স্মৃতিমেঘে কিশোরগঞ্জের শাহ আজিজুল হক



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক

  • Font increase
  • Font Decrease

পটভূমি

ঘটনাক্রমে ২০২২ সালের ১৬ থেকে ২০ মে আমাকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে জরুরি কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। সে সময় অসুস্থ অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে সাবেক পিজি হাসপাতাল ও বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। কিছুদিন আগেই তাঁকে দেখে এসে মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত খোঁজ-খবর জানান। আমরা আশায় ছিলাম যে, তিনি সুস্থ হয়ে সবার মাঝে ফিরে আসবেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি এসেছেন জেনে আমি দ্বিতলে ছুটে যাই। কিন্তু তিনি তখন আইসিও’র ঘেরাটোপে আবদ্ধ এবং সাক্ষাৎ দেওয়ার অবস্থায় ছিলেন না। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করেও আশার বাণী শুনতে পাই নি। গভীর বেদনা নিয়ে আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে আসি।

১০ মে তাঁর জন্মদিন ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুদিনও উপস্থিত হয়। ২৬ মে (২০২২) দুপুর দেড়টার দিকে কিশোরগঞ্জ নিউজের প্রধান সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ফোনে তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানান। আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হই যে, ঘণ্টাখানেক আগে তিনি পরলোকে যাত্রা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বজন হারানোর ব্যথায় আক্রান্ত হই। কমপক্ষে চল্লিশ বছরের সম্পর্কসূত্রে খন্ড খন্ড স্মৃতিমেঘ আমাকে আচ্ছন্ন করে। মেহনতি মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখা অনন্য মানুষটি শ্রমিক আন্দোলনের মহান মে মাসেই নিজের জন্ম ও মৃত্যুদিনের চিহ্ন অঙ্কন করে চিরদিনের মতো চলে গেলেন।

শৈশবে আশি দশকের শুরুতে একমাথা চুলের বিপ্লবী শাহ আজিজুল হককে দেখেছি কিশোরগঞ্জ শহরের গৌরাঙ্গ বাজারে আমাদের বাসার পাশে কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে। একটি ইয়ামাহা মোটর সাইকেলে তিনি তখন পুরো কিশোরগঞ্জ চষে গণআন্দোলন সংগঠিত করতেন। আমরা চা খেতে খেতে সেসব গল্প শুনেছি। তাঁর কাব্য গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে জড়িত থেকেছি। আরও পরে তিনি খড়মপট্টিতে ঢেরা তৈরি করেন। সেখানেও আড্ডায় মেতেছি। তারপর স্থায়ীভাবে আবাসন তৈরি করলে সেখানে বিকাল, সন্ধ্যা, রাত অবধি আড্ডা, আলাপে অতিবাহিত করেছি। ততদিনে আমি কর্মসূত্রে কিশোরগঞ্জের বাইরে অবস্থানকালে যখনই জন্মশহরে এসেছি, আবশ্যিকভাবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। কখনও আলাপে আলাপে রাতও কাটিয়েছি তাঁর বাসায়। বিকালে হাঁটতে গিয়েছি পাট গবেষণরার খোলা প্রাঙ্গণে। কখনও সারাদিনের জন্য তাঁর সঙ্গে চলে গিয়েছি তাঁদের গ্রামের বাড়িতে, তাঁর কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে কিংবা কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।

আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপে যে আনন্দ ও অনুভূতি অর্জিত হয়েছে, তা মফস্বল শহরে বিরল। সৃষ্টিশীল কাজে ও মননশীলতায় তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল সবসময়। কিশোরগঞ্জের শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস বিষয়ক ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত সম্মাননা বক্তৃতা এবং অন্যান্য সকল অনুষ্ঠান ও আয়োজনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের মেধাঋদ্ধ রাজনীতি, গতিশীল সামাজিক তৎপরতা, বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক উদ্যোগের সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষের মতো। সমকালীন কিশোরগঞ্জের প্রতিনিধিত্বশীল উজ্জ্বল মুখচ্ছবি তিনি। একটি শহরকে নান্দনিক আঙিকে যেসব ব্যক্তিত্ব প্রতিনিধিত্ব করেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁর শূন্যতা সহজে পূর্ণ হবে না। কিশোরগঞ্জের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রূপে বর্তমান ও অনাগতকালে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

১.
২০১৫ সালে কিশোরগঞ্জের সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা’র প্রবর্তন ও সূচনার ধারাবাহিকতায় ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস: নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হক’ শীর্ষক ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা ২০২০ প্রদান করা হয়। অতীতের মতোই কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-নাগরিক কর্মকান্ডের নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন’ সর্বসম্মতভাবে উদ্যমী, নিবেদিতপ্রাণ, বুদ্ধিদীপ্ত আইনজ্ঞদের সংবর্ধিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিক্ষা বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা বক্তৃতা’ ২০১৫ সালে শুরু হয়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সুতীব্র প্রকোপের মধ্যেও অব্যাহত ধারায় চলমান থাকা নিঃসন্দেহে উৎসাহজনক ঘটনা। তবে করোনাকালে আমরা ১ম ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০১৫’ প্রাপ্ত প্রফেসর প্রাণেশকুমার চৌধুরী এবং ৬ষ্ঠ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০’ প্রাপ্ত অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে হারিয়েছি, তাঁরা ছিলেন সমকালীন কিশোরগঞ্জের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার উজ্জ্বল মুখচ্ছবি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১ম মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০১৫ প্রাপ্ত ‘আলোর পথের যাত্রী শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক প্রাণেশকুমার চৌধুরী গত ২৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে পরলোকগমন করেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। করোনাকালে তাঁর মৃত্যুতে আনুষ্ঠানিক ও সম্মিলিতভাবে শোক প্রকাশের সুযোগ সীমিত ছিল। ফলে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শোকবাণী প্রদান এবং আমার নিজের একটি নাতিদীর্ঘ শ্রদ্ধামূলক নিবন্ধের মাধ্যমে আমরা তার জীবন ও কীর্তিকে স্মরণ করেছি, যা প্রকাশিত হয়। ৬ষ্ঠ ‘মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০’ প্রাপ্ত ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস’-এর বিশিষ্টজন অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হককে আমরা হারিয়েছি ২৬ মে ২০২২ সালে। তাঁর মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে ফাউন্ডেশন শোক ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং তাঁর জীবন র্কীতিকে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনার্থে পুস্তিকাকারে প্রকাশ ও প্রচার ব্যবস্থারও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন সম্মাননা ২০২০ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, কিশোরগঞ্জের আইন পেশার ঐতিহ্য শতাধিক বছরের প্রাচীন এবং তা ঐতিহাসিক গৌরবে ভূষিত। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের আইন পেশায় একে ব্রোহি, রামজেট মালানি, পালকিওয়ালা, স্নেহাংশু আচার্য্য, ইশতিয়াক আহমেদ এবং রফিক-উল হকের মতো কীর্তিমানদের দেখা পাওয়া গেছে। কিশোরগঞ্জের আইন পেশাতেও অনেকেই ছিলেন বা আছেন, মফস্বলে অবস্থানের কারণে যাদের মেধা, মনন, দক্ষতার উপযুক্ত মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয় নি। অথচ তাঁরা পেশার উজ্জ্বলতার পাশাপাশি সমাজের বৃহত্তর অঙ্গনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও রাজনীতিতে বহুমাত্রিক অবদান রেখে স্থানীয় সমাজ প্রগতিকে বেগবান করছেন। আমার লিখিত সম্মাননা বক্তৃতায় কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস ও অর্জনের ইতিহাসটুক তুলে আনার চেষ্টা করা হয় তিনজন সমকালীন-অনন্য ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হককে সামনে রেখে।

২.
সাম্প্রতিক ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, বিগত ষাট, সত্তর, আশি দশকের কিশোরগঞ্জ যখন মহকুমা ছিল, তখন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখরিত করার মতো পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল অত্যল্প। মূলত এবং একমাত্র স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূল। কারণ, তখন মহকুমায় ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন দুই-তিন জন মাত্র। যাদের মধ্যে ছিলেন এসডিও (মহকুমা প্রশাসক বা সাবডিভিশনার অফিসার), এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ প্রশাসক), সিও (সার্কেল অফিসার) এবং এক-দুই জন ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে প্রশাসনিক দিক থেকে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের দায়িত্ব পালনের মতো প্রচুর সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন না তখনকার কিশোরগঞ্জে, যা এখন রয়েছে।

অন্যান্য পেশাজীবী, যেমন চিকিৎসকের সংখ্যাও ছিল কম। প্রথম এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডা. এ. এ. মাজহারুল হক পঞ্চাশের দশকে কিশোরগঞ্জে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রেরণায় বাঙালির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হয়ে মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় অংশ নেন এবং দলের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। তখন মহকুমা ও আশেপাশের অঞ্চলের অন্যতম প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুদয়াল কলেজ ও এর শিক্ষকম-লীকেই সকল সামাজিক-সাংস্কৃকি কাজের সামনের কাতারে দেখা গেছে। অতএব, কিশোরগঞ্জের বাস্তবতা ছিল এই যে, মহকুমার সামগ্রিক তৎপরতায় সেসময় বেশ কয়েকজন আইনজীবী অংশ নেন এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, খেলাধুলার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাম্প্রতিক অতীত ও নিজস্ব অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায় যে, নিজের পেশার বাইরে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী অগ্রণী আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন হেমেন্দ্রচন্দ্র রায়, আবদুস সাত্তার (এমএনএ ও আওয়ামী লীগের সহাপতি), আবদুর রশীদ (পৌরসভার চেয়ারম্যান), মুস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া, (এমএনএন ও আওয়ামী লীগ নেতা), আবদুল আলী মেনু মিয়া, মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া (পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সাংসদ), মোহাম্মদ আবদুল হামিদ (মহামান্য রাষ্ট্রপতি) সমরেশ চন্দ্র রায়, লতিফুর রহমান খান মরু প্রমুখ।

বলা বাহুল্য, শতবর্ষের অধিক প্রাচীনত্বের অধিকারী কিশোরগঞ্জ আইনজীবী সমিতি দেশের রাষ্ট্রপতিসহ আইন পেশা ও সামাজিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ বহুজনকে উপহার দিয়েছে। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতাকালে আশি দশকে আইনজীবী সমিতির শতবর্ষ উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় অংশ গ্রহণের স্মৃতি থেকে সেসব কথা জানার সুযোগ আমার হয়েছে। উৎসবকালে সমিতির সম্পাদক ছিলেন লতিফুর রহমান খান মরু ভাই, যিনি অগ্রণী ছাত্রনেতা ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সমিতির একটি মূল্যবান স্মরণিকায়ও বহু তথ্য রয়েছে।

৩.
কিশোরগঞ্জের স্থানীয় সুধীজন ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আইনজীবীগণ। যার বাস্তব প্রমাণ শৈশবে আমরা লক্ষ্য করেছি। শহর তখন এতোটা বড় হয় নি এবং শহরের বিশিষ্ট নাগরিক বলতে কয়েকজন আইনজীবীর নাম আমাদের কানে আসতো। তাঁদের অনেকে সে সময়েই প্রয়াত হলেও তাঁদের নাম লোকমুখে প্রচারিত হতো এবং শহরের বিভিন্ন স্থানের নিদের্শনা দিতে তাঁদের বাড়িকে ল্যা-মার্ক ধরা হতো। যেমন, এমাদ মিয়া মোক্তার, শাবান আলী মোক্তার, বোরহান মোক্তার, মেনু মিয়া মোক্তার ছিলেন অন্যতম। পরবর্তীতে মোক্তারশিপ আর ছিল না এবং সকলেই অ্যাডভোকেট নামে পরিচিত হন। যাদের নাম শৈশবে শুনেছি, তাঁদের অনেকেই লোকান্তরিত হলেও মৃত্যুর ২০/৩০ বছর পরেও চর্চিত হতেন। আমার নিজের শৈশবেও আইনজীবীদের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতাপ স্বচক্ষে চাক্ষুষ করেছি। আমার পিতা ডা. এএ মাজহারুল হক আওয়ামী লীগের নেতা ও সর্বজনমান্য চিকিৎসক হিসেবে এদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বকালে ও পরবর্তীতে পিতার গৌরাঙ্গ বাজারের চেম্বার আওয়ামী লীগের অলিখিত কার্যালয় রূপে পরিগণিত ছিল। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার, মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু মিয়া, বোরহান উদ্দিন আহমেদ, শহর আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল ওয়াদুদ খোন্দকার সমবেত হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। কিশোরগঞ্জ এলে বর্ষীয়ান জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমার পিতার চেম্বারে আসতেন এবং ফোনে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। চিকিৎসক হিসাবে তখন আমার পিতার টিএনটি ফোন ছিল। আর কোনও নাগরিক বা আওয়ামী লীগ নেতার ফোন সংযোগ পাকিস্তান আমলে ছিল না। শহরে মোট ফোনই ছিল মাত্র কয়েকটি। ফলে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসে এই ফোন নম্বরটি পরিচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা এই ফোনে আমার পিতার কাছে আসে ও তিনি সেটা কিশোরগঞ্জে প্রচারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।

৪.
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের একটি অন্যতম সামাজিক উপাদান হিসাবে এইসব ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা ও অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং কিশোরগঞ্জের স্থানীয় ইতিহাসের একটি তাৎপর্যপূর্ণ কালপর্বের উজ্জ্বল অংশ। দুঃখজনক বিষয় হলো, স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এইসব সামাজিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বকে নথিভুক্ত করার যোগ্যতা কেউ দেখাতে পারেন নি। অধিকাংশই পূর্বে প্রকাশিত প্রাচীন আমলের সেকেন্ডারি তথ্যকে পুনরায় উপস্থাপনের নকলনবিশি করেছেন। সামাজিক গতিশীলতার প্রপঞ্চগুলোকে লিপিবদ্ধ করতে না পারায় কিশোরগঞ্জের সামাজিক বিকাশ ও আধুনিক বিনির্মাণের ধারা সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ-ফলিত তথ্যাবলীর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়ে গেছে।

কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন, অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার ছিলেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালীন সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষানুরাগী। গুরুদয়াল কলেজ ছাড়া যখন পুরো অঞ্চলে কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, তখন কিশোরগঞ্জ মহিলা কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তা এই আইনজীবী-রাজনীতিবিদ কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাকালেই প্রাণ ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু বেদনাদায়ক হলেও কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে জনহিতমূলক কাজে আত্মনিবেদনের উজ্জ্বল ও বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত স্বরূপ।

হেমেন্দ্রচন্দ্র রায় ছয় দশকের বেশি সময়কাল কিশোরগঞ্জে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। একাদিক্রমে তিনি সমিতির বহুবারের সভাপতি ছাড়াও বহু নবীন আইনজীবীর সিনিয়র রূপে ভূমিকা পালন করেন। তারাপাশা-নিউটাউন নিবাসী আবদুর রশীদ স্বাধীন-পূর্ব ও পরবর্তীকালে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আইনজীবী সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। তদুপরি আইন পেশায় আগমনের পূর্বে তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

বোরহান উদ্দিন ছিলেন কিশোরগঞ্জের নগরায়নের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। ষাট ও সত্তর দশকে অনেকগুলো পাকা বাড়ি নির্মাণ করে তিনি আধুনিক আবাসিক সুবিধা বিস্তারে ব্রতী হন। তখনকার কিশোরগঞ্জ শহরে সর্বজনাব বোরহান মোক্তার, মেনু হাজি, হাজি মলু মিয়া প্রমুখের একাধিক মানসম্পন্ন বাসা-বাড়ি ছিল ভাড়া দেওয়া জন্য। নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য হলেও স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের বিকাশে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নিঃসন্তান সমরেশ রায় পরহিত ও দানশীলতার অন্যন্য নজির রেখেছেন, যা কিশোরগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতিতে প্রদত্ত অনুদান ও ইটনায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিভাত। হয়ত এই তালিকায় আরো অনেকের নাম আসতে পারে, হয়ত অনেকের অনেক কৃতিত্ব সেভাবে প্রকাশও পায় নি।

৫.
বস্তুতপক্ষে নিজের পেশাগত সাফল্যের বাইরে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অবস্থানে থেকে নানামুখী উন্নয়নে ভূমিকা পালন করার যোগ্যতা একজন মানুষের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ও কর্ম-কৃতিত্বের স্মারক। আইনজীবী সমাজের বিশ্লেষণে সমকালের নিরিখে তিনজন আইনজীবীকে সম্মাননা জ্ঞাপন করার কারণ এই যে, তাঁরা তাঁদের জীবনব্যাপী কাজের মাধ্যমে তাঁদের স্ব স্ব পেশাক্ষেত্রকে আলোকিত করার পাশাপাশি সমাজ প্রগতি, সাংস্কৃতিক গতিশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের সারথি হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে, যা ব্যক্তিগত পরিধি ছাড়িয়ে সামাজিক কাঠামোতে বিস্তৃত হয়ে ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছে এবং এদের মধ্যে শতবর্ষ প্রাচীন আইনজীবী সমাজের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহনের কৃতিত্ব দেখা গেছে।

ঐতিহাসিক পর্যালোচনার নিরিখে বলা যায়, কিশোরগঞ্জের আইন পেশার বহুমাত্রিক, বর্ণময় কাঠামোটি আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। বরং সহস্র বর্ষের প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং শতাব্দী প্রাচীন আইনজীবী সমাজের উত্তরাধিকারের সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি, যার ভিত্তিতে বিনির্মিত হয়েছে সমকালের নান্দনিক পাটাতন। এই ঐতিহাসিক গৌরবের কথাগুলো বিবেচনায় রেখেই আমরা সাম্প্রতিক সময়ের আইন পেশা ও এ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণের জীবন ও কর্মের পর্যালোচনা করতে পারি। তদুপরি, সাম্প্রতিক কিশোরগঞ্জের আইন পেশার নান্দনিক বিন্যাস সৃজিত হয়েছে যে তিনজন কীর্তিমানের মাধ্যমে, আমাদের সামাজিক ইতিহাসের গতিশীলতার প্রয়োজনেই তা শনাক্ত করা অপরিহার্য্য। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে তাঁদের প্রসঙ্গে আলোচনা ও বিশ্লেষণকালে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক ইতিহাস ও স্মৃতি প্রায়শই ঝাপসা ও অস্পষ্ট অবয়বে উপস্থাপিত হয়। কোনও কোনও ব্যক্তি, বিশেষ কিছু মানুষ ও ঘটনার কথা স্মৃতিচারণে উল্লেখ করতে পারলেও সুগ্রন্থিত ইতিহাস বা লিপিবদ্ধ তথ্য আকারে সেসব পাওয়ার আশা করা যায় না। এতে প্রবহমান ইতিহাসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও ঘটনার তাৎপর্য ক্রমে ক্রমে চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং ইতিহাসের বহুমাত্রিকতাকে ক্ষুন্নকারী। এহেন ধারা চলতে থাকলে আমাদের জীবনের চারপাশে পুঞ্জিভূত মানুষ, তাঁদের কৃতিত্ব এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে সঞ্চারিত বহুমাত্রিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোও হারিয়ে যাবে।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, স্থানীয় ইতিহাস চর্চাকারীরা সামাজিক প্রপঞ্চগুলো সংগ্রহ করার বদলে প্রাচীন বা প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত নাড়াচাড়া করার নকলনবিশ চরিত্র ও কেরানি মানসিকতা থেকে বের হতে না পারায় পরিস্থিতির উন্নতি হয় নি। এমনকি, অসৎ-মতলববাজদের হাতে ইতিহাসের কোনো কোনো ইস্যু বিকৃতি প্রাপ্ত হয়। কারণ, ইতিহাস সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠভাবে চিহ্নিত ও লিখিত না হলে সমাজ প্রগতির সত্যনিষ্ঠ অবয়বটি আমাদের সামনে অস্পষ্ট হতে বাধ্য। তখন নানা উপকথা ও আরোপিত বিষয় ইতিহাসের নামে জঞ্জাল তৈরি করে, যা বাস্তবতা ও সততার সম্পূর্ণ বিপরীতি। একটি জনপদ যে বহু মানুষের কীর্তি ও কর্মের আলোকমালায় দ্যুতিময় হয়, সেই বাস্তবতাটিও তখন অস্পষ্ট হয়ে সামাজিক কৃতিত্বের গৌরবসমূহ চাপা পড়ে যায়। এতে ঐতিহ্য বিনির্মাণের ধারায় ছেদ ঘটে ও ইতিহাস দিকভ্রান্ত হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অতীতের দিকে তাকিয়ে দিশা পায় না। ফলে আজকের ইতিবৃত্ত শুধু যে ইতিহাসের অংশ, তা-ই নয়, বরং ইতিহাসের পরম্পরার সূত্রে অনাগত ভবিষ্যতকালের পথের দিশাও বটে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণেও এ বিষয়টি আমি আলোচনায় আনা জরুরি মনে করেছি এবং ২০১৫ সাল থেকে কিশোরগঞ্জের সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ক সম্মাননা বক্তৃতার ধারাবাহিক চর্চার একটি বিষয় জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমকালীন কিশোরগঞ্জ শহরের অগ্রণী প্রজন্মের অনেকেই জাগতিক জীবন শেষ করে চির বিদায়ের পথে চলে যাচ্ছেন। অথচ এদের জীবদ্দশায় তাঁদের সমকালীন ইতিহাস লিপিবদ্ধ ও মূল্যায়ন করা এবং তাঁদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতাবাদী তথ্য-উপাত্ত জ্ঞাত হওয়া স্থানীয় ইতিহাসচর্চার অমূল্য উপকরণের শামিল। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি উত্তর-প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ বা বক্তব্য আকারে রেখে গেলে সাধারণভাবে আইন পেশার পরম্পরায়, বিশেষভাবে কিশোরগঞ্জের নাগরিক সমাজ ও সামাজিক ইতিহাসচর্চায় পরিপূর্ণ কাঠামো প্রভুতভাবে সমৃদ্ধ ও উপকৃত হবে। এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে অনাগত ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের সামনে কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সংরক্ষিত রাখার কথা বিবেচনা করে ৬ষ্ঠ মাজহারুন-নূর সম্মাননা ২০২২ জ্ঞাপন করা হয় সর্বজনাব নাসিরউদ্দিন ফারুকী, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, শাহ আজিজুল হককে।

৬.
মাজহারুন-নূর সম্মাননাপ্রাপ্ত তিন সিনিয়র আইনজীবীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিসত্ত্বায় কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও ঐতিহ্যিক পরম্পরায় গুণগত ও কৃতিত্বপূর্ণ জায়গাগুলো বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য। তিনজনই মোটের উপর তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত প্রজন্মের প্রতিনিধি। একজনের বিকাশ ষাট দশকের শেষে। আরেক জনের সত্তর দশকে এবং অন্যজন আশির দশকে। তিনজনই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, উদারনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজ প্রগতিপন্থী। আবার আশ্চর্যজনকভাবে, তিনজনের প্রত্যেকেই স্বনির্মিত ব্যক্তিত্ব, ইংরেজিতে যাকে ‘সেলফ মেড’ বলা হয়। জীবনে তাঁদের রাজনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, পেশাগত ইত্যাদি যাবতীয় অর্জন বা প্রাপ্তি, পরিবার বা বংশের বরাতে কিংবা পৃষ্ঠপোষকের দানে প্রাপ্ত নয়, সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব চর্চা, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে লব্ধ। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতে পরিবার, বংশ ও পরম্পরার অচলায়তন ভেঙে রেনেসাঁসের মানুষ যেভাবে বিকশিত হয়েছিলেন আলোকায়িত ইউরোপে কিংবা ঊনিশ শতকের বঙ্গদেশে, আলোচ্য তিনজনের আত্মপ্রতিষ্ঠা তেমনি শ্রমসাধ্য ও মেধাবী অর্জনের পথে আত্মজাগরণের বার্তাবহ।

আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বাংলার জাগরণ যেমনভাবে আঞ্চলিকতা (কলকাতাকেন্দ্রীক) বা ধর্মীয় ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল, কিশোরগঞ্জের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায় নি। ‘রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্বান পূজিত হন সর্বত্র’. চাণক্যের নামে প্রচলিত এই লোককথার তাৎপর্য আর কেউ না বুঝলেও বাঙালিরা অন্তত মর্মে মর্মে বোঝেন। বাংলার বাইরে, সমগ্র উপমহাদেশে, বাঙালিরা ঔপনিবেশিক আমল থেকেই ‘বাবু’ ও ‘বিদ্বান’ বলে পরিচিত ছিলেন। তবে বিনয় ঘোষের ভাষায়, ‘এক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান ট্র্যাজিডি হলো, বাংলার এই নতুন বিদ্বৎসমাজ প্রায়-সম্পূর্ণ ‘মুসলমানবর্জিত’ রূপ ধারণ করলো এবং সেইজন্য একে সাধারণভাবে ‘বাঙালি বিদ্বৎসমাজ’ না বলে, বিশেষ অর্থে ‘বাঙালি হিন্দু বিদ্বৎসমাজ’ বলাই যুক্তিসঙ্গত।’ কিন্তু ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক বিভাজনে দেশভাগের ক্ষত মুছে স্বাধীনতাকামী পূর্ব বাংলা এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশস্থ কিশোরগঞ্জের পটভূমিতে এই তিনজনের উত্থান সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ, আঞ্চলিকতামুক্ত ও পেশাগত নৈপূণ্যের মাধ্যমে স্বোপার্জিত আবহে সাধিত, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অগ্রগতির চিহ্নবাহী এবং কিশোরগঞ্জের অপরূপ সামাজিক গতিশীলতার নিদর্শন স্বরূপ প্রতিভাত হয়েছে, যাদের মধ্যে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক জাগতিক জীবনের সীমানা পেরিয়ে আমাদের কাছ থেকে চলে গেছেন এবং রেখে গেছেন কর্ম ও কীর্তির অম্লান স্মৃতি।

৭.
কিশোরগঞ্জের শহরতলীর একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষিভিত্তিক পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে থেকে তীব্র গতিতে বেরিয়ে এসে শাহ আজিজুল হক তাবৎ পৃথিবীকে একটি আনন্দ ও সংগ্রামময় পাঠশালার মতো পঠন ও পাঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেন। জীবনকে বাস্তবের রসায়নে জারিত করে তিনি অর্জন করেন ফলিত অভিজ্ঞান। পথ চলেছেন তিনি আবেগ ও যুক্তির সন্ধিক্ষণ পেরিয়ে। জীবনের রূঢ়-কঠিন রণাঙ্গণ আর প্রকৃতির লীলায়িত ক্ষেত্র তাঁকে দিয়েছে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানবিকতার দীক্ষা। ‘অতএব কারণে’ তার জীবনের অভিমুখ হয়েছে বহুমাত্রিক ও অসীমান্তিক। তিনি নিবিড়ভাবে মাটি. মানুষ ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ধারাবাহিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণকারী রূপে মিশেছেন। জড়িয়েছেন লোকজ সংস্কৃতি, চিরায়ত সাহিত্য, সমাজ বীক্ষণ ও শ্রেণিভিত্তিক চৈতন্য জাগরণী রাজনীতিতে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়, মানুষের জন্য শিল্প’ ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মর্মকথায় তিনি অবস্থান করেছেন শ্বাশত বাংলার অন্তরাত্মায়। গজদন্ত মিনারকে তুচ্ছ করে এবং গতানুগতিক-প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসকে উপেক্ষা করে তিনি আলিঙ্গন করেছেন বিশ্বসাহিত্য ও স্বদেশের সুমৃত্তিকাকে এবং এরই ভিত্তিতে রাজনীতি, কাব্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা করেছেন, সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হয়েছেন। এবং পরিশেষে রাজনীতি ও আইন পেশায় নিজেকে স্থিত করলেও অন্যান্য কর্মকা- থেকে তিনি হাত গুটিয়ে নেন নি। আধুনিক বিশেষায়িত যুগে একটি পেশায় সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনই যখন কঠিনতম, তখন তাঁকে দেখা যায় অনেকগুলো পেশায় সচল ও সফল। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বহুমুখী কৃতিত্বশীল মানুষ বিরল। অন্তত কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে দ্বিতীয় আরেকজন নেই, যিনি একাধারে রাজনীতি, আইনপেশা, সাংবাদিকতা, কাব্যচর্চা, সাহিত্য সাধনা, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইত্যাদি যাবতীয় নন্দনকলায় সমান সরব ও সফল। প্রাচীন, ধ্রপদী, গ্রিক বিদ্যাচর্চার সংলাপ-নির্ভর জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির ট্র্যাডিশনাল পথের সঙ্গে আধুনিক জীবনবোধের মিলিত পথে তিনি ছিলেন আজীবনের যাত্রী।

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক ছয় বার কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হওয়া অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর কৃতিত্ব শতবর্ষাধিক প্রাচীন কিশোরগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ক্ষেত্রেই বিরল রেকর্ড নয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা। বিশেষত মফঃস্বলের মতো ক্ষুদ্র গ-িতে রেষারেষি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে এবং যেখানে সুযোগের চেয়ে প্রার্থী অধিক, সেখানে সকলের মধ্যে বছরের পর বছর আস্থা, সমর্থন ও সম্মতিতে বার বার বিপুল ভোটে জয়লাভ করা অসামান্য বিষয়। কিন্তু আইনজীবী সমাজের রাজনীতিতে প্রবাদপ্রতীক সাফল্য তাঁর বহুমাত্রিক সফলতার মাত্র একটি দিক। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুবক্তা ও সুলেখক। একজন প্রযুক্তি-নির্ভর অগ্রসর-আধুনিক মননের অধিকারী মানুষ তিনি। শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি দিয়ে শুরু করে তিনি জীবনের সকল পর্যায়ে অচিন্তনীয় সাংগঠনিক নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। শুরুতে ক্ষেতমজুর ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বার্থে তাঁকে চারণের মতো গ্রাম-গঞ্জে-জনপদে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষিতে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে জেলার অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে পরিণত হয়েছেন। যখন যেখানে থেকেছেন, সেখানেই সর্বোচ্চ অবদান রেখে শীর্ষতম স্থানে নিজেকে উত্তীর্ণ করার অসাধারণ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। মূলত একজন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী হলেও তাঁর জীবন ও কর্মের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সাহিত্য সাধনা ও সাংস্কৃতিক অনন্যতার নানামুখী প্রচেষ্টা। মনোদার্শনিক উচ্চতায় তিনি জীবন ও কর্মকে একটি সুস্নিগ্ধ আবহে পরিচালিত করেছেন সর্বদা। প্রকাশ করেছেন কাব্যগ্রন্থ, যা কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে কম রাজনীতিবিদ বা আইনজীবীর পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

নব্বই দশকের শেষ দিকে আমি যখন গবেষণার ছুটিতে ঢাকায় অবস্থানকালে আশি দশক থেকে আমার অতীত সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার কারণে কিংবদন্তী সম্পাদক তোয়াব খানের আমন্ত্রণে দৈনিক জনকণ্ঠ-এ বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি, তখন তিনি জনকণ্ঠে কিশোরগঞ্জের প্রতিনিধি হয়ে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি অনেকগুলো টিভি ও মিডিয়ার সঙ্গেও জড়িত হন। সাংবাদিকতায় তাঁর সাহসী ও আপোসহীন মনোভাব এবং বেশ কিছু আলোচিত রিপোর্টিং দেখে প্রায়শই আমি আশি দশকের শুরুর দিকে কিশোরগঞ্জে আমার সাংবাদিকতার পুরনো দিনগুলোর স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছি।

গণমানুষের প্রতি নিবেদিত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক তৃষ্ণা ও দার্শনিক প্রেরণা তাঁকে পেশার বাইরেও আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে টেনে নিয়েছে সব সময়। সর্বত্রই তিনি সত্য, সুন্দর ও মানুষের জয়গানে মুখরিত হয়েছেন। একজন কুসংস্কারমুক্ত, উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষক, গণতান্ত্রিক মতাদর্শের দীক্ষায় তিনি চেয়েছেন মানুষের সাংস্কৃতিক মানের এবং রাজনৈতিক তৎপরতার বিষয়গুলোকে পরিশুদ্ধ ও ঋদ্ধ করতে। নিজের সুললিত বচনের সুপ্রযুক্ত বাক্যাবলী দিয়ে কিশোরগঞ্জের মানুষকে সন্মোহিত করার যে দুর্লভ যোগ্যতা তিনি প্রদর্শন করেছেন, তা কিশোরগঞ্জের সমকালীন ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এমন মোহনীয় ও অদৃষ্টপূর্ব যোগ্যতা কারো কারো মধ্যে বহু বহু বছর পর পরিদৃষ্ট হয়। নিজের সামগ্রিক কৃতিত্ব ও যোগ্যতাকে তিনি মোটেও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেন নি। পরবর্তী প্রজন্ম ও অনুসারীদের মধ্যে প্রবহমান করতে নিরত ও সচেষ্ট রয়েছেন। তিনি পরিণত হয়েছে বৃহত্তর আওয়ামী লীগ পরিবারের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীদের সর্বক্ষণের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সুখে-দুখে-বিপদে-আপদে সকলের পাশে ছুটে যাওয়ার একটি বিশ্বস্ত নাম হয়ে বিরাজ করেছেন তিনি কিশোরগঞ্জের মানুষের কাছে। জীবনের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে নারীনেত্রী, শিল্প উদ্যোক্তা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব স্ত্রী এবং দুই কন্যাকে নিয়ে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হক কিশোরগঞ্জে শিল্পিত ভুবনের বাসিন্দা থেকে এখন আরেক অদেখা জগতের অধিবাসী। তাঁর অনুপস্থিতি ও অবর্তমানেও চলনে, বচনে ও যাপনে তাঁর বিশিষ্টতা সদা-দৃশ্যমান। কর্ম ও কীর্তির পরিস্ফূট বিন্যাসে তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে যে অভিজ্ঞতা ও অর্জন সঞ্চয় করেছেন ও মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন, তা এক জীবনের মহার্ঘ্য সম্পদ, যা তাঁকে বিত্ত, বৈভবের পাশাপাশি সুগভীর বোধের সমুদ্র-সমান বিশালতায় অভিষিক্ত করেছে।

অ্যাডভোকেট শাহ আজিজুল হকের সাফল্যের পেছনে শ্রম, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা ও ত্যাগের সূচক যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বুদ্ধি, মেধা, দক্ষতা ও কুশলার ছাপ। সঙ্কুল জীবনপথের নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সাফল্যের মোহনার সন্ধান পাওয়া এ কারণেই তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তদুপরি এরা সকলেই ওমনিলিজেন্ট। কারণ, তাঁর যাবতীয় অর্জন জ্ঞাননির্ভরতাকে আশ্রয় করেই সম্পন্ন হয়। যে জন্য, কিশোরগঞ্জের বিবেচনায় অনেক সম্ভাবনাময় ও অপেক্ষাকৃত অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা ব্যক্তিকে অতিক্রম করে পেশাগত যোগ্যতায়, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বকীয়তায় এবং সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে তিনি অগ্রগামী হতে পেরেছিলেন। তাঁর যাবতীয় অর্জনই পরিপূর্ণভাবেই ‘একক’, ‘স্বোপার্জিত’। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে ধরণের সামাজিক কাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাসকে তিনি পেরিয়ে এসেছিলেন, তা ক্রমশ পরিবর্তমান। বিশ্ব পরিস্থিতির পালাবদলের মতোই দেশজ অঙ্গনে জ্ঞান, শিক্ষা, মেধার প্রভাব ক্রম-হ্রাসমান। অর্থ, বিত্ত, শক্তি ও যোগাযোগ নির্ধারণ করছে চলমান সামাজিক স্তরবিন্যাসগত ক্ষমতার কাঠামোর বাস্তবতাকে। ফলে তাঁর মতো উজ্জ্বল ও অগ্রণী চরিত্র ধীরে ধীরে ‘ধ্রুপদ শৈলী’ বা ‘ক্লাসিক্যাল স্টাইল’-এর পুরনো প্রজন্মের স্থান দখল করছে। অথচ তিনি ও তাঁদের প্রজন্মের সাধনক্ষেত্র ছিল বহু-বিস্তৃত। কর্তৃত্ব জাহির করার মানসিকতা আদৌ তাঁদের ছিল না। অর্পিত কাজকেই জীবনব্রতে পরিণত করে তাঁরা যাপিত-জীবনকে উপভোগ ও সমৃদ্ধ করেছেন। কিশোরগঞ্জের সুমার্জিত নাগরিক সমাজের প্রতীক স্বরূপ তাঁরা নিঃসন্দেহে শেষ প্রতিনিধি বা ‘লাস্ট মুঘল’-এর মতো আভিজাত্য ও সুকুমার বৃত্তিতে আলোকময়।

তবে, যতই পরিবর্তনের পালাবদল হানা দিক, অতীত ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণের স্বার্থে অ্যাডভোকেট শাহ আজিজের মতো নমস্য ব্যক্তিবর্গের সংগ্রাম, সাধনা, অর্জন ও জীবনাদর্শ নানাভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে বিরাজমান থাকবে। কর্মফলের চেয়ে কর্মে আগ্রহ বেশি, তাঁর মতো এমন মানুষ আজ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অথচ তিনি কি পাবেন তার চিন্তা না করেই কাজের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। কাজের গভীরে প্রবেশের মাধ্যমে নিজের অবস্থান ও মর্যাদাকে স্বাভাবিকভাবে হাতের মুঠোয় পেয়েছিলেন তিনি। তিনি নিঃসন্দেহে অগ্রণী, অনুকরণযোগ্য এবং নিবেদিতপ্রাণ। বহুবিস্তৃত কর্মের জগতের বাসিন্দা হয়েও তিনি আত্মমগ্ন সাধকের জীবন যাপন করেছিলেন নিজের আলোকিত জগতে। এবং সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, বহু ব্যক্তির জীবনে তীব্র-আনন্দধ্বনিতে নান্দনিক প্রতিধ্বনি তুলেছিলেন। মৃত্যুর পরও তাঁর অপরিহার্য্য উপস্থিতি কিশোরগঞ্জের মানুষ ও সুমৃত্তিকায় মেধাদীপ্ত, মননঋদ্ধ, সৃজনশোভিত একজন অনন্য ব্যক্তিত্বের সুতীব্র শূন্যতায় ও অপরিসীম বেদনায় সঞ্চারিত হচ্ছে। কাল-কালান্তরে এবং প্রজন্ম ও পরম্পরায় তিনি প্রেরণাদায়ী আবহে সতত প্রবহমান থাকবেন কিশোরগঞ্জের ইতিহাসধারার বহুমাত্রিক স্রোতধারায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশন; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;