ইতিহাসে বাংলার মালো সম্প্রদায়

  • পায়েল দেশমুখ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসে বাংলার মালো সম্প্রদায়। সংগৃহীত।

ইতিহাসে বাংলার মালো সম্প্রদায়। সংগৃহীত।

জলকেন্দ্রিক মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীগুলি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের চর্চায় চিরকালই উপেক্ষিত। অথচ সুদূর প্রাচীন বাংলায় ‘সমুদ্রকুলোদ্ভব’ মহারাজ গোপালের (আ: ৭৫০-৭৫০ খ্রি) সময় থেকেই ও পরে কৈবর্ত বিদ্রোহের (একাদশ শতক) মধ্য দিয়ে এই মৎস্যজীবীগণ বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের বর্তমান আলোচ্য গ্রন্থটি ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ-পরবর্তী যুগে এই মৎস্যজীবী জলচারী গোষ্ঠীদের জীবনসংগ্রাম, আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান এবং সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ইতিহাসের একটি অনবদ্য রেখাচিত্র হয়ে উঠেছে।

রূপ কুমার বর্মণ রচিত এই গ্রন্থটি (Rup Kumar Barman: Caste, Class and Culture: The Malos, Adwaita Malla Barman and History of India and Bangladesh, New Delhi, Abhijeet Publications, 2020, Hardback, ISBN 978-93-88865-49-4, Printed Price: 960/- INR, Page Number: 224)  মূলতঃ মালো জনগোষ্ঠী এবং তাঁদের আত্মপরিচয়-অন্বেষার একটি ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ। বইটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত মালো সমাজের অন্যতম বৌদ্ধিক প্রতিভূ তথা বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ অদ্বৈত মল্লবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) সাহিত্যিক জগতের বিশ্লেষণ ও তা কিভাবে মালো জগতের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে তার বিশ্লেষণ। সম্পূর্ণ গ্রন্থটি ভূমিকা ও উপসংহার ব্যতীত তিনটি অধ্যায়ে বিভক্তঃ ১. ঔপনিবেশিক বাংলায় মালোদের অবস্থান (The Malos of Colonial Bengal), ২. বর্ণ, শ্রেণি ও জাতীয়তাবাদী সচেতনতার আলোকে মালো জনগোষ্ঠী (The Malos in Caste, Class and Nationalist Consciousness), ৩. সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রবাহমানতাঃ ও মালো জনগোষ্ঠীর অবদান (The Literary Culture and Continuity: The Contribution of the Malos’)।

বিজ্ঞাপন

গ্রন্থটির  ভূমিকাংশে লেখক দেখিয়েছেন যে কিভাবে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে ভারতে প্রথাগত ইতিহাসচর্চায় তপশিলি সম্প্রদায়গুলির ইতিহাসচর্চা উপেক্ষিত হয়েছে এবং নমঃশূদ্র ও মতুয়া সম্প্রদায় ব্যাতীত অন্য কোনো বর্গের রাজনৈতিক উচ্চাশা এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম অনালোচিত থেকে গেছে। গায়ত্রী স্পিভাকের সাবঅল্টার্নের কণ্ঠস্বরের অভাবের তত্ত্বের বিরোধিতা করে লেখক দেখিয়েছেন বাংলার তপশিলি জাতিগুলির স্বাধীন লেখনী ও কণ্ঠস্বরের কথা যা ভদ্রলোক উচ্চবিত্তের বৌদ্ধিক জগতের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে পেরেছিল।

প্রথম অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন যে কিভাবে বাংলার বিভিন্ন  মৎস্যজীবি জাতিগুলি যেমন ঝালোমালো, জেলিয়া কৈবর্ত, ক্যাওট, জলদাস, ইত্যাদি ঔপনিবেশিক জনগণনা এবং নথিতে স্থুলভাবে  জেলে/জেলিয়া/মাছুয়া নামে অভিহিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী তত্ত্ব (eugenics) এদের একমাত্রিক ভাবে আদি জনগোষ্ঠী এবং দ্রাবিড়-সুলভ শারীরিক বৈশিষ্টের অধিকারীরূপে চিহ্নিত করেছে। এর বিরুদ্ধে অবশ্য মালোদের মধ্যে একটি প্রতিবাদী স্বর দীর্ঘদিন যাবৎ দেখা যাচ্ছিল এবং ১৯১৪ সালে রচিত মহেন্দ্রনাথ মল্লবর্মণ লিখিত গ্রন্থ ‘ঝাল মালো তত্ত্বে’ (ময়মনসিংহ, ১৯১৪) মালোদের মল্লক্ষত্রিয় ঐতিহ্য দাবি করা হয়। লেখক এই অধ্যায়ে বাংলার বিভিন্ন মৎস্যজীবী ও জলজগৎ-কেন্দ্রিক রচনাগুলির (যেমন মানিক বন্দোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, আবদুল জব্বার, আব্দুল ইশাক, অমরেন্দ্র দাস, প্রমুখের রচনা) অতিরঞ্জনের পাশে অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের বৈশিষ্টগুলি এবং এই উপন্যাসের বিভিন্ন উদ্ধৃতির মাধ্যমে মালো জনজীবনের নানা বৈশিষ্ট উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন যে কিভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষ কয়েক দশকে এবং স্বাধীনতা ও দেশ বিভাজনোত্তর পর্বে প্রাদেশিক রাজনীতিতে মালোদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। হিন্দু মহাসভা এবং জাতীয় কংগ্রেস উভয়েরই তপশিলি ভোট ব্যাঙ্কে মালোদের ভূমিকা ছিল এবং প্রাদেশিক আইনসভায় মালোরা প্রতিনিধিত্বও করেন। এই সময় যাবৎ মা্লোদের মধ্যে একপ্রকার ‘ক্ষত্রিয়করণে’র ধারা বহমান ছিল। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ‘নিখিল বঙ্গীয় আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবি সমিতি’ প্রতিষ্ঠায় অন্য মৎস্যজীবী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মালোরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। মূলত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে। এরই পাশাপাশি আমরা দেখি, রামরতন বর্মণ, হরেন্দ্রকুমার বর্মণ, দ্বারকানাথ বর্মণ, হারান চন্দ্র বর্মণ, ভোলানাথ বিশ্বাস, প্রমুখ মালো ব্যক্তিত্বগণ স্বাধীনতার পূর্বে বিভিন্ন অ-মুসলিম বিধানসভার ভোটকেন্দ্রগুলি থেকে লড়াই করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পশ্চিমবঙ্গ মৎস্যজীবি সমিতি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সুদীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই সমিতি মৎস্যজীবিদের আড়তদার ও মহাজনদের শোষণের  ভূমিকার বিরুদ্ধে স্বার্থরক্ষার এবং সার্বিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ১৯৫৩ সাল থেকেই মালোদের সক্রিয় ভূমিকায় পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যজীবীদের আন্দোলন তথা বিখ্যাত  ‘জল যার জলা তার’ স্লোগান ধ্বনিত হয়। এই অধ্যায়টি সমাপ্ত হয়েছে ‘Adwaita Malla Barman Educational and Cultural Society’র গঠন এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্য এবং স্মৃতি উদ্ধার ও সংরক্ষণ এবং মালোদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁদের ভূমিকার বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

তৃতীয় অধ্যায়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিভিন্ন ছোট গল্প (যেমন আশালতার মৃত্যু), প্রবন্ধ, কবিতা ও উপন্যাসগুলিকে (সাদা হাওয়া, রাঙামাটি ও তিতাস একটি নদীর নাম*) বিশ্লেষণ করে মালো জনজীবন এবং এই রচনাগুলিতে তাঁদের বাস্তবতার কথা দেখানো হয়েছে। উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩) এবং ঋত্বিক কুমার ঘটকের (১৯২৫-১৯৭৬) পরিচালনায় তিতাস একটি নদীর নামের থিয়েটার এবং চলচ্চিত্রায়ণ কিভাবে এই উপন্যাসকে বৃহত্তরভাবে মানুষের কাছে ও বিশেষত মালোদের কাছে পৌঁছে দেয় তার আলোচনা রয়েছে। এই অধ্যায়ে আমরা দেখি, অদ্বৈত মল্লবর্মণের পরবর্তী যুগের মালো লেখকরা যথা ইন্দ্রজিৎ মল্লবর্মণ, রাজারাম বিশ্বাস, সুশান্ত হালদার, হরেকৃষ্ণ বিশ্বাস এবং শেষে গোবিন্দ হালদারের (১৯৩০-২০১৫) সাহিত্যসম্ভারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে (১৯৭১) জন্য গোবিন্দ হালদার রচিত গানগুলি যথা- এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, ইত্যাদির কথা পাঠকের চিত্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বইটির সংযোজনী অংশগুলিতে আছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের বিল ও জলাভূমির সংখ্যা, মালো ও অন্যান্য  তপশিলি সম্প্রদায়সমূহের জাত্যাগ্রশরণ আন্দোলন (Caste Mobility) সম্পর্কে সারণী, কল্পনা বর্ধনের পত্রাদি, মালোদের বিষয়ে H.H.Risleyর বর্ণনা (১৮৯১) এবং গোবিন্দ হালদারের গানগুলির লিরিক যা নিঃসন্দেহে বইটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, রূপকুমার বর্মণের বইটিতে দেখানো হয়েছে বর্তমান ‘দলিত প্রতর্ক’ (Dalit Discourse) ও চর্চায় মালোরা ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন এবং ঔপনিবেশিক বাংলায় তপশিলি জাতির চেতনা ও সামাজিক-ন্যায়ের ক্ষেত্রটির আলোচনা মালোদের ব্যাতিত সম্ভবপর নয়।

[* পূর্ববঙ্গীয় প্রান্তিক জনজীবন থেকে উত্থিত এক অনামা লেখকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসটি আত্মপ্রকাশের ঐতিহাসিক সুযোগ লাভ করে মাওলানা আকরম খাঁ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'মাসিক মোহাম্মদী'তে। কয়েকটি অধ্যায় মোহাম্মদীতে মুদ্রিত হবার পর উপন্যাসটির মূল পাণ্ডুলিপি রাস্তায় হারিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব ও অত্যাগ্রহী পাঠকদের আন্তরিক অনুরোধে তিনি পুনরায় কাহিনীটি লেখেন। কাঁচড়াপাড়া হাসপাতালে ভর্তির আগে এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি বন্ধু-বান্ধবকে দিয়ে যান। অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যুর কয়েক বছর পর 'তিতাস একটি নদীর নাম' শিরোনামের এই উপন্যাসটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।]

লেখক: পায়েল দেশমুখ, গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।