জয়নব আরা বেগমের কবিতায় মনস্বিতা



মমতাজ উদ্দিন আহমদ
জয়নব আরা বেগমের কবিতায় মনস্বিতা

জয়নব আরা বেগমের কবিতায় মনস্বিতা

  • Font increase
  • Font Decrease

 

জয়নব আরা বেগম (২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৮) বাংলা কবিতার রথে উঠে আসা একটি নাম। পেশায় শিক্ষক হলেও লিখনিতে সিদ্ধহস্ত অর্জন করছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে প্রনষ্ট সময়ের অভিঘাতের বিষন্নতা। আবার কখনোবা প্রকাশ ঘটে নস্টালজিয়া, কখনো অন্তর্বিহীন মৌন-নিস্তব্ধতা, মানবীয় ভালোবাসার অন্তর্লীনতা এবং নির্মোহ সম্পর্কের গভীর আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রকাশ।

জয়নব আরা বেগমের কবিতায় রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কবিতাগুলো অনুরাগী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনতিদীর্ঘ, অনলস, তেজস্বী ও মনস্বী অনুশীলনের চাপ লক্ষ্যণীয় তাঁর কবিতায়। প্রচলিত আধুনিক কবিতার ধারায় রচিত হয়েছে তাঁর কাব্যের শরীর। এতে রয়েছে গভীর রসবোধ, সমাজচিন্তন, নারী-পুরুষের চিরকালীন প্রেম-বিরহ ও উদার-নৈতিকতার সুসমন্বয়। কবিতাগুলোতে রয়েছে বিদগ্ধ আত্মমগ্নতা। আবার কখনো বা ইহজাগতিক ভাবনার সাথে পরলৌকিকতার সংমিশ্রণ।

সাহিত্যের নানান শাখার তুলনায় বোদ্ধা মহলে কবিতার আলোচনাই সর্বাধিক। কবিতা অনন্ত শক্তির উৎসধারাও বটে। তাই কবিতার সংজ্ঞা পুরোপুরি দেয়া কঠিন। কবিতার কল্পনার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা কী কবিও দিতে পারেন কিনা তা পাঠকমাত্রই সন্দিহান থাকেন। জয়নব আরা বেগমের আধুমিক কবিতাগুলো পড়লে মনে লাগে সুর-ছন্দের তীব্র আকস্মিক শব্দতীর, পৌঁছে যায় অন্তরেরও ভেতর!

‘কবিতা অনন্ত শক্তির উৎসধারা’। সে ভাবনা থেকে বলা যায়, জয়নব আরা বেগমের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ ও ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর কবিতাগুলোয় রয়েছে নিজস্ব একটি গতিধারা। আছে ভাবের প্রাচুর্য। তাঁর প্রতিটি কবিতায় যে তৃষ্ণাবোধ রয়েছে তা দৃশ্যমান বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কবিতায় রয়েছে দৃশ্যমান বাস্তবতা থেকে ভিন্ন দৃশ্য তৈরীর সক্ষমতা।

কবি অসাধারণ সব শব্দের বুননে তৈরী করেন নিজের ক্ষুরধার লিখনীতে কবিতামালা। সাধারণ কল্পনার উর্ধ্বে উঠে কবিতায় তিনি নিজস্ব কল্পনায় শিল্পবুনেন। কবি মূহূর্তের অভিজ্ঞতা থেকে চলে যান সুদূরে। মাঝে মাঝে কল্পলোকের সিংহধারে পৌঁছে বেদনার বেদীমুলে অনর্থক শাপবর্ষণ করেন প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে। সেখানে থাকে না বাস্তবতার কোন সীমারেখাও! সেখানে শুধুই কল্পলোকের ঘরবসতি!

বসন্তের নিদাঘ-শোভা আমাদের শরীর-মনকে জাগিয়ে তোলে। সে অনুভূতি যৌবনের। কবিতায়ও বসন্তের দৃশ্য ও বাতাসের ঝড়োগতি ও আত্মজাগরণ নিয়ে আসতে পারেন কবিরা। যেমন- আমাদের জাতীয় কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা একটি আত্মজাগরণের কবিতা। সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়গান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে চরণে সুস্পষ্টরূপে দেদীপ্যমান। এ কবিতায় ১২১ বার ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে কবি প্রতীয়মান করেছেন মানুষ অসম শক্তির অধিকারী!

কবি মূলতঃ অনন্ত কল্পনা শক্তি দিয়ে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ছন্দ-মাত্রায় কবিতা বুনেন। এটি অত্যন্ত দূরহ কাজ বটে। জয়নব আরা বেগম তাঁর কবিতায় সাম্য, সত্য-সততা, প্রেম-অনুরাগ, ক্ষোভ, চাওয়া-পাওয়া, আশাহত জীবনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা এবং সমাজের মিল-অমিল বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ মনের আয়নার ফ্র্রেমে।

কবিতায় মনের ভাবপ্রকাশের অবদান বিশ্ববিশ্রুত। কবির কবিতা শরীর-মনের চারদিকে অনুভূতি জাগিয়ে দিতে সক্ষম। সে অনুভূতি যৌবনের, সে অনুভূতি পাওয়া-না পাওয়ার বেদনাকাব্য। পল্লী মানুষের জীবন নির্ভর আধুনিক কবিতায় সিদ্ধহস্ত কবি জয়নব আরা বেগম।

ছোট্ট পরিসরে কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কবিতার শক্তির উৎসধারার নাগাল খুব কম মানুষই পান। কবিতার রূপ-আকৃতি-প্রকৃতি একেক জনের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। তাই প্রত্যেক কবির আলাদা আলাদা ভাবের জগতের সাথে আমরা পরিচিত। মৌলিক কবির ভাবের জগৎ সর্বদাই আলাদা। যেমন গত শতকে রবীন্দ্র বলয়ে প্রদক্ষিণ করেও নজরুল তাঁর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই হয়েছেন কালজয়ী।

কবিতা কি! কী তার পরিচয়? তার সহজ বর্ণনা পাই কবি আল মাহমুদের ‘কবিতা এখন’ কবিতাটি পাঠে। কবিতাটির শেষাংশটি এমন-

‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস

ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর

গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর

কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’

কবিতা এক-একজনের কাছে ধরা দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি দিয়ে। কবিতার সহজ বর্ণনায় যেভাবে ‘মক্তবের চুলখোলা আয়েশা আক্তার’ এর বর্ণনা উঠে আসে তেমনি আমরা দেখতে পাই জটিল-কঠিন বর্ণনার পক্তিমালাও। যাঁর মাথামু-ু সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতাই বাইরে। এদিক দিয়ে কবি জয়নবের কবিতাগুলোর শব্দগাঁথুনি বেশ সাবলিল ও ঝরঝরে।

কবি জয়নব আরা বেগমের কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’র কবিতা ‘শব্দের তাঁতী’তে কবিতার রূপ ধরা পড়েছে এভাবে-

‘সোনার সুতোয় রূপোর গিট মেরে

বুনন করি রেশমী কবিতা।

অজানার অতৃপ্তি ঘুচাতে

নিজেকে পিপাসার্ত করে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য

গণ্ডুষ ভরে পান করি

সাহিত্য-সংস্কৃতির রস।

তারপর নিজের মত কলম ঘুরাই

কখনো স্বপ্নে হারাই।’

তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর ২৫-২৬ পৃষ্ঠার একটি কবিতার নাম ‘কবিতা’। এ কবিতাটির শেষাংশে ‘কবিতা’র পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

‘বোমার আগুনে ধ্বংস ও বিরান হয়ে যাওয়া

দগ্ধ প্রান্তরে

নতুন আশ্বাসের বাণী শোনায়।

জীবনের সঞ্চিনী বাড়ায়-

বিমর্ষ তালিকার নাম মুছে দিয়ে।

সে অন্য কেউ নয়- ‘কবিতা’।’ (চম্বুক অংশ: কবিতা, আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ)।

তাঁর কবিতায় মাঝে মাঝে ধরা পড়ে শিল্পিত ভাবনার স্বাধীন প্রকাশ। কবির বিরহী ভাবনা, কবিতার ঝাঁঝালো ভাষা আর পঙতি যেন এক একটি বুলেট। এতে ধরা পড়ে তাঁর অন্তরের প্রবল শক্তি। যে শক্তি জ্ঞানগম্মিদের ধারণারও উর্ধ্বে। কবি তাঁর ‘অশ্রুপ্লাবন’ কবিতায় লিখেন-

‘বিশ্বাসের একাগ্রতায় আমার বুকে

তোমার প্রেমকে ধারণ করে

প্রাণের মধ্যে খুঁজেছি প্রাণের বাঁধন।’ 

তখন পাঠকমাত্রেই হৃদয়ের অলিন্দে খুঁজে পান কবির প্রেমারাধানার সাধনা আর ভাবনার সীমারেখা। একইসাথে খুঁজে পান কবির ব্যথিত হৃদয়ের প্রকাশের ব্যাপ্তির গভীরতা। আবার যখন দেখি-

‘পাষাণে পরান বেঁধে,

ম্লান বেশে সজল নয়নে

নিজের বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনি

আজ আমাকে করছে ক্ষত-বিক্ষত’।

                                (‘অশ্রপ্লাবন’ : সমর্পিত শব্দাবলী)

এখানে পাঠকমাত্রই কবির হৃদয়ে বেদনার অনুরণন দেখে ব্যথিত হন। যখন কবি বলেন, ‘বেদনার শতদল হয়ে ফুটে আছি যন্ত্রণা দিঘীর মাঝখানে‘ তখন পাঠকের হৃদয়ে কবির যন্ত্রণা দিঘীতে শাপলা ফুটানোর আকুলতা সৃষ্টি করে। কবি পাঠকের মনকে আকাঙ্খিত করে তোলেন কষ্টের দিঘীতে শাপলা ফোটানোর। কবি যখন লেখেন-

‘অকারণে শুধু আজ মনে বাজে বেদনার তান,

বুকে বাজে হাহাকার করতালি-

অশ্রুপ্লাবনে হাবুডুবু খাই বেদনার উপকূলে’।

                                (‘অশ্রুপ্লাবন’ : সমর্পিত শব্দাবলী)

কবি এখানে নিজেই স্বীকার করেছেন ‘অকারণে আজ মনে বাজে বেদনার তান’। এখানে কবির কল্পনা ধরা পড়ে। কবির দুঃখের কারণে যোগ হয়েছে অকারণ ভাবনা-কল্পনা। কবির এ বিরহের মধ্যে বাস্তব অনুষঙ্গ নেই। আছে শুধু প্রিয়জনের প্রতি অকারণ দ্বেষ আর অনুচিত শাপবর্ষণ। কবির বিরহ এখানে শুধুই কল্পনাপ্রসুত। যাতে বাস্তবতার সংশ্লেষ নেই।

কবি জয়নব আরা বেগমের কাব্যগ্রন্থ ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ এবং ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ’ এর ১০৩ টি কবিতার মধ্যে অনেকগুলো কবিতাই বেশ উঁচুমর্গের বলে মনে হয়। সাহিত্য সমালোচকের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন বিখ্যাত কবিও কবিতাকে দেখেছেন বিভিন্ন রূপে। সেদিক দিয়ে তাঁর কবিতার মূল অনুষঙ্গ কি তা সময়ই বলে দেবে একদিন।

কবিতাই কবির মননের পরিচয় বহন করে। দু’টি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় পরিবেশ-প্রকৃতি, প্রেম, সমাজ-সভ্যতা, সুখ-দুঃখ, প্রতিবাদ, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা-মৌনতা, রাগ-অনুরাগ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানান প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে শব্দ-তরঙ্গে।

নারী প্রেমিকা; নারী কবিতার শক্তির উৎস। কবিতার অন্যতম উপজীব্যও বটে নারী। যেমনিভাবে নারী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেন-

‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,

যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

নর দিল ক্ষুধা, নারী দিল সুধা, সুধায় ক্ষুধায় মিলে’

জন্ম লভিছে মহামানবের মহাশিশু তিলে তিলে!’

কিন্তু নারীই যখন হয়ে উঠেন কবি তখনও প্রাধান্য পায় এমন কাউকে ঘিরে। যা তার মানসসঙ্গী! কবি জয়নব আরা বেগম লিখলেন,

‘হৃদয়ের সোনালী কুঞ্চন ভেঙ্গে

নক্ষত্র হয়ে এসেছিলে তুমি

কোন এক বুধবার সন্ধ্যায়।

স্নায়ুর ভেতর টগবগ করেছিলো রক্তরস।

স্বাদে-গন্ধে সিক্ত হয়েছিলাম,

নিমফুলের স্নিগ্ধ গন্ধের মতো

একটা গন্ধ আমাকে মাতিয়ে রেখেছিলো;

ধুকপুক হৃদয়ে অনুভব করেছিলাম

এক রহস্যময় ভালোলাগা।

(প্রথম স্পর্শ : সমর্পিত শব্দাবলী)

তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরর বীজ’ এর কবিতা ‘অস্তিত্বের রেণু’তে কবি লিখলেন-

‘যদি কখনো তোমার প্রত্যাখানের কৃষ্ণবলয়

আমাকে এসে গ্রাস করে,

তবে সেই দিন যেন পৃথিবীর

অন্তিম দিন হয় আমার।

আমার যাত্রা-পথের দিন-রাত্রির

উত্থান-পতনে তুমি রোমাঞ্চ পুলক।

তোমার ভালোবাসার রহস্য সৃজনের পঞ্চভূত

আমার বুকের তপস্যা।’

এ কবিতাগ্রন্থ দু’টির কবিতাগুলোয় প্রেম-পরিবেশ-প্রকৃতি ধরা পড়েছে বেশ আধুনিক কবিতার পঙ্তিমালায়। পাঠককে দোলা দেয় কবিতাগুলো। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় শিল্প-প্রকরণ, আদর্শ-চেতনা, চিন্তা প্রভৃতির গভীরতা অনেকখানি গভীর। কবিতায় তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও বলিষ্ঠতা এবং ইচ্ছাশক্তির প্রচ-তা কবিতার শব্দের ভারী ওজন প্রভৃতি গুণ আমরা ভবিষ্যতেও লক্ষ্য করবো বলে আশা করি। এছাড়া ভাষার-বৈচিত্র্য এবং নিজস্বতায় আলাদা সুর সৃষ্টি হোক তাঁর কবিতায় এ প্রত্যাশা।

মানুষ ঐতিহ্য অনুসন্ধানে এবং দেশপ্রেমে আগ্রহী। ঐতিহ্যসন্ধান মানেই তার অস্তিত্ব অনুসন্ধান করা। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সমাজের চারপাশকে ঘিরে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনাচরণ। কবি তাঁর চারপাশ থেকে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন। প্রকাশ করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘স্বদেশ’ কবিতায় কবি জয়নব আরা বেগম লিখলেন-

‘বটের ডালে কালো কোকিল

ডাকছে কুহুতানে,

তারই সুরে মন ভরে যায়

স্বপ্ন জাগে প্রাণে-

এমনি সুখের স্বপ্ন পারে

ভাসছি সুখের তারে।’

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে অন্তবির্হিন মৌননিস্তব্ধ সৌন্দর্যের দিগন্ত বিস্তৃত গ্রন্থিল পাহাড়ি জনপদ বান্দরবান। এই অপরূপ বান্দরবান জেলাকে নিয়ে কবি জয়নব আরা বেগম লিখেছেন ১০০ লাইনের ৫০০ শব্দের দীর্ঘ একটি কবিতা। কবিতাটি শুরু এবং শেষের পঙ্তিগুলো এই-

‘পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের মেলা,

তারি সাথে মেঘ খেলে লুকোচুরি খেলা।

ঝর্ণা-পাহাড়-নদী আর সবুজ বন,

অপরূপ রূপ দেখে হারায় এ মন।

---

পাহাড়ি-বাঙ্গালী সম্প্রীতি অটুট এখানে

ছুটে আসে সব সুখ তাই এই পানে।

জন্মেছি এইখানে কী চাই আর,

আমার জেলা ‘বান্দরবান’ আমার অহংকার।’

(বান্দরবান : আঁধার ক্ষেতে বুনেছি ভোরের বীজ)।

কবি জয়নব আরা বেগম লোকজ-উপাদানে শৈল্পিক করে সাজিয়েছেন তার কবিতার অবয়ব। মা, বাবা, গন্তব্য, প্রথম স্পর্শ, সুঁই সুতো, বেদনার শব্দ, নালিশ, মিনতি, হৃদমাঝার, বাজখাই অধিকার, বিশ্বাসের ঝুলি, অনন্ত তৃপ্তি, স্বর্গীয় পুলক, স্বপ্নস্নান, অনন্ত সুখ, জৈব বিষ, আমি মুক্তি চাই, সোনালী সূর্য, ধিক্কার ধ্বনী, শব্দের তাঁতী, হিরক রাজা, মন পদ্মের ঢেউ, তোমাকে ভালোবাসি বলে, ভীনগ্রহবাসী, সলজ্জ আস্তানা, বান্দরবান, চন্দ্রালোকের সিঁড়ি, আগামীর প্রত্যাশা , অথৈ যমুনা, যন্ত্রণার ঐশ্বর্য্য, স্বদেশ, সর্বগ্রাসী, নারী, বিশ্বাস, দৈবধন, ভালোবাসা ও ঘৃণা, নিন্দাবাদের বৃন্দাবন, হে অমানিশা, অস্তিত্বের রেণু, সুপ্রিয়’ ইত্যাদি কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে স্মৃতিকথার উপাদান। কয়েকটি নস্টালজিক কবিতা পড়লে পাঠক ফিরে যাবেন অতীতে।

কবি জয়নব আরা বেগমের কবিতায় ইসলামী মিথ এবং পুরাণের ব্যবহার তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। বাঙ্গালী মুসলিম কবিদের মাঝে যাঁরা তাঁদের কবিতায় ইসলামী মিথের ব্যবহার করেছেন তারা বাঙ্গালী মুসলিম মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তদ্রুপভাবে কবিতায় পুরানের ব্যবহারও বাঙ্গালী মানসকে সমানভাবে আকর্ষণ করে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ তাঁর কবিতায় এ দু’টি মিথ এর দারুণ সমন্বয় করেছেন। ফলে তার অনেক কবিতাই মানুষের বোধ-বিশ্বাস, অস্তি-মজ্জার কথা বলে বিধায় কবিতাগুলো নিত্য প্রাসঙ্গিক।

পাশাপাশি কবিতায় ইংরেজি, আরবি, উর্দু-ফারসি, প্রাচীন সংস্কৃত ও সাধু ভাষার শব্দের জুঁতসই ব্যবহার করলে কবিতাগুলো আরো সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে বলে মনে করি। তাঁর কবিতায় উঠে আসুক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্না, অনুভব-অনুভূতির শৈল্পিক বুনন। লোকজ শব্দ, ঐহিত্য চেতনা, ধর্মাশ্রয়ী কবিতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর কাব্যের দুয়ার আরো খোলে অপূর্ব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হোক! ‘সমর্পিত শব্দাবলী’ কবির প্রথম দিকের কবিতার সমারোহের গ্রন্থিত রূপ।

কবি জয়নব আরা বেগম পেশায় একজন শিক্ষক। ১৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তাঁর রয়েছে অনেক অর্জন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন পরিচালিত ‘শিক্ষক বাতায়নে’ একজন সক্রিয় ও সেরা শিক্ষক। ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রী থেকে সেরা শিক্ষক এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তাঁর তৈরি মাল্টিমিডিয়া মডেল কন্টেন্টগুলো দেশের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরূমে পাঠোপযোগী। মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রতিযোগিতা ২০১৭-এ এটুআই কর্তৃক তিনি দেশসেরা শিক্ষক নির্বাচিত হন। বান্দরবান জেলায় একাধিকবার তিনি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক তাঁকে স্টাডি ট্যুরে মালয়েশিয়া সফরে পাঠানো হয়।

গ্লোবাল লার্নিং এর উপর উচ্চতর অভিজ্ঞতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি লন্ডন সফর করেন। তাঁর এ সফরের ব্যয়ভার বহন করে সরকার ও ব্রিটিশ কাউন্সিল। লন্ডনের স্কটস প্রাইমারি স্কুলে তিনি অতিথি শিক্ষক ছিলেন। ইউকে ভিজিটকালে লন্ডনের হেভারিং এর মেয়র ব্রায়ান ইগলিং তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে রানীর পোষাক পরিয়ে সম্মাননা এবং এ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন। এছাড়াও কবি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন একাধিক সম্মাননা।

একটি সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জয়নব আরা বেগমের জন্ম ও বেড়ে উঠা। পৈত্রিক বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্ব কাকারা গ্রামে। বাবা জয়নাল আবেদীন একজন ব্যবসায়ী। মাতা হোছনে আরা বেগম গৃহিনী। চাকুরিসূত্রে তিনি বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা।

লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;