'রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?'
'রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?' জানতে চেয়েছিলেন এক আপাদমস্তক কবি। বলেছেন, 'এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?/সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?/তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;/অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরী।'
নিশ্চিতভাবে এই কবি মুসলিম ঐতিহ্যবাদের কথা বলেছেন। ইসলামের পুনর্জাগরণের আহ্বান সঞ্চারিত করেছেন তিনি। প্রাপ্তি বা জাগতিক কারণে নয়, মতাদর্শিক প্রণোদনায় তিনি ইসলামের মর্মবাণীর কাব্যরূপ দিয়েছেন। মুসলিম রেনেসাঁর কাব্যনায়ক হিসাবে পরিচিতি এই কবির নাম ফররুখ আহমদ।
১৯ অক্টোবর কবি ফররুখ আহমদের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। শত বিরূপতা ও দারিদ্র্যের মধ্যে ইসলামের আদর্শিক কাব্যসুধা বর্ণনা করতে করতে তিনি ১৯৭৪ সালে ঢাকায় পরলোকগমন করেন। নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে আপোষহীন এই দৃঢ়চেতা কবি ১০ জুন, ১৯১৮ সালে মাগুরা জেলার শ্রীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
ফররুখ আহমদের কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
ইসলামী আদর্শ ও আরব-ইরানের ঐতিহ্য তার কবিতায় ব্যাঙময় হয়ে উঠে।
আধুনিকতার সকল লক্ষণ নিয়ে তিনি তার কবিতায় রোমান্টিকতা ধ্বনির পাশাপাশি
দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ, অনাহার ক্লিষ্টের করুণ পরিনতি, সমকালের সংকট, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা, সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতার বিরুদ্ধে কাব্যভাষ্য রচনা করেছেন।
১৯৪৪ সালে প্রকাশিত 'সাত সাগরের মাঝি' ফররুখ আহমদের অবিস্মরণীয় কাব্যগ্রন্থ। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো, সিরাজাম মুনীরা (সেপ্টেম্বর, ১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (জুন, ১৯৬১), কাব্যনাট্য মুহূর্তের কবিতা (সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩), ধোলাই কাব্য (জানুয়ারি, ১৯৬৩), হাতেম তায়ী (মে, ১৯৬৬)-কাহিনীকাব্য নতুন লেখা (১৯৬৯), কাফেলা (অগাস্ট, ১৯৮০), হাবিদা মরুর কাহিনী (সেপ্টেম্বর, ১৯৮১), সিন্দাবাদ (অক্টোবর, ১৯৮৩), দিলরুবা (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪)।
ফররুখ আহমদে শিক্ষাজীবনের সূচনা নিজের
গ্রামের পাঠশালায়। পরে তিনি কলকাতার নিউমার্কেটের পাশে তালতলা মডেল এম,ই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে পড়তে যান কলকাতার বালিগঞ্জ সরকারি হাই স্কুলে। সেখানে তিনি মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রণী-বরেণ্য কবি গোলাম মোস্তফাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে পান। ফররুখ আহমদকের কবিত্ব বিকাশে কবি গোলাম মোস্তফা ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করেন।
১৯৩৭ সালে ফররুখ আহমদ খুলনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৩৯ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।
কিন্তু দারিদ্রতার কষাঘাতে পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি এই কবি।
ছাত্রাবস্থায় ফররুখ আহমদ বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। পরে চল্লিশের দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত ভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন এবং মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রতি আস্থাশীল হন। কবি তার বিশ্বাসের প্রতি সমস্ত জীবন অটল ছিলেন। তবে পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারী মনোভাবের তিনি সমালোচক ছিলেন।
মূলগত অর্থে তিনি ইসলামের সাম্যবাদী ও কল্যাণময়তার প্রতি বিশ্বস্ততার পরিচয় দেন।প্রথম যৌবনে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সমাজতন্ত্রী কমরেড এম.এন রায়ের শিষ্য কবি ফররুখ ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় চিন্তায় নিমগ্ন হলেও ধর্মের নামে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি অগাধ আস্থা রেখেও তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যা মাসিক সওগাত-এ পাকিস্তান: রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে বলেন: "গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।"
বায়ান্নর বাংলা ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ঘটনার পর রেডিওতে কর্মরত শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হালিম চৌধুরীদেরকে নিয়ে তিনি ধমঘটে যোগ দেন। তিনি তদানিন্তন পাকিস্তানী শাসকদের ব্যাঙ্গ করে ‘রাজ-রাজরা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকটি মঞ্চায়িত হয়। প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী এতে অভিনয় করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার “মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা” গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়।
কবি ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কলকাতায়। প্রথমে তিনি (১৯৪৩ সালে) আই.জি.প্রিজন অফিসে এবং পরে (১৯৪৪ সালে) সিভিল সাপ্লাইতে চাকরি করেন। তিনি ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মেও চাকরির পাশাপাশি বিখ্যাত মাসিক 'মোহাম্মদী'-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি স্থায়ীভাবে চাকরি করেন বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন অনিয়মিত হিসেবে। পরে তিনি নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
কবি ফররুখ আহমদ কবি স্বীকৃতি স্বরুপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
অন্যতম হলো- বাংলা একাডেমি (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৬৫), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৭৭-মরনোত্তর), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০-মরনোত্তর)।
কবি ফররুখ আহমদকে চরম দারিদ্রের সাথে জীবন যাপন করতে হয়েছে। কিন্তু অর্থের প্রতি, ক্ষমতার প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। দারিদ্রতাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। ভোগ বিলাসিতা তিনি ঘৃণা করতেন। তার কবিতার মতই ছিল কবির দৈনিক জীবন। তিনি অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে যা, কবিতায়ও বলেছেন সেই কথা: 'তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া/তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।'
জাগতিক বা রাজনৈতিক কারণে নয়, মতাদর্শিক বিশ্বাসে আলোকে কবি ফররুখ আহমদ একজন ইসলামপন্থী ছিলেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি সততা, কৃচ্ছ্বতা, শুদ্ধতার ছাপ রেখেছেন। ইসলামের মর্মবাণীকে ধারণ করেছেন যাপিত জীবনে ও কাব্যচেতনায়। 'রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?' বলে তিনি তার শাশ্বত বিশ্বাসের প্রতিধ্বনিই উচ্চারণ করেছেন।