে অনন্যসাধারণ।

১৯৯১ থেকে ১৯৯৭—মাঝখানে আট মাস বাদ দিয়ে এই পুরোটা সময় কাজে লাগিয়ে কেবলই সাহিত্যের সরোবরে স্নান, এখন ভাবি এমন চমৎকার জীবন-অধ্যায় মানুষের জীবনে কমই আসে। চারশ’ বছর আগেকার শেক্সপিয়রের সনেট পড়ি—হোয়েন্ মাই লাভ সয়্যারস্ দ্যাট শি ইজ মেইড্ অব ট্রুথ,/ আই ডু বিলিভ হার, দো আই নো শি লাইজ। ট্রি-ব্রেকের সময় জানলা দিয়ে দেখি ক্লেয়ার কলেজের লাগোয়া সবুজ চাতালটার মধ্যে বেঞ্চিতে বসা তরুণ-তরুণি পরস্পর পরস্পরকে কাছে টেনে নিচ্ছে, কিন্তু সবই শোভন ও সুন্দর। শেক্সপিয়রের পংক্তিগুলো যেন তাদের সেই নৈকট্য-পর্বের বেনেডিক্শন্। প্রেমের মধ্যে সুপ্ত-গোপন কত কীই তো থাকা সম্ভব কিন্তু বর্তমানের সেই দৃশ্যটি কোনোভাবেই অবিশ্বাস আর প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি বয়ে আনে না। সবটাই শুধু ভাললাগার আর ভালোবাসার। চিত্রকর-কবি উইলিয়ম ব্লেইকের কবিতা পড়ি—ও রোজ দো আর্ট সিক্,/ দ্য ইনভিজিবল্ ওয়ার্ম/দ্যাট ফ্লাইজ ইন দ্য নাইট/ ইন দি হাউলিং স্টোর্ম। সিটি সেন্টারের কাছেই পিটার হাউজ যেখানকার ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত এলিজি রচয়িতা কবি টমাস গ্রে। একবার আগুন লেগেছিল পিটার হাউজে। ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন টমাস। ভাগ্যিস বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি, নইলে এমন চমৎকার এলিজি কোথায় পাওয়া যেতো! আবার পড়ি টি. এস. এলিয়ট—এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ, ব্রিডিং/ লাইলাক্স আউট অফ দ্য ডেড্ ল্যান্ড, মিক্সিং/ মেমোরি এ্যান্ড ডিজায়ার, স্টারিং/ ডাল্ রুটস্ উইথ স্প্রিং রেইন। হাত বাড়ালেই বই, হাত বাড়ালেই বই, বই আর বই। যা পাই পড়ি, তাতে ধারাবাহিকতা বা ক্রোনোলজি ঠিক থাকে না। পড়তে গেলে বোঝা যায়, টমাস গ্রে’র ভাষা এলিয়টের ভাষার চাইতে বেশ আগেকার কিংবা শিমাস হিনি ইয়েটস্-এর উত্তরসূরী। আমাদের হল থেকে মিনিট বিশেকের হাঁটা পথ পেরোলে গ্রান্টা বলে একটা শান্ত-স্নিগ্ধ জায়গা পাওয়া যেতো—একটানা সবুজ প্রান্তর অনেকটা এলাকা জুড়ে। গাছপালার ফাঁক-ফোঁকর গলে চোখে পড়ে ঘরবাড়ি কি পাব-রেস্টুরেন্ট। ওখানেই দেখতে পাই একটা পাব কবি রুপার্ট ব্রুকের নামে। একটু দূরেই হেলে পড়া দিগন্ত যেন সবুজ প্রান্তরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আর ছোট্ট একটি নদী ইংরেজিতে হয়তো ‘রিল’ বা ‘ট্রাইবুট্যারি’ বলা যায় ঝিরঝিরে জলের প্রবাহ নিয়ে কোত্থেকে কই চলে যায় কে জানে। জর্জিয় কবিদের কবিতায় ইংল্যান্ডের গ্রামীণ জীবনের যে চমৎকার ছবিগুলো দেখা যায় ব্রুকও তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সম্মানে যে-পাবটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেখানে শোভা পাচ্ছিল ফ্রেমে বাঁধাই তাঁর ছবিটাও।  দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে সত্তর-দশকের হলিউড সিনেমার নায়ক হয়তোবা। তাই তো কবি ডব্ল্যু বি ইয়েটস্ তাঁকে ইংল্যান্ডের সবচাইতে সুশ্রী যুবক বলে অভিহিত করেছিলেন। তাঁর জন্ম ওয়ারউইকশায়ারে হলেও লেখাপড়া করেন কেম্ব্রিজ-এর কিংস কলেজে। কোথাও পড়েছিলাম ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উল্ফ্ ভিটা স্যাকভিল-ওয়েস্টকে বলেছিলেন, তাঁর কেম্ব্রিজবাসের সময় একবার জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে তাঁরা উভয়েই প্রায় নগ্ন হয়ে সাঁতার কেটেছিলেন একটা সুইমিং পুলে। ব্রুকের এক বন্ধু তাঁকে ‘সোনালি চুলের তরুণ এ্যাপোলো’ নাম দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ নেভি’র পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯১৫ সালে ভূমধ্যসাগরে অবস্থানকালীন রক্তদূষণের কবলে পড়ে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোকভরে লিখেছিলেন ডি এইচ লরেন্স। কেম্ব্রিজ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা গেল তাঁর কবিতার বই ‘দি ওল্ড ভিকারেজ, গ্র্যান্টচেস্টার’।

ইংল্যান্ডের লোকেদের ভাষা ইংরেজি হলেও গ্রেট বৃটেনের অন্য অঞ্চলগুলোর স্বাতন্ত্র্যও লক্ষণীয়। আমাদের হলেই থাকতো জেসিকা এবং শ্যন। দু’জনেই জন্মসূত্রে আইরিশ এবং অনেক সময় দেখতাম কিচেনে কিংবা বাগানে যখন তারা দু’জন নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। পরে লক্ষ করলাম তারা কথা বলে আইরিশ ভাষায়। আবার, নিক নামের একটি যুবক ছিল আমাদের হাউজমেট, স্কটিশ। একদিন খাবার টেবিলে আমাকে বলছে, ক্যানা হ্যাভ্ উই বি আ স্যল? উত্তরে আমি বলি, স্যরি, আই ক্যান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ সে। হাসতে হাসতে সে জানায়, তার নুন ফুরিয়ে গেছে, আমি কী তাকে একটু নুন দিতে পারি। হয়তো খাঁটি ইংরেজ উচ্চারণে কথাটা দাঁড়াতো—ক্যান্ আই হ্যাভ্ আ লিটল্ বিট অব সল্ট্—ঠিক সেরকমটাই প্রযোজ্য ওয়েলশিয়দের বেলায়ও। তবে একটা বিষয় অপ্রতিরোধ্যভাবে লক্ষণীয় ইংরেজদের ক্ষেত্রে। তাদের একটা গড় ভাষা রয়েছে যেটা মোটামুটিভাবে মূল বা প্রমিত বা আদর্শ (মডেলও যদি বলি) ভাষার কাছাকাছি। দৃষ্টান্ত দিয়েই বলতে পারি, বাজারের  ফুলওয়ালি মেয়েটা, কিংবা আমাদের হলের ইলেকট্রিসিয়ান লোকটা, অথবা আমাদের উইনডো ক্লিনার, এমনকি হলের মালিগুলো এরা সবাই যে-ভাষায় কথা বলে সেসবই উচ্চারণে শোনাতো প্রায় একই রকম। আমাদের দেশে অঞ্চলভিন্নতা তো রয়েছেই এমনকি পেশাগত ভিন্নতাও বাংলা ভাষার উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিচিত্র ফারাক তৈরি করে। এর একটা কারণ হতে পারে দেশটা শতভাগ শিক্ষিত মানুষের দেশ। একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে একসঙ্গে স্কুলে কলেজে কাটাতে হয়। ফলে যে যেরকম পরিবেশ থেকেই আসুক না কেন, সমষ্টিগত প্রক্রিয়ায় তাদের কথাবার্তা চলাফেরা ও মেলামেশার মধ্য দিয়ে তাদের ভাষাটাও নিজ-নিজ পরিমার্জনা ও পরিশীলনের পরিক্রমা অতিক্রম করে একটা মানদণ্ডে গিয়ে পৌঁছায়।

 

তবে হ্যাঁ, ইয়র্কশায়ারের লোকেদের একটা বিশেষ টান তারা খুব কমই বিসর্জন দিতে পারে। এটা আমি জিওফ্রে বয়কটের ক্রিকেট-কমেন্ট্রির মধ্যে লক্ষ করেছিলাম। বিভিন্ন শব্দপ্রয়োগে ‘ইউ’-কে ইউ বলা, যেমন, ‘মাচ’ এবং ‘বাট’ না বলে ‘মুচ’ ও ‘বুট’ বলা এবং এরকম আরও কিছু ভিন্নতর উচ্চারণ করা। আমাদের হলে থাকতো ইংলিশ সাইমন, স্কটিশ নিক, আইরিশ শ্যন ও জেসিকা এবং ওয়েলস্-এর মর্গান। সবাই যখন একসঙ্গে আড্ডায় বসতাম তখন সকলেরই মাধ্যম ইংরেজি হলেও বিশেষ করে নিক, জেসিকা, শ্যন এবং মর্গানের উচ্চারণ খানিকটা আলাদা মনে হতো। কিন্তু সাইমনের ইংরেজিকে আমার কাছে ইংল্যান্ডের মান ভাষার কাছাকাছি মনে হতো। হতে পারে আমি ইংল্যান্ডিয় উচ্চারণে অভ্যস্ত কিংবা হয়তো ইংলিশ সাইমন ছাড়া অন্য সকলেই যার-যার আঞ্চলিক টানটা বজায় রাখবার কারণেই তাদের উচ্চারণও স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ  হয়ে যেতো। তবে দুয়েকমাসের অভ্যস্ততায় প্রায় সকলেই আমার নিকটে হয়ে পড়ে সুবোধ্য।

আমরা যে-হলে থাকতাম সেখানকার ক্লিনিং লেডি ছিল একজন ফরাসি মহিলা। আমার খানিকটা ফরাসি জ্ঞানের সুবাদে মাঝে-মাঝে দেখা হলে সে আমাকে ফরাসি ভাষায় সম্বোধন করতো—আলো, মস্যুঁ, কমঁ তালেভু? বলতাম, সা ভা, এ ভু? এভাবেই পরস্পরের মধ্যে কথকতা চলতো। ওঁর নাম ছিল মাদাম জিলবেঘ্ (ইংরেজিতে গিলবার্ট)। ওর একটা পোষা বেড়াল ছিল, নাম স্পট। আমরা আদর করে ডাকতাম স্পটি বলে। সারা গা সাদা কিন্তু ডান পায়ের পেছনের দিকটাতে একটা কালো প্যারাবোলা’র কারণে তার অমন নাম দেওয়া হয়েছিল। ও আসলে জিলবেঘের নয় পরিণত হয়েছিল আমাদের হাউজ-ক্যাটে। যদিও একটি প্রচলিত ধারণা, বেড়াল যতটা স্বার্থপর হয় কুকুর হয় ততটাই প্রভুভক্ত কিন্তু কেইন্সাইড হাউজে আমরা যারা থাকতাম তাদের যে-কেউ ‘স্পটি’ ডাক দিতেই সে ফিরে চাইতো। টিভি দেখবার সময় কিংবা আড্ডা দেওয়ার সময় অনেকেই তাকে পাশে বসিয়ে রাখতো। আরাম বুঝে সে-ও চুপটি করে বসে থাকতো। যাহোক, জিলবেঘের সঙ্গে আমাদের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার কারণে প্রথমবার ক্রিসমাসের ছুটিতে সে যখন ফ্রান্স যায় ছুটি কাটাতে আমাকে সে অনুরোধ জানায় আমি যেন স্পটিকে রোজকার খাবারটা খেতে দিই। স্পটের সব খাবারই টিন্ড্—মাংস, লিভার, কলিজা, কন্ডেন্সড্ মিল্ক। কাপবোর্ড থেকে খুলে টিন-ওপেনার দিয়ে মুখটা কেটে স্পটকে দিলেই হলো। দু’দিন দেওয়া হলো। সেদিন আমরা খানিকটা রাত করে ঘুমোই ‘মেক-আ-ডিশ’ হাউজপার্টির পরিণামে। এমনিতে সকাল ৭টার মধ্যে ওঠার অভ্যেস কিন্তু সেদিন আটটা বেজে গেল। হঠাৎই কানে এলো দরজায় কেউ যেন শব্দ করছে। কিন্তু সেই শব্দকে ঠিক টোকা বা সেই জাতীয় কোনো নামে চিহ্নিত করা মুশকিল। একবার মনে হয় আলতো ঘষটানো আবার মনে হয় হাল্কা আঁচড়ানো ধরনের। ডোরভিউ দিয়ে তাকালাম কিন্তু কোনো কিছুই চোখে পড়ছিল না। এদিকে শব্দও থামছিল না। হুট করে দরজার পাল্লাটা মেলতেই দেখি নিচে দাঁড়ানো স্পট, সে-ই লেজ দিয়ে দরজায় শব্দ করছিল। তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই শব্দ সে করে। সঙ্গে-সঙ্গে নিজেকে আমার খুব অপরাধী মনে হতে থাকে। বেচারার খাবার সময় পেরিয়ে যায়, আমার বিলম্বিত গাত্রোত্থানের সংবাদ তার জানবার কথা নয়। দ্রুত নিচে নেমে ওর খাবার দিলাম। দেখি লেজ নাড়িয়ে আর তার টলটলে দুই চোখে আমার দিকে তাকায় সে। বুঝলাম প্রাণিটি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল আমাকে।

আমাদের প্রিয় স্পটি একদিন মরে গেল। কোনো আলামত দেখা যায় নি। একদিন ঘুম থেকে আর না ওঠায় ঘুমন্ত স্পটির গা স্পর্শ করে জিলবেঘ বুঝতে পারে, স্পট মৃত। ওকে সমাহিত করা হলো আমাদের হাউজসংলগ্ন একটা বেরিফলের ঝোঁপের পাশেই। জিলবেঘ কান্না করলো। আমাদেরও মন খারাপ, স্পট এবং জিলবেঘ উভয়ের জন্যে। সেদিন ক্লেয়ার হল থেকে সেক্রেটারি স্বয়ং এসে ক্লিনিং লেডি জিলবেঘকে সমবেদনা জানিয়ে যায়। একটা কাগজে তার মৃত্যুসংবাদটি সংক্ষিপ্তভাবে প্রচার করা হয়—স্পটি দ্য হাউজক্যাট অব কেইন্সাইড হাউজ পাস্ড্ এ্যাওয়ে টুডে এ্যাট সিক্স এ. এম.। যেদিন স্পট চলে যায় সেদিন আমাদের মনটাও খুব শোকাচ্ছন্ন থাকে। আমি এবং আমার স্ত্রী প্রায়শ স্পটের খবর নিতাম। দেখা হলেই বলতাম, হাই স্পটি, হাউ আর ইউ? কখনও কখনও ও ‘মিউঁ’ শব্দে ওর উপস্থিতি জানান দিত। আমার মনে পড়লো হুলিও কর্তাজারের সেই গল্পগ্রন্থের—উই লাভ গ্লেন্ডা সো মাচ। বেড়াল-চরিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প আছে কর্তাজারের। বইয়ের প্রথম গল্পটাই বেড়াল নিয়ে—ওরিয়েন্টেশন অব ক্যাট্স্। আর সেই বইটির অনুবাদকও বিখ্যাত গ্রেগরি রাবাসা, যিনি মার্কেজের ‘শতবর্ষের নির্জনতা’র অনুবাদের জন্যে খ্যাতিমান। বিকেলটা সত্যি মরা রোদের মধ্যে দেখাচ্ছিল অতিরিক্ত ম্লান আর আমাদের কামরার ওভালাকৃতির জানলা দিয়ে গলা বাড়ালেই স্পটির ছোট্ট সমাধিটা দেখতে পাওয়া যায়। ওর ছোট্ট প্রাণি-শরীরের শিয়রের দিকটাতে একটা ক্রুশ গেঁথে দেওয়া রয়েছে। আমি তখন ভাবছিলাম হয়তোবা স্পটির মৃত্যুর সূত্রে সাধারণভাবে মৃত্যু সম্পর্কেই। তাছাড়া দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে আত্মীয়-পরিজনদের ছেড়ে নিতান্ত জীবনের প্রয়োজনে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কষ্টটাও আহত করছিল ভেতরে-ভেতরে। কি জানি কেন আমার সেই বিষন্নতা ছাপিয়ে মনের ভেতরে কিছু একটা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিল। আমি বুঝতেও পারি সেই অনুভূতির চারিত্র। আসলে সৃজনের উদ্গম বেরোতে চাইছিল সম্ভাবনা নিয়ে। আমার স্ত্রী তখন কেম্ব্রিজ ক্যাভেন্ডিশ ল্যাব-এর হিলিয়ম এটম ডিফ্রেকশন্ প্রজেক্টের ওখানটায় কম্প্যুটার সিমুলেশনের হিসেব কষছিল অথবা হয়তো প্রাপ্ত ফলাফলের তাত্ত্বিক কোনো দিক নিয়ে ছিল ভাবনান্বিত।

আমার করোটির ভেতর থেকে ‘আজি এ প্রভাতে’র মত নয় বরং বলা যেতো ‘আজি এ গোধূলিতে’ কেননা তখন সূর্য ডুবে গিয়েছিল, দূরে রবিনসন কলেজের মাঠ ছাড়িয়ে আরও দূরে সবুজ প্রান্তর যেখানে দিগন্তের গায়ে মিশে গেছে সেখানে ডুবে যাওয়া সূর্যের লালিমা আরও খানিকটা সময়ের রক্তিম সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত ছিল। ডান দিকে কেইন্স সাহেবের মূল বাড়ির বাগানে সান্ধ্যোত্তর গল্প নিয়ে বসেছিল কেইন্সের উত্তরসূরীদের কেউ-কেউ। আমার ভেতর থেকে আসা পংক্তিগুলো আমি সাজিয়ে রাখি কাগজে-কলমে। যদিও মনের মধ্যে পোষা বেড়ালেটার মৃত্যুচিহ্নিত বেদনা কিন্তু যে-কবিতার লাইনগুলো বেরিয়ে আসে তাতে না ছিল বেড়াল না ছিল মৃত্যু বরং সে এক ভিন্ন দৃশ্যের প্রকল্প। লিখতে থাকি পর-পর:

দ্য ফায়ার অব টিউলিপ জাম্পড্ ইন্ দ্য সান

উই গেদার্ড এ্যালং এ্যারাউন্ড দ্য রচেস্টার চার্চ

উইথ দ্য ড্যান্সিং সিম্ফনি অব দ্য মরিস ড্যান্স,

দেয়ার ফ্লোজ দ্য রিভার মেড্ওয়ে

দ্য টেইল অব দ্য টু সিটিজ অন্ দ্য টু শোর্স্ 

এভাবেই একটা গোটা কবিতা তৈরি হয়ে যায়। কেন ঠিক এই দৃশ্য ও চিত্রগুলো আসে তার কারণ আমার পক্ষে নির্ণয় দুরূহ হয় না কিন্তু একটা ভাবনা উঁকি দেয়—স্পটির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ার জন্যেই কেন প্রকাশের এমন অপেক্ষমানতা! কিছুকাল আগেই আমরা ক্যান্টারবারিতে গিয়েছিলাম ঔপন্যাসিক চার্লস্ ডিকেন্সের জন্মস্থান এবং বিখ্যাত রচেস্টার দুর্গ দেখতে আর সেদিনটা ছিল মে মাসের ১ তারিখ। কলকারখানার শ্রমিকেরা নদীর কাছাকাছি এবং দুর্গ ও চার্চের নিকটের বিশাল প্রাঙ্গণে সম্মিলিত হয়েছিল মরিস ড্যান্সের আনন্দে। এছাড়াও নানারকম ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার আর রং-তামাশা নিয়ে তারা উদযাপন করছিল বিশ্ব শ্রম দিবস। কবিতায় যে-টিউলিপ লাফ দিয়ে রোদের মধ্যে পড়ে সেই টিউলিপ দেখেছিলাম ডিকেন্সের বাড়ির আঙ্গিনায়। দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকালে সেই দৃষ্টি বয়ে যাবে যে-নদীর আস্তরণ ছুঁয়ে সেইটিই হলো মেড্ওয়ে রিভার, ডিকেন্সের উপন্যাসের নদী। ‘আ টেল অব টু সিটিজ’ উপন্যাসের নদী—যেখানে লন্ডন আর প্যারিস উভয়ের পরিপ্রেক্ষিত বর্তমান। পরে এই কবিতাটির একটি বাংলা সংস্করণও আমি দাঁড় করাই যেটি আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সান্তিয়াগোর মাছ’-এ ‘রচেস্টার চার্লস্ ডিকেন্স সেন্টারে’ নামক কবিতা শিরোনামে স্থান পায়। সেই আমার প্রথম ইংরেজি কবিতা রচনা। যদিও ইংরেজি কবিতা লিখবো বলে কখনও কোনো প্রস্তুতি আমার ছিল না। এসব কবিতা রচিত হয় হয়তোবা ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি আমার মুগ্ধতার স্মারক রূপেই। কবিতা ভালো হলো কি খারাপ হলো সেকথা নিয়ে একটুও ভাবিত না হয়ে আমি লিখে যাই এবং আমার সেসব কবিতা সংরক্ষিত থাকে পাণ্ডুলিপিতে।

একটা বিষয় আমি নিঃসন্দেহ থাকি। ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, দ্বিতীয় ভাষা এবং তা-ও বহু সাধ্যসাধনায় তা অর্জিত। যতই আমি ইংরেজি পরিবেশে থাকি যতই আমি ইংরেজি পাঠ করি আমার শিরা-ধমনিতে তো বাংলারই প্রবাহ! আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয় জোসেফ কনরাড। তাঁর জন্ম ইউক্রেনে এবং তিনি হলেন পোলিশ-ইংলিশ ঔপন্যাসিক। তাঁকে ইংরেজি ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  কনরাড তাঁর কুড়ি বছর বয়সেও ইংরেজিতে ভালো ছিলেন না কিন্তু সেই তিনিই মাস্টার ইংলিশ রাইটার।

এরিমধ্যে বেড়াতে যাওয়া হয় অক্সফোর্ডে। কেইন্সাইডে আমাদের পাশের কামরার বাসিন্দা ফ্রাঞ্চিন ম্যাকেঞ্জির বয়ফ্রেন্ড মাইক জনি চৈনিক ইতিহাসের ওপর পিএইচডি করছিল অক্সফোর্ড-এর নিউ কলেজে। ফ্রাঞ্চিনও ইতিহাসের ফেলো। মাইকের আতিথ্যে আমরা ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ঐতিহাসিক স্মৃতিময় অক্সফোর্ডে। নিউ কলেজে কবি পার্সিভিসি শেলি’র শাদা মার্বেল পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি কবিরা রাষ্ট্রনায়কদের চাইতেও অধিক সম্মানের যোগ্য—আর সেটা সম্ভব ইংল্যান্ডেই। গেলাম বড্লিয়ান লাইব্রেরিতে। ইউরোপের তৃতীয় প্রাচীনতম এবং বৃটেনের সবচাইতে প্রাচীন সেই গ্রন্থাগারের সুপ্রাচীন বেঞ্চিতে বসে বসে ভাবছিলাম হয়তো এরকম কোনো একটি বেঞ্চিতে বসেই সি. এস. লুইস কিংবা অস্কার ওয়াইল্ড বা রবার্ট গ্রেভস্ একমনে একধ্যানে পাঠ করে গেছেন বই। আরে, কবি শেলিই তো ছিলেন অক্সফোর্ডে! হতে কি পারে না, যে-বেঞ্চিতে আমি বসেছিলাম সেখানেই বসেছিলেন শেলি! অক্সফোর্ডের আরও নাম হয়তো এসে যায়—লুইস ক্যারল, ভেরা বৃটেন, জন বেৎজেম্যান, হার্পার লি। আর সেই বিখ্যাত জে. আর. আর. টলকিয়েন যাঁর ‘হবিট’ এবং ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস’ হলিউডের কল্যাণে সারা পৃথিবী ছড়িয়েছে। এঁর নাম পরে আবারও আসবে অন্যতম কারণে।

অক্সফোর্ডের বিখ্যাত চারওয়েল নদীতে পান্টিং করলাম আমরা আর মাইক ও ফ্রাঞ্চিন। হঠাৎ আমার মনে পড়ে নীরদ সি চৌধুরীকে। তাই তো এমন কি হতে পারে না আমরা যখন পান্টিং করতে করতে দীর্ঘ সরু চারওয়েল নদী এর দুই ধারের নির্জন ঝোঁপঝাড় প্রান্তর আর লোকালয় খামার কিংবা গোপালনক্ষেত্র পেরিয়ে যাই, আমরা হয়তোবা নীরদ বাবুর বাড়ির পাশ ঘেঁষেই যাই। ধাঁ করে মাথঅর ভেতরে জন্ম নেয় একটির পর একটি চিত্রকল্প। ভাবি, ইংরেজ না হয়েও কী চমৎকার জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন তিনি লর্ড ক্লাইভের আর সেই অটোবায়োগ্রাফি। মাইক বললো, নীরদ বাবু অক্সফোর্ডে বিখ্যাত। এমনকি সিটি কাউন্সিল থেকে সরকারি নির্দেশনা আছে, ভিন্ন ভিন্ন স্কুল থেকে একেক সপ্তাহের একেক দল গিয়ে নীরদ সি চৌধুরী’র বাড়ি গোছগাছ করে দিয়ে আসবে। ভাবলাম, এই সম্মান তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর লেখনীর জোরেই। কেবলই দয়ার বশে ইংরেজরা তাঁকে এতটা সম্মান জানানোর কথা নয়। অক্সফোর্ড  থেকে ফিরে এলাম কেম্ব্রিজে পুনরায় লেখাপড়া আর গবেষণাকর্মের মধ্যে। কিন্তু আবারও মাথায় কবিতার ধাক্কা এবং বসে পড়া গেল ইংরেজি কবিতা লেখায়—এবারে বিষয় হিসেবে এলো অক্সফোর্ড এবং চারওয়েল নদী এবং অবশ্যই নীরদ সি চৌধুরীর চরিত্রটা। কবিতার শিরোনাম ‘পান্টিং এ্যাট দ্য রিভার চারওয়েল’। বারো কি তেরো পংক্তির একটি কবিতা যেটিও পরে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সান্তিয়াগোর মাছ’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থে ইংল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে লেখা অনেক কবিতা অবশ্য মূল বাংলা ভাষাতেই রচিত হয়েছিল যদিও আমাকে অনেকের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কবিতাগুলো মূলত ইংরেজিতেই রচিত হয়েছিল কিনা। 

আমার অক্সফোর্ড বেড়াতে গেলে মাইক আমাদের জানায়, ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত আইরিশ কবি সিমাশ হিনি তখন অক্সফোর্ডে কবিতা বিষয়ের অধ্যাপক। হিনি অবশ্য ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত এ-পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মাইক এবং ফ্রাঞ্চিন দু’জনেরই খুব ইচ্ছে ছিল একবার হিনি’র সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু ঠিক সেসময়টাতেই কবি অক্সফোর্ডে ছিলেন না। হয়তো তখন তিনি চলে গিয়েছিলেন উত্তর আয়ারল্যান্ডে তাঁর নিজের বাড়িতে। আর যেহেতু সময়টা ছিল উইকএন্ড সকলেই ছিল ছুটির আমেজে। মজার কথা ১৯৯৫ সালে, তখনও আমরা কেম্ব্রিজেই, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন কবি সিমাস হিনি। সত্যি বলতে কি অনেকেরই ধারণা ইয়েটসের পরে হিনি হলেন আরেক আইরিশ কবি যিনি তাঁর কাব্যপ্রতিভা আর সৃষ্টির সম্ভারে সমৃদ্ধি যুগিয়ে গেছেন বিশ্বসাহিত্যকে। মাথার মধ্যে গেঁথে রইলেন এ-কবি এবং ক্লেয়ার হলের সেমিনার রুমেই একটি পত্রিকায় আমি পড়লাম তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য হ্য ল্যানটার্ন’। অসাধারণ একটি কবিতা। কবিতাটিতে গ্রিক ডায়োজিনিসের হ্যারিকেনের চিত্রকল্পকে এমন মর্মভেদীভাবে ব্যবহৃত হয় যা অত্যন্ত গভীর ভাবনা থেকে আসা। লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়লাম ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ডেথ অব আ ন্যাচারালিস্ট’। তাঁর আরেকটি কবিতা পড়ি ‘ফ্রম দ্য ফ্রন্টিয়ার অব রাইটিং’—ঐ কাব্যেরই। তখন ইংল্যান্ডে চলছিল স্বাধীনতাকামী আইরিশদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার লড়াই। যখন-তখন যেখানে-সেখানে বোমা ফাটার দিন। বহু লোক মারা পড়ে ‘সিনফেন’-দলের ভয়ংকর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে। একবার আমরা গিয়েছিলাম কভেন্ট গার্ডেনে। আমরা যে-ট্রেনে যাই তার পরের ট্রেনেই ফেটেছিল বোমা। বহু লোক হতাহত হয়। হিনি’র কবিতাটিতে সেই সময়কার পরিস্থিতির দারুণ প্রতিফলন লক্ষ করি। অনেককাল পরে আমার নিজের ইংরেজি ভাষায় লেখা দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ’র শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘রেজারেক্শন্ অব আ রিফর্মিস্ট্’। সে-বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত এটুকু বলা যায়, বস্তুত সিমাস হিনি’র কাব্যের মৃত্যুচিন্তাকে খানিকটা মোচড় দিয়ে আমি চেষ্টা করি পুনরুত্থানের ব্যঞ্জনার দিকে নিয়ে যেতে। সে-পুনরুত্থান এমন একজনের যার থাকবে নববার্তা’র ইঙ্গিত।

কেইন্সাইড হাউজে আমাদের আরেকজন সুহৃদ ছিল মারিয়া গ্রাৎসিয়া লোলা। ইতালিয় লোলা’র পিএইচডি’র বিষয় সেন্ট হেলেনা’র কবি ডেরেক ওয়ালকট। মজার বিষয় গ্রাৎসিয়া ইতোপূর্বে একটি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিল বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতালিয় ভাষায়। কেম্ব্রিজে চলছিল তার দ্বিতীয় পিএইচডি। জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, এমনটা করা যায় নাকি। ও বললো, যায়, সমস্যা নেই। ওর কাছ থেকে পড়বার জন্যে একটা বই নিলাম ডেরেক ওয়ালকটের ‘ওমেরস’। আরও একটি মজার ব্যাপার না বললেই নয়। ওর কাছে দু’টো কপি ছিল কাব্যটির। একটাতে ওয়ালকটের সই তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে এবং আরেকটাতে সই নোবেল পাওয়ার পর—দু’টোতেই তারিখ চিহ্নিত। আমরা যখন কেম্ব্রিজের কেইন্সাইড হাউজে তখনই নোবেল পান ওয়ালকট (১৯৯২)। কী যে আনন্দ গ্রাৎসিয়া’র। ডেরেক নয় যেন নোবেল পেয়েছিল গ্রাৎসিয়াই। তারপর আমরা গ্রাৎসিয়া’র বদৌলতে (কিংবা হয়তো ওয়ালকটেরই বদৌলতে) পিৎজা হাটে গিয়ে খেলাম পিৎজা মার্গারিটা, বিফ লাজানিয়া এবং ডেজার্ট হিসেবে বিখ্যাত ইতালিয় কেক মারমরিজ্জাতো। গ্রাৎসিয়া থেকে নিয়ে ‘ওমেরস’ পড়তে পড়তে মনে হলো এ এক আশ্চর্য জগত। সত্যিকার অর্থে ক্যারিবিয় অঞ্চলের এমন সমৃদ্ধ কাব্যসৃষ্টির স্বাদ আমি এর আগে পাই নি। কিন্তু ‘ওমেরস’ এক নতুন দৃষ্টির উন্মোচন ঘটালো মনে।

কেম্ব্রিজ না গেলে জীবনে কখনও হয়তো নাইজেরিয় ঔপন্যাসিক চিনুয়া এ্যাচেবে’র সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটতো না। সেটা ছিল সত্যিকার অর্থে আমার জীবনের এক পরম পাওয়া। তিনি এসেছিলেন ক্লেয়ার হলেরই ‘ট্যানার এ্যান্ড এ্যাশবি লেকচার’ দেওয়ার জন্যে। তাঁর বিষয় ছিল ‘এডুকেশন অব আ ব্রিটিশ প্রোটেকটেড চাইল্ড’। এঁর কথা আমি ইতোপূর্বে আলাদা রচনায় লিখেছি। এখানে এটুকুই বলা প্রাসঙ্গিক, তাঁর সঙ্গে ঘন্টা দেড়েকের আলোচনায় এবং বিশেষ করে উত্তর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তাঁর কথকতায় পেয়েছিলাম দিকনির্দেশনা। ইংরেজি ভাষায় লেখালেখির বিষয়টা নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম। তখন আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেনিয় লেখক এনগুগি নিয়ে কিছু কথাবার্তা হতো। ইংরেজি ভাষায় এনগুগির আর না লেখার ঘোষণা এবং বাকি জীবন তাঁর নিজেরই মাতৃভাষায় লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রকাশকে অনেকেই উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনায় এক নতুন ধরনের অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন। এনগুগির কথা, ইংরেজি ভাষাটা যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শোষকের একটা বড় হাতিয়ার কাজেই সে-ভাষায় লেখালেখি চলে না। সে-ভাষায় সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যুত্তর হয় না। চিনুয়া’কে উস্কে দিয়েছিলাম বিষয়টা সামনে এনে। তাঁর বক্তব্য, এনগুগি বড় লেখক এবং বিশিষ্টও, কাজেই তাঁর কথার মূল্য আছে। তিনি তাঁর অবস্থানকে সম্মান জানিয়েই সে-বিষয়ে তাঁর নিজের অবস্থানটিকেও ব্যাখ্যা করেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তুমি তো আমার ‘টক্’-এ ছিলে এবং শিরোনামটাও দেখেছো। নিজেরই উপন্যাস ’থিংস ফল এ্যাপার্ট’-এর দৃষ্টান্ত দিয়ে চিনুয়া বলেন, ১৯৫৮ সালে তাঁর সেই উপন্যাস প্রকাশ পেলে ইংরেজ সমালোচকরাই মন্তব্য করেছিলেন, এ কেমন ধারা ভাষা উপন্যাসের, এমন ইংরেজি তো ব্রিটিশরা ব্যবহার করে না। চিনুয়া’র কথা হলো, এমন ইংরেজি কার, সেটা হলো এককালের উপনিবেশিত’র। ঔপনিবেশিকের হাতিয়ারটাকে ব্যবহার করে পাল্টা জবাব দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানোটাও এক ধরনের উত্তর ঔপনিবেশিক অবস্থান। কেন তাঁর উপন্যাসের ভাষাকে অবিকল ইংরেজদের ভাষা মনে হয় না কিংবা কেন তাঁর এবং ইংলিশ ঔপন্যাসিকের মধ্যে একটা প্রবল সাংস্কৃতিক দূরত্বও আভাসিত হয় সে-প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত চিনুয়া’র অবস্থানের যৌক্তিকতা। একই কথা নিশ্চয়ই বলা যায় ভারতীয় ঔপন্যাসিক আর. কে. নারায়ণ কিংবা রাজা রাওয়ের বেলায়ও। বস্তুত চিনুয়ার সঙ্গে কথা বলে অনেক ধারণাই নতুন আকার নেয়, ইংরেজি ভাষার ওপর এককালের ঔপনিবেশিক শক্তির একচেটিয়া অধিকারের বিষয়টাও এসে পড়ে নতুন আলোকের প্রক্ষেপণে। মার্কিন মায়া এ্যাঞ্জেল্যু কিংবা টনি মরিসনের সাহিত্যের প্রবল কৃষ্ণাঙ্গ চেতনার দিকগুলি সম্পর্কে জাগে নতুনতর ভাবনা। আর সেই কৃষ্ণাঙ্গ চেতনার শেকড় ফের নিহিত থাকে আফ্রিকিয় জলমাটিতে। ১৯৬২ সালে ফ্রাঞ্জ ফানোঁ যখন আফ্রিকিয় চেতনা এবং উত্তর ঔপনিবেশিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন তা তিনি করেন ফরাসি ভাষাতেই যে-ভাষা ফানোঁ’র জন্যে ছিল ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। কাজেই বিষয়টা এক অর্থে জটিল হলেও তা বহুমাত্রিকও বটে। আমরা হয়তো অন্তত দু’টো চরম দৃষ্টান্তও এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। এ হলো বাস্তবতাকে বা উত্তর ঔপনিবেশিকতার ডিসেকোর্সকে উল্টো দিক থেকে ধরা। ক্লেয়ার হলের লাইব্রেরিতে দু’টো বইয়ের সন্ধান মিলে যায়—একটি দক্ষিণ আফ্রিকিয় লেখক-কবি ব্রেটেন ব্রেটেনবাখ রচিত ‘দ্য ট্রু কনফেশন্স অব এ্যান এ্যালবিনো টেররিস্ট’ এবং অন্যটি ‘আন্দ্রে ব্রিংক রচিত ‘আ ড্রাই হোয়াইট সিজন’। দু’জনেই শ্বেতাঙ্গ লেখক কিন্তু তাঁদের রচনায় তাঁরা বর্ণবাদবিরোধী এবং শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসের স্বরূপ উদ্ঘাটনকারী। ব্রেটেনবাখকে তাঁর দায়বদ্ধ সাহিত্যের জন্যে কারাবরণ ও নির্বাসনও ভোগ করতে হয়। ১৯৯১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি নির্বাসন কাটিয়ে ফিরে আসতে পারেন স্বদেশে। আন্দ্রে ব্রিংক-এর উপর্যুক্ত উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট ইনভেস্টিগেশন জার্নালিস্ট (স্কুল-শিক্ষকও) দ্যু তোয়া’র দৃষ্টিতে উন্মোচিত হয় শ্বেত সন্ত্রাসের ভয়ংকর রূপ। দ্যু তোয়া’র নিরাপোষ অঙ্গীকারের জন্যে তাঁর নিজেরই পরিবারের নিকটজন (স্ত্রী ও কন্যা) পরিত্যাগ করে তাঁকে কিন্তু তাতেও পিছপা হন না তিনি। উপন্যাসে একটা স্পষ্ট বক্তব্য আমরা পাই –বক্তব্যের কথা অনেককাল আগে বলেছিলেন ফানোঁ তাঁর সেই বিখ্যাত রচনা ‘দ্য রেচেড্ অব দ্য র‌্যাথ’ গ্রন্থে। উপন্যাসটির শেষে দ্যু তোয়া’র চেতনাটি ভেসে ওঠে নতুন দ্যুতি নিয়ে—

“হয়তোবা একটা আশাই কেবল করা যেতে পারে, কেবল এটুকুই আমার বলার এখতিয়ারে পড়ে। এটা লিখিত আকারে পেশ করা। যা আমি জানি তার প্রতিবেদন রেখে যাওয়া। আর তাহলেই আর কখনও কোনো ব্যক্তির পক্ষেই বলা সম্ভব হবে না: এ-বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।”

আমরা কেম্ব্রিজে থাকাকালেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন টনি মরিসন। ১৯৭০-এ প্রকাশিত ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ কিংবা ১৯৭৭-এর ‘সং অব সলোমন’ ছাড়াও বহু বিখ্যাত রচনার স্রষ্টা টনি মরিসনের নোবেল যেন চিনুয়ার শেকড়-চেতনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। টনি মরিসনের নোবেল পুরস্কারের মাত্র কয়েক মাস আগে আমি বিবিসি টিভি-তে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম যেটি নিচ্ছিলেন ঔপন্যাসিক সালমান রুশদী। সেখানে মরিসন যে-বক্তব্য দেন তার সঙ্গে আমি কয়েক মাস পরে প্রদত্ত চিনুয়ার কথার অনেকখানি মিল লক্ষ করতে পারলাম। চিনুয়া’র কথা স্পষ্ট ইংরেজি ভাষাটা কলোনিয়াল তো ঠিক আছে, তোমার যে-শক্তি তার ওপর নিয়ন্ত্রণ তোমারই, কলোনি তোমার মনটাকে যদি কব্জা করতে না পারে তাহলে তাদের ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত তোমার ক্ষোভ তোমার প্রতিবাদ এবং তোমার ন্যায্য যুক্তির বিরুদ্ধাচারণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সালমান রুশদী তখন আত্মগোপনে। কেম্ব্রিজ লাইব্রেরি, ক্লেয়ার হল সেমিনার, ব্রিটিশ মিউজিয়ম, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি প্রভৃতি জায়গায় আমি সময় কাটাতে থাকি নিজের লেখাপড়া-গবেষণা এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত সাহিত্য পাঠে ও ভাবনায়। আরেক নাইজেরিয় ঔপন্যাসিক বেন্ ওকরি কেম্ব্রিজে এলেন ‘টক’ দিতে। বিষয়: নাইজেরিয় হিসেবে ইংরেজি সাহিত্য রচনায় নিজের অভিজ্ঞতার সম্পর্কে বলা। ১৯৯১ সালে তিনি ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান ‘দ্য ফেমিশ রোড’ উপন্যাসের জন্যে। নাইজেরিয় গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠা ওকরি সেখানকার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের মধ্যে গোত্রীয় পৃথকতার পরিণামে সংঘটিত ভয়াবহতার বিবরণ দেন। গিকুয়ু, হোক্সা, ইউরোবা প্রভৃতি জাতিগত বিভেদের কাছে কী করে বৃহত্তর নাইজেরিয় জাতিসত্তার পরাজয় ঘটে তার নৈব্যক্তিক সামলোচনা তিনি করেন। এরকম পরিস্থিতিতে পোস্ট মডার্নিজম এবং উত্তর ঔপনিবেশিকতার ধারণাগুলো অনেক সময় যে আর ‘কপিবুক’ থাকে না সেকথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। সেমিনারের এক ফাঁকে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন নিউটনকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বেন বললেন, দেখুন কতকাল আগে চলে গেছেন নিউটন। কিন্তু আমরা এখনও তাঁকে আমাদের চেতনার উপাদানে পরিণত করেছি। আমরা কখনও ভাবি না তিনি ব্রিটিশ কিংবা তাঁর ভাষা আমার ভাষা নয়, আমাদের মনে হয় যে নিউটন আমাদেরই লোক।

লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পর্কিত নানান ভাবনায় কেটে যায় দিন। সেসময়টাতে রুশদি’র ‘স্যাটানিক ভার্সেস্’ উপন্যাস সম্পর্কিত জটিলতা ইংল্যান্ডে, ইরানে, ভারতীয় উপমহাদেশে এবং আরও নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। উপন্যাসটি ১৯৮৮ সালে বেরোলেও আত্মগোপনে থাকা রুশদি এবং তাঁর অনুবাদকদের ওপর ‘বাউন্টি হান্টার’দের হুমকি ও ধারাবাহিক ঘোষণা ইত্যাদি সারা বিশ্বে লেখকদের নিরাপত্তা ও তাঁদের সামাজিক অবস্থান এইসব প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। ঠিক তখনই একদিন সকালবেলা দেখা হলো সিটি সেন্টারে আমাদের পোলিশ বন্ধু ভয়েশ্চেক মিয়েরজুস্কি’র সঙ্গে। ইংল্যান্ডে থাকাকালে আমি যখন আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের ‘শোশা’ উপন্যাসের অনুবাদ শুরু করি ভয়েশ্চেক আমাকে খুবই অনুপ্রাণিতকরে উৎসাহ যুগিয়ে। যদিও ধর্মসূত্রে সে ছিল ক্যাথলিক কিন্তু সে যথেষ্টই গোঁড়ামিমুক্ত। খোলামনেই সে আমাকে জানায়, সিঙ্গার ইহুদি হলেও সে তাঁকে শ্রদ্ধা করে এবং সিঙ্গার যখন ১৯৭৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পায় তখন তার মত অসংখ্য পোলিশ আনন্দোল্লাসের উৎসব করেছিল। তারা সিঙ্গারের গ্রাম ক্র্যাকফে গিয়ে জগো হয়েছিল। আবার কিছুকাল পরে ক্র্যাকফেরই কবি পোলিশ ভিস্লাভা সিম্বর্সকা নোবেল পুরস্কার পেলে ভয়েশ্চেক সে-সংবাদ আমাকে জানায় এবং আমরা তাঁর সম্মানে একটা বিকেল মিলিত হই কফিশপে। যাহোক, ভয়েশ্চেকের মারফত জানতে পারি, ভোররাতে ঠিক চারটার দিকে কিংস কলেজে একটা ‘টক’ দিতে এসেছিলেন ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি। তাঁর বিষয় ছিল: ‘আন্ডার দ্য শ্যাডো অব দ্য ফতোয়া’। রুশদি এই কিংস কলেজেরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন। সেমিনারে সর্বমোট ১৮ জন শ্রোতা উপস্থিত ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম কারা এই বিশেষ ১৮ জন শ্রোতা! দেখলাম ইংরেজি ভাষায় লেখার কী প্রবল পরিণাম। ব্রিটিশ সরকার রুশদি’র নিরাপত্তার জন্যে কোটি-কোটি টাকা খরচ করে চলেছে। একজন লেখককে বৈরী পরিস্থিতির সমুখে সার্বিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবার ব্রিটিশ তৎপরতাকে লেখকের জন্যে এক অসাধারণ ব্যতিক্রমী ঘটনাই বলতে হবে। নিজের মাতৃভাষা ইংরেজি না হলেও সে-ভাষাকে নিজের সত্তায় অর্জন করবার মেধা-প্রতিভাধারী রুশদি’র মূল্যায়ন করেছিল ব্রিটিশরা।

১৯৯৭ সালে আমি যখন ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি সঙ্গে নিয়ে আসি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানিতে বসবাসের বিচিত্র অভিজ্ঞতা। পাঠ ও পঠনের এক আয়ত ভুবনের ছায়া মাথার ওপরে। যখন ফিরে আসছিলাম তার অল্প আগেই আমাদের অত্যন্ত প্রিয়জন প্রাণের মানুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মৃত্যুবরণ করেছেন। মনটা ছিল প্রবল ভারাক্রান্ত-বিষণ্ন। কয়েকমাস আগেই তাঁকে লেখা শেষ চিঠির জবাব দিয়েছিলাম। সেই চিঠিতে তাঁর পূর্বেকার চিঠির সূত্রে উল্লেখ করেছিলাম আমার সাম্প্রতিক লেখালেখি সম্পর্কে কিছু কথা। কিছুকাল আগে আমি একটি উপন্যাস রচনা করেছিলাম ‘ব্রিকলেন কোয়ার্টার’ শিরোনামে। কিন্তু সেটি আমার মনঃপূত না হওয়ায় গোটা উপন্যাসটির স্থান হয় বর্জ্য কাগজের স্তূপে। অনেকটা কাল পরে ২০০৩ সালে দেখতে পাই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মণিকা আলী’র উপন্যাসের নাম ‘ব্রিক লেইন’। এটি সম্পূর্ণই ছিল এক সমাপতনিক ঘটনা। যদিও বিষয়টি ভেবে মাঝে-মাঝে আমি কৌতুক অনুভব করি। বস্তুত ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডনের বাঙালি উপনিবেশ ব্রিক লেন লেখালেখির জন্যে এমনই এক চমকপ্রদ বিষয়বস্তু, যে-কারুরই সৃজনশীলতায় এটিকে সাহিত্যের বিষয়ে পরিণত করবার ভাবনা উঁকি দিতেই পারে। 

১৯৯৭ থেকে শুরু করে ২০১৭—হিসেব করলে প্রায় কুড়ি বছর, দুই দশককাল। সাতানব্বইতে দেশে ফেরার পরেই আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের ‘শোশা’ উপন্যাসটি চূড়ান্ত করা গেল। এদিকে সিঙ্গারের পাশাপাশি আরেকজন লেখক আমাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন: ইতালো ক্যালভিনো। ১৯৯২ সালে আমার জন্মদিনে আমাদেরই হাউজমেট ফিনল্যান্ডের এ্যান ফিনেল আমাকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একখানা বই উপহার দেয়—ইতালো ক্যালভিনো’র ‘এ্যাডাম, ওয়ার আফটারনুন’। পড়ে রীতিমত বিস্মিত, অভিভূত এবং আচ্ছন্নতার অনুভূতিমগ্ন। তখন থেকেই মাথার ভেতরে ক্যালভিনোর ঘুরপাক। একে একে তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থ উপন্যাস এবং সেই বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ ‘হোয়াই রিড ক্ল্যাসিক্স’ পড়ে ফেললাম। তাছাড়া তিনি যে-বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলোর সংগ্রহ এবং একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিপ্লবী চ্যে গ্যেভারা’র। দীর্ঘদিন সেটি ইতালিতে নিষিদ্ধ ছিল। পরে তা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। এইসব প্রস্তুতি সেরে একপর্যায়ে শুরু করা গেল ক্যালভিনো’র নির্বাচিত গল্পের অনুবাদ। পরে বিখ্যাত ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আবুল হাসনাত ভাইয়ের আগ্রহে-উৎসাহে সেটি প্রকাশিত হয় ‘বেঙ্গল’ থেকে। এই দুই দশককাল সময়ের মধ্যে মূলত গল্প কবিতা উপন্যাস গবেষণা প্রবন্ধ অনুবাদ ইত্যাদি লেখালেখির কাজ চলতে থাকে। একই সমান্তরালে চলমান থাকে ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাইভেট মোমেন্টস্’। নানান বিষয় নিয়ে লেখা এ-কাব্যগ্রন্থকে আমার বিচারে উৎকৃষ্ট ও স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত কোনোভাবেই বলা যাবে না। যে-সমকালীন কবিতা আমি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন পাঠ করেছিলাম এবং মূলত এ্যান্টি-পোয়েট্রির সমর্থক আমি মিরোস্লাভ হোলুভ, ভাস্কো পোপা, ওসিপ ম্যানডেলস্টাম কিংবা জর্জ ফালুদি’র যেসব কবিতায় উদ্বুদ্ধ হই তেমন কবিতা লিখতে চেয়েও সত্যিকার অর্থে নিজের বিশিষ্টতাকে কোনোভাবেই মুদ্রিত করতে পারি না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করি। কেননা আমার মনে হতে থাকে, আমি আমার স্বাতন্ত্র্যকে করায়ত্ত করবার যে-পথে নেমেছি সে-পথে আমার হাঁটাটাকে রাখতে হবে অব্যাহত। এবারে ইংরেজি ছন্দ মেনে বেশ কিছু কবিতা লেখা হলো। লিখলাম অনেকগুলি সনেট। ২০২১ সালে প্রকাশিত হলো ইংরেজিতে লেখা আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘রেজারেকশন অব আ রিফর্মিস্ট’। বলা যায় এ-গ্রন্থে খুঁজে পাওয়া গেল খানিকটা ছন্দ। এরিমধ্যে বিশ্বের নানা জায়গায় যেসব কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল সেগুলো পাঠ করতে গিয়ে দেখলাম, সর্বত্র গদ্যছন্দে লেখা কবিতার চর্চাই অধিক। তবে ব্যতিক্রমও  লক্ষ করা যায়। মার্কিন কবি কেন্ জস-এর কবিতা পড়তে গিয়ে দেখি ছন্দকে যেন ময়দা মাখানোর মত মাখাচ্ছেন, যেমন খুশি খেলছেন এবং রূপ দিচ্ছেন সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ নানা ধরনে। পূর্বতন মার্কিন কবি ওগ্ডেন ন্যাশ-এর কিছুটা অনুসারী কেন্ জস-এর এই প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার পথ আমার নয়। শেষ পর্যন্ত আমার চূড়ান্ত পথ হলো গদ্যছন্দের পথ এবং শুরু হলো আমার সে-পথে হাঁটা অব্যাহত রাখা। মনে-মনে ভাবলাম বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছাবার পথ হলো ভালো পোয়েট্রি জার্নালে কবিতা-প্রকাশ। একসময়ে বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতার পত্রিকায় কারও কবিতা মুদ্রিত হলে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হতো না। কাজেই যোগ্য সম্পাদকের বিচারও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড। তবে একথাও আমার মনে ছিল, হাসান আজিজুল হক একবার বলেছিলেন কথাটা। ১৯৬০ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘শকুন’ নামক ছোটগল্প এবং প্রকাশের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি খ্যাতি অর্জন করে নেন। সকলেরই আগ্রহের বিষয় ছিল, কে এই হাসান আজিজুল হক যিনি ‘শকুন’-এর রচয়িতা। কিছুকাল পরে সিকান্দার আবু জাফরের অুনরোধে হাসান আজিজুল হক আরেকটি গল্প পাঠান ‘সমকাল’-পত্রিকায়। কিন্তু এবারে আর গল্পটি সিকান্দার আবু জাফরের মনঃপূত হয় না এবং তিনি আর ছাপলেন না হাসানের সেই ছোটগল্প। অনেকটা ক্ষোভ আর অভিমানে নিজের লেখা সেই গল্প পান্ডুলিপিসমেত নষ্ট করে ফেলেন তিনি। সেটি বর্জ্য রূপেই স্থান করে নেয়। হাসান স্যারকে জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, আপনার কী ধারণা কেন তিনি ছাপেন নি আপনার লেখা গল্পটি? লেখাটি ধ্বংস করে ফেললেও হাসান স্যার জানতেন গল্পটি সম্পাদকের পছন্দ না হওয়ার হেতু। আসলে গল্পটিতে ছিল দার্শনিকতার জোর প্রভাব এবং তাতে খানিকটা ব্যক্তিবাদিতার ছাপও প্রকট ছিল। গল্পটি হয়তো আলাদাভাবে বিবেচনা করার পক্ষে কোনো বাধা থাকবার কথা নয় কিন্তু সমকালের সম্পাদকীয় দৃষ্টিকোণের নিরিখেই সে-গল্প সিকান্দার আবু জাফরের পক্ষে অনুমোদন করা সম্ভব হয় নি। হাসান আজিজুল হকের কাছিই জানতে পারি, পরে সেই ছোটগল্পেরই বৃহত্তর সংস্করণ হয়ে দেখা দিয়েছিল ‘বৃত্তায়ণ’ যেটি কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলেও দীর্ঘকাল অমুদ্রিত থাকে এবং একদিন তা মুখ দেখে গ্রন্থাকৃতির।

যে-নতুন ভাবনার কবিতাগুলো ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে মূলত গদ্যে রচিত হতে থাকে সেগুলো থেকে নির্বাচিত কবিতা আমি ইংরেজিভাষী কবিতাপত্রিকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তারই পরিণতিতে বেছে নিলাম একটি পোয়েট্রি জার্নাল—লোথলোরিয়েন পোয়েট্রি জার্নাল। পত্রিকার নামের ‘লোথলোরিয়েন’ শব্দটা নিঃসন্দেহে আকর্ষণীয়। বুঝতে পারি এর সম্পাদক নামকরা কবি স্ট্রাইডার মার্কাস জোন্স নিশ্চয়ই বিখ্যাত লেখক জে. আর. আর. টোলকিয়েনের ভক্ত হবেন। সেই টোলকিয়েন যাঁর ‘হবিট’ এবং ‘দ্য লর্ড অব দ্য রিংস্’ দুনিয়াজুড়ে তাঁকে বিখ্যাত করেছে। টোলকিয়েনের সাহিত্যকর্ম পরিণত হয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যে। টোলকিয়েনের রচনায় লোথলোরিয়েন হলো ভূস্বর্গ। এর শাসক হলেন গ্যালাডরিয়েল এবং সেলেবোর্ন যাঁরা রাজ্য পরিচালনা করেন তাঁদের কারাস্ গ্যালাঢোনের বৃক্ষের সাম্রাজ্য থেকে। দেখলাম পোয়েট্রি জার্নালটির সম্পাদকীয় নীতিমালা। বয়স, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি, দেশ কোনোকিছুরই কোনো সংস্কার নেই। কিন্তু কবিতাকে হতে কবে ‘অরিজিন্যাল’ এবং কবিতার থাকবে নিজস্বতা, নতুনত্ব এবং এর ভাষা হবে কবির চারিত্রের প্রতিনিধিত্বকারী। অনেক ভেবেচিন্তে দু’টো কবিতা বেছে নিলাম—২০২১ সালের যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ তারিখে লেখা ‘টু মি সরো’জ লাইক’ এবং ‘আ রেয়ার এন্কাউন্টার’। প্রথমটির প্রেক্ষাপট কেম্ব্রিজে ক্রিসমাসের আসন্নতায় আমার দুঃখবাদী ভাবনার অনুভূতি-প্রকাশ। প্রথম পংক্তিদ্বয়—“টু মি সরো’জ লাইক দ্য লাস্ট উইন্টারস্ কোল্ড,/ কুড্ বি ওয়র্স এ্যান্ড ইভেন দ্য ওয়র্স্ট। এভাবে শীতের বিশীর্তার মধ্যে টুকরো-টুকরো দৃশ্য-চিত্র আর উপমায় সজ্জিত কবিতাটি। আসে নিউটন, রামানুজন, ডিকেন্সের চরিত্র স্ক্রুজ এবং চারদিককার শীতার্ত পরিবেশ। আর শেষটুকুতে থাকে ক্যাম্ নদীতে একটি পুরুষ হাঁস এবং একটি নারী হাঁসের চিত্রকল্প—“টু মি সরো’জ লাইক/ দ্য লোনলি কব্ ইন ওয়েটিং অন্ দ্য ক্যাম,/ আই নিউ দ্য পেন্ উড বি জয়নিং ইন আ ওয়াইল”। দ্বিতীয় কবিতাটির বিষয় হিসেবে আসে একটি ছিন্নমূল শিশুর খাদ্য-গ্রহণের চিত্র। বস্তুত রাজধানি শহরের শেরাটন হোটেল সংলগ্ন ফুটপাথে একটি শিশু খাচ্ছিল আন্তর্জাতিক ফোর-স্টার হোটেলের উচ্ছিষ্ট খাবার। তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটির শেষে ছোটগল্পের মত নাটকীয়তা থাকে। কবির নিকটে মুহূর্তে শিশুটিকে তাঁর নিজেরই সন্তানের মত মনে হলে এক ধরনের আবেগ তাঁকে দখল করে। কিন্তু পরে তাঁর মনে হয় যে শিশুটি আসলে তো তাঁর সন্তান নয়, দেখতে তাঁর সন্তানের মত।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে পাঠানো আমার কবিতাদু’টি লোথলোরিয়েন পোয়েট্রি জার্নাল-এর ৫-ফ্রেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখের সংখ্যায়। ইমেইল পেলাম স্বয়ং কবি-সম্পাদকের। এত বড় একজন কবি সসম্মানে আমাকে ‘কবি’ সম্বোধন করে তাঁর স্বীকৃতিপত্র পাঠালেন। কিছুকাল পরে জার্নালটির ৮ম ভল্যুম-এ বিশ্বের ৭৪ জন কবির কবিতার সঙ্গে একত্রে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ পেলো আমার কবিতাদু’টিও। বলা যায় পোয়েট্রি জার্নালটিতে কবিতা-প্রকাশের ঘটনা আমার জন্যে ছিল দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ক একটি উপলক্ষ্য। ইংল্যান্ড আমেরিকা ইউরোপ এবং উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালের একটি বিষয় প্রশংসনীয়। জার্নাল সম্পাদকগণ প্রতিটি লেখা গুরুত্ব সহকারে পাঠ করেন এবং প্রতিটি লেখা সম্পর্কে মন্তব্য-মূল্যায়ন রচয়িতাকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। কয়েকদিন আগেই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পোয়েট্রি জার্নাল-এর (আপাতত নামটি উহ্য থাকুক) সম্পাদকের মেইল পেলাম, লিখেছেন, তাঁরা প্রাথমিক বাছাইয়ের তালিকায় রেখেছেন আমার কবিতা এবং আমাকে আরও কবিতা পাঠানোর জন্যে করেছেন আন্তরিক অনুরোধ। আমাদের দেশে এমন ঐতিহ্য ও প্রতিক্রিয়া দুর্লভ। আমি আমার মাতৃভাষায় লেখালেখি করছি আজ প্রায় ৪৬ বছর (১৯৭৬ সাল থেকে ধরলে) এবং ১৯৮৮ সালে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত এই চৌত্রিশ বছরে আমার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ষাটের কাছাকাছি। সত্যিকার অর্থে প্রকাশক এবং সম্পাদকের চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা আজও আমার মনে সৃষ্টি হয় নি। হয়তো সেটা আমারই ব্যর্থতা অথবা হয়তো তাঁরা এমন কোনো অধরা জগতের বাসিন্দা যে-জগত সম্পর্কে আমার কোনো অনুমানই সঠিক হওয়ার নয়।

ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, দ্বিতীয় ভাষা। সেটা আমি যেমন জানি যে-সম্পাদকেরা আমার লেখা পড়েন তাঁরাও সেটা জানেন। কিন্তু পোয়েট্রি জার্নালের অদেখা সেই সম্পাদকেদের হৃদয়ের উষ্ণতা আমি অনুভব করতে পারি তাঁদের প্রতিক্রিয়ায়, তাঁদের পাঠানো বার্তায় এবং তাঁদের প্রসন্ন শুভকামনায়। নিজের লেখা লিখে যেতে হবে আমাকেই কিন্তু ইংরেজি ভাষায় লেখালেখির সূত্রে বিভিন্ন পোয়েট্রি জার্নালের সম্পাদকেদের অনুপ্রেরণায় ভাবি, সত্যিই তো আমাদের দেশে লেখালেখিকে হয়তোবা ততটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হয় না, লেখকগণ এখানে এখনও সেই সম্মানের অবস্থানে পৌঁছান নি। আমি সেই অবস্থানের কথা বলতে চাইছি যেখানে মানদণ্ড হবে কেবল লেখার সফলতাই। মার্কেজ বলেছিলেন, লেখা দুই ধরনের—ভালো লেখা ও মন্দ লেখা। ইংরেজি ভাষায় কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখতে গিয়ে এবং আমার তৃতীয় ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য মেমোরি-স্ট্রাক সোয়ান অব কেম্ব্রিজ এ্যান্ড আদার পোয়েমস্’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তত করতে গিয়ে এতসব নেপথ্য-কথা আমার মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল। ভাবলাম—দিন যায়, কথা থাকে। থাকুক না কথাগুলো।

এপ্রিল ২০২২, চট্টগ্রাম।

   

শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না কবি হেলাল হাফিজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

কবি হেলাল হাফিজ, নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

 

‘আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর…’

‘হৃদয়ের ঋণ’ কবিতার কবি হেলাল হাফিজ এখন নিঃসঙ্গ ও একাকী জীবন-যাপন করছেন সবার চোখের আড়ালে।

এখন মোটেও ভালো নেই কবি! সুস্থও নন! কথা বলতে গেলে তাঁর খবু কষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না তিনি! নেত্রকোনা থেকে কবি হেলাল হাফিজকে দেখতে আসা সাংবাদিক আলপনা বেগম বার্তা২৪.কমকে কবির এ অসুস্থতার কথা নিশ্চিত করেন।

আলপনা বলেন, কবিকে দেখার কেউ নেই! ভীষণরকম একাকী আর সবার চোখের আড়ালে বাস করছেন তিনি। রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকার হোটেল সুপার হোম নামে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে থাকেন কবি হেলাল হাফিজ। হোটেল কর্তৃপক্ষ বিনা ভাড়ায় তাঁকে একটি ভিআইপি কক্ষ বরাদ্দ করেছে। সেখানেই অনেকদিন ধরে নিঃসঙ্গে সময় কাটছে তাঁর।

আলপনা জানান, কবি হেলাল হাফিজ একা একা গোসল করতে পারেন না। তাঁকে গোসল করিয়ে দিতে হয়। হোটেলের এক বয় কবিকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দেন।

কবি বাম চোখে কম দেখতে পান বলে জানান আলপনা। তিনি জানান, কবি বয়সজনিত কারণে শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। বাংলা ভাষার এই কবি গ্লুকোমায় আক্রান্ত। এর পাশাপাশি কিডনি, ডায়াবেটিস ও স্নায়ুরোগেও ভুগছেন তিনি।

রোমান্টিক ও প্রেমের কবিতা লিখেও কবি নিজে সারাজীবন থেকেছেন চিরকুমার!

নেত্রকোনায় বাড়ি কবি হেলাল হাফিজের। সে সূত্রে নেত্রকোনা থেকে আসা সাংবাদিক আলপনার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, একবার ইচ্ছে আছে, নেত্রকোনায় যাওয়ার। শরীর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি সেখানে একবারের জন্যও হলে যেতে চান। দেখতে চান নিজের জন্মভিটা! সবাইকে একনজরও দেখে আসবেন তিনি।

নিজের চিকিৎসার বিষয়ে ভীষণরকম উদাসীন কবি হেলাল হাফিজ। ইতোপূর্বে, বার বার চেষ্টা করেও তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো যায়নি।

২০২২ সালে শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হলে কবি হাসপাতালে ভর্তি হতে রাজি হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন তিনি। খানিকটা সুস্থ হলে ফের হোটেলে ফিরে আসেন কবি। এর ৪/৫ দিন পর ফের অসুস্থতাবোধ করলে হোটেলের লোকজন তাঁকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যান। তারপর কিছুটা সুস্থ হয়ে আজও শাহবাগের হোটেল কক্ষে একাকী জীবন-যাপন করছেন কবি হেলাল হাফিজ।

বাংলা ভাষার ভীষণ জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'যে জলে আগুন জ্বলে' প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর কবি প্রতিভার পরিচিতি লাভ করে। কবিতার জন্য ২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

কর্মজীবনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্য সম্পাদনাও করেছেন কবি হেলাল হাফিজ।

;

চুরুলিয়ার স্মৃতি ও নজরুলের অসাম্প্রদায়িক স্বদেশের অধরা স্বপ্ন



অঞ্জনা দত্ত
নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিমের সঙ্গে সঙ্গে ও প্রদীপ কুমার দত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

(পূর্ব প্রকাশের পর) উপাচার্যের কক্ষ থেকে বের হয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো অন্য একটি কক্ষে, যেখানে বেশ কয়েকটি আলমারিতে নজরুলের সৃষ্টি সংরক্ষিত আছে। রয়েছে প্রায় চার হাজার গানের স্ক্রিপ্ট। এছাড়া দুটো কলের গান দেখতে পেলাম, যেগুলোতে নজরুল একসময় গান শুনতেন। দু’একটা বাদ্যযন্ত্রও ছিল মনে হয়। কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম কবিতীর্থ চুরুলিয়ার পথে। এর মধ্যে ভদ্রলোক জানিয়ে রাখলেন তিনি চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমিতে বলে রেখেছেন আমাদের কথা, ‘অতএব আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না’।

একাডেমির দেখভাল বিশ্ববিদ্যালয়ই করে থাকে। চুরুলিয়ায় পৌঁছে অবাক হলাম নজরুলের ভ্রাতুষ্পুত্র একজন এখনো জীবিত আছেন, যে কথাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ বলেননি। সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওখানে আমাদের লোক আছে, নজরুল একাডেমি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ইত্যাদি অনেক কথাই জানালেন। অথচ ওখানে যে নজরুল পরিবারের একান্ত আপনজন রয়েছেন সেটি উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গেলেন! এটি জানা থাকলে কুড়ি কিলোমিটারের পথ আমাদের নিকট হয়তোবা দুই কিলোমিটারে দাঁড়াত!

আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার পথে একধরনের উত্তেজনা নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত নজরুলের স্ট্যাচ্যুর সাথে ছবি নিতে ভুল হলো না। কুড়ি কিলোমিটার খুব বেশি দূর তো নয়। নিমেষেই পৌঁছে গেলাম। দু’জন সাধারণ চেহারা ও বেশভূষার মানুষ আমাদের দেখা মাত্র সাথে নিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাড়ির একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। টেবিলের ওপারে বসে আছেন শ্যামল বরণ, বলিরেখামণ্ডিত চেহারা, চশমা পরিহিত প্রায় আশির অধিক বয়েসি এক ভদ্রলোক। পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি, ওটা ঠিক সাদা ছিল না, বহুল ব্যবহারে মলিন হয়ে পড়েছে আসল রঙ। আর চশমার ওপারে চোখ দু’টি কি ঘোলাটে ছিল ? আমাদের সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তিনি, কাজী রেজাউল করিম, নজরুলের কনিষ্ঠ ভাই আলী হোসেনের একমাত্র জীবিত উত্তরাধিকার। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে রইলাম কাজী রেজাউল করিমের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এঁর কথা কেন কিছু বলা হয়নি। আশ্চর্য!

রেজাউল করিমের সাথে গল্পে জমে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কথাবার্তায় সাবলীল ছিলেন। বয়স তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর এখনো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এই বৎসর ত্রিপুরায় নজরুলের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এই উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। স্মরণিকার জন্য আয়োজকরা পি কে ডি’কে লেখা দিতে বলেছিলেন। ওর লেখা কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল প্রায়।

রেজাউল করিম সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পি কে ডি জানালেন আজকে চুরুলিয়ায় এসে রেজাউল করিমের সঙ্গে কথা বলার পর সে ভাবছে তাঁকে আবার নতুন করে লিখতে হবে নজরুলকে নিয়ে। রেজাউল সাহেব জানালেন, আগরতলা থেকে তাঁকেও লিখতে বলা হয়েছে। সুস্থ থাকলে তাঁর যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে ঐ অনুষ্ঠানে। তাঁর নিজের পরিবারের কথা জানালেন। নজরুলের নাতি নাতনিদের কথা বললেন। বলা বাহুল্য সেগুলো খুব প্রীতিকর কিছু নয়। তাঁর নিজের কষ্টের কথা জানালেন। সুবর্ণ কাজী, রেজাউল করিমের তিন পুত্রের একজন, যার মধ্যে তিনি কিছু সম্ভাবনা দেখেছিলেন সংগীতে , তিনি তেমন কিছু করতে পারেননি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে একজন হলেন সোনালী কাজী। বাকি এক মেয়ে এবং দুই পুত্রের কেউই নজরুলের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। সংসারের নিয়মই মনে হয় এমন। একজন আয় (সেটি যে কোনোকিছুই হতে পারে) করেন। পরের প্রজন্ম সেটি এনক্যাশ করে চলেন (তবে এক্ষেত্রে এটি বলা যাবে না কেননা কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ নিজগুণে গুণান্বিত ছিলেন)। আর তৃতীয় প্রজন্ম দেউলিয়া হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এই ফর্মুলা পুরোপুরি কাজে না লাগলেও নজরুলের আদর্শ থেকে এরা অনেক দূরে। আপাদমস্তক মার্ক্সিস্ট কাজী রেজাউল করিমের চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে উঠল।

এবারে রেজাউল সাহেব আমাদের তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পাকা একতলা বাড়ি। টিনের ছাউনির ওপর পুরনো বাড়ির অনুকরণে খড় দিয়ে ছেয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর হলো। যে দুজন আমাদের প্রথমেই তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন তারাই রেজাউল সাহেবের দেখাশোনা করেন। পরিবারটি, অন্তত রেজাউল সাহেব, তাঁর চাচার মতো অসাম্প্রদায়িকই রয়ে গেলেন। আমি বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাইলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর এবং বাসনপত্র দেখে অবাক হলাম। কেননা ছেলেরা এল্যুমিনিয়ামের ডেকচি কড়াই এমন পরিষ্কার রাখতে পারার কথা নয়। জানালেন রান্নার জন্য অন্য মহিলা আছে। আর তাঁর স্ত্রী যে ঘরে রাঁধতেন, সে ঘরটিও অবহেলায়, অযত্নে পড়ে নেই।

হঠাৎ রেজাউল করিম সাহেব আমাদের এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি জানতে চাইলেন এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করার পর আমাদের দেশে কীভাবে মৌলবাদের উত্থান হয়? উত্তর দেবার বিশেষ কিছু ছিল না। অথবা বলা ভালো সংক্ষেপে বলার মতো নয় বিষয়টি। তাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর তিনি তাঁর সহচরদের বললেন, আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাতে। সব বলতে নজরুল একাডেমি, লাইব্রেরি, নজরুল যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, তার ভগ্নাবশেষ, পারিবারিক গোরস্থান ইত্যাদি সব দেখিয়ে দিতে। তিনি এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবেন। ও হ্যাঁ, নজরুল একাডেমি-যেটি রেজাউল করিমের বড়ো ভাই প্রয়াত মোফাজ্জল ইসলাম সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে নেয়ায় তিনি খুশিই হয়েছেন।

‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি...’ কবির বিখ্যাত সেই ছবিতে সাজানো অফিস কক্ষ..

কেননা এটি চালিয়ে নেয়ার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর সন্তানদের এবং নজরুলের নাতি নাতনিদের এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ নেই। আমার মনে হয়েছিল কাজী রেজাউল করিম সাহেব স্বস্তিতে আছেন এই ভেবে যে নজরুল যথার্থভাবে বেঁচে থাকবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর একটি ব্যাপার অনেকক্ষণ থেকে আমার মাথায় পাক খাচ্ছিল নজরুলের বাড়ির সীমানা, একাডেমি, বিশাল লাইব্রেরি (যেখানে সতের হাজার বই রয়েছে, এটা পরে হয়েছে), কবরস্থান ইত্যাদি দেখে ভাবছিলাম কেন নজরুলকে বালক বয়েসে বাবাকে হারানোর পরে সংসার প্রতিপালনের জন্য রোজগার করতে যেতে হয়েছিল।

আরও পড়ুন: কবিতীর্থে একদিন

নয় বছর বয়েসে মক্তব শেষ করার পর ঐ মক্তবে ছোটো শিশুদের তিনি পড়াতেন। মসজিদে আযান দিতেন। যোগ দিলেন লেটো দলে। এটি অবশ্য একেবারে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল না আমার দৃষ্টিতে। কেননা ঐ সময়ে তাঁর সঙ্গীত প্রতিভা স্ফুরিত হয়। নজরুল নিজেই সংস্কৃত এবং অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণ করেন। স্কুলে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন। শিক্ষকরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় তাঁর থেকে ভালো রেজাল্ট আশা করেছিলেন। কিন্তু তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজায় নজরুল যুদ্ধ করতে চলে যান। আর স্কুলে ফিরে আসেননি।

আমার মনে হয় প্রকৃতিগত ভাবে নজরুল ছিলেন অতি চঞ্চল। ধরাবাঁধা জীবন যাপনে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন না। সৃষ্টির নেশা তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত। সংসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের মৃত্যুর পরে (প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের মাস কয়েক পরে মারা যান) তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বুলবুল কচিকন্ঠে অপূর্ব সুন্দর গাইতেন। নজরুলের ইচ্ছে ছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। সেই ইচ্ছায় বাধ সাধলেন স্বয়ং ঈশ্বর।১৯৩০ সালের মে মাসে বুলবুল না ফেরার দেশে চলে যান। বারো বছর পরে ১৯৪২ সাল হতে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল। লেখালেখি করার ক্ষমতা সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল ! বুলবুল মারা যাওয়ার পর কবি ছেলের স্মৃতিতে লিখেছিলেন ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি …’!

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেই বাবরি দোলানো ঝাঁকরা চুলের নজরুল ধীরে ধীরে অপস্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলেন। কবি বুঝতে পারেননি তিনিও ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।

কবি তাঁর ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছিলেন-
“অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
“হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!”

চিরকালের অসাম্প্রদায়িক নজরুল, যিনি সবসময় লড়াই করেছিলেন মানব ধর্মের জন্য; তিনি জানলেন না তাঁর দেশ বিভক্ত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই সম্প্রদায়ের লোক। এই বিভাজন নজরুল মেনে নিতে পারতেন না জেনেই বিধাতা হয়তো বা তাঁকে বহু আগে থেকেই বাকশক্তি রহিত করে রেখেছিলেন। কে জানে!

নজরুলের এই কথাগুলো আজকের বাংলাদেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক। যে স্বপ্ন আমাদের দেখিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের, সেটি ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক, যাঁর এক ডাকে মুক্তিকামী বাঙালি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। তবে এই দেশের মাটিতে মীরজাফরদের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদ, চার লক্ষাধিক মা-বোনের নৃশংস অত্যাচার নির্যাতন ঘটিয়েছিল এই দেশের মীরজাফররা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে। আর কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। দেশের এই অপশক্তিরা ঝাড়েবংশে বেড়ে চলেছে। একজন নজরুলের আবির্ভাব কী তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নকে, লড়াইকে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে? (সমাপ্ত) 

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

ফিউচার প্ল্যান



শরীফুল আলম। নিউইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ফিউচার প্ল্যান

ফিউচার প্ল্যান

  • Font increase
  • Font Decrease

কখনো কখনো সমুদ্রের কাছে গিয়ে আমি হারিয়ে যাই
কখনো শিল্পীর আঁকা ছবির কাছে
আমি স্নিগ্ধ আকাশের কাছে গিয়ে উড়িয়ে দেই
আমার সমস্ত বিষণ্ণতা
আমি মেঘের আস্তরে ঢেকে রাখি আমার সুখ , আমার মুখ
আমার সজিবতা ।

ঝিরিঝিরি বাতাসে ভেসে আস তুমি শেষ বিকেলে
অদ্ভুত সুখ তখনও বিরাজ করে এই আত্মায়
পলাতক শব্দ গুলো শিশিরের ন্যায়
আধো আধো প্রেমের ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে ।

একটা সুদীর্ঘ সময়ের সমাপ্তি করলে তুমি ,
সেই পুরনো রাত , পুরনো দিন
মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আস তুমি
অনেকটা জোনাকির ছলে ।

তুমি এক আলৌকিক আগুণ
তুমুল পোড়াও তুমি আমাকে
কখনো স্বপ্নের ভিতর
কখনো পিয়ানোর সানাই হয়ে
তুমি নিত্য পরিক্রমা এই মনে ,
তোমার ঠোসকা পড়া তেরছা কথা
"ডাকলেও আর আসবো না "
শুনতে বড় বেখাপ্পা লাগে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা তখন মনে পড়ে যায়
ঝড় , ঝঞ্ঝার কথা তখন মনে পড়ে যায়
প্রকৃত প্রস্তাবে তখন তোমার বিবর্তনের কথাই মনে পড়ে যায়
আর বিবর্তন মানে - আড়াল রাখতেই সে পছন্দ করে
ফাগুনে আগুণ লাগাতেই সে পছন্দ করে
তার সানগ্লাস তখন যেন থেমে যায় গ্ল্যালাক্সি ক্রসিংয়ে
আড়চোখ দেখে নেয় সব
বিলম্বিত লাবণি , ফিউচার প্ল্যান ।

;

কবিতীর্থে একদিন



অঞ্জনা দত্ত  
-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

-কবিগৃহের আদিরূপে সজ্জিত বাড়ি ও দেয়ালে অঙ্কিত তরুণ নজরুল। ছবি: লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি’ সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।/নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধূর ধূপ!’’

অনেক ছোটোবেলায় যখন এই কবিতাটি পড়ি তখন কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে পড়েছিলাম। সেদিনের সেই অনুভূতি আজও মনে আছে। কেননা কবি তখন বাকরহিত ছিলেন। সেই ছোটো বয়েসেও অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে, তিনি কীভাবে বুঝেছিলেন একদিন তাঁর এমন পরিণতি হবে? সত্যি বলতে আজও এর উত্তর খুঁজে পাইনি। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ দু’জনের ওপরেই ছিল সরস্বতীর আশীর্বাদ। সেই অর্থে তাঁদের ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। তবে ছিলেন স্বশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহ ছিল সংস্কৃতি চর্চায় পরিপূর্ণ। নজরুলও পিছিয়ে ছিলেন না। তাঁর চাচা বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় তাঁর দখল ছিল অপরিসীম। চাচার প্রভাবে নজরুল লেটো দলে যোগ দেন এবং অতি স্বল্প সময়ে তিনি নিজের প্রতিভায় অন্যদের মুগ্ধ করেন। কবিতীর্থ সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে জানাতে চাই কীভাবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার প্রোগ্রাম হলো ?

এই বছর জানুয়ারি মাসের শেষদিকে কলকাতায় এক বিয়ের প্রোগ্রামে যেতে হচ্ছিল। সবসময়কার মতো কোথাও যাওয়ার নামে ঢোলে বাড়ি বাজলে আমার মন নেচে উঠে। কিন্তু যতই যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে ততই মনে হয়, ধুর না গেলেই ভালো হতো। কিন্তু ততদিনে ‘পি কে ডি’র প্ল্যান পেকে টসটসে হয়ে উঠে। অর্থাৎ টিকেট কাটা, থাকা, গাড়ির ব্যবস্থা করা সব কমপ্লিট। অতএব ব্যাগ গোছাতে হয় হাঁড়িমুখে। তবে যখন চাকরিতে ছিলাম তখন বেড়ানোর কথা হলে মন ময়ূরের মতো নেচে উঠত। সেই সময়টায় ছুটি পেতে নানারকমের ঝঞ্ঝাট পোহাতে হতো। আদম সন্তান! সহজলভ্য জিনিসের চেয়ে যেটি পেতে অসুবিধে হবে সেদিক পানে মন ছুটে যেত। ‘পি কে ডি’ দেখল কলকাতায় শুধু বিয়ে খেতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এরসাথে আর কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারলে বেশ হতো। আমার তো কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছেই নেই। তাই আর কোথায় যেতে চায় সে বিষয়ে কোনো কৌতূহল ছিল না। জানি মোগলের হাতে যখন বাবা সঁপে দিয়েছেন, তখন খানাটা তার সাথেই খেতে হবে।

অন্য কথা শুরু করার আগে ‘পি কে ডি’র নামের অর্থটা জানিয়ে দেয়া উচিৎ বলে মনে করি। কেননা লেখালেখির প্রথম জীবনে পাঠকদের মধ্যে একধরনের ঔৎসুক্য থাকত এই নাম নিয়ে। পি কে ডি, প্রদীপ কুমার দত্ত, যার সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছি (‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’… তবে জানিয়ে রাখি এই গাঁটছড়ায় অন্য অনেক কিছুই আছে, সুর ছাড়া। কখন আপনারা আবার গান শোনার আবদার করে বসেন!)

তাঁর অন্যতম নেশা হলো বেড়ানো। অন্য স্ত্রীরা আনন্দে বাক বাকুম করত, সেখানে আমি মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখি, ঐ যে বললাম না সহজে পাওয়া জিনিসের কোনো মর্যাদা থাকে না! আর বাংলা পাঁচের সাথে অপ্রসন্ন চেহারার তুলনা যে কোন পণ্ডিত করেছেন জানি না। মানুষের চেহারা কখনও বাংলা পাঁচের মতো দেখাতে পারে, বলুন?

পি কে ডি ঠিক করলেন কলকাতার বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে দেওঘর, রামপুরহাট আর আসানসোল যাবে। দেওঘরের নাম আপনারা পড়েছেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে, যিনি তাঁর গল্পের কোনো চরিত্রের অসুখ করলেই হাওয়া বদলের জন্য দেওঘরে  পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যখনই শুনলাম ঐ সময়ে দেওঘরে ভালোই শীত থাকবে, মেজাজ সপ্তমে পৌঁছাতে মোটেই সময় নিল না। এর মাস দুয়েক পূর্বে নৈনিতাল এবং আশেপাশের হিমালয়ের অঞ্চলসমূহে বেড়িয়ে এমন ঠাণ্ডায় ভুগেছিলাম, এরপরেও শীতের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে! মেজাজ কেন খারাপ হবে না বলুন? কে জানে পি কে ডির মনে কী আছে? সাধারণত বলা হয়ে থাকে স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাই স্বাভাবিক। নারীদের হাতে ক্ষমতা থাকলে তাঁরা বলতেন পুরুষাণাং চরিত্রম দেবী ন জানন্তি, কুতো মনুষ্য! তবে আপনারা এইটি কোথাও ব্যবহার করবেন না। ইহা অধমার মস্তিষ্কপ্রসূত! দেওঘর হাওয়া বদল ছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য তীর্থস্থানও বটে। রামপুরহাটও তাই। আর আসানসোল? যখন জানাল চুরুলিয়ায় যাবে, অমনি মেজাজ পঞ্চমে নেমে এলো। আর দেওঘরের শীতের হাওয়া নাচতে শুরু করল আমলকির ডালে ডালে।

কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম, লেখক ও পি কে ডি (প্রদীপ কুমার দত্ত)। ছবি: লেখক

সত্যি বলতে কি চুরুলিয়ায় গিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পাবো সেটি ভাবিনি। ভেবেছিলাম আমাদের দুখু মিয়া তো সেই কবে থেকেই দুঃখের সাগরে ভাসছিলেন। তাঁর সাথে আমরাও ভাসছিলাম বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে। একজন মানুষ এক জীবনে এতটা কষ্ট পেতে পারেন? এমন একটা প্রতিভা এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল শুধুমাত্র সময় তাঁকে অবজ্ঞা করায়। তা না হলে আর কী বলা যেতে পারে? যদি নজরুল যুদ্ধের দামামার ভিতরে অসুস্থ না হয়ে আরও বছর কয়েক পরে অসুস্থ হতেন তাহলে হয়তো বা তাঁকে সুস্থ করা যেত। আর একেবারে তিনি যদি এই দুরারোগ্যে আক্রান্ত না হতেন, তা হলেই বা সংসারে কার কতটা ক্ষতি হতো? এই কথাগুলো অনেকের কাছে যেমন অর্থহীন মনে হবে, তেমনি অনেক নজরুলপ্রেমীর বুকের ভিতরটা চুরচুর করে ভেঙে পড়ে!

দেওঘর রামপুরহাটে দেবী দর্শন করে মনে হয় ভালোরকমের পূণ্য সঞ্চয় করেছিলাম। কেননা আসানসোল স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর এক সুবেশধারী ভদ্রলোক আমাদের নিতে এলেন ততোধিক ঝকঝকে জীপ নিয়ে। এই লিঙ্কগুলো পি কে ডির রোটারির কানেকশনে। রোটারিয়ান হওয়ার এই এক সুবিধে।  পৃথিবীর যে কোনো দেশে রোটারিয়ানরা ফেলোশিপের হাত বাড়িয়ে দেয়। পূর্ব পরিচিতির প্রয়োজন নেই। অভিষেক তেমন একজন রোটারিয়ান, যাকে তাঁর সিনিয়র একজন বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের এক রোটারিয়ান যাচ্ছেন তোমার শহরে। Help him with what he needs, ব্যস এটা তাঁর জন্য বেদবাক্য হয়ে গেল!

অভিষেক অবাঙালি। বাংলা বলতে পারেন। বয়েস বড়োজোর পয়ঁতাল্লিশ – পঞ্চাশের কাছাকাছি। বাবা মা দু’জনেই আছেন। বহু বছর ধরে তাঁরা আসানসোলে বসবাস করছেন। কিন্তু পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল শহর থেকে মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে চুরুলিয়া সম্পর্কে কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না। তবে চুরুলিয়ায় যাওয়ার জন্য নিজেদের একখানা গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পরদিন সকালে। ও হ্যাঁ, বলা হয়নি অভিষেক আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে আসানসোল ক্লাবে পৌঁছে দিল। নিজের কিছু কাজ সারতে চলে গেল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল ড্রাইভার এসে আমাদের নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে লাঞ্চ করার জন্য। তবে ঘন্টা দু’য়েক পরে নিজেই এসে হাজির ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। মা বাবা এবং অভিষেকের স্ত্রী সবাই অপরিচিত অতিথিদের সাথে বহুদিনের পরিচিতের ন্যায় আচরণ করলেন। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন।

লাঞ্চ সেরে পি কে ডি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন মাইথন বাঁধ (Maithon Dam) দেখতে যেতে চায়। আমার ভালো লাগত একটু যদি বিছানায় গড়িয়ে নেয়া যেত। কিন্তু বেড়াতে বের হলে এটি পি কে ডি’র অভিধানে থাকে না। তাঁর হলো কম সময়ে কত বেশি দেখা যায় অথবা কতবেশি জানা যায়? আমি নিতান্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার রক্তমাংসের মানুষ। সকালবেলায় ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে হয়েছিল। কাজেই রাতের ঘুমের কোটা যেটুকু অপূর্ণ ছিল, সেটুকু পুরিয়ে নিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু এত বছরে এইটুকু বুঝেছি সব ইচ্ছের কথা প্রকাশ করতে নেই। তাছাড়া অভিষেক ইতিমধ্যে ওদের ক্লাবের কয়েকজন রোটারিয়ানের সাথে কথা বলে সন্ধ্যেবেলায় একটা ফেলোশিপ মিটিং এর আয়োজন করেছে। রোটারিতে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা মিটিং হয়। অভিষেকদের মিটিং হয়ে গিয়েছিল। অভিষেক চাইছিল আমিও যেন মিটিং এ যাই। তাহলে ওর স্ত্রীও যাবে। অগত্যা।

অভিষেকদের একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম মাইথন বাঁধ দেখতে। কাপ্তাই বাঁধে যে স্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেটি দেখেও যখন পি কে ডির আশ মিটেনি তখন সাথে যেতেই হলো। তবে এই বাঁধটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্র হলো মাটির নিচে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এটিই প্রথম  ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ তৈরির স্থাপনা। এটি ষাট হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। ১৯৫৭ সালে উদ্বোধন হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। বিছানা তখন দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছে আয় আয় আমার কাছে আয়। সে ডাক কি উপেক্ষা করা যায় ? পাগল!

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য বিছানার সাথে মিতালি করা গেল না। মিটিং এ যাওয়ার জন্য উঠতে হলো। ড্রাইভার আমাদের সাথেই ছিল। হঠাৎ করে ডাকা মিটিং এ রোটারিয়ানদের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। বেশি ছিল আন্তরিকতা আমাদের প্রতি তাঁদের। দুই ক্লাবের পতাকা বিনিময় হলো। পি কে ডি তাঁর নিজের ক্লাব নিয়ে এবং দেশ নিয়ে কথা বলল। ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। ভারতের বাইরের দেশগুলোকেও অচ্ছ্যুত রাখল না। অনেক কথাই হয়েছিল। সাথে খাবার দাবার তো ছিলই। একসময় মিলনমেলা ভাঙলো। ফেরার পথে অভিষেক জানাল পরদিন সকালে আসানসোলে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। এতক্ষণ আপনারা ধান ভাঙতে শীবের গীত শুনেছেন। এবারে  মূল প্রসঙ্গে আসি। যে কারণে আসানসোল আসা।

কবির পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রের পাশে লেখক; যেখানে প্রমীলা নজরুলসহ স্বজনদের কবর রয়েছে।

লেখার শুরুতেই বুঝে নিয়েছেন বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি, দুঃখী মানুষদের কবি, ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য এতদূর আসা। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব ২১৩ কিলোমিটার। সড়কপথে বা রেলপথে যাওয়া যায়। আর আসানসোল থেকে চুরুলিয়া মাত্র কুড়ি কিলোমিটার দূরে। আমরা বাঙালিরা শান্তিনিকেতনে দৌড়ে যেতে (বারণ করছি না যেতে) যত পছন্দ করি, ততোটা কি চুরুলিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবি ? নজরুল জীবিত থাকা অবস্থায় ছিলেন অবহেলিত, অসুস্থ অবস্থায়, ঢাকায় আসার আগে কেমন ছিলেন জানা নেই, তবে মৃত্যুর পরে যে আমাদের স্মৃতিতে ধুলো বালি জমতে শুরু করেছে সে নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

অভিষেক জানিয়েছিল আসানসোল শহর থেকে অদূরে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওখনে হয়তো বা কোনো তথ্য পেতে পারি। রওনা দিলাম সেদিকে। যেহেতু পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে এসেছি উপাচার্য মহাশয়ের সাথে দেখা করতে তাই জায়গায় জায়গায় এখানে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছিল। অবশেষে উপাচার্য মহাশয়ের কক্ষে ডাক পড়ল। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে  প্রীত হলেন মনে হলো। তাঁর মামাবাড়ি একসময় চট্টগ্রামে ছিল। তাঁকে চট্টগ্রামে  আমাদের অতিথি হয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানালাম। চুরুলিয়ায় যেতে চাই শুনে তিনি আরও উৎসাহিত বোধ করলেন। সাথে সাথে তাঁর ইউনিভার্সিটিতে যিনি  নজরুল সক্রান্ত কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। জানা  গেল তিনি সেদিন , অন্তত তখনও এসে পৌঁছাননি। অন্য আর একজনকে খবর পাঠিয়ে আনালেন। তাঁকে আমাদের পরিচয় জানিয়ে বললেন কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তাঁদের যে মিউজিয়াম রয়েছে তার কার্যক্রম দেখাতে। তবে নতুন একটি মিউজিয়াম নির্মাণের পথে।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল চুরুলিয়ায়। তবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্য সরকার (সি পি এম) এটি আসানসোলে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা ভেবেছিলেন চুরুলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে ওখানে ছাত্র সংখ্যা খুব বেশি হবে না। তাছাড়া ছাত্রদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ অনেক বেড়ে যাবে। এখনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন /চার সহস্রাধিক ছাত্র ছাত্রী পড়ছে। বাইশটি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। চুরুলিয়ায় গিয়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। উপাচার্য মহাশয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার আগে তাঁর সাথে ছবি তুলে নিলাম। ঐ সময়ে তাঁর সেলফোনে রিং বেজে ওঠায় অভদ্রতা হলেও ফোনের স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল। দেখতে পেলাম ‘সোনালী কাজী ইজ কলিং’। কথা সেরে স্যার জানালেন নজরুলের নাতনি ফোন করেছিলেন। মনে মনে বললাম ও আমার দেখে নিয়েছি! যদিও সোনালীর নাম আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ে না। (ক্রমশ…)

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;