করোনা হলোকাস্ট



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আমি আর যাব না ভেবে রেখেছিলাম সোফিয়ার বাসায়। কিন্তু এই লকডাউনে হোম কোয়ারেন্টিনের সন্ধ্যায় যেতে হলো। সোফিয়া পড়াশোনা করেছে বার্লিনে। ফিল্মের ওপর। তার প্রিয় পরিচালকদের একজন রুগেরো দেদাতো। ইতালিয়ান। উনার একটি মুভির নাম—ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট। সোফিয়ার বাসা বার্লিনের এন্ডিসোভি এলাকার জার্জেস লেনে। দোতলা বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের। সন্ধ্যায় যাই বলে অনেক ওয়াইন আর নানা রকমের তিতা বিয়ার ছিল। ওখানে বসেই ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট মুভিটা দেখি। একটা রেস্কিউ দল গিয়ে (অবশ্যই পশ্চিমী) বিপদজ্জনক প্রজাতির ট্রাইবালদের ডকুমেন্টেশন বানায়। ওখানে দেখি এক নারী জঙ্গলে শুয়ে আছে। নেকেড। সে একটা স্ক্রু দিয়ে এক লোকের পাছার মাংস তুলে নিচ্ছে। ওই লোকের যৌনাঙ্গ কাটার আগে তার ওপরে ওঠে বসে লাফাচ্ছে। বিচ্ছিরি যৌনতা। ক্রোধ থেকে সে এসব করছে। সবশেষে লোকটির লাশ কেটে কেটে আগুনে পুড়ে সসেজ মাখিয়ে খাচ্ছে তার মাথার ওপর দিয়ে ঝরা পাতা ওড়ে যায়। জোরেসোরে বহে বাতাস। সে নির্বিকার।

ইনফ্যাক্ট এই মুভিটি যখন প্রথম রিলিজ হয় তখন ইতালিতে রুগেরো দেদাতোর বিরুদ্ধে আদালতে কেস হয়।

আজই জানলাম ইতালিতে ক্যাভলিনিয়া সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ক্যাভলিনিয়ার যে স্টোরি প্রকাশ করেছে নিউজ উইথ আউট বর্ডারস অনলাইনে সেটি এরকম:

“মিলানের ফিফথ এভিনিউতে অফিস। পিসিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মাথায় চাপচাপ ব্যথা। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। দেরি না করে বেরিয়ে ইট্রা হসপিটালে গেলাম। করোনার টেস্ট করালাম। রেজাল্ট এলো নেগেটিভ। তবু ডাক্তার হোম কোয়রেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিলেন। বাসায় ফিরলাম। অফিসে মেইল করে ছুটির এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিলাম। ৯ মার্চের ঘটনাবলি এসব। আমার বাবা ছিলেন হসপিটালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সেই রাতেই ফোন পেলাম বাবা মারা গেছেন। হোম কোয়রেন্টিন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি বিশেষ সিকিওরিটি ফোর্স একটা কফিনকে ঘিরে রেখেছে। ডাক্তার ইশারায় ডাকলেন। জানালেন কফিনের বাক্স খোলা যাবে না। প্রিয় বাবার মুখ দেখা যাবে না। ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে। আমার বাবার কফিন কিনা কে জানে! তেইশটা কফিনের বাক্স থরে থরে সাজানো। আমাকে নির্দির্ষ্ট একটা কফিনের বাক্স দেখিয়ে বলা হলো এই কফিনে তোমার বাবা শুয়ে আছেন। আমি জানি না তিনি ওখানে শুয়ে আছেন কিনা! এরকম আরো তেইশজন তেইশটা কফিনের বাক্সের সামনে দাঁড়ানো। একজন জানতে চাইল তাদের শেষকৃত্য কোথায় হবে? তারা জানাল, সিস্টিনের গণকবরে। আমরা বাই জানালাম কফিনের বাক্সকে।

বাসায় ফিরে আসি। পাশের রুমে আমার হাজব্যান্ড বেইগি দরোজা বন্ধ করে হোমকোয়ারেন্টিনে। ছোট আমাদের মেয়েটি আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে আসতে চাইল। আমি পালিয়ে আমার রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলাম। পিপিসোফান্ডা থেকে খাবার রেখে ফোন কল দিল। বেইগি ও আমি দুজনেই ফোনে কথা বললাম। আমাদের ছোট মেয়ে সিনিরিয়াকে বললাম খেয়ে নিতে। সে বুঝতে পারছিল না কিছু। কান্না করছিল। আহা বেচারি। পিপাকে (ওর প্রিয় কুকুর) জড়িয়ে কাঁদছে। পিপাই ওর সঙ্গী।

বাবার চেহারা মনে পড়ল। সিনিরিয়ার মতো যখন আমার বয়স তখন বাবা আমায় বলেছিলেন, যেদিন আমি মারা যাব, সেদিন তুই পিয়ানো বাজিয়ে আমাকে বিদায় দিস। আর যত বছর বয়সে মারা যাব ততোটা ক্যান্ডেল জ্বালাস।

কী এক দুঃসময় এলো! এই জগতে। আমার তো এমন কোনো ইচ্ছার কথা বলার দরকার নেই সিনিরিয়াকে? যীশু, তুমি কেন এরকম কফিনের বাক্স ভরে ফেলছো প্রিয়মুখকে না দেখার সুযোগ দিয়ে? আমি এরকম প্রিয়জনকে মরে যাওয়ার পর না দেখতে দেওয়ার জন্য মামলা করব নিশ্চিত।”

জার্মানিতেও অবস্থা ভালো নয়। তবু কেন যে এলাম সোফিয়ার বাসায় এমন দিনে আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারব না। জার্মানির সারলান্ড, বাভারিয়া, লোয়ার সাক্সোনি, বার্লিন ও নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যেন দিন আর রাত একাকার হয়ে এলো। নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার রিনান নামের ছোট পাহাড়ি শহরে আমার বাস ছিল। ভাগ্যিস আমি এর আগেই বার্লিন চলে এসেছিলাম। ফেব্রুয়ারিতে। গতকাল আমার বন্ধু ফিলিপের একটা আবেগঘন মেইলে পাই।

“তুমি চলে গেলে। হয়তো কিছুটা নিরাপদ আছো। আমি মার্চের ১ তারিখ রাতে বাসায় ফেরার পর ডিনার শেষে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি ছাড়ার সাথে সাথে প্রথম দেখি সিটি মেয়র শহরটিকে লকডাউন করেছেন। এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কিছুটা আতঙ্ক বিরাজ করছে সবখানে। এরপরই আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনস স্পাহন একটি সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, করোনা ভাইরাসটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মধ্যে ফেলবে। সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর।

তিনি বলেন আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই তবে বেঁচে থাকতে হলে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আমি এ শহরের একটি কলেজে তুলনামূলক বিশ্বসাহিত্য পড়াই। আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগের কথা মনে পড়ল। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আতঙ্ক ও সুরক্ষা বিষয়ে এক লাইনে পরস্পরবিরোধী কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কারণ রাজনীতিবিদরা যখন চাপে থাকেন তখনই এমন কথা বলেন।

যাক, লকডাউন মানে আর বাসা থেকে না বেরুলেও চলবে। কিন্তু খাবার তো কিনিনি যথেষ্ট। অষুধ, সেও নেই। সকালে মাস্ক ও গ্লাভস, ফ্লিফিথ ওভারকোট পরে বেরুলাম ওসব কিনতে। পুরো জিনিসগুলো কিনলাম মুভি চলাকালে যান্ত্রিক ক্রুটি হলে যেভাবে কোনো চরিত্র একবার এদিকে যায় তো আরেকবার অন্যদিকে সেরকম অবস্থায়। মানে নিয়ন্ত্রণ নেই নিজের ওপর। বাসায় ফিরে হোম কোয়ারেন্টিনে গেলাম। শহরের সবারই এক অবস্থা।

ঘরে বসে সময় কাটছে। এক/দুই তিনদিন পরপরই বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্তের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি। গণকবরে এসব লাশগুলো কবর দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে ৫ মার্চ স্তিফানি মরগেট নামের আমার ছাত্রীটি আমাকে ফোনকল দিল, জানতে চাইল, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা! সে জানে আমি একা থাকি। পোলান্ডে মা থাকেন। বাবা নিখোঁজ। ওর প্রশ্নে জবাব না দিয়ে পাল্টা ওর কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কেমন আছো? সে বলল সেও তার বন্ধুরা ঘরে বসে বসে বিভিন্ন রংয়ের ছবি আঁকছে।

জানতে চাইলাম সেসব ছবিতে কী আঁকছো? সে জানাল, প্রায় সব ছবিই পরাবাস্তব। কোনোটিতে একটা মুদ্রার ওপর ভাইরাস এসে বসেছে। অমনি মুদ্রাটির সামনের অংশ পাখি হয়ে উড়াল দিচ্ছে। কোনো ছবিতে বা একটি ফাঁকা থালার দিকে একটা হাত বাড়ানো, কিন্তু সেই হাত চাপা পড়েছে রাষ্ট্রনায়কদের পায়ের নিচে। এবার আমি তার কথা শুনে একটু চুপ হয়ে গেলাম। সে পরম উচ্ছ্বাসে বলে যাচ্ছিল। চুপ থাকায় জানতে চাইল, শুনছেন কি? আমি জানতে চাইলাম রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে কারা? সে বলল, ডোনাল্ড ট্রাম্প। একজনই।

সে বলল তারা লেখছে, আমরা হেরে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। নিশ্চয়ই সুদিন ফিরাব।

ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায় শহরের সব বাসার সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়। এরমানে জানান দেওয়া, ‘আমরা বেঁচে আছি।’ আমার বিশ্বাস যদি বেঁচে থাকি তাহলে রাইনের তীরে চেরিগাছের নিচে কোনো এক ভোরবেলা জগিং শেষে আমি গিয়ে একটু বসব, তখন স্তিফানি মরগেট তার দাদুকে নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, গুঠেন ঠাগ (শুভদিন)। আমি জানি আমি বা স্তিফানি মরগেট কোনোদিন অন্ধ হব না।

হোসে সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাস ব্লাইন্ডনেসের কথা ভুলে যাইনি আমি। উপন্যাসের প্রথম দিকে এক অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখে সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে! তারপর সত্যিই অন্ধ হয়ে যায় সে। অন্ধ মানুষগুলোকে শহরের কোনে অ্যাসাইলামে আটকে ফেলার পরও ছড়াতে থাকে মহামারিটি, আরো নতুন নতুন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন। কিভাবে একটা অন্ধ চোখ, যা দেখতে পায় না, সেটি অন্য কারো চোখকে সংক্রমিত করে, তা বুঝতে পারে না কেউ। এ অবস্থায় কূলকিনারা করতে না পেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাহায্য চায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শেষ অবধি এক কর্নেল এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, যেহেতু অন্ধ চোখই কেবল রোগটা ছড়াতে পারে, তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো অন্ধ হওয়ামাত্র সেই চোখটাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া। অন্ধ মানুষের চেয়ে বরং মৃত মানুষ ভালো! কী ভয়ানক আর নিদারুণ পরিহাস ছিল সারামাগোর!

নিশ্চয়ই সেই কর্নেলের মতো আমরা মৃতমানুষ চাই না। চাই না বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমাদের সব করোনার অষুধ কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন আমাদের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, এসব অষুধ শুধু আমেরিকার জন্য নয়, সারা বিশ্বের সবার, সকল মানুষের।”

ফিলিপের এ মেইলটা পড়েই মূলত আমার সোফিয়ার চোখের কথা মনে পড়ে। ব্লাইন্ডনেসের চোখ! সোফিয়া যখন ঢাকায় ছিল তখন পিজি হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসক হিসেবে ছিল। পরে বার্লিন যায় মুভি বানানো শিখতে। খেয়াল কত রকমের মানুষের।

মুভিটি দেখা শেষ হওয়ার পর সোফিয়াকে আমি বলি, এইরকম পারভারশন আমাকে দেখানোর জন্য না ডাকলেও পারতে এই লকডাউনের কালে। এটি কেন দেখিয়েছো?

সোফিয়া হাসে। ওয়াইনে চুমুক দিয়ে চুরুটে টান দেয়। বলে, সেক্সুয়াল একসাইটমেন্ট ইমিউন সিস্টেমকে সবল রাখে।

ওইদিন এরপর চলে আসি। এরপর আর কয়েকদিন সোফিয়া আমাকে ফোন দিয়ে যেতে বলেছে কিন্তু আমি যাইনি। বড় কারণ আমাদের ডিভোর্সের পর আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইনি। সোফিয়া আসলে কেমন বা তার সাথে কেন আমার ডিভোর্স হলো সেটি বলা দরকার।

আমরা তখন ঢাকায়। সোফিয়ার আমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। সেই পরিবারে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। সোফিয়ার আগের স্বামীর নাম জাভেদ পীরজাদা। তার মাধ্যমেই সোফিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার তখন চেম্বার কলাবাগান মাঠের উল্টোদিকে ল্যাবএইড ভবনের পাশের ভবনে তিনতলায়। রাত সাড়ে দশটার দিকে জাভেদ পীরজাদা এলেন। ওহ, আচ্ছা বলা হয়নি। আমি একজন সাইকিয়াট্রিক। জাভেদ আমার মুখোমুখি বসলেন। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই বললেন, বলা শুরু করি?
পেশেন্ট কে? জানতে চাইলাম।
জাভেদ বললেন, মনে হয় আমার বউ। তার নাম সোফিয়া। বা আমিও হতে পারি। আমি কনফিউসড।
এমন কথায় কৌতূহল জন্মাল। জাভেদ বলা শুরু করলেন, সোফিয়াকে বাইরে থেকে দেখলে বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। সিঁথি কেটে, পাট করে আঁচড়ানো চুল, পরিপাটি পোশাক-আশাক। চোখের চাহনিতেও কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই। ভালো করে নজর করছি দেখে আবার বললেন, বিশ্বাস করুন, আমার স্ত্রী অন্য গ্রহের জীব।
আমি হেসে বললাম, এ আর নতুন কথা কী? মেন আর ফ্রম মার্স, উইমেন আর ফ্রম ভেনাস।
জাভেদ কিঞ্চিৎ রেগে গেলেন, মনে হলো। বললেন হাসির কথা হচ্ছে না। সে সত্যিই অন্য গ্রহের জীব। মানুষ সেজে আমার সঙ্গে ঘর করছে।
আপনি কি একা এসেছেন না সঙ্গে কেউ আছে?
না, না, সেই নিয়ে এসেছে জোর করে। বাইরে বসে আছে, ডাকব?
একটু পরে। আগে আপনার সঙ্গে কথা বলে নিই। কতদিন বিয়ে হয়েছে বললেন আপনাদের?
তা সে অনেক দিন হলো। শেষ যেবার হ্যালীর ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল। বছর তিরিশ আগে।
কবে থেকে বুঝছেন সে মানুষ নয়?
মাস ছয়েক… বড় ছেলের বাচ্চা হলো… তখন আমেরিকায় গিয়ে ছেলে-বৌয়ের সাথে ছিল মাস তিনেক। ফেরার পর বুঝলাম মানুষটা বদলে গেছে।

সাইকিয়াট্রিতে রোগটার একটা নির্দিষ্ট নাম আছে—ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশান। এই রোগের পেশেন্টদের মনে হয় কোনো ভণ্ড তাদের কাছের লোক সেজে বসে আছে, তাদের উঠতে বসতে ঠকাচ্ছে। আসল মানুষটাকে বেমালুম হাপিশ করে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখে বুঝলেন বদলে গেছে?
জাভেদ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, সোফিয়ার চোখের মণির রঙ বদলায়।
কী রকম?
এই ধরুন, বিরক্ত হলে সবুজ, রেগে গেলে কটকটে লাল। আজকাল বেশির ভাগ সময় রেগেই থাকে।
অন্য রঙ দেখেননি?
হ্যাঁ, নীল হতেও দেখেছি, তবে সে খুব কম।

জাভেদের চোখের পাতা পড়ল কয়েকবার। স্বাভাবিকের থেকে বেশি দ্রুত। মনে হলো সামান্য অস্বস্তিতে পড়েছেন। ঠিক কোন সময় চোখের মণি নীল হয় জিজ্ঞাসা করে তাঁকে অপ্রস্তুত করার ইচ্ছা হলো না। প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, আর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি?
একটু ইতস্তত করে বললেন, বোঝানো মুশকিল। কাছে গেলে একটা হালকা ফুলের গন্ধ পাই আজকাল। আগে কোনদিন পাইনি।
ছেলের কাছে আমেরিকায় গিয়েছিল বলছিলেন। হয়তো কোনো বিদেশি পারফিউমের গন্ধ। ছেলে কিনে দিয়েছে মাকে। আজকাল ফ্লোরাল পারফিউম খুব পপুলার। কোন ফুলের গন্ধ চিনতে পারেন?
জাভেদ অন্যমনস্ক ভাবে চোখ তুলে তাকালেন, বললেন, কয়েকদিন আগে শাহবাগে ফুলের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন গন্ধটা পেলাম। একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। দেখলাম স্তূপ করে নাল সুদ্ধ পদ্ম বিক্রি হচ্ছে। গন্ধটা সেখান থেকেই আসছে।
জানতে চাইলাম, এসব নিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেননি? তিনি কী বলেন?
আরে, জিজ্ঞাসা করেই তো বিপত্তি! আমার নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। মা মেয়ে জোর করে আপনার এখানে টেনে আনল।
আপনার ছেলে মেয়ে কটি?
ওই দুজনই। ছেলে বড়, দু-বছর হলো বিয়ে দিয়েছি। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। মেয়ে ইডেনে ইংরিজি অনার্স।
সব বুঝলাম, তাহলে আপনি এখন কী করবেন ডিসিশন নিয়েছেন?
সোফিয়ার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আমি আলাদা থাকতে চাই। ভাবছি ডিভোর্সের মামলা করব।
আমি মজা করে বললাম, আমার মনে হয় আদালতে আপনার কথা টিকবে না। আপনার স্ত্রী বলবেন তিনি রঙিন কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করছেন আজকাল। আর ফুলের গন্ধটা পারফিউমের।
তাহলে কী করি? জাভেদকে অসহায় দেখাল।
আপনাকে প্রমাণ করতে হবে উনি অন্য গ্রহের জীব। নাহলে চুপচাপ মেনে নিয়ে বাকি জীবনটা উনার সঙ্গেই কাটিয়ে দিতে হবে।

ক্যাপগ্রাস ডিল্যুশন অনেকসময় সাময়িক হয়। কিছুদিন পর নিজে থেকেই সেরে যায়। এমনিতে জাভেদকে আমার সুস্থ স্বাভাবিকই মনে হচ্ছিল। বললাম, আপনার স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি।

ইন্টারকমে হারুনকে বললাম, পেশেন্টের সঙ্গে যাঁরা এসেছেন তাঁদের নিয়ে এসো। দুই নারী চেম্বারের দরজা ঠেলে ভিতরে এলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ। দুজনেরই। জানি বলে বুঝলাম, মা মেয়ে। নাহলে দুই বোন বলে ভুল হতো। দুজনকে বসতে বললাম। ভদ্রলোককে অনুরোধ করলাম চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করতে। আমি উনার স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। ভদ্রলোক নিতান্ত অনিচ্ছাভরে উঠলেন।

হারুন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আর কোনো পেশেন্ট নেই স্যার। আমি কি যাব?

সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল। কাল ছুটি। হারুন সাভার যাবার জন্য উসখুস করছে। সাভারে ওর বউ-বাচ্চা থাকে। বললাম, ঠিক আছে, যাও। এনাকে ওয়েটিং এরিয়ায় বসিয়ে যাও। আপনি চা বা কফি কিছু নেবেন?
জাভেদ মাথা নেড়ে না বলে বেরিয়ে গেলেন। আমার চোখের ইশারায় হারুন চেম্বারের দরজাটা টেনে দিয়ে গেল। খুব সুন্দর মানুষ-জনের কাছাকাছি এলে একটা দমবন্ধভাব হয়। চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়। আমি একটু গুছিয়ে নিলাম। এক্ষেত্রে আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। মা মেয়ের দিকে ফিরলাম, বললাম, কী মতলব বলুন তো আপনাদের? বয়স্ক মানুষটাকে অযথা ব্যস্ত করছেন কেন?

সোফিয়া হকচকিয়ে গেল। নিজেও পিজিতে ডাক্তারি করে। ফলে এমন আচরণ হয়তো আশা করেনি। সেসব কথা আমাকে পরে বলেছে। সোফিয়া চুপ। মেয়েটি আমার দিকে প্রখর চোখে তাকাল, কী বলতে চান আপনি?
আমি মেয়েটির দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার সোফিয়ার দিকে ফিরলাম, উনাকে অসুস্থ ভেবে কী লাভ? কোনো সম্পত্তি টম্পত্তির ব্যাপার নেই তো এর মধ্যে?
মুহূর্তের জন্য সোফিয়ার চোখের মণি পান্নার মতো সবুজ হয়ে জ্বলে উঠেই নিভে গেল, স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি চমকালেও লাইনচ্যুত হলাম না, আসল ব্যাপারটা কী একটু বলুন তো।
এবার মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, আপনি আম্মুর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনার কাছে আমরা সাহায্যের জন্যে এসেছিলাম। অনেক হয়েছে। আম্মু ওঠো। সোফিয়া মেয়েকে থামাল। বলল, আমার স্বামী কী বলেছেন আপনাকে?
‘উনার হঠাৎ ধারণা হয়েছে আপনি নাকি অন্য গ্রহের জীব। আপনার সঙ্গে থাকা ওনার আর পোষাচ্ছে না।

সোফিয়ার চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে এলো। চোখের মণির রঙ বদলাল আবার। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুয়াশার মতো ঘোলাটে সাদা। বলল, আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম এই ভেবে যে আপনি ওঁকে বোঝাতে পারবেন উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাহলে আর কোনো ঝামেলা থাকত না।
তার মানে?
মানে, উনি একবর্ণ মিথ্যে বলেননি। আমি সত্যিই পৃথিবীর মানুষ নই। চার দেওয়ালের মধ্যে আপনি ব্যাপারটা জানলে ক্ষতি নেই। কারণ আপনি বাইরে চাউর করলেও আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ভাববে, মনের ডাক্তার নিজেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। এছাড়া রোগীর বিষয় বাইরে জানানোও ডাক্তারের কাজ না। এথিকস বলে কথা!

এ তো আচ্ছা মুশকিল হলো। সোফিয়া প্রলাপ বকতে শুরু করল। আমিও কনফিউসড। আসলেই তো সোফিয়ার চোখের রঙ বদলায়। অথচ কথাবার্তা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মানসিক রোগের রোগীদের কথাবার্তায় সাধারণত সাযুজ্য থাকে না। ইনি বেশ যুক্তি সাজিয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া, চোখের মণির রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা যে সত্যি, আমি নিজের চোখে দেখেছি। মেডিকেল সায়ান্সে এর কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা আমি জানি না। সামান্য ইতস্তত করে বললাম, দেখুন, আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক। এই চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি মেনে চলে।
আমাকে দোষারোপ করাও কি এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে?
কখনো কখনো রোগের মূলে পৌঁছনোর জন্য রোগীকে আঘাত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমি তো রোগী নই। তাছাড়া, আপনাদের বিজ্ঞান তো চেতনার সীমান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই বিজ্ঞান দিয়ে আমায় বুঝতে পারবেন না। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আপনাদের পৃথিবীতে এসেছিলাম একটি সায়েন্টিফিক রিসার্চ টিমের মেম্বার হয়ে। আমাদের কাজ ছিল আপনাদের… মানে পৃথিবীর মানুষদের জীবন প্রণালী ভালো করে স্টাডি করা। আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জানতাম ওই বদলটা ঠিক তিরিশ বছর স্থায়ী হবে। ওইটাই ছিল আমাদের মিশন টাইম। তারপর আমরা আবার নোবডি হয়ে যাব, আমাদের ফিরে যেতে হবে… অথচ ফিরে যেতে পারছি কই? হয়তো ফিরে যাব অন্য কোনো ভাইরাস এসে যদি তোমাদের মাঝে মহামারী ঘটায়।

শেষ বাক্যটা মনে হলো সোফিয়ার অন্যমনস্ক স্বগতোক্তি। আম্মুর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা। সোফিয়া যেন সব সত্য বলছে। সোফিয়া যখন কথাগুলো বলে থামল ঠিক তখনি যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য আমরা তিনজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হুড়মুড় করে চেম্বারের দরজা ঠেলে জাভেদ ঢুকে পড়লেন। আঙ্গুল তুলে বললেন, অ্যায়, দেখেছেন তো! আগেই বলেছিলাম। তখন মানছিলেন না। এখন বিশ্বাস হলো তো ও মানুষ নয়।
সোফিয়া বলল, ছিঃ, ছিঃ! তুমি আড়ি পেতে সব শুনছিলে?
জাভেদ বললেন, শুধু শুনিনি, দেখছিলামও। আমি দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই। তিন মাইল দূর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পাই।
সে কী!

এরপর তারা তিনজনই চলে গেলেন।আমার কাছ থেকে বিদায়ও নিলেন না।

পরের দিন সন্ধ্যার দিকে ফোনটা এলো, চিনতে পারছেন? গতকাল সন্ধেবেলা আব্বু আম্মুকে সঙ্গে করে আপনার চেম্বারে এসেছিলাম। আমার নাম এশা।
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন উনারা?
ভালোই। আপনাকে ধন্যবাদ। দুজনে বেশ ভাব হয়ে গেছে। শনিবার কি আপনার চেম্বার খোলা থাকে?
থাকে।

শনিবার সন্ধ্যায় মেয়েটি এলো। মুখোমুখি বসে আমার দিকে তাকাল। চোখে ঘন মেঘের কালো। কথা বলতে বলতে রঙ বদলে অতলান্ত নীল। ভয় হল ডুবে যাব। ঠিক তখনই গন্ধটা পেলাম। কেক পেস্ট্রির গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। সব চেনা গন্ধর থেকে আলাদা, অথচ খুব চেনা। বলল, আমার আম্মু আনহ্যাপি। জানে আপনি ডিভোর্সি। আমার আব্বুটা সত্যি অসুস্থ। আম্মু আপনাকে মিথ্যা বলেছিল যে সে অন্যগ্রহের। ভেবেছিল এমন বললে আপনি তাকে অসুস্থ ভাববেন এবং আব্বু তাকে তালাক দিবে। প্লিজ আপনি আমাদের আম্মুকে বিয়ে করেন।

মেয়েটির এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে সত্যি কথা কি মেয়েটিকেও আমার অসুস্থ মনে হলো।

সেইরাতেই ফোন করল সোফিয়া। বলল, আপনার সাথে দেখা হওয়া জরুরি।

আমি গ্যাসের চুলোয় রান্না চাপিয়ে পাশে একটা উঁচু জিরাপ মার্কা টুলে বসে শহীদুল জহির পড়ছিলাম। কী বলব, বুঝে উঠতে পারলাম না। জানতে চাইলাম কোথায় দেখা করা যায়। সোফিয়া বলল ধানমন্ডির ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে (এটি এখন আর নেই)। সময়? সোফিয়া জানাল। পরদিন সোফিয়া এলো না।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল, কোনো যোগাযোগও নেই তাদের কারোর সঙ্গেই। আগ্রহও নেই বাড়তি। তবে একটু রহস্য মনের কোথাও ছিল। না হলে এক মাস পুরো হওয়ার আগেই সোফিয়াকে পিজি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সন্ধ্যার একটু পর আমি ডাক দেব কেন!

সোফিয়া পিজি থেকে বেরিয়ে শাহবাগের জনতা ব্যাংকের ব্রাঞ্চটা যেখানে সেখানকার সামনে এসে সম্ভবত টেক্সি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আরেফিনের জন্য। সোফিয়ার দিকে নজর যেতেই ডাক দিলাম একটু এগিয়ে। আমার ডাকে এবং সামনাসামনি হয়ে যাওয়ায় জানতে চাইল, কেমন আছি। আমিও প্রায় যেন একই সময় কুশল জানতে চাইলাম। দুজনেরই মুখ থেকে ‘ভালো’ শব্দটি যেন বেরিয়ে প্রথম অক্ষর মিলিয়ে গেল রমনা উদ্যানের দিকে। আর শেষ অক্ষর মিশে গেল চারপাশের হাওয়ায়। সোফিয়া হাসল, বলল, এখানে কী করছেন?
তেমন কিছু না।
বাসা কোথায় আপনার?
আজিমপুর।
এখানে বুঝি প্রায়ই আসেন?
জ্বী। সময় পেলে।
ভালো তো! নেক্সট এলে আমাকে কল কইরেন। যদি হাসপাতালে থাকি তবে চইলা আইসেন। চায়ের দাওয়াত রইল।
আমি একটু থেমে ইতস্ততভাব কাটিয়ে বললাম, আচ্ছা ঘটনা কী, বলেন তো? ওইদিন ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসলেন না?

একথা বলার সময় যেন প্যারালালি এটিও ভাবছিলাম এশা যে তার আম্মু মানে সোফিয়াকে বিয়ে করতে আমাকে বলেছে দেখা করে সেটি বলব কিনা ! কিন্তু চেপে গেলাম।

মনে আছে শীতকাল ছিল। একটু শৈত্যপ্রবাহ বইছিল। সোফিয়া তার চাদরটিকে যেন ঠিক করল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করে দু ঢোক পানি খেলো। এরপর বলল, ইয়ে আপনার সাথে আমার মেয়ে এশা দেখা করেছিল, তাই না?

আমার মধ্যে একটা থতমতো অবস্থা। সেটি সোফিয়া টের পেল সম্ভবত। কারণ এরপরই আমাকে আরো থতমতো করার জন্যই হয়তো-বা যেন বলল, এশা আপনাকে বলেছে না আমি আনহ্যাপি, আমাকে বিয়ে করার জন্য।

সত্যি নিজেকে কেমন লাগছিল বোঝাতে পারব না। ঠিক সেইসময়ই সোফিয়া সেই হাসিটি দিল। যে হাসিতে একই সঙ্গে মায়া ও শ্লেষ মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে ভালোবাসা ও তাচ্ছিল্য মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে কিছুই আসলে আদৌ থাকে না আবার অনেক কিছু যেন থাকে। এমন হাসিতে কিন্তু চোখেরও একটা ভাষা থাকে। মানসিক রোগের মধ্যে একটা রোগের নাম, ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রপি। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগী মনে করেন, তিনি হঠাৎ করেই কোনো একটি জন্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন এবং অনেক সময়ে তারা আচরণও করা শুরু করেন জন্তুর মতো। আমার হঠাৎ করেই নিজেকে মনে হলো আমি গাধায় রূপান্তরিত হয়ে গেছি। কান বড় হয়ে গিয়েছে। গাধা একা থাকতে পছন্দ করে না। সঙ্গী হিসেবে অন্য প্রাণী তাদের পছন্দ। প্রতিবন্ধীরা গাধাদের সঙ্গে সময় কাটালে মানসিকভাবে অনেক সুস্থবোধ করে! আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সোফিয়া হাসতেই থাকে। সেই কুহক হাসি। ওই হাসি ও তার চোখের কারণেই কিনা আমি নিশ্চিত না, আমাদের প্রেম হয়, বিয়েও হয়। এরপর যা হবার তাই হলো, মানে ডির্ভোস। কিন্তু এই জার্মানিতে এসেই আমাদের ফের দেখা হবে কেন?

বাসায় রাতের রান্না শেষে টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে এসব মনে পড়ছিল। তখনই দেশ থেকে ফোনকল দেয় মেসেঞ্জারে ছোটভাই কায়েস। কায়েস জানতে চায়, ভাইয়া কেমন আছো? উত্তর দিই। জানতে চাই তারা কেমন আছে। সে বলে, বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না ভাইয়া। এরপর মিনমিনে কান্নার শব্দ। লাইন কেটে যায়। মনে পড়ে সোফিয়ার সেই বহু বহু দিন আগের কথা, যেটি সে আমার চেম্বারে বসে বলেছিল, আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে যাব যদি অন্য কোনো ভাইরাস এসে তোমাদের মাঝে মহামারী ঘটায়।

আমি ছোটভাই কায়েসকে কল করি।
না সে নেই। লগ আউট।

   

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

বাংলাদেশের বৈশাখি মেলা

  ‘এসো হে বৈশাখ’



সাইমন জাকারিয়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ হাজারো মেলার দেশ। এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রাম-শহর জুড়ে প্রতি বছর এখনও প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত প্রতিটি মেলা আয়োজনের পিছনে কোনো না কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। সেটি হয় ধর্মীয়, নয় ব্রত-পালা-পার্বন অথবা যে কোনো একটি নির্ধারিত বিষয় বা ঐতিহ্যকে স্মরণ করে।

মেলার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে- নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত তারিখ বা তিথি-লগ্নে এক একটি মেলাতে নর-নারী, শিশু-কিশোর এমনকি আবাল বৃদ্ধরাও সমাগম ও সমাবেশ করে থাকে। উল্লেখ্য, একটি জায়গায় অনেক লোকের সমাবেশ ও সমাগম মানেই সাধারণ বাংলা অর্থে মেলা বলা হয়। তবে, মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে- ব্যবহার্য পণ্য ও গৃহ সামগ্রীর বিরাট সমাবেশ এবং চিত্তবিনোদনের জন্যে যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদির আসর।

আধুনিক এই যুগের খেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ এখন অনেকটাই তার চরিত্র বদলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এরমাঝে তাকে নানা উত্থানপতন ও অবক্ষয়ের ধকল সইতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মেলাগুলো কিছুতেই তার ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে পুরোপুরি যেতে নারাজ। বাংলাদেশের মেলাগুলো এখন আগের সনাতন চেহারা থেকে রূপান্তরিত হয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও অতিমারি কালে বাংলাদেশের বহু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির মতো মেলাগুলোও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। তবে, মানুষের জীবিকার চাহিদা ও মননশীল মনের তাগিদে ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আয়োজনে সাময়িক বাধাপ্রাপ্ত হলেও কোভিড-১৯ উত্তরকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যগত মেলাগুলো আবার আগের মতো অনুষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।

উল্লেখ্য, এদেশের প্রচলিত মেলাগুলির প্রকৃতি বহুবিধ ধরনের। এক বাক্যে তার প্রকৃতি অনুসারে শ্রেণী করণ দুঃসাধ্য। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে এদেশে প্রচলিত মেলাগুলির একটি সরল শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের মেলা প্রায় সর্বাংশই ছিল গ্রামকেন্দ্রিক, যুগের পরিবর্তনে ধীরে ধীরে সেই চিত্র পাল্টে গিয়ে এদেশের মেলা বর্তমানে গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই ছড়িয়ে পড়েছে।

চারিত্র্য বিচারে এদেশে প্রচলিত মেলাসমূহকে মোটামুটি সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে, যথা- ১. ধর্মীয় উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ২. কৃষি উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলা, ৩. ঋতুভিত্তিক মেলা, ৪. সাধু-সন্তের ওরশ উপলক্ষে ফকিরী মেলা ৫. জাতীয় জীবনের বিভিন্ন বরেণ্য ব্যক্তি যেমন, কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ইত্যাদির স্মরণোৎসব উপলক্ষে স্মারক মেলা, ৬. জাতীয় দিবসসমূহ উদ্যাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃৃতিক মেলা, ৭. বাণিজ্যিক সামগ্রী প্রদর্শনী ও বিক্রয় মেলা। উল্লেখ্য, যেসকল মেলার ঐতিহ্য বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রচলিত আছে এই শ্রেণীবিন্যাসে কেবল সেসকল মেলাগুলিকেই বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে, ভিন্ন বিবেচনায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের মেলাসমূহের এমন সরলকৃত শ্রেণীবিভাগকে যে কেউ নতুনভাবেও পুনর্বিন্যস্ত করতে পারেন।

এক

উপলক্ষই বাংলাদেশের মেলা উদ্যাপনের স্বাভাবিক উৎস কথা। কিন্তু উপলক্ষ যা-ই থাকুক বাংলাদেশের মেলার একটা সার্বজনীন রূপ কিন্তু আছেই। এদেশের মেলায় অংশগ্রহণে সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিন্নতা কোনো দিনই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশের সবগুলো মেলাই আর্থ-সাংস্কৃৃতিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে মানুষের মধ্যে মিলন কথাকেই প্রকাশ করে থাকে। সে কারণে এদেশের মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ধর্ম ও শ্রেণীর মানুষের আনাগোনা ঘটে। অতএব, বাংলাদেশের মেলা মানে মৈত্রী সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু -কিশোর সকলেই আসে এই মেলাতে।

এখানে সকলের অভিন্ন আকাক্সক্ষা একটিই, আর তা হলো- মেলা বা আড়ৎ দেখা। যার সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে আরেকটি বিষয় জড়িয়ে থাকে, তা হচ্ছে-বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। মেলাতে গাঁয়ের বধুর ঝোঁক থাকে আলতা-সিঁদুর-স্নো-পাউডার-সাবান আর ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি সামগ্রীর প্রতি। আরেকটি আকর্ষণ থাকে বিনোদনের প্রতি, আর তা হচ্ছে- যাত্রা, পুতুল নাচ বা সার্কাস প্রদর্শনী দেখা।

তবে, শিশু-কিশোরদের টান থাকে মূলত খেলনার দিকে, যেমন- মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ। শিশু-কিশোরদের আরেক আকর্ষণের বস্তু হচ্ছে- খই, বাতাসা, রসগোল্লা, চমচম, কদমা, খাগড়াই, মুড়ি-মুড়কি, জিলিপি আর দানাদার। তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের খেলনা বাঁশির কথাও বলা যায়। মেলার প্রাঙ্গণে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোরই বাঁশি কিনে থাকে।

বাংলাদেশের মেলার একটি দিকে থাকে অনিবার্যভাবেই বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন- নাগরদোলা, পুতুলনাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, যাত্রা, বাউল-ফকির বা কবি গান, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, কুস্তি, জারিগান ইত্যাদি। কিছু কিছু মেলাকে মাতিয়ে রাখে সঙ-এর কৌতুক ও মশকরা, তারা স্বাধীনভাবে মেলাতে ঘুরে ঘুরে রঙ্গ করে থাকে। এছাড়া, মেলায় বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাড়ি-মদ আর জুয়ার আসর বসে থাকে। নেশায় এমন ডুবে এবং জুয়ার খেলায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে অনেকেই। এটা বাংলাদেশের মেলার একটি প্রাত্যহিক চিত্র।

তবে, বাংলাদেশে বর্তমানে চিত্তবিনোদনের ক্ষেত্রেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এদেশের মেলায় এখন হর-হামেশাই মাইকে বা সাউন্ড বক্সে উচ্চ আওয়াজে গান বাজে। মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানে দোকানে এখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে পছন্দমতো গান বেছে নিয়ে তা সাউন্ডবক্সে বাজানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করা হয়।

সময় বদলের সঙ্গে এদেশের মেলার চিত্র-চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলার রূপ ও মেজাজ অনেকখানিই বদলে গেছে। সনাতন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে এইদেশে যে সকল মেলার আয়োজন হতো তার মধ্যে অনেক মেলার আয়োজন এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং অনেক মেলা এখন বিলুপ্তির পথে, কিছু মেলা এরই মাঝে রূপান্তরিত হয়ে নতুন রূপ গ্রহণ করে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামীণ মেলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এদেশের গ্রামীণ মেলার স্বাভাবিক ও সাধারণ চিত্র কুটির শিল্পজাত গ্রামীণ পণ্যের বদলে দেশী-বিদেশী চোখ ধাঁধানো বাহারি পণ্যের জৌলূস ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি চ্যানেলে প্রচলিত কাটুনের চরিত্রের মুখ ও নকশা এখন প্লাস্টিক ও বাতাস দিয়ে ফোলানো বেলুনের উপর শহর থেকে গ্রামের মেলায় বাতাসে উড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে জনপ্রিয় কাটুন চরিত্র মটু-পাতলু সারা বাংলাদেশের মেলাগুলোতে প্রত্যক্ষ করা যায়। এগুলোই এখন শিশুদের প্রধান আকর্ষণের বস্তু হয়ে গেছে।

এদেশের বহু নাগরিক প্রয়াসের সঙ্গেই বাংলায় প্রচলিত মেলার লৌকিক ধারা এসে মিশেছে। যেমন- বৈশাখীমেলা, ঈদমেলা, বইমেলা, বিজয় মেলা ইত্যাদি মূলত এদেশে প্রচলিত মেলার লোকধারার প্রেরণা নিয়ে নতুন আঙ্গিক ও মাত্রায় আজ নগরজীবনে প্রতিষ্ঠিত এবং তা এর মধ্যেই ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করেছে। এমত ধারায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে বিজয়মালা, যা যথার্থ অর্থেই ‘ঐতিহ্য ও আধুনিক চেতনার.. অপূর্ব সমন্বয়’।

দুই

বাংলা নববর্ষ ১৪৩১-এর শুরু উপলক্ষে এখানে এদেশের বৈশাখি মেলার অতীত ও বর্তমান চালচিত্র সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই।
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম মাস। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল থেকে যখন বাংলা সনের গণনা শুরু হয় তখন বছর সূচনার মাস হিসেবে বৈশাখকেই প্রথমে রাখা হয়। অনেকের ধারণা, সম্ভবত তখন থেকেই নববর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বৈশাখী মেলার সূচনা। বৈশাখী মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এ মেলা ধর্মসম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির মেলা।

বৈশাখি মেলার অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যকে কোনো দিনই কোনো ধর্মের গোঁড়ামী খর্ব করতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই বৈশাখী মেলারও রয়েছে অন্যান্য মেলার মতো দুটো দিক। একটি বাণিজ্যিক আর একটি সাংস্কৃতিক। বাংলার ব্যবসায়ীরা চৈত্রের শেষ দিন বা ‘চৈত্রসংক্রান্তি’তে এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘হালখাতা’ করে থাকে। আসলে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র দিনটা পালন করে বাংলাদেশের মানুষেরা পুরনো বছরকে বিদায় দেওয়ার উৎসব করে থাকে।

এতে মেলা, গান-বাজনা ও খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশে বাংলার একটা বছর বিদায় নেয় এবং নতুন একটা বছরের সূচনা হয়। এই দেশে তাই বৈশাখি মেলার সূচনা হয় বৈশাখের আগে থেকেই মানে চৈত্রের শেষ দিক থেকে। তবে, বৈশাখের প্রথম দিনটিই আসলে উৎসবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সবাই পরিষ্কার ও সুন্দর জামা-কাপড় পরে। ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। আর ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ছোটে মেলাতে।

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে কৃষক, কামার, কুমোর, তাঁতি, ময়রা এবং অন্যান্য শিল্পী-কারিগরেরা যে সব সামগ্রী তৈরি করে, বৈশাখী মেলায় তা প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ এনে দেয়। গ্রামীণ কৃষিজাত পণ্য, মিষ্টান্ন দ্রব্য, কুটির শিল্পজাত পণ্য, মাটি ও বেতের তৈরি শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি নিয়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান সাজায় এই মেলায়। বাঁশ ও তালপাতার রঙিন বাঁশি, ভেঁপু, একতারা, দোতারা, ডুগডুগি, বেলুন, লাটিম, মার্বেল, ঘুড়ি-লাটাই, চরকি, পুতুল, মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া, কাঠ, কাগজ ও বাঁশের পাখি, মাটির হাড়ি-বাসন, কলস, কাচের চুরি, পুঁতির মালা ইত্যাদি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে ছোট ছোট দোকানিরা।

এছাড়া আছে কাঠের আসবাবপত্র, খাট, পালঙ্ক, চৌকি, চেয়ার-টেবিল, আলনা, আলমারি, ঢেঁকি, পিঁড়ি, গাড়ির চাকা প্রভৃতি। মেলায় আরও পাওয়া যায় পিতলের হাড়ি, কলস, বাসন-কোসন, লাঙল-জোয়াল, লোহার দা, বটি, কুড়–ল, খন্তা, কাচি, নিড়ানি, গরুর গলার ঘুঙুর। ময়রারা তৈরী করে নানা রকমের মিষ্টান্নদ্রব্যÑ কদমা, জিলিপি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচের মিঠাই, খাগড়াই আরো কতো কি। বলে রাখা ভালো এসব মিষ্টান্নদ্রব্য মেলাতে আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে মেলার প্রচলিত রীতিকে ধরে। মুড়ি, মুড়কি, খই, চিড়ে, ছাচ খাজা, মোয়া, নারিকেলের নাড়–, বুট, চানাচুর, বাদাম ভাজা আর দিল্লির লাড্ডু, মটরভাজা, তিলের খাজা আজও মেলা আগত মানুষের প্রিয় খাবার।

বৈশাখি মেলার আরেক আকর্ষণ হচ্ছে তাঁতবস্ত্র। এই মেলাতে তাঁতিরা নিয়ে আসে নক্সীপাড়ের শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানের চাদর প্রভৃতি। মেলার একপাশে ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি জামা-কাপড়ও পাওয়া যায়। স্যাকরার দোকানে মেয়েরা ভীড় জমায় রূপা, তামা ও পিতলের গহনা কিনতে। বৈশাখী মেলায় গ্রামের কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের উন্নত জীবন গঠনের উপযোগী কিছু শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকে।

এরমধ্যে রয়েছেÑ পশু প্রদর্শনী, চরকায় সুতা কাটা, গালার কারিগরি, গাছের চারা বা নার্সারি এবং অন্যান্য শিক্ষামূলক প্রদর্শনী। গ্রামের মেয়েদের তৈরি নানাপ্রকার পাখা, মাদুর, কাঁথা, শিকে, বেত ও বাঁশের তৈরি হরেক রকম জিনিসপত্র সাজানো হয়। আর থাকে উন্নত ধরনের শাক-সবজি,উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি, শস্যের বীজ প্রদর্শনী ও কেনার ব্যবস্থা।

যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মেলার যে রীতি ও ধরন আমাদের দেশে চালু রয়েছে, বৈশাখি মেলা তার সবটাই ধারণ করে আছে। যেমনÑ ১. বহু মানুষের সমাবেশ, ২. গানবাজনাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা, ৩. গ্রামীণ ব্যবহারিক শিল্পসামগ্রীর প্রদর্শনী ও বিক্রয়, ৪. বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন।

মেলায় এসে মানুষ আনন্দের উপকরণ খোঁজে। তাই এখানে থাকে আনন্দলাভের নানা আয়োজন। পালাগান, বাউলগান, যাত্রা, কবিগান, গম্ভীরা, আলকাপ, জারিগান, পুতুলনাচ, সার্কাস প্রভৃতি বৈশাখি মেলার প্রধানতম সাংস্কৃতিক দিক। দেশজ খেলাধূলাও যে মানুষকে আনন্দ দিতে পারে তার প্রমাণ মেলে আমাদের বৈশাখি মেলায়। লাঠিখেলা, কুস্তি, হা-ডু-ডু, ঘুড়ি ওড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড়, মোরগের লড়াই, বানেরর খেলা ইত্যাদি দেশজ মজার খেলা সবাইকে মাতিয়ে রাখে।

গ্রামই ছিল একসময় বৈশাখি মেলার প্রধান ক্ষেত্র। সাধারণত পথের তেমাথায়, তিন নদীর মিলনস্থানে, ফাঁকা মাঠে, কিংবা বিশাল অশ্বত্থ বা বট গাছের নিচে এই মেলা বসত। যেখানে নানান দিক থেকে অনেক লোক এসে জড়ো হতে পারত। কালক্রমে মেলার স্থান গ্রাম থেকে শহরে বি¯তৃত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এখন তাই পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ সারাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে, রাজধানী ঢাকা থাকে এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলে। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকায় নববর্ষের উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) বৈশাখি মেলার আয়োজন করে আসছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত বিসিকের বৈশাখি মেলা দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগিয়েছে। কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে বিসিক বৈশাখী মেলার আয়োজন করে, যেমন- ১. কুটির ও হস্তশিল্পজাত পন্যের বাজার সৃষ্টি,

২. গ্রামীণ কারুপণ্য শহুরে মানুষ ও বিদেশীদের সামনে তুলে ধরা, ৩. ক্রেতার চাহিদা সম্বন্ধে উৎপাদকদের অবহিত করা, ৪. কারুশিল্পীদের বিভিন্ন পণ্য, নক্সা ও নমুনার সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটানো। এবছর ঈদের ছুটির পর পরই পহেলা বৈশাখ পড়ে গেছে বিধায় বিসিক বৈশাখী মেলা ঈদের পর সুবিধাজনক সময়ে করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, বৈশাখি মেলা কেবল একদিনেই শেষ হয় না। একদিন, তিনদিন, সাতদিন, পক্ষকাল, পুরো মাস আবার কোথাও-বা দুই মাসব্যাপীও বৈশাখি মেলা চলে। সারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই কোনো না কোনো স্থানে বৈশাখি মেলা বসে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, যশোর, বরিশালসহ আরো অনেক জেলায় পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে মাসব্যাপী বৈশাখি মেলা চলতে থাকে।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য বৈশাখি মেলার মধ্যে দিনাজপুরের আমবাড়ির মেলা, বগুড়ার গাঙনগরমেলা, যশোরের নিশিনাথ তলার মেলা, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা-বিত্তিপাড়ার ঘোড়াপীরের মেলা এবং বরিশালের বাকালের মেলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ।

কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়ার চান্দনা গ্রামের বৈশাখি মেলা ছিল বিখ্যাত। এই মেলার আড়ম্বর, জাঁকজমক অন্যান্য মেলার চেয়ে বেশি হতো। এছাড়া, কুমিল্লা জেলার সিদলাই, কান্দুঘর, ময়নামতিসহ বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলার ঐতিহ্যের সুখ্যাতি রয়েছে। এ অঞ্চলে বৈশাখি মেলায় বিক্রির জন্য বাঁশের বাঁশি তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর প্রভৃতি স্থানে বৈশাখি মেলা বসে।

চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলার অন্যতম পর্ব ‘জব্বারের বলীখেলা’। একদিনের এই বলীখেলা উপভোগ করতে সমবেত হয় অসংখ্য মানুষ। চৈত্রের শেষে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা আয়োজন করে ‘মহামুনির মেলা’। এই মেলা বর্ষবরণেরই অংশ। চট্টগ্রামের আদিবাসী মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসব পরিচিত সাংগ্রাই, বিঝু বা বিষু নামে। এই উৎসব উপলক্ষেও মেলা জমে ওঠে।

বর্তমানে প্রচলিত বৈশাখিমেলার তালিকা প্রণয়ন ও তার সম্পূর্ণ বিবরণসহ আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে নথিভুক্ত করা জরুরি। ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এই বৈচিত্র্যময় রূপ তুলে ধরতে পারলে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় এদেশে যেমন প্রচুর বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটতো, তেমনি নতুন প্রজন্ম বৈশাখি মেলার ঐতিহ্য সুরক্ষায় সচেতন হতো।

বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো এবং বৈশাখি মেলায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা উদ্ধুদ্ধ হতেন ঐতিহ্যপ্রেমে। এমনকি এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির সাধনা বিস্তার ঘটতো এবং বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তো।

লেখক: বিশিষ্ট লোক-ঐতিহ্য গবেষক, নাট্যকার ও উপ-পরিচালক, সংস্কৃতি উপবিভাগ, বাংলা একাডেমি। 

;