চুমকির ঘরে ফেরা



এম এল গনি
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মেয়েটির নাম চুমকি। মধুময় কণ্ঠ, আকর্ষণীয় দেহবল্লবী, স্বতঃস্ফূর্ত হাসি, সাহসী, দৃপ্ত চাহনি, অমৃতধারায় বহমান চোখজোড়া। বয়সের তুলনায় বড়োবেশি বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত আর প্রত্যয়ী। দৈহিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি পড়াশোনাও আছে বেশ। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় তার বিজয় পরিবারটির নজর কাড়ে। এমন দ্যূতিছড়ানো মেয়েই খুঁজছিলেন শিমুলের মা-বাবা তাঁদের একমাত্র পুত্রের জন্য।

শিমুলও কম কিসে? সুদর্শন, ব্যাক্তিত্বময়, প্রতিভাবান,সুগঠিত পেশির বাঁধন, চোখ যেন হৃদয়ের জানালা। অসাধারন মেধাবী শৈশব হতেই। শিমুল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র তখন সহপাঠিনী রিমির মনে ধরে তাঁকে। রিমির আগ্রহেই শিমুল তাঁর স্টাডি পার্টনার হন। পড়াশোনার নামে সময়ে অসময়ে শিমুলের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে আড্ডা দিতেন রিমি। মাঝে মাঝে মায়ের রান্না ভুনা খিচুড়ি নিয়ে এসে শিমুলের সাথে ভাগাভাগি করে খেতেন। সুযোগমতো পড়াশোনার বাইরের ব্যক্তিগত বিষয়ও আলোচনায় আনতেন। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, এমনকি পরিবারের খুঁটিনাটিও শিমুলের সাথে সহভাগ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন রিমি। শিমুল যেন তাঁর সাক্ষাৎ স্বজন, একান্ত কাছের মানুষ।

মাসের পর মাস এভাবে পেরুলেও শিমুলের দিক হতে ভালোবাসার ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে রিমির। এমনি অবস্থায় একদিন শিমুলকে সরাসরি বলে ফেলেন তাঁর জন্য পরিবারের পক্ষ হতে পাত্র দেখার কথা।

- শিমুল, তোমার সাথে একটা ব্যক্তিগত বিষয় শেয়ার করতে চাইছি; বলবো?

- বন্ধুদের সাথে কথা বলতে অনুমতি লাগে নাকি? তাড়াতাড়ি বলো।

- বাবা-মা কিন্তু আমার বিয়ের কথা সিরিয়াসলি ভাবছে।

- কিন্তু, তোমার তো অনার্স শেষ হতে আরো এক বছর বাকি। এখনই কেন তাঁরা বিয়ে দিতে চাইছেন?

- আমার ছোট খালা রুনু আমেরিকা প্রবাসী এক পাত্রের প্রস্তাব এনেছে। গ্রীনকার্ড নয়, একেবারে আমেরিকার পাসপোর্টধারী। বিয়ের পর স্পনসর করে আমেরিকা নিয়ে যেতে যে সময়টা লাগবে সে সময়ে আমার অনার্স শেষ হয়ে যাবে। মানে, পড়ার ক্ষতি হচ্ছে না মোটেও।

- তাই নাকি? তাহলে তোমাকে তো আর খুব বেশিদিন দেখছি না মনে হয়, সহসাই স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় উড়াল দিচ্ছো।

- কিন্তু ..., আমি তো কোথাও যেতে চাইনা শিমুল, দেশেই থাকতে চাই।

- তবে তা তোমার পরিবারকে জানাও না কেন?

- কোন ভরসায় জানাবো?

- মানে?

- মানে, কার ভরসায় জানাবো?

- বুঝলাম না রিমি, একটু খুলে বলো।

- খুলে আর কি বলবো? এটুকুতে না বুঝলে আমার আর বলার কি আছে? তুমি তো দেখছি ক্লাস ফাইভের খোকাকেও হার মানালে হে।

- সরি রিমি, আমি আপাতত পড়াশোনার বাইরে কিছু ভাবছি না। সহপাঠী আর বন্ধু হিসেবে তুমি অদ্বিতীয়, এটা আমি মানি, তবে, এর বেশিকিছু ভাবার সুযোগ যে আমার আপাততঃ নেই।

রিমির উচ্ছাস, ব্যাকুলতা শিমুলের মনে ঢেউ জাগাতে পারেনি দেখে তিনি নিজেকে ব্যর্থ ভাবতে থাকতে থাকেন। অথচ, হৃদয়ের গভীরে এই শিমুলকে নিয়ে তিনি কতো স্বপ্নের জালই না বুনেছেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে শিমুলের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলেন রিমি। - -

বরাবরের মতো পরীক্ষায় খুব ভালো ফল করায় শিমুল তার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে চাকুরী পেলেন। তিন বছরের শিক্ষকতাকালে সঞ্চিতা নামের এক জুনিয়র সহকর্মীও তাঁর দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছিলেন। শিমুল সে প্রস্তাবও এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে।

অবশেষে সুযোগ এলো বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডা যাবার। শিমুল তা কাজে লাগলেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় বৃত্তিসহ মাস্টার্স লিডিং-টু-পিএইচডি প্রোগ্রামে স্টুডেন্ট ভিসা বাগিয়ে নিলেন তিনি। পাড়ি জমালেন হাজারো কিলোমিটার দূরের দেশ কানাডায়। জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো তাঁর।

পড়াশোনায় প্রতিভার স্বাক্ষর কানাডায়ও রেখে চলেন শিমুল। এক টানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে টরোন্টোর এক নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

লেখাপড়ার পাশাপাশি কানাডার বর্ণিল জীবনধারা তাঁর মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রও প্রশস্থ করে। সময়ের পরিক্রমায় তিনি আরো প্রবলভাবে অনুভব করতে শুরু করেন সমাজের আর দশটা পুরুষের মতো গতানুগতিক চিন্তা বা অনুভবের মানুষ তিনি নন। মানে, নারীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ ঠিক অন্য দশ পুরুষের মতো নয়। নারীদের শ্রদ্ধাসম্মান করেন তিনি, ভালোবাসেনও, কিন্তু কোন নারীকে জীবনসঙ্গিনী করে দুই জীবন এক ফ্রেমে বন্দি করবেন এমন চিন্তা ঘুনাক্ষরেও তাঁর মাথায় আসে না।

এরই মাঝে সপ্তাহান্তের এক সকালে মায়ের ফোন বেজে উঠে।

- বাবা, তোকে আজ খুব মিষ্টি একটা খবর দেব। তুই কিন্তু না বলবি না, কথা দেয়।

- বলই না মা, না শুনে কেমনে হাঁ বলি?

- তোর জন্য অসম্ভব গুণী, লক্ষী একটা মেয়ে পেয়েছি, দেখতে পুতুলের মতো সুন্দর; বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী সে।

- বলো কি মা? মেয়েটা কে?

- এই যে, মিস বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় সেদিন প্রথম স্থান পেলো। টিভিতে দেখালো তাকে। তোকে ঝুমা (শিমুলের ছোটবোন) ছবি পাঠাবে কাল। তার আগে তোকে বলে রাখছি, মেয়েটা আমাদের সবার, এমনকি তোর বাবারও পছন্দের। মেয়েপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে আমরা প্রাথমিক সম্মতিও পেয়েছি। নাম চুমকি। যেমন নাম, তেমনই দেখতে। বিবিএ শেষ করেছে। এমবিএ পড়ার পাশাপাশি কাজও করে। শত গুনে গুণী সে।

শিমুলের বাবা অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আজ প্রায় তিনবছর। মা স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসার চালান। ঝুমা আর সীমা, দুই ছোটবোন পড়ে কলেজে। শিমুলই এখন পরিবারের চালিকাশক্তি। তিনি কিছুতেই মায়ের, তথা, পরিবারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বাবার কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিতে পারেন না। অন্তত বাবাকে খুশি করতে হলেও শিমুলকে এ বিবাহে রাজি হতে হবে, যদিও নারীদের ব্যাপারে শিমুলের তেমন আগ্রহ নেই। - -

যেই কথা সেই কাজ। চুমকি এখন শিমুলের বিবাহিতা স্ত্রী। বিবাহের উদ্দেশ্যে চাকুরী হতে দুসপ্তাহের ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি শিমুল দেশে এসেছিলেন। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা আর দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনের দাওয়াতে হাজিরা দিতে দিতেই দুসপ্তাহ যেন দুদিনেই কেটে গেলো। চুমকি বনেদি পরিবারের মেয়ে। তাদের আত্মীয়স্বজনের পরিধি অনেক বড়ো। তাছাড়া, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী চুমকি কেবল সৌন্দর্যের চর্চাই করেননি, জড়িত থেকেছেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও। একটা সুইডিশ এনজিও'র কোঅর্ডিনেটর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র একুশ বছর বয়সেই। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সামাজিক উন্নয়নে তিনি কয়েকবছর কাজ করেছেন এরই মাঝে।

মাত্র দুসপ্তাহের এতো স্বল্প সময়ে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ খুব একটা হয়ে উঠেনি শিমুল-চুমকি দম্পতির। অতঃপর দুই পরিবারের চাপাচাপিতে দ্রুতই শিমুল তাঁর স্ত্রী চুমকিকে কানাডায় নিয়ে এলেন। শুরুর কিছুদিন টরোন্টো শহরের কয়েক দর্শনীয় স্থানে ঘোরাফেরায় কেটে গেলো এ দম্পতির। পাশাপাশি পুরোনো বন্ধু অশেষ, জাবেদসহ পরিচিত বাঙালিদের বাসায়ও বেড়ানো হলো কয়েকদিন। সময়টা কাটছিলো ভালোই; তবে, দুজনের একান্ত মুহূর্তগুলোতে শিমুলের অস্বাভাবিক আচরণে চুমকি বেশ অবাকই হলেন।

মাস তিনেক এভাবে পার হবার পর তার এক বিবাহিত বন্ধু সাথী সেনগুপ্তার সাথে এ নিয়ে কথা বলেন চুমকি। সাথীর সাথে শৈশব হতেই তাঁর বন্ধুতা। দুজনই দুজনার অনেক ব্যক্তিগত বিষয় জানেন। ইন্টারমিডিয়েটে পড়া অবস্থায় সাথীর বিবাহ হয়েছিল। সঙ্গতকারণেই, সংসার ধর্মে তাঁর রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা।

- সাথী, তোকে একটা কথা বলবো, কারো সাথে শেয়ার করবি না বলে প্রমিজ কর।

- কেন, অতীতে তোর কোন কথা কাউকে বলে দিয়ে তোকে বিপদে ফেলেছি নাকি? প্রমিজ করতে হবে কেন, যা বলার খুলে বল।

- ওই যে, ডঃ শিমুল, মানে, তোর দুলাভাইয়ের কথা বলছিলাম।

- কেন, কি হলো রে? তুই তো খুব লাকি, শিমুল ভাই যেমন ব্রিলিয়ান্ট দেখতেও তেমন হ্যান্ডসাম। দেশে যেমন সফল মানুষ ছিলেন, বিদেশেও তেমনই সাকসেসফুল। কি, তাঁর উপর আর কারো নজর পড়েছে নাকি?

- না, তেমন কিছু না, ওরকম সমস্যা নেই।

- তবে কি? চটজলদি বলে ফেল।

- ও না একটু কেমন।

- কেমন মানে?

- মানে ..., ঘনিষ্ঠ হতে চায়না।

- আরে, ওটা কোন ব্যাপার না, আমাদেরও তো ঘনিষ্ঠ হতে টানা একমাস লেগে গেছে। তোর দুলাভাই তো আমার ঠোঁটে ঠোঁট মেলাতেই তিনদিন ফেলেছে। আমি তো জোর করে তাঁকে দিয়ে প্রথম আমার বুক স্পর্শ করিয়েছি। ... শিমুল ভাই বেশি পড়াশোনা জানা আঁতেল মানুষ তো, মাথায় হয়তো নানাপদের বুদ্ধি কিলবিল করে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। খামাখাই দুশ্চিন্তা করছিস।

- কিন্তু, আমাদের যে সময়টা একটু বেশিই লাগছে। কানাডা এসেছি চারমাসে পড়লো তো।

- বলিস কি? চারমাসেও ...!

- না, একবারও না।

- যা, কি বলছিস?

- সত্যি।

- তুই কি নিজে থেকে চেষ্টা করেছিস? পুরুষদের জাগাতে হয়, সবাই একরকম না, অনেকে খুব ইন্ট্রোভার্ট। তেমন হলে তোকে কিন্তু এগ্রেসিভলি চেষ্টা চালাতে হবে।

- দেখি।

- তাতেও কাজ না হলে ডাক্তারের সাথে কথা বল। আর দেরি করা ঠিক হবে না। চারমাস তো মেলা সময়রে !

আরো সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষা করে চুমকি এক রাতে নিজে থেকেই শিমুলের কাছে নিজেকে মেলে ধরেন।

চুমকি আজ নির্লজ্জ্ব, বেহায়া, তাঁর যা কিছু আছে সব বিলিয়ে দিয়ে শিমুলকে জাগিয়ে তোলাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি চান, শিমুল আজ তাঁকে দুমড়ে-মোচড়ে একাকার, আর, বুকে চেপে চূর্ণবিচূর্ণ করুক। নিজের ব্লাউজ নিজেই খোলেন চুমকি, বক্ষবন্ধনী খুলে বাথরুমের দরোজার দিকে ছুঁড়ে মারেন, দুধে আলতা স্তন্যচূড়ায় ঘষতে থাকেন শিমুলের মুখ-বুক, ভেজা চুমুতে ভাসিয়ে দেন শিমুলের লোমশ প্রশস্থ বুক।

প্রথমটায় শিমুল অনাঘ্রাতা রমণীর মতো গুটিসুটি মেরে থাকলেও একসময় চুমকিকে বুকে টেনে নেন। অর্ধ উলঙ্গ চুমকির শাড়ির বাকি অংশ খুলে তাঁর খাঁজকাটা তুলতুলে দেহ বাহুডোরে বন্দী করেন শিমুল। জানালায় ঝুলানো ভেলভেটের পুরু পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইর হতে ছুটে আসা নিয়ন লাইটের আলোয় তখন বিজলি চমকাচ্ছিল চুমকির দেহে। তখন চুমকিকে আক্ষরিক অর্থেই চুমকির মতো লাগছিলো। মিলনের আকাঙ্খায় থরথর কাঁপছিলেন তিনি। শিমুলও এগিয়ে এলেন। তবে, শিমুল যে পন্থায় সম্পর্ক গড়তে চাইছেন তা স্বাভাবিক নয়। চরম মুহূর্তে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চুমকি তাতে রাজি হন। এভাবে মেলামেশা ভীষণ কষ্টের ঠেকে চুমকির কাছে। তিনি আহত, রক্তাক্ত হন। তারপরও স্বামীর পছন্দ মেনে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রানপন চেষ্টা চালান চুমকি।

এভাবেই চলতে থাকে দুজনের ঘনিষ্ঠ সময়গুলো। বারবার অনুরোধ করেও চুমকি কোনভাবেই শিমুলকে নারীপুরুষের স্বাভাবিক মেলামেশায় রাজি করাতে পারেননি। ফলে, শারীরিক-মানসিক অতৃপ্তি, লোকলজ্জার ভয়, সামাজিক চাপ, ইত্যাদি নানা ভাবনা ক্রমশ চুমকিকে গ্রাস করতে থাকে। একইসাথে, এ দাম্পত্য সম্পর্কের গন্তব্য কোথায় তা ভেবেও তিনি অস্থির হন। এভাবেই পার হতে থাকে অনিশ্চিত যুগল জীবন।

টরন্টো শহরের যে বহুতল ভবনে এ দম্পতি বসবাস করেন সেটি ভিকটোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশনের অনতিদূরে। ভবনের চৌদ্দ তলা হতে নিচে হেটে চলা মানুষগুলো খানিক খর্বাকৃতি দেখালেও তাদের মুখমন্ডল পরিষ্কার দেখা যায়। সাতসকালে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনায় প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে এ এলাকা। এক প্রত্যুষে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারজোড়ার একটিতে বসে ভবনের নিচে সরু রাস্তায় কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা দেখছিলেন চুমকি। চোখ পড়ে পাশের ভবনের সপ্তম তলার বাসিন্দা তৃষ্ণা ভাবীর দিকে।

তৃষ্ণাদের দুই সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি অটিজমে আক্রান্ত; বয়স দশ কি এগারো। তাকে প্রতিদিন স্পেশাল নীড স্কুলে নিতে হয়। দুই সন্তানকে নিয়ে সেই তৃষ্ণাও সাবওয়ে স্টেশনের দিকে দৌঁড়াচ্ছেন। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জেতার আগে চুমকি অটিস্টিক বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতেন বাংলাদেশে। তাই তাঁর বেশ জানা অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের দেখভাল কি করে করতে হয়। তৃষ্ণাদের দিকে চোখ থাকলেও ক্ষনিকের জন্য চুমকি নিজেকে তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের মিষ্টিমধুর স্মৃতিতে হারিয়ে ফেলেন। তাঁর মানসপটে ভেসে উঠে অটিজমে আক্রান্ত অনেকগুলো নিষ্পাপ শিশুমুখ।

এরই মাঝে দুকাপ চা নিয়ে কাঁপো হাতে শিমুল এসে হাজির।

- কী, একা বসে আছো যে?

- ঘুম ভেঙে গেলো খুব ভোরে; আর ঘুম আসছিলো না। তাই তোমাকে ডিস্টার্ব না করে এখানে চলে এলাম। তুমি কখন বিছানা ছেড়েছো?

- আমি তো তুমি উঠার খানিক পরই উঠে পড়ি। আমারও ঘুম আসছিলো না।

- ঠিক আছে, বসো।

দুজনই নিচে তাকিয়ে কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা দেখছেন। এরই মাঝে চুমকি প্রশ্ন ছুড়ে দেন শিমুলের উদ্দেশ্যে।

- আচ্ছা শিমুল, আমাদের বিয়ের আগে তোমার কি কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে কখনো?

- হঠাৎ এ প্রশ্ন?

- না, জানতে চাইছি, তোমার কি বলতে আপত্তি আছে?

- আপত্তি থাকবে কেন? সত্যি বলতে কি, দুটো মেয়ে আমাকে কাছে পেতে চেয়েছিলো, কিন্তু ...

- থামলে কেন? ভালো ছাত্র, তাই তুমি পাত্তা দাওনি, তাইতো?

- তা না, পাত্তা না দেবার কি আছে? ওরা খুব ভালো মেয়ে।

- আমার চেয়েও?

- আরে পাগল, তুলনা করছো কেন? প্রতিটি মেয়েই তো যারযার মতো সুন্দর।

- তাহলে তুমি জড়ালে না কেন?

- আমি আসলে ...

- বলে ফেল, থামলে কেন?

- অনেস্টলি, আমি তাদের প্রতি বন্ধুতার বাইরে অন্যরকম কোন আকর্ষণবোধ করিনি কখনো। বলতে পারো, সম্পর্কে জড়ানোর চিন্তা মাথায় আসে নি।

- তার মানে মেয়েদের প্রতি কি তুমি কোন আকর্ষণ বোধ করো না?

- না না, তা বুঝাইনি। তেমন হলে তোমার সাথে এতগুলো দিন একসাথে কাটালাম কি করে?

- শিমুল, আমার সাথে তোমার প্রায় ছয়মাস হতে চলেছে। তুমি যেভাবে আমার সাথে দিন কাটাচ্ছো তাকে কি আসলে দিন কাটানো বলা চলে? বিবাহিত দম্পতির জীবন কি এভাবে কাটে? চলো, তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।

- ডাক্তার কেন? আমি অসুস্থ নাকি?

- আগে যাই, পরে বুঝবে কেন নিয়ে গেলাম?

- বলো না, কেন ডাক্তারের কাছে নিতে চাইছো? ডাক্তারের এখানে করার কি আছে?

- ডাক্তার কি করবে মানে? ডাক্তার তোমাকে তোমার স্ত্রীর সাথে কিভাবে ঘনিষ্ঠ হতে হয় তা শিখিয়ে দেবে, প্রয়োজনে ওষুধও দেবে। ছ মাসেও তুমি আমার সাথে ঠিকমতো মেলামেশা করতে পারলে না, এটা কি এড়িয়ে যাবার বিষয়?

- কেন? করলাম তো; গতরাতেও তো আমাদের ইয়ে হলো।

- আমাদের নয়, বলো, তোমার মেলামেশা হয়েছে। এভাবে আমি আর পারছি না। তুমি যেভাবে মেলামেশা করছো তা স্বাভাবিক নয়। না না, এভাবে হয়না, আমি ভীষণ কষ্ট পাই। তোমাকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে হবে শিমুল। আমি আর এসব সহ্য করতে পারছি না। ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা উপায় বাতলে দেবেন। - -

চুমকির পীড়াপীড়িতে অবশেষে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন শিমুল। বিস্তারিত শুনে ডাক্তার মুখ গম্ভীর করলেন। তিনি পরিষ্কার বুঝলেন, শিমুলের সেক্সচুয়াল ওরিয়েন্টেশন অন্যসব পুরুষের মতো নয়; তিনি একজন পায়ুকামী, বা সডোমিস্ট, যা কোন ওষুধে সংশোধিত হবার নয়। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি তেমন; ডাক্তারের খুব কিছু করার নেই এ অবস্থায়। তারপরও, বিদায় জানাবার আগে পায়ুকামের বিশেষ ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কিছু মেডিক্যাল পরামর্শ দিলেন ডাক্তার।

চিকিৎসকের পরামর্শ শুনে চুমকি চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন। অতৃপ্তি, অক্ষমতা, লোকলজ্জা, জগদ্দল পাথর হয়ে দাঁড়ালো চুমকির সামনে। মা-বাবা বা পরিবারের কারো সাথে এমন বিব্রতকর গোপন বিষয়ে আলাপও অসম্ভব। তবে কি বান্ধবী সাথীকে তিনি সব খুলে বলবেন? তাঁর কাছে চাইবেন সমাধান? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেন চুমকি।

আবার ভাবলেন, ডাক্তার যেখানে না করে দিয়েছেন সেখানে সাথী আর কি করবে? তবে কি শিমুলকে বুঝিয়ে সুজিয়ে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতেই থাকবেন, একদিন যদি কিছু হয়? বুঝানোর চেষ্টা হয়তো করা যায়, কিন্তু তাতে কাজ হবার সম্ভাবনা যে তেমন নেই। জোর করে তো মানুষের সেক্সচ্যুয়াল ওরিয়েন্টেশন পরিবর্তন করা যায় না। তেমন কিছু সম্ভব হলে ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা পথ দেখিয়ে দিতেন।

যৌন জীবনে স্বামীর এ অস্বাভাবিক আচরণ চুমকির কাছে কানাডার চাকচিক্য, রংচঙা জীবন, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সবই ম্লান করে দিয়েছে। এই কানাডা জীবনের চেয়ে বনজঙ্গলে সন্ন্যাসিনীর জীবন অনেক ভালো, এমনই চিন্তাই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আজকাল। পাশাপাশি, পুরুষজাতির প্রতি কেমন এক ঘেন্নাবোধও পুঞ্জীভূত হলো তাঁর মনে।

অবশেষে চুমকি একদিন হঠাৎই ফিরে এলেন দেশে। তার আকস্মিক কানাডা ত্যাগে সাথীসহ অন্য বন্ধুরাও বিস্মিত হলেন; পরিবারের কৌতূহলী প্রশ্নেরও মুখোমুখি হলেন তিনি। তাঁর হৃদয়ের একান্ত গভীরে লুকিয়ে থাকা নির্জলা সত্য, ধর্মীয় সংস্কার, লজ্জাবোধ আর সামাজিকতার বেড়াজালে আলোর মুখ দেখেনি কোনদিন।

সুন্দরী প্রতিযোগিতার জয়লাভের পরপরই চুমকি বাংলাদেশে নামিদামি মডেল হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র দুবছরেই তাঁর পরিচিতি হয় আকাশচুম্বী। নাটক সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাবও পেতে থাকেন সমানে। বিজ্ঞাপনের আয় তো ছিলই, তাছাড়া ব্র্যান্ড এম্বেসেডারও হয়েছিলেন এক কোম্পানির। নিজদেশের এমন ফকফকা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পেছনে ফেলে মেধাবী কানাডা প্রবাসীর জীবনসঙ্গিনী হতে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশে। অথচ, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর স্বপ্নগুলো চুরমার করে দেয় দ্রুতই। কারো কারো কাছে জীবন এমনই নিস্পন্দ, নিষ্ঠুর।

এমন অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতার পরও দমে যাবার পাত্রী নন চুমকি। তবে, পুরুষ মানুষ সম্পর্কে তাঁর যে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা তাঁকে পুরোদমে পুরুষবিমুখ করে তুলেছে। শিমুলকে তিনি ডিভোর্স দেননি কোনদিন, শিমুলও তা আগ বাড়িয়ে চাননি। তবে, কেবল নামেই তাঁরা আজও স্বামী-স্ত্রী। শিমুল মাঝে মাঝে দেশে এলে চুমকির সাথে কিছু সময় কাটিয়ে যান, তবে চুমকি কখনো তাঁর সাথে শারীরিক মেলামেশায় আগ্রহ দেখাননা। শিমুলও তা এড়িয়ে যান বোধগোম্যকারণেই। কানাডায় ফিরে না যাবার চুমকির যে সিদ্ধান্ত তাও শিমুল মেনে নেন।

দেশে ফেরার পর আর মিডিয়ার মুখোমুখিও হননি চুমকি। বলা চলে, মিডিয়ার লোকজনকে এড়িয়েই চলেছেন পাছে তাঁর কানাডা জীবন, বিবাহ, স্বামী-সংসার ইত্যাদি অপ্রিয় প্রসঙ্গ আলোচনায় চলে আসে সে ভয়ে, সে লজ্জায়। কিছুদিন এভাবে কাটিয়ে ধাতস্থ হয়ে আগের সেই স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন চুমকি। স্পেশাল নীড বা, বিশেষ চাহিদার শিশু কিশোরদের দেখভালেই সময় কাটে তাঁর। ওরাই তাঁর পরমাত্মীয়, পরিবার বা স্বজন। আর, কানাডার কথা মনে হতেই তাঁর চোখে ভেসে উঠে তৃষ্ণা ভাবীর সেই অটিস্টিক ছেলেটিকে, যার হাত ধরে তিনি ভোরের আলো-আঁধারিতে দ্রুতলয়ে টরোন্টোর ভিকটোরিয়া পার্ক সাবওয়ে স্টেশন অভিমুখে হাঁটছিলেন।

লেখক: এম এল গনি
পেশা: কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (RCIC-IRB)
ইমেইল: [email protected]

   

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত



নাজমুল হাসান
কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

কারার ঐ লৌহ কপাট: সৃষ্টি-বিকৃতির ইতিবৃত্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান; কবিতাটির শিরোনামের মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

পটভূমি:

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলাকালীন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পাদনায় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন হেমন্ত কুমার সরকার। ব্রিটিশ বিরোধী এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকার ব্যাপকভাবে তরুণদেরকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। ওই সময় 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার হাল ধরেন চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী।

একদিন বাসন্তী দেবী 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশের জন্য একটি কবিতা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে দাশ পরিবারের সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। এ সময়ে নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজাফফর আহমদ কলকাতার ৩/৪ সি, তালতলা লেনের একটি বাড়ির নিচ তলায় একই রুমে ভাড়া থাকতেন। 'ভাঙার গান' শীর্ষক এই গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁর 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন- "আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম।‌ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল।”

পড়া শেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুকুমাররঞ্জন দাশের হাতে দেন, যা 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাসন্তীদেবীর অনুরোধে পরবর্তীতে নজরুল ইসলাম কবিতাটি সুরারোপ করে সে গানের স্বরলিপিও তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন বলে জানা যায়। ফলে এ গানের সুরকার নজরুল ইসলাম নিজেই। এই কবিতাটি লেখার দুই/তিন সপ্তাহ আগে ওই বাড়িতে থাকার সময়েই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ হুগলী জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনিসহ সেখানে বন্দি থাকা অন্যান্য স্বদেশী আন্দোলনের বন্দিরা একত্রে কোরাস আকারে কাজী নজরুল ইসলামের দেওয়া সুরে সর্বপ্রথম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি জেলখানার ভিতরেই গেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ রাজরোষের কারণে কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামে নজরুলের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এ মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরেরদিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

নজরুল ইসলামকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ এই এক বছর জেলে রাখা হয়। জেল-জীবনে কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস কণ্ঠে তিনি বহুবার এ গানটি গেয়েছেন। যদিও সে গানের কোনো রেকর্ড নাই। পরবর্তীতে গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া এ গানটি সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া সুরই ছিল নজরুল ইসলামের নিজের করা সুর।

মূলভাব:


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের জন্য একটি উদ্দীপনামূলক গান। গানটির মাধ্যমে কবি যে দ্রোহের প্রকাশ করেছেন তা হলো—প্রতিবাদ-ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জাগ্রত হবে পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার নতুন পতাকা, স্বাধীনতার নতুন সূর্য স্বাধীন জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে আলো ছড়াবে। গানটির মাধ্যমে নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পরাধীনতার বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার আমিয় বাণী।

কবিতাটির প্রকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. পত্রিকা: বাঙলার কথা, শিরোনাম: ভাঙার গান, ২০ জানুয়ারি, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ, শুক্রবার, ৭ মাঘ ১৩২৮।
২. কাব্যগ্রন্থ: ভাঙার গান, প্রথম সংস্করণ- শ্রাবণ ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, আগস্ট ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ, কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’। দ্বিতীয় সংস্করণ- ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম স্ট্রিট, কলিকাতা- ১২। খ্রিষ্টাব্দ ১৯৪৯ । কবিতার শিরোনাম ‘ভাঙার গান’ (গান) ১। পৃষ্ঠা: ১-২।
৩. নজরুল-রচনাবলী। জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। প্রথম খণ্ড। বাংলা একাডেমি, ঢাকা। ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩/মে ২০০৬। ভাঙার গান। গান-১। পৃষ্ঠা: ১৫৯-১৬০।

গানটির রেকর্ড সংক্রান্ত ইতিহাস:
১. Columbia Records- কলাম্বিয়া রেকর্ডস, প্রখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি কলাম্বিয়া’র তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রেকর্ড। জুন ১৯৪৯, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৫৬, জি.ই. ৭৫০৬। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
২. এইচএমভি (HMV), হিজ মাস্টার’স ভয়েস- His Master's Voice, জানুয়ারি ১৯৫০, পৌষ-মাঘ ১৩৫৬, এন. ৩১১৫২। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী।
৩. ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার শ্রোতারা ভোট দিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি বাংলা গানের যে তালিকা করেছে তার মধ্যে ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি ১৬তম।

গানটির চলচ্চিত্রে রূপদান সংক্রান্ত ইতিহাস:

১. চলচ্চিত্র: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। কাহিনীকার- চারুদত্ত। চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালক- নির্মল চৌধুরী। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্টুডিওর ব্যানারে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ নভেম্বর, রবিবার ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৫৬। গানটির চলচ্চিত্রের স্বরলিপিকার ও স্বরলিপিতে করেছিলেন- রশিদুন্‌ নবী। নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (বিংশ খণ্ড)। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, পঞ্চম গান। শিল্পী: গিরীন চক্রবর্তী ও সহ-শিল্পীবৃন্দ। সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।
পর্যায়: বিষয়াঙ্গ- স্বদেশ, সুরাঙ্গ- সামরিক মার্চ, তাল- দ্রুত দাদরা, গ্রহস্বর: সা।
লিঙ্ক: চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন https://www.youtube.com/watch?v=F1StxYnf-yU

২. চলচ্চিত্র: জীবন থেকে নেয়া। জহির রায়হান নির্মিত শেষ কাহিনী চিত্র। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের এপ্রিলে মুক্তি পায়। সঙ্গীত পরিচালক ও সঙ্গীত শিল্পী: খান আতাউর রহমান। শিল্পী: অজিত রায়, খন্দকার ফারুক আহমেদ ও অন্যান্য। চলচ্চিত্রটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
লিঙ্ক: জীবন থেকে নেয়া https://www.youtube.com/watch?v=4gOJVlb_9-A

‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ উভয় চলচ্চিত্রেই শিল্পী গিরীন চক্রবর্তী এবং অজিত রায় ও খন্দকার ফারুক আহমেদ গানটিকে কাজী নজরুল ইসলামের সুরে গেয়েছেন। দুটি চলচ্চিত্রের গানের সুরের মধ্যে সামান্য একটু ভিন্নতা থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই গানটির বিপ্লবী মূলভাব ফুটে উঠেছে। চেতনার সাথে মিল রেখে ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে গানটিকে বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়েছে। মূল গানটি জেলখানায় বসে কয়েদিরা কোরাস কণ্ঠে গেয়েছিলেন বলে দুটি চলচ্চিত্রেই গানটিকে জেলখানার কয়েদিদের দ্বারা কোরাস কণ্ঠে গাওয়ানো হয়েছে।

কবিতাটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

এখানে ‘কারা’ মানে কারাগার, তৎকালীন পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতের যে কারাগারে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনরত তরুণ বিপ্লবী বীরদের গ্রেপ্তার করে আটক করে রাখছিল। সেই কারাগারের শক্ত লোহার দরজা তথা লৌহকপাট ভেঙে ফেলে তাকে লোপাট অর্থাৎ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে ফেলার আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘পূজার বেদী’ হলো যেখানে পূজা করা হয়, সে শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান। পূজার বেদীতে মানুষের মনের গভীর থেকে উঠে আসা পরম ভক্তির আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে। কবি এখানে স্বদেশকে পূজার বেদীর সাথে তুলনা করেছেন। যে পূজার বেদীতে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য থাকার কথা সে বেদীতে আজ ব্রিটিশ সরকার দ্বারা অত্যাচারিত ভারতের বীর সন্তান, স্বাধীনতাসংগ্রামী, বিপ্লবীদের রক্ত জমাট বেঁধে আছে, সে বেদীতে আজ পরাধীনতার শিকল পরানো। এ বেদী আজ বেদী নেই, একে নির্মমতার পাষাণে পরিণত করা হয়েছে। এ শিকল ভেঙে, জমাটবাঁধা রক্ত সরিয়ে পাষাণময় পূজার বেদীকে মুক্ত করে মায়াময় ও পবিত্র করতে হবে, অর্থাৎ পরাধীন দেশের শোষণ-নির্যাতন থেকে দেশকে মুক্ত-স্বাধীন করে তাকে উপভোগ্য ও আত্মনির্ভর করতে হবে।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে যেভাবে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে সেভাবে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদের সক্ষমতাকে কবি প্রলয়ের দেবতা মহাদেবের মহাশক্তির সাথে তুলনা করে তাদেরকে পরাধীনতার শিকল ভাঙতে প্রলয় বিষাণ বাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদি’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে কারাগারে আটক রেখেছে সে কারাগার ভেদ করে ফুড়ে বেরিয়ে আসে, পরাধীনতার প্রাচীর বা দেওয়াল ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী স্বাধীন-মুক্ত হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।


গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘গাজন’ সনাতনধর্মীদের একটা সামাজিক উৎসবের নাম। চৈত্র মাসের শেষ দিকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের মিলিত বাজনা বাজিয়ে গাজন উৎসব পালন করা হয়। মিলিত বাদ্যযন্ত্রের বাজনা বাজায় গাজন উৎসবের বাজনা খুব প্রকট হয়। কবি এখানে গাজনের বাজনার মতো প্রবল শব্দে বাজনা বাজিয়ে লড়াইয়ে নেমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হওয়ার তীব্র আহ্বান জানিয়েছেন।

কবি এখানে ব্যঙ্গ করে ব্রিটিশ শাসকদের স্বরূপ প্রকাশ করার নিমিত্তে পরাধীন ভারতবাসীকে প্রশ্ন করেছেন—কে মালিক, কে রাজা, কে সাজা দেয়, কে মুক্ত, কে স্বাধীন, কে সত্য? অর্থাৎ ওরা বিদেশি, ভিনদেশি, ওরা আমাদেরকে শাসন করার অধিকার রাখে না। এ দেশ আমাদের, এ দেশের মালিক আমরা, এ দেশের রাজা আমরা, এখানে আমরা মুক্ত-স্বাধীন, এখানে আমাদেরকে কেউ সাজা দেওয়ার অধিকার রাখে না। এখানে আমরাই সত্য, ওই ব্রিটিশরাই এখানে মিথ্যা। ওরা মিথ্যার উপরে দাঁড়িয়ে আমাদের সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে না।

হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

ভগবান মানে সর্বশক্তিমান, সর্বমুক্তমান, সর্বমালিক মহাশক্তি। কবি এখানে ভগবান বলতে এ দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীরদের বুঝিয়েছেন। তারাই এ দেশের মালিক। ভগবানকে যেমন বন্দি রাখা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বন্দি করা অসম্ভব, ভগবানকে যেমন বেঁধে রাখা তথা ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব, ভগবানকে যেমন ধ্বংস করা অসম্ভব—তেমনি এ দেশের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বীর, যারা এ দেশের মালিক তাদেরকেও বেঁধে রেখে তথা বন্দি রেখে ফাঁসির দড়ি পরানো অসম্ভব। সুতরাং এই বীরদেরকে জেলে আটকে রেখে তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেওয়ার যে পায়তারা ব্রিটিশরা করছে তা দেখে কবির হা হা হা কোরে অট্টহাসি পাচ্ছে। কারণ, স্বাধিকারের জন্য যেভাবে প্রতিরোধ-সংগ্রাম চলছে তাতে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভগবান অর্থাৎ এ দেশের বিপ্লবী-বীরদেরকে ফাঁসি দেওয়া অসম্ভব।

ব্রিটিশ শাসকেরা বিপ্লবী-বীর ও স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দেরকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়ার কথা প্রচার করে মানুষকে বিপ্লব-বিরোধী করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। তাদের এ চক্রান্তে যাতে মানুষ ভয় পেয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যায় সে জন্য কবি প্রচণ্ড আস্থার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন—বিপ্লবী-বীরদের ফাঁসি দেওয়া যায়, এমন হীন অর্থাৎ নীচ ও জঘন্য তথ্য কে শেখাচ্ছে? কে ছড়াচ্ছে এমন অসম্ভব কথা? অর্থাৎ কবি মানুষকে অভয় দিচ্ছেন যেন ব্রিটিশ শাসকদের এমন চক্রান্তে ভয় পেয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে না যায়। কারণ, এই বিপ্লবী স্বাধীনতাকামী শক্তিকে আটকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।


ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

প্রলয় বা ধ্বংসের দেবতা এবং ধ্বংসের মাধ্যমে সৃষ্টির দেবতা দুটোই শিব বা মহাদেব। অর্থাৎ মহাদেব ইচ্ছে করলে যেমন সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছে করলে আবার প্রলয় বা ধ্বংসও করতে পারেন; এটা নিতান্তই তাঁর খেয়াল। এজন্য শিবকে বলা হয় ‘পাগলা ভোলা’। কবি এখানে জেলখানায় বন্দি স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদেরকে ‘পাগলা ভোলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কবির মতে ব্রিটিশ সরকার এই পরাধীন ভারতের পুরোটাকেই কারাগার বানিয়ে রেখেছে। ফলে এই কারাগারে বন্দি প্রতিটি মানুষই আসলে ‘পাগলা ভোলা’। পরাধীনতার কারাগারে বন্দি স্বাধীনতাকামী মানুষকে কবি আহ্বান করছেন তাঁরা যেন মহাশক্তিধর ‘পাগলা ভোলা’ তথা মহাদেবের ধ্বংস বা প্রলয় ক্ষমতার মতো ক্ষমতা প্রয়োগ করে পুরো ভারতবর্ষকে দোলা দিয়ে কাঁপিয়ে তাঁদের ক্ষমতার জানান দেয়। তাঁরা যেন এই কারাগার বা গারদের লোহার শিক জোরসে ধরে হেচ্‌কা টান দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে মুক্ত হয়ে আসে।

মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

‘হায়দার’ অর্থ শক্তিশালী, তরবারি বা সত্যের তলোয়ার। আব্রাহামিক ধর্মের শেষ নবি হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর আপন চাচাত ভাই ও জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর প্রচণ্ড শক্তি ও শৌর্য-বীর্য থাকার কারণে তাকে ‘হায়দার’ বলা হয়। ‘হাঁক’ শব্দের অর্থ হুংকার। কবি ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীকে হজরত আলীর সেই হায়দারী হাঁকের মতো প্রচণ্ড হুংকার দিয়ে ব্রিটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে পদানত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

‘দুন্দুভি ঢাক’ হলো একপ্রকার বৃহৎ ঢাক বা দামামা জাতীয় প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, রণবাদ্যবিশেষ। বন্দি-জীবন আসলে মৃতপ্রায়-জীবন; কবি বন্দিদশাকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন এবং সেই মৃত্যুদশা থেকে জীবনকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশে সজীব হয়ে গৌরবের সাথে বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সে সাহস সঞ্চার করেছেন।


নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বাংলা বৈশাখ মাস এবং এর কাছাকাছি মাসগুলোতে যে প্রচণ্ড ঝড় হয় তাকে ‘কালবোশাখী’ বলে। পরাধীন ভারতবাসীর মনের ভিতরে ব্রিটিশবিরোধী যে ভয়ঙ্কর আক্রোশ ক্রমাগত তোলপাড় করে চলেছিল তাকে কবি কালবোশাখীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি মুক্তিকামী দ্রোহী ভারতবাসীকে কালবোশাখীর ভয়ঙ্কর প্রলয় শক্তি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, এখন বৃথা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। এভাবে কাল বা সময় হরণ করা খুবই অনুচিত। সময় নষ্ট না করে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম হলো পঞ্চপাণ্ডবের দ্বিতীয় পাণ্ডব। ভীম অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন। ভারতবর্ষের বিপ্লবী বীরদের উপরে ব্রিটিশরাজ ভীমের শক্তি প্রয়োগ করে অত্যাচার-নির্যাতন করছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করে ভীমের মতো শক্তিশালী কারাগারে বন্দি করে রাখছে। কবি ভারতবাসীকে আহ্বান করছেন যেন তারা তাদের সংগ্রামী শক্তি প্রয়োগ করে ওই ‘ভীম কারা’ বা শক্ত কারাগারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়ে তা উপড়ে ফেলে মুক্তি-সংগ্রামীদের মুক্ত করে আনে।

লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।

ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ:

বল প্রয়োগ করে যারা ভারতবর্ষকে দখল করেছে তাদের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কবি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী নন, তিনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করেই অধিকার ছিনিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বন্দিরা কবে মুক্তি পাবেন অথবা আদৌ পাবেন কি না সে অপেক্ষায় তিনি বসে থাকতে রাজি নন। তিনি জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে একত্র করে এখনই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সকল বন্দিশালা বা কারাগার ভেঙে সকল বন্দিকে মুক্ত করতে চান। এই শক্তি প্রয়োগকেই কবি ‘লাথি’র সাথে তুলনা করেছেন এবং মুক্ত হওয়াকে ‘তালা ভাঙা’র সাথে তুলনা করেছেন এবং বলেছেন “লাথি মার ভাঙ্গরে তালা”।

‘আগুন-জ্বালা,ফেল উপাড়ি’ শব্দগুলি দিয়ে কবি স্বদেশীদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন যেন তারা আন্দোলন-সংগ্রাম করে ব্রিটিশদের সকল অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনকে ভারতবর্ষের মাটি থেকে চিরতরে উপড়ে ফেলেন, উচ্ছেদ করেন। এ দেশের মালিক হবে এ দেশেরই জনগণ, এ দেশকে শাসন করবে এ দেশেরই জনপ্রতিনিধি, ভারতবর্ষ হবে বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম শোষণ-নির্যাতনমুক্ত দেশ।

গানটি বিকৃতির ইতিহাস:

রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত, আরএসভিপি মুভিজ এবং রায় কাপুর ফিল্মস প্রযোজিত, ইশান খাট্টার, মৃণাল ঠাকুর, প্রিয়াংশু পাইনুলি ও সোনি রাজদান প্রমুখ অভিনীত ‘পিপ্পা’ ছবিটি ১০ নভেম্বর ২০২৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধকে তুলে ধরেছে। ছবিটিতে নজরুলের গান 'কারার ঐ লৌহকপাট'-এর রিমেক করা হয়েছে। অস্কারজয়ী সুরকার এ আর রাহমানের রিমেক সংস্করণে গানটি গেয়েছেন ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী।

এ আর রাহমান বাংলা গান নিয়ে আগেও কাজ করেছেন। ‘নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: আ ফরগটেন হিরো’ সিনেমার জন্য রবীন্দ্রসংগীত ‘একলা চলো রে’-এর সংগীতায়োজন তিনি করেছিলেন। এ ছাড়া ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ গানটির সুরারোপও তিনি নিজের মতো করেছেন। তবে নজরুল সংগীত নিয়ে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। দক্ষিণ ভারতীয় এ সুরকার তাঁর রেমিক সংস্করণে ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটির মূল সুরের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট রাখেননি। বিপ্লবী-বিদ্রোহী চেতনার ভাব ও সুরের গানটিকে তিনি লোকগীতির রোমান্টিক ঢংয়ে পরিণত করে নষ্ট করে ফেলেছেন। এমন একটি রুদ্র চেতনার গানকে হত্যা করে তিনি জঘন্য অপরাধ করেছেন যা ক্ষমাহীন।

মূল গানটি কারাগারে মধ্যে গাওয়া হলেও ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে- ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে আগুন জ্বালিয়ে নাচগান করে রীতিমতো উৎসব করে গানটি গাইছেন। গানটি গাওয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। গানটি রচনার প্রেক্ষাপট এবং এর বিপ্লবী চেতনা এমন উত্সবপূর্ণ দৃশ্যের সাথে যায় না।

চলচ্চিত্রে দৃশ্যের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও উদ্দেশ্য বুঝে সেই দৃশ্যের উপযোগী গানের সুর সৃষ্টি করা সুরকারের কাজ। ‘পিপ্পা’ ছবিতে গানের যে পরিবেশ দেখানো হয়েছে ওই পরিবেশে এই বিপ্লবী গানটি খাটে না। সিনেমার দৃশ্যে নরম সুরে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে আনন্দরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে সেটি মানানসই ও যুতসই হয়নি, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ অসংগতির দায় স্ক্রিপ্টরাইটার ও পরিচালককে বহন করতে হবে। ফলে এ বিকৃতির জন্য এ আর রহমানের সাথে তারাও দোষী।

ভারতীয় গায়ক রাহুল দত্ত, তীর্থ ভট্টাচার্য, পীযূষ দাস, শ্রায়ী পাল, শালিনী মুখার্জি ও দিলাসা চৌধুরী এরা প্রতিষ্ঠিত গায়ক এবং সম্ভবত সবাই বা অধিকাংশই বাঙালি। এই গানের সুর তাদের অজানা থাকার কথা নয়। ফলে এরা সবাইও বিকৃত সুরে গানটি গাওয়ার জন্য অপরাধী।

২০২১ সালে নজরুলের ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের ছেলে কাজী অনির্বাণ ও তাঁর মা কল্যাণী কাজী ‘পিপ্পা’ সিনেমা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গানটি ব্যবহারের লিখিত চুক্তি করেন। চুক্তিনামায় প্রথম সাক্ষী ছিলেন অনির্বাণ কাজী। কাজী অনির্বাণ স্বীকার করেন—মা গানটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন সুর এবং কথা না বদলে রিক্রিয়েট করার জন্য। মা ওদের বলেছিল, গানটা তৈরি হয়ে গেলে একবার শোনাতে। কিন্তু ওরা তা শোনায়নি। ছবির নির্মাতারা এ দায় এড়াতে পারে না।

উপসংহার:
সব সৃষ্টি কালজয়ী হয় না, সবাই কালজয়ী সৃষ্টি করতে পারে না। যারা কালজয়ী সৃষ্টি করেন তারা তাদের সৃষ্টির সাথে সাথে নিজেরাও কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন সেই কালজয়ী স্রষ্টা; তিনি নিজেও অমর, তাঁর সৃষ্টিও অমর। 'ভাঙার গান' শিরোনামে লেখা ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি নজরুলের সৃষ্টিসমূহের মধ্যেও এক অনন্য সৃষ্টি। এ সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এ আর রহমান রাখে না। অনেকে বলেন—সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কথাটা হয়তো সত্য কিন্তু সৃষ্টিকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করা এবং তাকে বিকৃতরূপে প্রকাশ করা এককথা নয়। মানুষ যদি পুরনো সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ সানন্দে গ্রহণ করে তবেই তাকে পরিবর্তন করে প্রকাশ করা হয়, একেই বলে সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টির ভিন্নভাবে প্রকাশ।

‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটির সুর পরিবর্তন বাঙালি গ্রহণ করেনি, এটাকে বিকৃতি হিসেবে নিয়েছে। ফলে এ পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়।

নাজমুল হাসান: লেখক ও চিকিৎসক।

;

কবি সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের অগ্রদূত জননী সাহসিকাখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামালের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সমস্ত প্রগতিশীল আন্দেলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের এই দিন (২০ নভেম্বর) সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বিকেল ৩টায় বরিশালের শায়েস্তাবাদস্থ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এই আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন।

পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন এবং তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন।

১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণসহ কার্ফু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেন।

সুফিয়া কামালের লেখা কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি। ‘কেয়ার কাঁটা’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ ছাড়াও তিনি ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথা, শিশুতোষ এবং আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। সোভিয়েতের দিনগুলি এবং একাত্তরের ডায়েরী তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ।

সুফিয়া কামাল দেশ-বিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক।

;

গৌরীপুরে হুমায়ুন ভক্তদের পাখির আবাস তৈরি 



উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,গৌরীপুর,ময়মনসিংহ
ছবি: বার্তা ২৪

ছবি: বার্তা ২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিনে পাখির নিরাপদ আবাসের জন্য গাছে গাছে পাখির বাসা ঝুলিয়েছেন ভক্তরা।

সোমবার (১৩ নভেম্বর) দুপুরে ভক্তদের সংগঠন হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন উপজেলা পরিষদ চত্বরে হাড়ি-কলস ঝুলিয়ে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। পরে বন, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় পৌর শহরে প্রচারাভিযান চালান ভক্তরা। এর আগে সোমবার হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফৌজিয়া নাজনীন বলেন, ‘গাছপালা ও বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় এখন আগের মতো পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় না। পাখি আমাদের প্রাণবৈচিত্রের অংশ। পরিবেশে পাখি বেঁচে থাকা খুবই জরুরি। পাখির প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকাও জরুরি। বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়। এ জন্য সাধারণ জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।'

এ সময় হুমায়ুন আহমেদ স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পদক প্রভাষক স্বপন কুমার ঘোষের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন শ্যামগঞ্জ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হারুন আলী বারী, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য এইচএম খায়রুল বাসার, বোকাইনগর ইউপি চেয়ারম্যান আল মুক্তাদির শাহীন, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু কাউছার চৌধুরী রন্টি, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রহিম, মোঃ শেখ সাদী সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পীযুশ রায় গণেশ, প্রচার সম্পাদক হারুন মিয়া প্রমুখ।

;

‘খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত ছিলেন আবুল হাসনাত’



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

‘বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য’ গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে বিশিষ্টজনরা

  • Font increase
  • Font Decrease

কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত ছিলেন খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এবং সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে নিরলস একজন মানুষ। প্রয়াত আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংকলন 'বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য' এর প্রকাশনা উৎসব ও স্মরণ আলোচনায় যোগ দিয়ে বিশিষ্টজনরা তাকে নিয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

রোববার (১২ নভেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে অনুষ্ঠিত হয় এই মোড়ক উন্মোচন ও স্মরণ আলোচনা অনুষ্ঠান। গ্রন্থটি ছিলো আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস। বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী।

আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সঞ্চালক প্রজ্ঞা লাবণীর কণ্ঠে তার কবিতা ‘স্বপ্নের কাছে ফিরে যাওয়া সহজ নয়’ আবৃত্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এর পর গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন পর্বে অংশ নেন- প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী ও আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক।  

আবুল হাসনাতের অগ্রন্থিত এই সংকলনে রয়েছে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ-সমালোচনা। এই বইয়ের প্রবন্ধ অংশে- বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, শামসুর রাহমান, আনিসুজ্জামান, মুর্তজা বশীরকে নিয়ে যে প্রবন্ধাবলি রয়েছে, তাতে মূর্ত হয়েছে বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তার ভাবনার স্বরূপ। আর পাবলো নেরুদা ও ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ দুটিতে ফুটে উঠেছে তার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি। বইটি পাঠককে আবুল হাসনাতকে বুঝতেও সাহায্য করবে।

গ্রন্থটির ওপর আলোচনা ও লেখকের স্মরণে বক্তারা তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা এবং স্মৃতিচারণা করেন। আলোচনায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আবুল হাসনাত ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী। তিনি মানুষের ভেতরে সততা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বপ্ন দেখতেন। জাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির বিকাশে যারা নীরবে কাজ করে গেছেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম।

সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাতের ভূমিকা উল্লেখ করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, কার ভেতরে কোন ধরনের মেধা ও সৃজনশীলতা আছে, তা তিনি চট করেই বুঝতে পারতেন। তাদের দিয়ে সেই ধরনের কাজ করিয়েছেন। তিনি বহু লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতেও সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে নিজেও ছিলেন উঁচু মানের কবি, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক। তার বিভিন্ন রচনায় নান্দনিক ভাবনা, পরিশীলিত মেজাজ, পরিমিতিবোধ ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়।'

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, 'আবুল হাসনাতের সঙ্গে পুরান ঢাকার নবাবপুর স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। এছাড়া ক্রিকেট খেলা, কবিতা লেখা, সাহিত্যচর্চা, ষাটের দশকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছি। আবুল হাসনাত নেই, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না। পরবর্তী জীবনে আবুল হাসনাত দেশের সব লেখক, শিল্পীর ঘনিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার নিজের লেখালেখিও অনেক। ২১টি মৌলিক গ্রন্থ, এককভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২১টি আর যৌথভাবে সম্পাদিত গ্রন্থ ২২টি। তার লেখায় শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, ভাবনা উপস্থাপনা উচ্চ মানের। মৃত্যুর পর নির্মোহ মানুষটিকে আমরা যেনো আরও গভীরভাবে জানতে পারছি।  

লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে তিনি লেখক নন, বরং লেখার গুণমানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মোরশেদ শফিউল হাসান। এ প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম থেকে তিনি ডাকে সংবাদের সাহিত্য পাতার জন্য লেখা পাঠাতেন। লেখাগুলো সাময়িকীতে গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হতো। কিন্তু তখন আবুল হাসনাতের সঙ্গে তার সরাসরি পরিচয়ই ছিল না। আবুল হাসনাত স্বল্পভাষী, নেপথ্যচারী লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল খোলামেলা। গুণীর কদর করতে কার্পণ্য করেননি।'

আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, 'এটি আবুল হাসনাতের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ। তবে বইটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে তিনি সারা জীবন নিরলস কাজ করেছেন। খ্যাতির প্রতি নিরাসক্ত এই মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত প্রচারবিমুখ। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই মানুষটি মৃত্যুর আগেও কালি ও কলমের বিদ্যাসাগর সংখ্যা নিয়ে কাজ করে গেছেন। বারবার সেটি সম্পন্ন করার কথাই বলেছেন। নতুন প্রজন্মের প্রতি তার ছিলো গভীর আস্থা। তিনি মনে করতেন দেশের নতুন প্রজন্মই সব সংকটে জাতিকে উত্তরণের সঠিক পথ দেখাবে।

সভাপতির বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এতে ১৫টি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ সমালোচনা রয়েছে ৬টি। প্রতিটি লেখা সুলিখিত, প্রাণবন্ত। গভীর পাণ্ডিত্য আর বিষয়গুলোতে লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রকাশ রয়েছে। লেখা দুর্বোধ্য নয়। সব শ্রেণির পাঠকই লেখাগুলো পড়ে যেমন অনেক বিষয়ে জানতে পারবেন, তেমনি আনন্দও পাবেন। স্কুলজীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তিনি নিজেও ছিলেন নবাবপুর স্কুলের ছাত্র। তবে আবুল হাসনাতের চেয়ে পাঁচ বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন।প্রচারবিমুখ আবুল হাসনাতের লেখা ভালোভাবে সংরক্ষণ এবং সেগুলো পরের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তার প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে- এমনটাই জানান তিনি।

আবুল হাসনাতের স্ত্রী সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, আবুল হাসনাতের স্মৃতিরক্ষা ও তার কাজ সংরক্ষণের জন্য আবুল হাসনাত ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। গত ১ নভেম্বর ছিল আবুল হাসনাতের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সে উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জানান, পর্যায়ক্রমে তার সব রচনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ নিয়ে রচনাসমগ্র প্রকাশের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।

আবুল হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামে। কবিতা, উপন্যাস, চিত্র-সমালোচনাসহ সাহিত্যের নানা বিভাগে তিনি পদচ্ছাপ রেখেছেন। দেড় দশকের বেশি সময় সাহিত্য ও শিল্প–সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা কালি ও কলম এর সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। এর আগে তিনি দুই যুগের বেশি সময় দৈনিক সংবাদ–এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’ সম্পাদনা করেন। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর সাহিত্যিক ও শিল্প সমালোচক আবুল হাসনাত রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে মারা যান। একজন বিচক্ষণ ও সংবেদনশীল সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন আবুল হাসনাত। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘদিন তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন ছায়ানটের অন্যতম সংগঠক ও সদস্য ছিলেন। ছায়ানটের কার্যকরী সংসদের সাবেক সহসভাপতি ছিলেন সাংবাদিক আবুল হাসনাত।

;