কথাকার হুমায়ূন আহমেদকে বাঙালি মনে রাখবে

  • স্বপন দত্ত
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কথাকার হুমায়ূন আহমেদ

কথাকার হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক। বহুল লোকনন্দিত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে এখন তাঁকে তুলনায় আনা হয়। শরৎচন্দ্র করেছিলেন সেকালের সমাজচিত্র অঙ্কন, আর হুমায়ূন করেছেন একালের যৌবমানস চিত্রণ। এর সাথে কোনো ভিন্নমত প্রকাশের তেমন যুক্তি নেই। জনপ্রিয় উপন্যাসসমূহ  লিখে হুমায়ূন আহমেদ এ দেশের নবীন প্রজন্মের বিশাল এক অংশকে তিনি তাঁর পাঠক করে তুলতে পেরেছিলেন। একে বড়ো ধরনের সফলতা বলাই সঙ্গত।

তবে, হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস "নন্দিত নরকে" গ্রন্থ দিয়ে। পরপর প্রকাশিত হয় "শঙ্খনীল কারাগার" ও "তোমাদের জন্য ভালোবাসা" গ্রন্থদ্বয়। এতেই বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে তিনি মননশীল সাহিত্যিকের অভিধা পেয়ে যান। "নন্দিত নরকে" উপন্যাসের বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় তাঁকে বাংলাদেশের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রূপে অভিহিত করা হতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তীতে তাঁর লেখনির প্রকৃতির রূপান্তর ঘটে। প্রকাশকের দল এখানে প্রতিযোগিতায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলত, হুমায়ূন আহমেদকে অর্থের পেছনে ছুটতে হয় নি। বরং অর্থই তাঁকে পিছু ধাওয়া করেছে। এভাবে সাফল্য হুমায়ূনের দুয়ারে বাঁধা পড়ে থাকে।

সত্যিই সে সময় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের স্বাধীনতোত্তর কালে বাংলাদেশের সাহিত্যের ধারায় নব চিন্তার সংযোজন ঘটাতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পরিপূর্ণ (তাঁর ভাষায়) ভাবে লেখক জীবনের অনিশ্চিত যাত্রার অভিযাত্রী হয়ে পড়েন। তাঁর এ ধরনের মননশীল অভিযানকে সাফল্য দানেরও পথ বেছে নেন। এ ধরনের কৌশল বেছে নেওয়ার অধিকার তিনি অবশ্যই রাখেন, যেহেতু তিনি ভবিষ্যতের বিপদসংকুল পথটি গ্রহণ করেছেন। এবং সুখের কথা এ অভিযানে তিনি সাফল্যকে করায়ত্ত করেছেন। এ সফলতার রাস হাতে নিতে পারায় কুর্ণিশ জানাতে হয়  তাঁকে। লেখক হিসাবে ভবিষ্যৎ তাঁকে মনে রাখবে কি-না এ নিয়ে আমাদের সারস্বত মহলে নানা দোলাচল দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে এতো কথা কীসের, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

একটি ঘটনার কথা বলে আমার বক্তব্যের ইতি টানি। সম্ভবত ১৯৮৮ সালের কথা। তখন স্বৈরাচারখ্যাত লে. জেনারেল হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমল। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতাসীনরা ক্রমাগত রাজাকারী দর্শনের দলকে তোষণ করে চলেছে। এরশাদের আমলেও রাজাকারদের রমরমা মূল্য এ দেশের প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী রাজনীতিতে। ঘটনাটি এই সময়ের।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে চলছে হুমায়ূন আহমেদের "বহুব্রীহি" ধারাবাহিক নাটক। সেই নাটকে, অনেক চাপ উপেক্ষা করে সেইকালের অবরুদ্ধ সময়ের বাংলাদেশে, হাজার হাজার টিয়া পাখির মুখ দিয়ে সারা বাংলার আকাশে বাতাসে "তুই রাজাকার, তুই রাজাকার" সংলাপটি তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। রাজাকার শব্দটি উচ্চারণ করা তখন প্রায় নিষিদ্ধ। সেদিন রাজাকার শব্দটি এভাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যেই তাঁর স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত।

বিষয়টা শুধু পাখিদের সংলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। এর পর থেকেই নাট্যাংশের, একটি চরিত্র, বৃদ্ধা গৃহকর্মীর ঘর ঝাড়পোছ করার সময় বিভিন্ন আসবাবপত্রের উপর ঝাড়ুপেটা করে 'তুই রাজাকার, তুই রাজাকার' সংলাপ উচ্চারণ ছিলো অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় দৃশ্যায়ন।

এর মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের জনগণের অবরুদ্ধ ঘৃণার নদনদীগুলোকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ওই সংলাপ উচ্চারণে মানুষেরা প্রচণ্ড উল্লসিত হতো। সেকালের ক্ষমতার তোষকশ্রেণীর মনেও ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো গণ-উচ্চারিত এ সংলাপ। এর জন্যেও হুমায়ূন আহমেদের চির স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত।