স্মৃতিমেঘে কিশোরগঞ্জের শাহ আজিজুল হক



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক

  • Font increase
  • Font Decrease

পটভূমি

ঘটনাক্রমে ২০২২ সালের ১৬ থেকে ২০ মে আমাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে জরুরি কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। সে সময় অসুস্থ অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে সাবেক পিজি হাসপাতাল ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিছুদিন আগেই তাঁকে দেখে এসে মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর জানান। আমরা আশায় ছিলাম যে, তিনি সুস্থ হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসবেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি এসেছেন জেনে আমি দ্বিতলে ছুটে যাই। কিন্তু তিনি তখন আইসিও’র ঘেরাটোপে আবদ্ধ এবং সাক্ষাৎ দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করেও আশার বাণী শুনতে পাই নি। গভীর বেদনা নিয়ে আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসি।

১০ মে তাঁর জন্মদিন ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুদিনও উপস্থিত হয়। ২৬ মে (২০২২) দুপুর দেড়টার দিকে কিশোরগঞ্জ নিউজের প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ফোনে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানান। আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হই যে, ঘণ্টাখানেক আগে তিনি পরলোকে যাত্রা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বজন হারানোর ব্যথায় আক্রান্ত হই। কমপক্ষে চল্লিশ বছরের সম্পর্কসূত্রে খন্ড খন্ড স্মৃতিমেঘ আমাকে আচ্ছন্ন করে। মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখা অনন্য মানুষটি শ্রমিক আন্দোলনের মহান মে মাসেই নিজের জন্ম ও মৃত্যুদিনের চিহ্ন অঙ্কন করে চিরদিনের মতো চলে গেলেন।

শৈশবে আশি দশকের শুরুতে একমাথা চুলের বিপ্লবী শাহ আজিজুল হককে দেখেছি কিশোরগঞ্জ শহরের গৌরাঙ্গ বাজারে আমাদের বাসার পাশে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে। একটি ইয়ামাহা মোটর সাইকেলে তিনি তখন পুরো কিশোরগঞ্জ চষে গণআন্দোলন সংগঠিত করতেন। আমরা চা খেতে খেতে সেসব গল্প শুনেছি। তাঁর কাব্য গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে জড়িত থেকেছি। আরও পরে তিনি খড়মপট্টিতে ঢেরা তৈরি করেন। সেখানেও আড্ডায় মেতেছি। তারপর স্থায়ীভাবে আবাসন তৈরি করলে সেখানে বিকাল, সন্ধ্যা, রাত অবধি আড্ডা, আলাপে অতিবাহিত করেছি। ততদিনে আমি কর্মসূত্রে কিশোরগঞ্জের বাইরে অবস্থানকালে যখনই জন্মশহরে এসেছি, আবশ্যিকভাবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। কখনও আলাপে আলাপে রাতও কাটিয়েছি তাঁর বাসায়। বিকালে হাঁটতে গিয়েছি পাট গবেষণরার খোলা প্রাঙ্গণে। কখনও সারাদিনের জন্য তাঁর সঙ্গে চলে গিয়েছি তাঁদের গ্রামের বাড়িতে, তাঁর কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে কিংবা কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।

আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপে যে আনন্দ ও অনুভূতি অর্জিত হয়েছে, তা মফস্বল শহরে বিরল। সৃষ্টিশীল কাজে ও মননশীলতায় তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল সবসময়। কিশোরগঞ্জের শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস বিষয়ক ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত সম্মাননা বক্তৃতা এবং অন্যান্য সকল অনুষ্ঠান ও আয়োজনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের মেধাঋদ্ধ রাজনীতি, গতিশীল সামাজিক তৎপরতা, বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষের মতো। সমকালীন কিশোরগঞ্জের প্রতিনিধিত্বশীল উজ্জ্বল মুখচ্ছবি তিনি। একটি শহরকে নান্দনিক আঙিকে যেসব ব্যক্তিত্ব প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁর শূন্যতা সহজে পূর্ণ হবে না। কিশোরগঞ্জের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রূপে বর্তমান ও অনাগতকালে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

১.
২০১৫ সালে কিশোরগঞ্জের সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা’র প্রবর্তন ও সূচনার ধারাবাহিকতায় ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস: নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হক’ শীর্ষক ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা ২০২০ প্রদান করা হয়। অতীতের মতোই কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-নাগরিক কর্মকান্ডের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’ সর্বসম্মতভাবে উদ্যমী, নিবেদিতপ্রাণ, বুদ্ধিদীপ্ত আইনজ্ঞদের সংবর্ধিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা’ ২০১৫ সালে শুরু হয়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সুতীব্র প্রকোপের মধ্যেও অব্যাহত ধারায় চলমান থাকা নিঃসন্দেহে উৎসাহজনক ঘটনা। তবে করোনাকালে আমরা ১ম ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০১৫’ প্রাপ্ত প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী এবং ৬ষ্ঠ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০’ প্রাপ্ত অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে হারিয়েছি, তাঁরা ছিলেন সমকালীন কিশোরগঞ্জের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১ম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০১৫ প্রাপ্ত ‘আলোর পথের যাত্রী শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক প্রাণেশকুমার চৌধুরী গত ২৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে পরলোকগমন করেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। করোনাকালে তাঁর মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক ও সম্মিলিতভাবে শোক প্রকাশের সুযোগ সীমিত ছিল। ফলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শোকবাণী প্রদান এবং আমার নিজের একটি নাতিদীর্ঘ শ্রদ্ধামূলক নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা তার জীবন ও কীর্তিকে স্মরণ করেছি, যা প্রকাশিত হয়। ৬ষ্ঠ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০’ প্রাপ্ত ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস’-এর বিশিষ্টজন অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে আমরা হারিয়েছি ২৬ মে ২০২২ সালে। তাঁর মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে ফাউন্ডেশন শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং তাঁর জীবন র্কীতিকে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার্থে পুস্তিকাকারে প্রকাশ ও প্রচার ব্যবস্থারও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, কিশোরগঞ্জের আইন পেশার ঐতিহ্য শতাধিক বছরের প্রাচীন এবং তা ঐতিহাসিক গৌরবে ভূষিত। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের আইন পেশায় একে ব্রোহি, রামজেট মালানি, পালকিওয়ালা, স্নেহাংশু আচার্য্য, ইশতিয়াক আহমেদ এবং রফিক-উল হকের মতো কীর্তিমানদের দেখা পাওয়া গেছে। কিশোরগঞ্জের আইন পেশাতেও অনেকেই ছিলেন বা আছেন, মফস্বলে অবস্থানের কারণে যাদের মেধা, মনন, দক্ষতার উপযুক্ত মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয় নি। অথচ তাঁরা পেশার উজ্জ্বলতার পাশাপাশি সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও রাজনীতিতে বহুমাত্রিক অবদান রেখে স্থানীয় সমাজ প্রগতিকে বেগবান করছেন। আমার লিখিত সম্মাননা বক্তৃতায় কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস ও অর্জনের ইতিহাসটুক তুলে আনার চেষ্টা করা হয় তিনজন সমকালীন-অনন্য ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হককে সামনে রেখে।

২.
সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, বিগত ষাট, সত্তর, আশি দশকের কিশোরগঞ্জ যখন মহকুমা ছিল, তখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখরিত করার মতো পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল অত্যল্প। মূলত এবং একমাত্র স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল। কারণ, তখন মহকুমায় ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন দুই-তিন জন মাত্র। যাদের মধ্যে ছিলেন এসডিও (মহকুমা প্রশাসক বা সাবডিভিশনার অফিসার), এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ প্রশাসক), সিও (সার্কেল অফিসার) এবং এক-দুই জন ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে প্রশাসনিক দিক থেকে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের দায়িত্ব পালনের মতো প্রচুর সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন না তখনকার কিশোরগঞ্জে, যা এখন রয়েছে।

অন্যান্য পেশাজীবী, যেমন চিকিৎসকের সংখ্যাও ছিল কম। প্রথম এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. এ. এ. মাজহারুল হক পঞ্চাশের দশকে কিশোরগঞ্জে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেরণায় বাঙালির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হয়ে মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন এবং দলের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তখন মহকুমা ও আশেপাশের অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুদয়াল কলেজ ও এর শিক্ষকম-লীকেই সকল সামাজিক-সাংস্কৃকি কাজের সামনের কাতারে দেখা গেছে। অতএব, কিশোরগঞ্জের বাস্তবতা ছিল এই যে, মহকুমার সামগ্রিক তৎপরতায় সেসময় বেশ কয়েকজন আইনজীবী অংশ নেন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, খেলাধুলার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাম্প্রতিক অতীত ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায় যে, নিজের পেশার বাইরে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী অগ্রণী আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন হেমেন্দ্রচন্দ্র রায়, আবদুস সাত্তার (এমএনএ ও আওয়ামী লীগের সহাপতি), আবদুর রশীদ (পৌরসভার চেয়ারম্যান), মুস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া, (এমএনএন ও আওয়ামী লীগ নেতা), আবদুল আলী মেনু মিয়া, মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া (পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সাংসদ), মোহাম্মদ আবদুল হামিদ (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) সমরেশ চন্দ্র রায়, লতিফুর রহমান খান মরু প্রমুখ।

বলা বাহুল্য, শতবর্ষের অধিক প্রাচীনত্বের অধিকারী কিশোরগঞ্জ আইনজীবী সমিতি দেশের রাষ্ট্রপতিসহ আইন পেশা ও সামাজিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ বহুজনকে উপহার দিয়েছে। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতাকালে আশি দশকে আইনজীবী সমিতির শতবর্ষ উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় অংশ গ্রহণের স্মৃতি থেকে সেসব কথা জানার সুযোগ আমার হয়েছে। উৎসবকালে সমিতির সম্পাদক ছিলেন লতিফুর রহমান খান মরু ভাই, যিনি অগ্রণী ছাত্রনেতা ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সমিতির একটি মূল্যবান স্মরণিকায়ও বহু তথ্য রয়েছে।

৩.
কিশোরগঞ্জের স্থানীয় সুধীজন ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইনজীবীগণ। যার বাস্তব প্রমাণ শৈশবে আমরা লক্ষ্য করেছি। শহর তখন এতোটা বড় হয় নি এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিক বলতে কয়েকজন আইনজীবীর নাম আমাদের কানে আসতো। তাঁদের অনেকে সে সময়েই প্রয়াত হলেও তাঁদের নাম লোকমুখে প্রচারিত হতো এবং শহরের বিভিন্ন স্থানের নিদের্শনা দিতে তাঁদের বাড়িকে ল্যা-মার্ক ধরা হতো। যেমন, এমাদ মিয়া মোক্তার, শাবান আলী মোক্তার, বোরহান মোক্তার, মেনু মিয়া মোক্তার ছিলেন অন্যতম। পরবর্তীতে মোক্তারশিপ আর ছিল না এবং সকলেই অ্যাডভোকেট নামে পরিচিত হন। যাদের নাম শৈশবে শুনেছি, তাঁদের অনেকেই লোকান্তরিত হলেও মৃত্যুর ২০/৩০ বছর পরেও চর্চিত হতেন। আমার নিজের শৈশবেও আইনজীবীদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতাপ স্বচক্ষে চাক্ষুষ করেছি। আমার পিতা ডা. এএ মাজহারুল হক আওয়ামী লীগের নেতা ও সর্বজনমান্য চিকিৎসক হিসেবে এদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বকালে ও পরবর্তীতে পিতার গৌরাঙ্গ বাজারের চেম্বার আওয়ামী লীগের অলিখিত কার্যালয় রূপে পরিগণিত ছিল। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু মিয়া, বোরহান উদ্দিন আহমেদ, শহর আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল ওয়াদুদ খোন্দকার সমবেত হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। কিশোরগঞ্জ এলে বর্ষীয়ান জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার পিতার চেম্বারে আসতেন এবং ফোনে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। চিকিৎসক হিসাবে তখন আমার পিতার টিএনটি ফোন ছিল। আর কোনও নাগরিক বা আওয়ামী লীগ নেতার ফোন সংযোগ পাকিস্তান আমলে ছিল না। শহরে মোট ফোনই ছিল মাত্র কয়েকটি। ফলে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসে এই ফোন নম্বরটি পরিচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা এই ফোনে আমার পিতার কাছে আসে ও তিনি সেটা কিশোরগঞ্জে প্রচারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।

৪.
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের একটি অন্যতম সামাজিক উপাদান হিসাবে এইসব ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা ও অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং কিশোরগঞ্জের স্থানীয় ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ কালপর্বের উজ্জ্বল অংশ। দুঃখজনক বিষয় হলো, স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এইসব সামাজিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বকে নথিভুক্ত করার যোগ্যতা কেউ দেখাতে পারেন নি। অধিকাংশই পূর্বে প্রকাশিত প্রাচীন আমলের সেকেন্ডারি তথ্যকে পুনরায় উপস্থাপনের নকলনবিশি করেছেন। সামাজিক গতিশীলতার প্রপঞ্চগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে না পারায় কিশোরগঞ্জের সামাজিক বিকাশ ও আধুনিক বিনির্মাণের ধারা সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ-ফলিত তথ্যাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে।

কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন, অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার ছিলেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষানুরাগী। গুরুদয়াল কলেজ ছাড়া যখন পুরো অঞ্চলে কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তা এই আইনজীবী-রাজনীতিবিদ কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাকালেই প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু বেদনাদায়ক হলেও কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে জনহিতমূলক কাজে আত্মনিবেদনের উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত স্বরূপ।

হেমেন্দ্রচন্দ্র রায় ছয় দশকের বেশি সময়কাল কিশোরগঞ্জে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। একাদিক্রমে তিনি সমিতির বহুবারের সভাপতি ছাড়াও বহু নবীন আইনজীবীর সিনিয়র রূপে ভূমিকা পালন করেন। তারাপাশা-নিউটাউন নিবাসী আবদুর রশীদ স্বাধীন-পূর্ব ও পরবর্তীকালে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। তদুপরি আইন পেশায় আগমনের পূর্বে তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

বোরহান উদ্দিন ছিলেন কিশোরগঞ্জের নগরায়নের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ষাট ও সত্তর দশকে অনেকগুলো পাকা বাড়ি নির্মাণ করে তিনি আধুনিক আবাসিক সুবিধা বিস্তারে ব্রতী হন। তখনকার কিশোরগঞ্জ শহরে সর্বজনাব বোরহান মোক্তার, মেনু হাজি, হাজি মলু মিয়া প্রমুখের একাধিক মানসম্পন্ন বাসা-বাড়ি ছিল ভাড়া দেওয়া জন্য। নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য হলেও স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিঃসন্তান সমরেশ রায় পরহিত ও দানশীলতার অন্যন্য নজির রেখেছেন, যা কিশোরগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতিতে প্রদত্ত অনুদান ও ইটনায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিভাত। হয়ত এই তালিকায় আরো অনেকের নাম আসতে পারে, হয়ত অনেকের অনেক কৃতিত্ব সেভাবে প্রকাশও পায় নি।

৫.
বস্তুতপক্ষে নিজের পেশাগত সাফল্যের বাইরে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অবস্থানে থেকে নানামুখী উন্নয়নে ভূমিকা পালন করার যোগ্যতা একজন মানুষের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও কর্ম-কৃতিত্বের স্মারক। আইনজীবী সমাজের বিশ্লেষণে সমকালের নিরিখে তিনজন আইনজীবীকে সম্মাননা জ্ঞাপন করার কারণ এই যে, তাঁরা তাঁদের জীবনব্যাপী কাজের মাধ্যমে তাঁদের স্ব স্ব পেশাক্ষেত্রকে আলোকিত করার পাশাপাশি সমাজ প্রগতি, সাংস্কৃতিক গতিশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের সারথি হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে, যা ব্যক্তিগত পরিধি ছাড়িয়ে সামাজিক কাঠামোতে বিস্তৃত হয়ে ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছে এবং এদের মধ্যে শতবর্ষ প্রাচীন আইনজীবী সমাজের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহনের কৃতিত্ব দেখা গেছে।

ঐতিহাসিক পর্যালোচনার নিরিখে বলা যায়, কিশোরগঞ্জের আইন পেশার বহুমাত্রিক, বর্ণময় কাঠামোটি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। বরং সহস্র বর্ষের প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং শতাব্দী প্রাচীন আইনজীবী সমাজের উত্তরাধিকারের সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি, যার ভিত্তিতে বিনির্মিত হয়েছে সমকালের নান্দনিক পাটাতন। এই ঐতিহাসিক গৌরবের কথাগুলো বিবেচনায় রেখেই আমরা সাম্প্রতিক সময়ের আইন পেশা ও এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের জীবন ও কর্মের পর্যালোচনা করতে পারি। তদুপরি, সাম্প্রতিক কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস সৃজিত হয়েছে যে তিনজন কীর্তিমানের মাধ্যমে, আমাদের সামাজিক ইতিহাসের গতিশীলতার প্রয়োজনেই তা শনাক্ত করা অপরিহার্য্য। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে তাঁদের প্রসঙ্গে আলোচনা ও বিশ্লেষণকালে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক ইতিহাস ও স্মৃতি প্রায়শই ঝাপসা ও অস্পষ্ট অবয়বে উপস্থাপিত হয়। কোনও কোনও ব্যক্তি, বিশেষ কিছু মানুষ ও ঘটনার কথা স্মৃতিচারণে উল্লেখ করতে পারলেও সুগ্রন্থিত ইতিহাস বা লিপিবদ্ধ তথ্য আকারে সেসব পাওয়ার আশা করা যায় না। এতে প্রবহমান ইতিহাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনার তাৎপর্য ক্রমে ক্রমে চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং ইতিহাসের বহুমাত্রিকতাকে ক্ষুন্নকারী। এহেন ধারা চলতে থাকলে আমাদের জীবনের চারপাশে পুঞ্জিভূত মানুষ, তাঁদের কৃতিত্ব এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে সঞ্চারিত বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোও হারিয়ে যাবে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, স্থানীয় ইতিহাস চর্চাকারীরা সামাজিক প্রপঞ্চগুলো সংগ্রহ করার বদলে প্রাচীন বা প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত নাড়াচাড়া করার নকলনবিশ চরিত্র ও কেরানি মানসিকতা থেকে বের হতে না পারায় পরিস্থিতির উন্নতি হয় নি। এমনকি, অসৎ-মতলববাজদের হাতে ইতিহাসের কোনো কোনো ইস্যু বিকৃতি প্রাপ্ত হয়। কারণ, ইতিহাস সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে চিহ্নিত ও লিখিত না হলে সমাজ প্রগতির সত্যনিষ্ঠ অবয়বটি আমাদের সামনে অস্পষ্ট হতে বাধ্য। তখন নানা উপকথা ও আরোপিত বিষয় ইতিহাসের নামে জঞ্জাল তৈরি করে, যা বাস্তবতা ও সততার সম্পূর্ণ বিপরীতি। একটি জনপদ যে বহু মানুষের কীর্তি ও কর্মের আলোকমালায় দ্যুতিময় হয়, সেই বাস্তবতাটিও তখন অস্পষ্ট হয়ে সামাজিক কৃতিত্বের গৌরবসমূহ চাপা পড়ে যায়। এতে ঐতিহ্য বিনির্মাণের ধারায় ছেদ ঘটে ও ইতিহাস দিকভ্রান্ত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অতীতের দিকে তাকিয়ে দিশা পায় না। ফলে আজকের ইতিবৃত্ত শুধু যে ইতিহাসের অংশ, তা-ই নয়, বরং ইতিহাসের পরম্পরার সূত্রে অনাগত ভবিষ্যতকালের পথের দিশাও বটে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণেও এ বিষয়টি আমি আলোচনায় আনা জরুরি মনে করেছি এবং ২০১৫ সাল থেকে কিশোরগঞ্জের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ক সম্মাননা বক্তৃতার ধারাবাহিক চর্চার একটি বিষয় জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমকালীন কিশোরগঞ্জ শহরের অগ্রণী প্রজন্মের অনেকেই জাগতিক জীবন শেষ করে চির বিদায়ের পথে চলে যাচ্ছেন। অথচ এদের জীবদ্দশায় তাঁদের সমকালীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ ও মূল্যায়ন করা এবং তাঁদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতাবাদী তথ্য-উপাত্ত জ্ঞাত হওয়া স্থানীয় ইতিহাসচর্চার অমূল্য উপকরণের শামিল। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি উত্তর-প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ বা বক্তব্য আকারে রেখে গেলে সাধারণভাবে আইন পেশার পরম্পরায়, বিশেষভাবে কিশোরগঞ্জের নাগরিক সমাজ ও সামাজিক ইতিহাসচর্চায় পরিপূর্ণ কাঠামো প্রভুতভাবে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হবে। এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে অনাগত ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের সামনে কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সংরক্ষিত রাখার কথা বিবেচনা করে ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর সম্মাননা ২০২২ জ্ঞাপন করা হয় সর্বজনাব নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হককে।

৬.
মাজহারুন-নূর সম্মাননাপ্রাপ্ত তিন সিনিয়র আইনজীবীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিসত্ত্বায় কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও ঐতিহ্যিক পরম্পরায় গুণগত ও কৃতিত্বপূর্ণ জায়গাগুলো বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য। তিনজনই মোটের উপর তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত প্রজন্মের প্রতিনিধি। একজনের বিকাশ ষাট দশকের শেষে। আরেক জনের সত্তর দশকে এবং অন্যজন আশির দশকে। তিনজনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজ প্রগতিপন্থী। আবার আশ্চর্যজনকভাবে, তিনজনের প্রত্যেকেই স্বনির্মিত ব্যক্তিত্ব, ইংরেজিতে যাকে ‘সেলফ মেড’ বলা হয়। জীবনে তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, পেশাগত ইত্যাদি যাবতীয় অর্জন বা প্রাপ্তি, পরিবার বা বংশের বরাতে কিংবা পৃষ্ঠপোষকের দানে প্রাপ্ত নয়, সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব চর্চা, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে লব্ধ। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতে পরিবার, বংশ ও পরম্পরার অচলায়তন ভেঙে রেনেসাঁসের মানুষ যেভাবে বিকশিত হয়েছিলেন আলোকায়িত ইউরোপে কিংবা ঊনিশ শতকের বঙ্গদেশে, আলোচ্য তিনজনের আত্মপ্রতিষ্ঠা তেমনি শ্রমসাধ্য ও মেধাবী অর্জনের পথে আত্মজাগরণের বার্তাবহ।

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বাংলার জাগরণ যেমনভাবে আঞ্চলিকতা (কলকাতাকেন্দ্রীক) বা ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল, কিশোরগঞ্জের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায় নি। ‘রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্বান পূজিত হন সর্বত্র’. চাণক্যের নামে প্রচলিত এই লোককথার তাৎপর্য আর কেউ না বুঝলেও বাঙালিরা অন্তত মর্মে মর্মে বোঝেন। বাংলার বাইরে, সমগ্র উপমহাদেশে, বাঙালিরা ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ‘বাবু’ ও ‘বিদ্বান’ বলে পরিচিত ছিলেন। তবে বিনয় ঘোষের ভাষায়, ‘এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান ট্র্যাজিডি হলো, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায়-সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করলো এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত।’ কিন্তু ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক বিভাজনে দেশভাগের ক্ষত মুছে স্বাধীনতাকামী পূর্ব বাংলা এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশস্থ কিশোরগঞ্জের পটভূমিতে এই তিনজনের উত্থান সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, আঞ্চলিকতামুক্ত ও পেশাগত নৈপূণ্যের মাধ্যমে স্বোপার্জিত আবহে সাধিত, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অগ্রগতির চিহ্নবাহী এবং কিশোরগঞ্জের অপরূপ সামাজিক গতিশীলতার নিদর্শন স্বরূপ প্রতিভাত হয়েছে, যাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক জাগতিক জীবনের সীমানা পেরিয়ে আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন এবং রেখে গেছেন কর্ম ও কীর্তির অম্লান স্মৃতি।

৭.
কিশোরগঞ্জের শহরতলীর একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষিভিত্তিক পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তীব্র গতিতে বেরিয়ে এসে শাহ আজিজুল হক তাবৎ পৃথিবীকে একটি আনন্দ ও সংগ্রামময় পাঠশালার মতো পঠন ও পাঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেন। জীবনকে বাস্তবের রসায়নে জারিত করে তিনি অর্জন করেন ফলিত অভিজ্ঞান। পথ চলেছেন তিনি আবেগ ও যুক্তির সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে। জীবনের রূঢ়-কঠিন রণাঙ্গণ আর প্রকৃতির লীলায়িত ক্ষেত্র তাঁকে দিয়েছে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানবিকতার দীক্ষা। ‘অতএব কারণে’ তার জীবনের অভিমুখ হয়েছে বহুমাত্রিক ও অসীমান্তিক। তিনি নিবিড়ভাবে মাটি. মানুষ ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ধারাবাহিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণকারী রূপে মিশেছেন। জড়িয়েছেন লোকজ সংস্কৃতি, চিরায়ত সাহিত্য, সমাজ বীক্ষণ ও শ্রেণিভিত্তিক চৈতন্য জাগরণী রাজনীতিতে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়, মানুষের জন্য শিল্প’ ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মর্মকথায় তিনি অবস্থান করেছেন শ্বাশত বাংলার অন্তরাত্মায়। গজদন্ত মিনারকে তুচ্ছ করে এবং গতানুগতিক-প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসকে উপেক্ষা করে তিনি আলিঙ্গন করেছেন বিশ্বসাহিত্য ও স্বদেশের সুমৃত্তিকাকে এবং এরই ভিত্তিতে রাজনীতি, কাব্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা করেছেন, সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হয়েছেন। এবং পরিশেষে রাজনীতি ও আইন পেশায় নিজেকে স্থিত করলেও অন্যান্য কর্মকা- থেকে তিনি হাত গুটিয়ে নেন নি। আধুনিক বিশেষায়িত যুগে একটি পেশায় সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনই যখন কঠিনতম, তখন তাঁকে দেখা যায় অনেকগুলো পেশায় সচল ও সফল। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বহুমুখী কৃতিত্বশীল মানুষ বিরল। অন্তত কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে দ্বিতীয় আরেকজন নেই, যিনি একাধারে রাজনীতি, আইনপেশা, সাংবাদিকতা, কাব্যচর্চা, সাহিত্য সাধনা, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি যাবতীয় নন্দনকলায় সমান সরব ও সফল। প্রাচীন, ধ্রপদী, গ্রিক বিদ্যাচর্চার সংলাপ-নির্ভর জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির ট্র্যাডিশনাল পথের সঙ্গে আধুনিক জীবনবোধের মিলিত পথে তিনি ছিলেন আজীবনের যাত্রী।

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক ছয় বার কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হওয়া অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৃতিত্ব শতবর্ষাধিক প্রাচীন কিশোরগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ক্ষেত্রেই বিরল রেকর্ড নয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। বিশেষত মফঃস্বলের মতো ক্ষুদ্র গ-িতে রেষারেষি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে এবং যেখানে সুযোগের চেয়ে প্রার্থী অধিক, সেখানে সকলের মধ্যে বছরের পর বছর আস্থা, সমর্থন ও সম্মতিতে বার বার বিপুল ভোটে জয়লাভ করা অসামান্য বিষয়। কিন্তু আইনজীবী সমাজের রাজনীতিতে প্রবাদপ্রতীক সাফল্য তাঁর বহুমাত্রিক সফলতার মাত্র একটি দিক। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুবক্তা ও সুলেখক। একজন প্রযুক্তি-নির্ভর অগ্রসর-আধুনিক মননের অধিকারী মানুষ তিনি। শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি দিয়ে শুরু করে তিনি জীবনের সকল পর্যায়ে অচিন্তনীয় সাংগঠনিক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। শুরুতে ক্ষেতমজুর ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বার্থে তাঁকে চারণের মতো গ্রাম-গঞ্জে-জনপদে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে জেলার অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে পরিণত হয়েছেন। যখন যেখানে থেকেছেন, সেখানেই সর্বোচ্চ অবদান রেখে শীর্ষতম স্থানে নিজেকে উত্তীর্ণ করার অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। মূলত একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী হলেও তাঁর জীবন ও কর্মের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সাহিত্য সাধনা ও সাংস্কৃতিক অনন্যতার নানামুখী প্রচেষ্টা। মনোদার্শনিক উচ্চতায় তিনি জীবন ও কর্মকে একটি সুস্নিগ্ধ আবহে পরিচালিত করেছেন সর্বদা। প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থ, যা কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে কম রাজনীতিবিদ বা আইনজীবীর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

নব্বই দশকের শেষ দিকে আমি যখন গবেষণার ছুটিতে ঢাকায় অবস্থানকালে আশি দশক থেকে আমার অতীত সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার কারণে কিংবদন্তী সম্পাদক তোয়াব খানের আমন্ত্রণে দৈনিক জনকণ্ঠ-এ বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি, তখন তিনি জনকণ্ঠে কিশোরগঞ্জের প্রতিনিধি হয়ে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি অনেকগুলো টিভি ও মিডিয়ার সঙ্গেও জড়িত হন। সাংবাদিকতায় তাঁর সাহসী ও আপোসহীন মনোভাব এবং বেশ কিছু আলোচিত রিপোর্টিং দেখে প্রায়শই আমি আশি দশকের শুরুর দিকে কিশোরগঞ্জে আমার সাংবাদিকতার পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছি।

গণমানুষের প্রতি নিবেদিত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক তৃষ্ণা ও দার্শনিক প্রেরণা তাঁকে পেশার বাইরেও আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে টেনে নিয়েছে সব সময়। সর্বত্রই তিনি সত্য, সুন্দর ও মানুষের জয়গানে মুখরিত হয়েছেন। একজন কুসংস্কারমুক্ত, উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষক, গণতান্ত্রিক মতাদর্শের দীক্ষায় তিনি চেয়েছেন মানুষের সাংস্কৃতিক মানের এবং রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়গুলোকে পরিশুদ্ধ ও ঋদ্ধ করতে। নিজের সুললিত বচনের সুপ্রযুক্ত বাক্যাবলী দিয়ে কিশোরগঞ্জের মানুষকে সন্মোহিত করার যে দুর্লভ যোগ্যতা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা কিশোরগঞ্জের সমকালীন ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এমন মোহনীয় ও অদৃষ্টপূর্ব যোগ্যতা কারো কারো মধ্যে বহু বহু বছর পর পরিদৃষ্ট হয়। নিজের সামগ্রিক কৃতিত্ব ও যোগ্যতাকে তিনি মোটেও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেন নি। পরবর্তী প্রজন্ম ও অনুসারীদের মধ্যে প্রবহমান করতে নিরত ও সচেষ্ট রয়েছেন। তিনি পরিণত হয়েছে বৃহত্তর আওয়ামী লীগ পরিবারের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীদের সর্বক্ষণের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সুখে-দুখে-বিপদে-আপদে সকলের পাশে ছুটে যাওয়ার একটি বিশ্বস্ত নাম হয়ে বিরাজ করেছেন তিনি কিশোরগঞ্জের মানুষের কাছে। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে নারীনেত্রী, শিল্প উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে নিয়ে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক কিশোরগঞ্জে শিল্পিত ভুবনের বাসিন্দা থেকে এখন আরেক অদেখা জগতের অধিবাসী। তাঁর অনুপস্থিতি ও অবর্তমানেও চলনে, বচনে ও যাপনে তাঁর বিশিষ্টতা সদা-দৃশ্যমান। কর্ম ও কীর্তির পরিস্ফূট বিন্যাসে তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে যে অভিজ্ঞতা ও অর্জন সঞ্চয় করেছেন ও মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন, তা এক জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ, যা তাঁকে বিত্ত, বৈভবের পাশাপাশি সুগভীর বোধের সমুদ্র-সমান বিশালতায় অভিষিক্ত করেছে।

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হকের সাফল্যের পেছনে শ্রম, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা ও ত্যাগের সূচক যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বুদ্ধি, মেধা, দক্ষতা ও কুশলার ছাপ। সঙ্কুল জীবনপথের নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সাফল্যের মোহনার সন্ধান পাওয়া এ কারণেই তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তদুপরি এরা সকলেই ওমনিলিজেন্ট। কারণ, তাঁর যাবতীয় অর্জন জ্ঞাননির্ভরতাকে আশ্রয় করেই সম্পন্ন হয়। যে জন্য, কিশোরগঞ্জের বিবেচনায় অনেক সম্ভাবনাময় ও অপেক্ষাকৃত অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিকে অতিক্রম করে পেশাগত যোগ্যতায়, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বকীয়তায় এবং সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে তিনি অগ্রগামী হতে পেরেছিলেন। তাঁর যাবতীয় অর্জনই পরিপূর্ণভাবেই ‘একক’, ‘স্বোপার্জিত’। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে ধরণের সামাজিক কাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাসকে তিনি পেরিয়ে এসেছিলেন, তা ক্রমশ পরিবর্তমান। বিশ্ব পরিস্থিতির পালাবদলের মতোই দেশজ অঙ্গনে জ্ঞান, শিক্ষা, মেধার প্রভাব ক্রম-হ্রাসমান। অর্থ, বিত্ত, শক্তি ও যোগাযোগ নির্ধারণ করছে চলমান সামাজিক স্তরবিন্যাসগত ক্ষমতার কাঠামোর বাস্তবতাকে। ফলে তাঁর মতো উজ্জ্বল ও অগ্রণী চরিত্র ধীরে ধীরে ‘ধ্রুপদ শৈলী’ বা ‘ক্লাসিক্যাল স্টাইল’-এর পুরনো প্রজন্মের স্থান দখল করছে। অথচ তিনি ও তাঁদের প্রজন্মের সাধনক্ষেত্র ছিল বহু-বিস্তৃত। কর্তৃত্ব জাহির করার মানসিকতা আদৌ তাঁদের ছিল না। অর্পিত কাজকেই জীবনব্রতে পরিণত করে তাঁরা যাপিত-জীবনকে উপভোগ ও সমৃদ্ধ করেছেন। কিশোরগঞ্জের সুমার্জিত নাগরিক সমাজের প্রতীক স্বরূপ তাঁরা নিঃসন্দেহে শেষ প্রতিনিধি বা ‘লাস্ট মুঘল’-এর মতো আভিজাত্য ও সুকুমার বৃত্তিতে আলোকময়।

তবে, যতই পরিবর্তনের পালাবদল হানা দিক, অতীত ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণের স্বার্থে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজের মতো নমস্য ব্যক্তিবর্গের সংগ্রাম, সাধনা, অর্জন ও জীবনাদর্শ নানাভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে বিরাজমান থাকবে। কর্মফলের চেয়ে কর্মে আগ্রহ বেশি, তাঁর মতো এমন মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অথচ তিনি কি পাবেন তার চিন্তা না করেই কাজের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। কাজের গভীরে প্রবেশের মাধ্যমে নিজের অবস্থান ও মর্যাদাকে স্বাভাবিকভাবে হাতের মুঠোয় পেয়েছিলেন তিনি। তিনি নিঃসন্দেহে অগ্রণী, অনুকরণযোগ্য এবং নিবেদিতপ্রাণ। বহুবিস্তৃত কর্মের জগতের বাসিন্দা হয়েও তিনি আত্মমগ্ন সাধকের জীবন যাপন করেছিলেন নিজের আলোকিত জগতে। এবং সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, বহু ব্যক্তির জীবনে তীব্র-আনন্দধ্বনিতে নান্দনিক প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন। মৃত্যুর পরও তাঁর অপরিহার্য্য উপস্থিতি কিশোরগঞ্জের মানুষ ও সুমৃত্তিকায় মেধাদীপ্ত, মননঋদ্ধ, সৃজনশোভিত একজন অনন্য ব্যক্তিত্বের সুতীব্র শূন্যতায় ও অপরিসীম বেদনায় সঞ্চারিত হচ্ছে। কাল-কালান্তরে এবং প্রজন্ম ও পরম্পরায় তিনি প্রেরণাদায়ী আবহে সতত প্রবহমান থাকবেন কিশোরগঞ্জের ইতিহাসধারার বহুমাত্রিক স্রোতধারায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মনের বীক্ষণে দলিত, তপশিলি, নিম্নশ্রেণির ইতিহাস



সাৰ্থক লাহা
ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাস চর্চা দীর্ঘকাল ধরে মূলত রাজনীতি, রাজনৈতিক চিন্তা, রাজবংশ, রাজা-রাজত্বের মধ্যে সীমায়িত ছিল। আবার একইসাথে ইতিহাসের সংজ্ঞায়নে কেউ কেউ বলেছেন মহান মহান মানুষের জীবন অবতারনা বা আলোচনার নামই হল ইতিহাস। থমাস কার্লাইলের ভাষায়, 'ইতিহাস হল অসংখ্য মহান মানুষের আত্মজীবনির সারবস্তু’।

মূলত একটা সময় ইতিহাস মানে নেপোলিয়ান, আলেকজান্ডার, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আকবর প্রমুখ মানুষদের জীবনীগাঁথা ও তাঁদের সময়কালকেই বোঝা হতো। কিন্তু ইতিহাসের যে অন্য অনুষঙ্গ আছে বা ইতিহাস যে সমস্ত শ্রেণির মানুষের ইতিবৃত্ত সেটা বুঝতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।

মূলত গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে নিম্নবর্গের কথা ঐতিহাসিক কলমে উন্মোচিত হয়। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে ‘নিম্নবর্গের মানুষ কি সত্যিই কথা বলতে পারে?’- এই প্রশ্নের উত্তরে সজ্জিত উপাত্ত নিয়ে ইতিহাসে যে দলিত শ্রেনি, তপশিলি জাতির উচ্চারনও সমানভাবে প্রতীয়মান, সেই জায়গাটি বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চার আলোকে যিনি সম্মুখে আনেন তিনি হলেন অন্যতম ইতিহাসবেত্তা রূপ কুমার বর্মন। যার কলমে বিভিন্ন গ্রন্থে দলিত শ্রেনি, তপশিলি শ্রেণির তথা নিম্নশ্রেনির ইতিহাস, আত্মকথন, স্বকীয় রচনাগুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। লেখকের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইতিহাসচর্চা বস্তুনিষ্ঠতা, বিজ্ঞানবাদিতা, নিরপেক্ষতা সহ নানা নতুন অনুষঙ্গ নিয়ে ক্রমশই অগ্রবর্তী হচ্ছে। ইতিহাসবেত্তাদের কলমে ক্রমশই পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মহামারি, বিজ্ঞান, ক্রীড়াসহ নানাবিধ চর্চা বিশ শতকে নানা আবর্ত আলোচিত হতে দেখা যায়।

মুখ্যত বাংলা ভাষায় জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ বিষয়ক আলোচনার আবর্ত দীর্ঘকাল যাবৎ ইতিহাসচর্চাকারীদের কলমে অপাংক্তেয় অবস্থাতেই থেকে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক কালপর্বে এবং সাম্প্রতিকে কিছুক্ষেত্রে জাতিচেতনা, দলিত আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি হলেও মূলত তা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই সীমায়িত। কাজেই কলকাতার গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ এই গ্রন্থটি জাতপাতের ও আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিকনির্দেশক গ্রন্থ তা বলাই যায়।

লেখক মূলত সমকালীন পশ্চিমবঙ্গকে এক্ষেত্রে অনুধাবন করেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষা সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্তিকরনের প্রয়াসের ফসল এই গবেষণা গ্রন্থটি। শিরোনামেই ধরা পড়েছে গ্রন্থের মূল নির্যাস। যার মধ্যে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত, জাতি-হিংসা, তপশিলিদের সামাজিক স্তরীকরণে কী অবস্থা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, নারীদের বৈষম্যকরনের পাশাপাশি ডান-বাম রাজনীতির আবহে এই তপশিলি জাতির চিত্রপটের স্বরূপ অনুধাবন, জাতিকেন্দ্রিক রচনা, কিছু ব্যক্তিত্বের বর্ননের সাথেও সরকারী নীতি, বিভাগ স্থাপন, প্রতিস্থান নির্মান ও নামকরন প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের সংযুক্তকরুন বইটিকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে।

রুপ কুমার বর্মনের গ্রন্থটিতে ভূমিকা, অধ্যায়ীকরন, উপসংহার, সুদীর্ঘ গ্রন্থ তালিকা সহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের সন্নিবিষ্টকরন পরিলক্ষিত করতে পারি। গ্রন্থ তালিকায় প্রাথমিক তথ্যাদি সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক রচনা, অফিসিয়াল ও লেখ্যাগারের তথ্যাদি ও বৈদেশিক গ্রন্থের প্রয়োগ গ্রন্থটির প্রামাণ্যতাকে নির্দেশ করে। অতিরিক্ত তথ্যাদির এই ব্যবহার গ্রন্থটিকে আরো প্রাঞ্জল করেছে।

গ্রন্থটির ভূমিকাংশে জাতপাত এবং জাতি, বর্ণবাদের উৎপত্তির ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের বর্ণবাদের বিকাশ এবং ক্রমশই যে জাতপাতের ভারতীয় সমাজে নিম্নবর্ণীয়দের প্রান্তিকায়িত করার আভাস তার ব্যাখ্যা দেখতে পায়। লেখক ইসলামিক এবং ঔপনিবেশিক সময়কালেও গ্রন্থগুলি অবলোকন করে ভারতীয় সমাজের নিম্নবর্ণীয়দের কি অবস্থান, তারা কিভাবে জাতি বৈষম্যের শিকার সেই ব্যাখ্যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আইন এবং প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা মধ্য দিয়ে নিম্নবর্ণীয়দের অবস্থা যে ক্রমিক প্রভু-দাস সম্পর্কের (patron-client Relationship) বন্ধনে নিমজ্জিত হয়েছে। এবং প্রান্তিকিকরন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা সেটা আমরা দেখতে পাই এবং স্বাধীনতার সময়কালে ভারতের নিম্ন বর্ণের জাতি জাতি হিংসা অবসানের যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টায় তপশিলি জাতি এবং জনজাতীয় অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতির স্বরূপ কতটা বিকাশমূলক হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবং খুব সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় প্রেক্ষিতে পরিবর্তনের অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন এবং সমকালীন পশ্চিমবঙ্গেও জাতপাতের যে ধারাবাহিকতা সেটির আলোচনা করেছেন।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে তপশিলি জাতি ক্রমিক কিভাবে মৌখিক তথা বাহ্যিক এবং মানসিক জাতপাতের শিকার হচ্ছে সেই নব ব্যাখ্যাও এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট।

গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই জাতপাত, জাতি-রাজনীতি, জাতি-হিংসা, জাতি-বৈষম্য এই বিষয়গুলি পরিস্ফুটিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত, জাতি হিংসা এবং সামাজিক সংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরীকরণের ক্ষেত্রে জাতপাতের যে গুরুত্বপূর্ণ সেই ব্যাখ্যা যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি অন্য মেরুতে পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে চলতে থাকা বাচিক, মানসিক, ব্যবহারগত জাতপাতের যে অন্ধকার দিক সেটি লেখক তুলে ধরেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বাধীনতার পর্বে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনকালীন রাজনীতি জাতপাত বা জাতি রাজনীতি কে কতটা ত্বরান্বিত করেছে এবং তপশিলি জাতির বিকাশ তথা উন্নয়ন নাকি তপশিলিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে সেই ব্যাখ্যায় আমরা মূলত সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত পর্যবেক্ষিত হতে দেখি।

গ্রন্থটির তৃতীয় অধ্যায় মূলত বাংলার নিম্নবর্ণীয়দের নিজস্ব স্বকীয় লেখনীর মাধ্যমে তাদের অবস্থা নির্ণয়ের বা নির্মাণের আলোকে উঠে এসেছে। খুব সুন্দর ভাবেই লেখক বিভিন্ন জীবনী সাহিত্য, সৃজনধর্মী সাহিত্য অবলোকন এবং ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে নিম্নবর্ণের উত্থানের প্রশ্নটিই উত্থাপন করেছেন। গ্রন্থটির চতুর্থ অধ্যায়ে বাংলার তপশিলি সমাজের থেকে রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্বকরণ এবং বেশ কিছু নিম্নবর্ণীয় মানুষের বিস্মৃত স্মৃতির নতুন করে চর্চা এবং চর্যার জগতে আনার আলোকে রচিত হয়েছে।

জাতপাত, জাতি-বৈষম্য, জাতি রাজনীতি এই শব্দবন্ধগুলি ভারতীয় সমাজের আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমানভাবেই বহমান হয়ে রয়েছে। সমাজে অন্যকে দেখার মানসিকতা, প্রভু-দাসত্বের সম্পর্ক উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের রূপক বর্তমান বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তির যুগেও সমভাবেই জাজ্বল্যমান সেটি পরিস্ফুটিত হয়েছে। গ্রন্থটি অনুধাবন করলে আমরা এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা ফুটে উঠতে দেখতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র ইতিহাস চর্চার আলোকে বা ইতিহাস পাঠকদের কাছেই নয়, সমাজের প্রতিটি মানুষের কাছে এই বইটির এক অন্যকথনের গল্প বলে যে গল্প জাতপাত, জাতি হিংসা, বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ের সংযোজনে জাতপাতের ইতিহাসে এই গ্রন্থটির গুরুত্বকে বর্নিত করে।

অনেক প্রশ্নের জবাব রূপ কুমার বর্মনের সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি সজ্জা, জাতি ইতিহাসের নানা আঙ্গিকে বর্ননা, নির্ভরযোগ্য গ্রন্থতালিকা এবং সার্বিক-সুস্পষ্ট বর্ননা গ্রন্থটিকে অনন্য মাত্রা দান করে। হাল আমলে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বর্ননা, আঞ্চলিক প্রেক্ষিত, জাতি-হিংসার নানা দিকের উন্মোচন এবং বিভিন্ন তথ্যাদির প্রয়োগে সার্বিকভাবে সমকালীন বাংলার জাতপাতের ইতিহাস নির্মানের ক্ষেত্রে এক দিকনির্দেশক পাঠ হয়ে উঠেছে রূপ কুমার বর্মনের ‘সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ জাতপাত জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ’ গ্রন্থটি।

গ্ৰন্থ আলোচনা
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ: জাতপাত, জাতি-রাজনীতি ও তপশিলি সমাজ
রূপ কুমার বর্মণ
গাঙচিল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০২২, দাম- ৪০০ টাকা
.....

সাৰ্থক লাহা, গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

;

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা



সোমঋতা মল্লিক
নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

নজরুল পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর শেষ ইচ্ছা

  • Font increase
  • Font Decrease

“তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু।

আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।।"

১৪ মে, সকাল। কলকাতার রবীন্দ্র সদনে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হল এই নজরুল সঙ্গীত। বহুল প্রচলিত গানটি এই বিশেষ দিনে আমার কাছে ধরা দেয় অন্যরূপে। সমুখে শায়িত রয়েছেন সদ্য প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ শ্রীমতী কল্যাণী কাজী। নিথর দেহে পুষ্পের অঞ্জলি। তাঁকে ঘিরে তাঁর আপনজনদের এই মর্মস্পর্শী উচ্চারণ মনকে ব্যাকুল করে।

তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ১২-১৩ বছরের আত্মিক সম্পর্ক। ছায়ানট (কলকাতা)-এর হাত ধরেই যদিও এই সম্পর্ক শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিবারের একজন। তাঁর কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা অবর্ণনীয়। আমার জীবনে এই প্রথম নজরুল জন্মজয়ন্তী যেদিন কল্যাণী কাজী আর সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই। একথা ভাবলেই চোখ ভরে ওঠে জলে। বছরের এই বিশেষ দিনগুলিতে তাঁর সাথে দেখা হলে মনে হত, কি অসীম ভালোবাসায় তিনি আমাদের প্রাণের কবিকে অন্তরে ধারণ করেন। আর পাঁচজন শিশুর মতো তিনিও নজরুলকে ভালোবেসেছেন শৈশবেই।


'অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ' বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, "ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 'প্রভাতী', ‘লিচুচোর’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্রোহী', 'আমার কৈফিয়ৎ’ ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘ইন্দ্রপতন’ প্রভৃতি কবিতা বিভিন্ন বয়সে মনে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবিতে তাঁর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর বড় বড় ভাবালু চোখ দুটোর দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার ইচ্ছা হত। মনে পড়ছে, একবার গৃহশিক্ষককে অনুরোধ করেছিলাম তাঁকে দেখতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু কেন জানি না শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। নিয়তি সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় হেসেছিলেন। নয়ত যে মানুষটাকে শুধু মাত্র চোখের দেখা দেখবার জন্য সেদিন ব্যাকুল হয়েছিলাম - পরবর্তী জীবনে তাঁরই পরিবারের একজন হয়ে তাঁর কাছে থেকে তাঁকে সেবা করার সুযোগ পেলাম কি করে? একেই বোধহয় বলে ‘বিধিলিপি’!

এই বিরল ব্যক্তিত্বের খুব কাছের মানুষ হয়েও, দুর্ভাগ্যবশত আমি সুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাইনি। আমি এ বাড়ীর ছোট বউ হয়ে আসার বেশ কয়েক বছর আগেই বিস্মৃতি তাঁর চেতনার ওপর কালো পর্দা টেনে দিয়েছিল। তবুও আমাদের সবার প্রিয় ‘মামনি’ প্রমীলার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে, তাঁর যতটুকু সেবা করার সুযোগ পেয়েছি তাতেই আমি ধন্য।"


এভাবেই কাজী অনিরুদ্ধর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুবাদে নজরুল পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহু অন্তরঙ্গ আড্ডায় তিনি পরিবারিক স্মৃতিচারণা করতেন।

প্রথমবার তাঁর শ্বশুরবাবা কে সামনে থেকে দেখার অনুভূতির বর্ণনা যখনই দিতেন, মনে হত আমরাও সেই সময়ে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি ছিল অসাধারণ। অতি সামান্য ঘটনাও তাঁর বাচনভঙ্গিতে হয়ে উঠত অসাধারণ।

তাঁকে ঘিরেই জমে উঠত আড্ডা। কখনও কথা, আবার কখনও গেয়ে উঠতেন একের পর এক নজরুল সঙ্গীত। নিয়মিত দূরদর্শনে নজর রাখতেন কোন্ শিল্পী কিভাবে নজরুলের গান গাইছেন। বিভিন্ন চ্যানেলের প্রভাতী অনুষ্ঠান দেখতে খুবই ভালোবাসতেন। পরিচিত শিল্পী হলে অনুষ্ঠানের পরেই চলভাষের মাধ্যমে অভিনন্দন জানাতেন। এভাবেই তিনি ভালোবাসায় আবদ্ধ করে রাখতেন সকলকে।

নজরুল চর্চার সঙ্গে যুক্ত যে কোন ব্যক্তি/সংগঠনকে তিনি আপন করে নিতেন। তাঁর পূর্ণদাস রোডের বাড়িতে ছিল নজরুল প্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। নজরুল বিষয়ক আলোচনায় তাঁর ক্লান্তি ছিলনা। যে কোন সময়, যে কোন পরিস্থিতে তিনি পাশে থেকেছেন। ২০১৭ সালে কলকাতার বুকে প্রথম নজরুল মেলার আয়োজন করে ছায়ানট (কলকাতা), উদ্বোধক কল্যাণী কাজী। শিশুদের জন্য নজরুলের লেখা ২৫টি ছড়া ও কবিতা নিয়ে ২০২১ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে কল্যাণী কাজীর কণ্ঠে ‘শিশু কিশোরদের নজরুল’ শিরোনামে একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। পরম যত্নে তাঁর হাতে গড়া দল 'বিষের বাঁশী' ছায়ানট (কলকাতা) - এর বহু অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে।


নজরুল সঙ্গীতের শিক্ষা তিনি কিভাবে পেয়েছিলেন সেই বিষয়ে কল্যাণী কাজী স্মৃতিচারণা করেছেন, "সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে গান শেখার সুযোগ পাই। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে আমি সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। বাংলা গানের সাথে সাথে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতেও যাতে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারি,  তিনি তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমার তখন চটুল গানের দিকেই ঝোঁক বেশি, তাই রাগ সঙ্গীতের জটিল পথে চলতে মন চাইত না। যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি গলাকে স্ববশে রেখে গান গাইতে হলে, বিশেষ করে নজরুল গীতিকে প্রাণবন্ত করতে রাগ সঙ্গীত চর্চা খুবই দরকার।

আজ সঙ্গীতের শিক্ষকতা করতে গিয়ে নজরুল গীতির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের সব রকমের বাংলা গানের চাহিদা যে মেটাতে পারি, তারজন্য আমি আমার গুরু শ্রদ্ধেয় শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্রের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। সেদিন যদি তিনি জোর করে খেয়াল, ঠুংরী, দাদরা, গীত, গজল এর সাথে সাথে কীর্তন, পুরাতনী, রাগপ্রধান প্রভৃতি গান না শেখাতেন, তবে গানের অনেক ধারাই আমার অজানা থেকে যেত। কাজী নজরুলের গানের সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে তিনিই আমায় প্রথম পরিচয় করান। প্রথম যে নজরুল গীতিটা শিখিয়েছিলেন সেটা হল হাম্বির রাগে নিবদ্ধ 'আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া'। এরপর তিনি শেখালেন 'ভোরের ঝিলের জলে', 'প্রথম প্রদীপ জ্বালো', 'শাওন আসিল ফিরে', 'ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি' প্রভৃতি নজরুলের রাগভিত্তিক গানগুলো।


আমার স্বামী অনিরুদ্ধ যখন নজরুল গীতির স্বরলিপির বই 'রাগবিচিত্রা'-র প্রস্তুতি নেন, তখন আমিই হাম্বির রাগের গানটির স্বরলিপির কাজে সাহায্য করেছিলাম। তিনি গানটা জানতেন না। অপ্রচলিত গানটা পরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।" 

তিনি অসুস্থ ছিলেন বেশ কয়েকমাস, কিন্তু তাঁর জীবনীশক্তি ছিল প্রবল। জীবনের বহু দুঃসময়কে তিনি জয় করেছিলেন অবলীলায়। ১২ মে ভোরে নজরুল অনুরাগীদের চোখের জলে ভাসিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দিলেন তিনি।

তাঁর কন্যা অনিন্দিতা কাজী বলেছেন মায়ের শেষ ইচ্ছের কথা। শোকবার্তায় অনিন্দিতা লিখেছেন - "মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়িতে (৭৪ এইচ, পূর্ণদাস রোড, ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক) দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে।"

আমরা সকলেই চাই তাঁর শেষ ইচ্ছে পূরণ হোক।

সোমঋতা মল্লিক, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক। সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)।

;

বাজারে এলো আতিফ ওয়াফিকের বই ‘এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া’ 



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক, যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ, তার সর্বশেষ বই "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" বাজারে এসেছে। এই বইটি আজকের পাঠকদের দ্রুত-গতির বিশ্বে সঠিক আচরণের শিল্প সম্পর্কে একটি সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করবে বলে লেখক মনে করেন।

একটি সমাজে যেখানে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, "এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" সেই ব্যক্তিদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে কাজ করবে বলে লেখক মনে করেন। বিশেষ করে আজকের স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রী দের এই বই টি অনেক কাজে আসবে। এই বইটি পাঠকদের আধুনিক আচরণের সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করতে সাহায্য করার জন্য ব্যবহারিক পরামর্শ এবং কার্যকরী টিপস প্রদান করে৷

"এটিকেট এনসাইক্লোপিডিয়া" যত্ন সহকারে গবেষণা করা হয়েছে, পাঠকদের সমসাময়িক শিষ্টাচারের নিয়ম সম্পর্কে সর্বশেষ অন্তর্দৃষ্টি এবং নির্দেশিকা প্রদান করে। এর সহজ ভাষা এবং উপস্থাপন উদাহরণ সহ, সমস্ত পটভূমির পাঠকদের জন্য উপযুক্ত, তারা তাদের সামাজিক দক্ষতা পোলিশ করতে চাইছে বা তাদের পেশাদার চিত্র উন্নত করতে চাইছে।

এইচ এম আতিফ ওয়াফিক একজন অন্বেষিত যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, তার আকর্ষক কথা বলার ব্যস্ততা এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ পরামর্শের জন্য পরিচিত। বর্তমানে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স এ ।

রিডিং ক্যাফে, বনানীতে বইটি উন্মোচনের সময়, জনাব ববি হাজ্জাজ (একজন অক্সফোর্ড স্কলার), জনাব সোলায়মান শুকন (একজন বাংলাদেশী যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ), জনাব শাহরিয়ার নাফীস (সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার), জনাব হাসান মাহমুদ (প্রতিষ্ঠাতা, স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ার্স), জনাব বেনজির আবরার (প্রতিষ্ঠাতা, এক্সিলেন্স বাংলাদেশ), মিসেস আফরুজা তানজি (রাষ্ট্রদূত, ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড), মিসেস শারমিন কবির (প্রতিষ্ঠাতা, রিতু), মিসেস ইশরাত নাহের ইরিনা (প্রতিষ্ঠাতা, প্রেসক্রিপশন বাংলাদেশ), জনাব ফাহিন আরাফিন (ক্রিয়েটিভ হেড, স্বপ্ন), জনাব সালেহীন মাহবুব (বিশ্ববিদ্যালয় অনুষদ), মিসেস ফারহানা শারমিন (ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজিস্ট, রিমার্ক এইচবি), এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় শিক্ষার্থীউপস্থিত ছিলেন।

;

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'



কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ'

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি একক ও অনন্য। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। যার অগ্নিঝরা লেখনি ত্রস্ত করেছে ঔপনিবেশিক শাসকদের। যার বই বার বার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। যাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন।

নজরুল শতবর্ষ আগে বন্দি ছিলেন কলকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেলখানায়। নজরুল বিষয়ক সংগঠন ছায়ানট কলকাতা শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা-গবেষণার পাশাপাশি নজরুল স্মৃতিধন্য হেরিটেজ স্থান ও স্থাপনাসমূহ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় রয়েছে। ছায়ানট কলকাতার সভাপতি, বিশিষ্ট শিল্পী, সোমঋতা মল্লিক কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নজরুলতীর্থগুলো নিজে গিয়ে সেগুলো রক্ষার প্রশাসনিক ও নাগরিক তৎপরতা চালিয়ে ছিলেন। যার ফলে এবছর নজরুল জয়ন্তীতে কলকাতা আলীপুর জেল মিউজিয়ামে স্থাপিত হয়েছে 'নজরুল কক্ষ'।


ছায়ানট কলকাতা সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বার্তা২৪.কম'কে জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর,২০২২ তারিখে ছায়ানট (কলকাতা) তথ্য সহ WBHIDCO - এর কাছে এই মর্মে আবেদন করে যে, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আলিপুর জেল মিউজিয়ামে কাজী নজরুল ইসলাম যে জায়গায় বন্দি হিসেবে ছিলেন, সেই জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং নজরুল মূর্তি স্থাপন করার জন্য।

তিনি বলেন, গত ১৭ জানুয়ারি,২০২৩ তারিখে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুলের আগমনের শতবর্ষকে স্মরণ করে ছায়ানট (কলকাতা) এবং আলিপুর মিউজিয়াম যৌথভাবে একটি অনুষ্ঠানও পালন করে।

শনিবার (২৬ মে) আমরা সত্যিই আনন্দিত, আমাদের এই প্রস্তাব তাঁরা বিবেচনা করেছেন এবং আলিপুর মিউজিয়ামে 'নজরুল কক্ষ' তৈরি হয়েছে, জানান সোমঋতা মল্লিক।

;