ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৭



মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

[সপ্তম কিস্তি]
ঘোরাক্রান্তের মতো ক্যাভিনের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে নির্ধারিত সময়ের আগেই উইলিয়ামের হাতে তুলে দেন ম্যারি। ম্যারির শুধুই মনে হয়, বইটি ক্যাভিন সাধারণভাবে পাঠকের জন্য লিখতেও বিশেষভাবে লিখেছেন তার জন্য। এতো দিন একসাথে থেকে যে ক্যাভিনকে ম্যারি চিনতে পারেননি, তার বই সেই চেনাজানার দুরত্ব নিমেষে ঘুচিয়ে দিয়েছে।

সম্পাদনার কাজে বার বার বইটি পড়ে অনেক দিন বাদে ম্যারির মধ্যে তৃপ্তির ভাব তৈরি হয়েছে। আসলেই তো, ক্যাভিন মুখে না বললেও, যেমন আশা করেছে, ম্যারি না জেনেই তেমনটিই করেছে এতোদিন ধরে। প্রচণ্ড চেষ্টায় টমাসকে যত্ন করেছে। বাবার অভাব মোটেও বুঝতে দেয় নি। মাতৃত্বের পেলবতার সঙ্গে পিতৃত্বের দায়িত্বশীলতা মিশিয়ে আপত্য স্নেহে লালন করেছেন তিনি টমাসকে। নিজের পুরো জীবনকে তিনি সীমায়িক করেছেন টমাসকে ঘিরে। তার স্কুল, খেলার মাঠ, ঘুরতে যাওয়া সবকিছুতে সঙ্গে থেকেছেন ম্যারি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার কথা বিশেষ একটা আলাপ করে না টমাস। শুধু অনুভব করে, বাবা আছেন।

ক্যাভিনকে হাতের কাছে না পেয়ে ম্যারি মনে মনে প্রায়ই তার সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত হন:

“আমি চেষ্টা করেছি তোমার ছেলেকে তোমার অভাব বুঝতে না দিতে। কিন্তু তুমি কি জানো, আমার জীবনে এখনো তোমার অভাব আমি অনুভব করি।”

ম্যারি জানেন, এসব কথা কোনো দিনও ক্যাভিনকে বলা হবে না। আবার তিনি এটাও জানেন, ক্যাভিনকে একেবারেই ভুলে যাওয়া অসম্ভব। অনেক প্রাপ্তি ও স্মৃতির মতো ক্যাভিনের হাত ধরে রংধনু চেনার অভিজ্ঞতা জীবনে ভুলতে পারবেন না ম্যারি।

রংধনুর কথা ভাবলেই আকাশে রঙের বর্ণালী আর মাটিতে বহুবর্ণা ক্যাভিনের ইমেজ ম্যারির সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘রংধনু’, যাকে নিয়ে কবি-ঔপন্যাসিকরা প্রচুর উপকথার মালা গেঁথেছেন এবং বিজ্ঞানীরা বের করেছেন রংধনুর আসল রহস্য। কিন্তু ম্যারিকে রংধনু চিনিয়েছে ক্যাভিন। ম্যারির হাতের তালুতে নিজের আঙুলের স্পর্শে ক্যাভিন ব্যাখ্যা করেছে রংধনুর একেকটি রঙ। ক্যাভিনের স্পর্শ মেখে রংধনুর রংগুলো চোখের সীমানা ছুঁয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ম্যারির হৃদয়ের অতলে। সেই অনুভূতি এখনো ম্যারিকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে মাধবী লতার আবেশে।

ক্যাভিন বলেছিল, “রংধনু হিসেবে আমরা যা দেখতে পাই তা আপাতদৃষ্টিতে ধনুকের মতো অর্ধচন্দ্রাকার হলেও তা আসলে গোল। বৃত্তাকার। অবাক লাগলো? অবাক লাগা এরকম অনেক কিছু ব্যাপার আছে রংধনুতে। যেমন বৈচিত্র্য আছে প্রতিটি মানুষের চরিত্রে ও ব্যক্তিত্বে, চিন্তায় ও চৈতন্যে।”

কোনো বই বা বিশেষজ্ঞ নন, ক্যাভিনই একবার নেপালের পোখরায় রংধনু-আবিষ্ট আকাশের নিচে সঙ্গোপনে পাশে এসে কানে কানে বলেছিল, “সূর্য থেকে যে আলোর রশ্মি পৃথিবীতে আসে তার রঙ মূলত সাদা। এই সাদা রঙের ভেতরে বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ হলুদ, কমলা ও লাল এই সাতটি রং বিদ্যমান থাকে। সাদা আলোর একটি বিশেষ ধর্ম আছে। প্রিজমের মধ্য দিয়ে গমন করলে সাদা আলো সাতটি ভিন্ন রঙে বিশ্লেষিত হয়ে যায়।"

ক্যাভিন আরো বলেছিল, "আকাশে যখন বৃষ্টি পড়ে তখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ভাসমান প্রিজমের মতো কাজ করে। সূর্য হতে আলো, বৃষ্টির ফোঁটার একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে বের হবার সময় সাত রঙা বর্ণালী সৃষ্টি করে। বৃষ্টির ফোঁটার প্রিজমসুলভ বৈশিষ্ট্যের কারণেই সৃষ্টি হয় রংধনু। বৃষ্টির ফোঁটা হতে বের হওয়া সাত রঙের আলো আমাদের চোখে এসে পৌঁছায় বলেই আমরা রংধনুকে দেখতে পাই।”

“মানুষও আসলে একটি অদৃশ রংধনু। তার হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনার আলাদা আলাদা রং আছে। আমরা তা দেখতে পাই না। কখনো কখনো কোনো শিল্পী কালো রঙে দুঃখ, সবুজে আনন্দ, হলুদে উৎসব, লালে দ্রোহ চিত্রিত করেন। এগুলোই এখন সাধারণভাবে মান্যতা পেয়েছে”, বলেছিল ক্যাভিন।

সেদিন কথাগুলোর গভীরতা ম্যারি বুঝেন নি। এখন বোঝেন, যখন ক্যাভিন পাশে নেই।

ক্যাভিন বুঝিয়েছিল, "আসলে মানুষ একরৈখিক নয়। কিছুটা বাঁকা। নানা কারণে এমন বক্রতা। কখনো স্বভাবের কারণে, কখনো পরিস্থিতির কারণে মানুষ বক্র হতে বাধ্য হয়। যেমন রংধনুও ধনুকের মতো বাঁকানো। কিন্ত কেন? এরও সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আসা বিভিন্ন রঙের আলো চোখের সাথে সামান্য কোণ উৎপন্ন করে। ত্রিমাত্রিক জগতে সেই কোণ চোখের চারদিকেই উৎপন্ন হয়। ফলে তা দেখতে অনেকটা চোঙের মতো হয়। চোঙের উপরিপৃষ্ঠ বৃত্তাকার হয়। চোখের সাপেক্ষে চোখের চারদিকে রঙধনুর চোঙও বৃত্তাকার। সেজন্য রংধনুকে দেখতে বাঁকানো মনে হয়। তবে কেউ যদি রংধনুর পুরো বৃত্ত দেখতে চায় তাহলে তাকে উপরে উঠতে হবে। হতে পারে সেটা প্লেনে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে। সূর্য এবং রংধনু এই দুইয়ের মাঝে অবস্থান করলে বৃত্তাকার রংধনু দেখা যাবে।"

"মানুষকেও পরিপূর্ণভাবে দেখতে হয় দূর থেকে। যেমন, হিমালয়ের পায়ের কাছে দাঁড়ায়ে একটি প্রস্তরীভূত দেয়াল দেখা যাবে। যতদূরে যাওয়া যাবে, ততই হিমালয়ের পূর্ণ অবয়ব প্রকাশিত হবে। কাছের মানুষ থেকে দূরের মানুষকে আমরা অনেক বেশি ভালো করে দেখতে ও বুঝতে পারি।" এই ছিল ক্যাভিনের অভিমত।

“এটা কেমনে সম্ভব?’ প্রশ্ন করেছিল ম্যারি।

“খুবই সম্ভব। সারাজীবন পাশাপাশি থেকেও মানুষেরা নিজেদের চিনতে পারে না। স্বামী স্ত্রীকে, পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে খুব কমই চিনে। যদি সত্যিই চিনতো, তাহলে এতো বেদনা, ভুল বোঝাবুঝি মোটেও হতো না।”

ম্যারি আর তর্ক করার যুক্তি পান না। চুপ করে থাকেন। ক্যাভিন খানিকক্ষন ভেবে বলে,

“রংধনুতে রঙের ভেতর বাহির আছে। মানুষেরও ভেতর আর বাহির আছে। মানুষ নিজেই নিজের সবটুকু দেখে না, বোঝে না। অন্য মানুষ কি করে বুঝবে বলো?”

কিছুটা সময় নিয়ে বিষয়টি ম্যারিকে বুঝিয়ে বলে ক্যাভিন। আসলে সাধারণভাবে মানুষের একটি বা দুটি দিক প্রাধান্য পায় আর সেটাকেই অন্যরা মানুষাটির সবটুকু বলে ধরে নেয়। মনে করে, তিনি একজন রাগী মানুষ কিংবা ভীতু মানুষ অথবা লোভী মানুষ। এমন ধারণা সর্বাংশে সঠিক নয়। রাগী মানুষটিও কারো কারো প্রতি স্নেহশীল। ভীতু লোকটিও অকস্মাৎ প্রচণ্ড সাহসী হয়ে উঠতে পারে। কিংবা কোনো লোভী লোকও গোপনে দানশীল হতে পারে। এসব সাধারণের চোখে হয়ত দৃশ্যমান নয়। রংধনুতে যেমন সবসময় লাল রঙ রংধনু-বৃত্তের বাইরে অবস্থান করে আর বেগুনি রঙ ভেতরের দিকে থাকে। বাকি রঙগুলোও একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সাজানো থাকে, তেমনি মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্য বাইরের দিকে বা প্রকাশ্যে থাকে আর কিছু অন্তরালে।

মানব বৈশিষ্ট্যের একটি ক্রম আছে রংধনুর রঙগুলোর মতোই। সব সময় এবং পৃথিবীর সর্বত্র রংধনুর রঙ-সজ্জার ক্রমের এদিক সেদিক হয় না। একেবারেই নিয়মতান্ত্রিকতায় বেষ্টিত রঙগুলো। মানুষও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দ্বারা এমনভাবে পরিবেষ্টিত থাকে যে, তার চরিত্রকে অন্যভাবে কল্পনা করা যায় না। এজন্য দায়ী তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। রংধনুর ক্ষেত্রে প্রতিটি রঙেরই একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আছে। সাতটি রঙকে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ক্রমানুসারে সাজালে এই ক্রমটি পাওয়া যাবে- বেগুনী, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল। তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের পরিমাণ কম বেশি হলে প্রিজমের মধ্যে তাদের বেঁকে যাবার পরিমাণও কম বেশি হয়। মানে বেঁকে যাবার দিক থেকে সাতটি আলোই আলাদা।

পদার্থবিদ্যার নিয়ম সবখানে সবসময় এক। তাই সবসময় লাল রঙ রংধনুর বৃত্তের বাইরে অবস্থান করে। আর বেগুনী রঙ বৃত্তের ভেতরের দিকে অবস্থান করে। তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ক্রমানুসারে প্রতিবার বিশ্লিষ্ট হয়ে একই ক্রম-রঙের রংধনু সৃষ্টি করে। মানুষও অভিজ্ঞতায়, আচরণে, কাজকর্মে এমনই একটি ক্রম নিজের মধ্যে তৈরি করে ফেলে। ফলে মেজাজ দেখানো লোকটি ইচ্ছা থাকলেও এক সময়ে সর্বসম্মুখে আর স্নেহ দেখাতে পারে না কিংবা দেখালেও অতি সঙ্গোপনে দেখান। এসব সীমাবদ্ধতা ও আচরণগত দাসত্বের কারণে খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বহুলোক সত্য কথা বলতে পারে না। ভালোবাসার মানুষটিকে ভেতরে ভেতরে গভীরভাবে ভালোবাসলেও সে কথাটি খোলাখুলি জানাতে পারে না।

তবে বৃষ্টি হলে যেমন রংধনু দেখা যায়, তেমনি সঙ্কটে, আবেগে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষের চরিত্রের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বিচিত্র রঙগুলো দেখতে পাওয়া যায়। তখন একজন মানুষের সবগুলো দিক সামনে চলে আসে। তবে বৃষ্টি হলেই যেমন রংধনু তৈরি হয় না আকাশে, তার জন্য সূর্যের উপস্থিতি থাকা লাগে, তেমনি বিশেষ পরিস্থিতি বা ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কোনো মানুষের উপস্থিতির দরকার হয় একজন মানুষের সামগ্রিক চরিত্রের পূর্ণতর উন্মোচনের জন্যে।

কাভিনের শেষ কথাগুলো বর্শার মতো বিদ্ধ হয়ে আছে ম্যারির মগজে,

“ভালভাবে রংধনু দেখতে হলে আমাদের অবস্থান এমন হতে হবে যেন সূর্য আমাদের পেছনে আর রংধনু সামনে থাকে। একজন মানুষকে ভালোভাবে দেখতে ও বুঝতে হলে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও আরো অনেকে মানুষের প্রয়োজন হবে। তখনই তুলনা করে দেখা যাবে সম্পূর্ণ মানুষটিকে তার নানা বৈশিষ্ট্যের আলোকে। এজন্যই কাছে থাকার মতো দূরে থাকাও জরুরি।”

ম্যারি এসব পুরনো কথা ভেবে শিহরিত হন যে, এমন একজন মানুষ তার জীবনে এসেছিল, যে কাছে থাকলে মনে হয় দূরের আর দূরে থাকলে অনুভব করা যায় অতি কাছের একজনের মতো।

পরবর্তী কিস্তি আগামী শুক্রবার।

আরও পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস 'রংধনু'-৬

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;