ইবির একই বিভাগের তিন বন্ধুর যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি’র স্বপ্নপূরণ
একজন মানুষের সফলতার পেছনে একজন বন্ধুর অবদান কখনো কম থাকে না! হাসি, ঠাট্টা, গল্প, আড্ডা, খেলাধুলা আর গানের পাশাপাশি যখন একই সঙ্গে সফলতার চূঁড়ায় আরোহন করা যায়, তার থেকে মধুর আর কিছু হতে পারে না!
তেমনি এক আকাশচুম্বী সফলতার মুখ দেখেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বন্ধু এবং তিনজনই একই বিভাগের। তিন বন্ধুই পেয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ’।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনি এক চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের তিন মেধাবী শিক্ষার্থী। তবে ‘শিক্ষার্থী’ বিশেষণ একপাশে রেখে তিন বন্ধু বলাই শ্রেয়! এই তিন বন্ধু হলেন- মামুনুর রশিদ, সুমন আলী ও নাঈম হোসেন।
জানা যায়, স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে তিনজনের রেজাল্ট একই। প্রথম থেকেই তাদের গবেষণা ও উদ্ভাবনীর দিকে আগ্রহ ছিল। পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. বখতিয়ার হাসানের সহায়তায় ‘Hasan's research lab’ নামে একটি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে সেখানে একসঙ্গে কাজ করতে থাকেন। করোনা মহামারির সময়ও থেমে থাকেনি তাদের কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এক বাসায় রুম ভাড়া নিয়ে কাজ চালিয়ে যান তারা। সেখানে তারা একইসঙ্গে গবেষণার মৌলিক কাজগুলো শেখেন।
এই সফলতার পেছনের ঘটনা বলতে গিয়ে তারা বার্তা২৪.কমকে জানালেন, আমরা সপ্তাহে ২-৩ বার জুমে মিটিং করতাম। ২০২১ সালের জুনের দিকে আমাদের গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয়। এর পর আমরা আরো বেশি ‘মোটিভেটেড’ হই। মনে প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে কাজ করতাম দিনরাত। স্যার আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন যে, তোমরা বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেবে। তারপর বিশ্বের নামি-দামি গবেষকের সঙ্গে কাজ করবে। আমাদের নাম উজ্জ্বল করবে।
মাঝে মাঝে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম। আবার মোটিভেটেড হতাম স্যারের কথায়। স্যারই আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা!
তারা বলেন, আমাদের এই সফলতার পেছনে সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. বখতিয়ার হাসান স্যারের অবদান সবচেয়ে বেশি। বখতিয়ার হাসান স্যার আমাদের হাতেকলমে গবেষণা শিখিয়েছেন। সবসময় আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। দেশি এবং আন্তর্জাতিকমানের গবেষকদের সঙ্গে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে সুমন আলী বলেন, আমার বিভাগের এবং আমার পরিবারের জন্য এই সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! সবচেয়ে মজার বিষয়, আমরা যখন ড. বখতিয়ার স্যারের পাবলিকেশন দেখতাম, তখন তিনজন আলোচনা করতাম, আমরাও একদিন স্যারের সঙ্গে পাবলিকেশন করবো।
নাঈম হোসেন বলেন, মানুষের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য থাকে। বিসিএস অবশ্যই ভালো পেশা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। তবে আমি কখনো সাধারণ জ্ঞান বা অনেক মুখস্থ পড়ায় আগ্রহ পেতাম না। অন্যদের মতো আমার পরিবারও বিসিএসকে গুরুত্ব দিতো। কিন্তু তারপরও আমার বড়ভাই আমাকে ‘সাপোর্ট’ জুগিয়েছেন। আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান বলবো, আমার বড় ভাইয়ের। একজন ভাইয়ের কী করা উচিত, তার সর্বোচ্চটা তিনি করেছেন। কোনো কিছুর কমতি কখনো তিনি আমার জন্য রাখেননি। সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
মামুনুর রশিদ বলেন, আমার জন্য এই সাফল্যটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! কারণ, বাংলাদেশ থেকে খুব কম শিক্ষার্থীই আছেন, যারা সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিন্যান্সে পিএইচডিতে ‘ইনরোল’ (ভুক্ত) হতে পারেন। তিনি বলেন, ফিন্যান্সের পিএইচডি প্রোগ্রামগুলো খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়। সেখানে একই বিশ্ববিদ্যালয়, একই বিভাগ এবং তিন বন্ধু একইসঙ্গে পিএইচডিতে সুযোগ পাওয়া, অনেক গর্বের বিষয়!
আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মামুনুর রশিদ বলেন, সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হলো, তিন বন্ধুর একইসঙ্গে পিএইচডি শুরু করা; যেখানে আমরা তিনজনই একসঙ্গে অনার্স চতুর্থ বর্ষ থেকেই গবেষণা শুরু করি।
সুপারভাইজারের শিক্ষকের অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, এখানে আমাদের তিনজনের সুপারভাইজার ড. বখতিয়ার হাসান স্যারের অবদান বলে শেষ করা যাবে না! তিনি না থাকলে হয়ত আমরা এই স্বপ্ন দেখার সাহসই পেতাম না! আমার মায়ের দোয়া সবসময় আমার সঙ্গেই ছিল।
আমার মা সবসময় বলতেন, ‘তুমি পারবা বাবা’- এই কথাটুকু আমার কাছে খুবই অনুপ্রেরণার ছিল। যাই হোক, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তাআলার প্রতি অশেষ শুকরিয়া যে, আমরা এই ‘চ্যালেঞ্জিং জার্নিতে’ সফল হয়েছি। তবে এটাই শেষ না; যেতে হবে বহুদূর!
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বখতিয়ার হাসান বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যবসায় শিক্ষার গবেষণা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমি তাদের পরার্মশ ও গাইডলাইন দিয়েছি। তারা তিনজনই ছিল অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী। তবে এটা খুবই ব্যতিক্রমী যে, তিন বন্ধু একইসঙ্গে ‘ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ’ পেয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এর চেয়ে আনন্দ ও গৌরবের আর কিছু হয় না! এটাই আমার সবচেয়ে বড় সফলতা!
উল্লেখ্য, তিন বন্ধুর মধ্যে মামুনুর রশিদ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে ফিন্যান্স নিয়ে পিএইচডির জন্য মনোনীত হয়েছেন। নাঈম হোসেন ইউনিভার্সিটি অব নিউ ওরল্যান্সে ফিন্যান্সিয়াল ইকোনোমিকসে মনোনীত হয়েছেন এবং সুমন আলী এল পাসোর ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে ফিন্যান্স নিয়ে পিএইচডি করার জন্য মনোনীত হয়েছেন।