জ্বালানী নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অবদান



ড. সেলিম মাহমুদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ ৯ই আগস্ট। জ্বালানী নিরাপত্তা দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে মৃত্যুর মাত্র ছয় দিন আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এই দিন তিনি জাতীয় স্বার্থে দেশের বৃহৎ পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র—তিতাস, বাখরাবাদ, রশীদপুর, কৈলাশটীলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রভাবশালী বহুজাতিক তেল কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছিলেন। জাতির পিতার এই পদক্ষেপ ছিল বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাতীয় স্বার্থে তাঁরই গৃহীত সাংবিধানিক, আইনি ও নীতিগত সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন।

একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাত অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী আমাদের মতো অর্থনীতিতে ১% জিডিপি বৃদ্ধির জন্য ১.৮%-২% জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও তাঁর সরকার প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বিষয়ক কিছু সাংবিধানিক বিধান, আইন ও নীতিমালা এদেশের জ্বালানী নিরাপত্তার মূলস্তম্ভ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানী ও খনিজ সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা (Permanent Sovereignty Over Natural Resources) প্রতিষ্ঠা করেন। এই আইনি অধিকারের ধারণাটি তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক আইন অঙ্গনে খুবই নতুন ছিল। ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানি সমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানী সম্পদের ওপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে জারি করা বঙ্গবন্ধুর এই বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ ছিল তাঁরই নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মাইলফলক অর্জন। জাতির পিতা গ্রামীণ উন্নয়ন এবং নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য দূর করার জন্য গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের বিষয়টিকে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন (অনুচ্ছেদ-১৬)। বঙ্গবন্ধুর এই বৈপ্লবিক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বে এটি একটি অনুসরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-২৭-এর মাধ্যমে দেশের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ খনিজ, তেল ও গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালে এর সংক্ষিপ্ত নামকরণ করা হয় ‘পেট্রোবাংলা’। তিনি জ্বালানী খাতকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও পেট্রোলিয়াম পলিসি প্রণয়ন করেন। উক্ত আইন ও পলিসির আওতায় তিনি দেশীয় কোনো মূলধন বা বিনিয়োগ ছাড়াই বিদেশি/বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উৎপাদন বন্টন চুক্তি’ পদ্ধতি বাংলাদেশে প্রবর্তন করেন। বর্তমানে সারা বিশ্বে এই মডেলটি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হলেও ঐ সময়ে পৃথিবীর অনেক দেশই এই মডেলটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯-এর মাধ্যমে দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য বিদ্যুৎখাত পুনর্গঠন করেন। জাতির পিতা ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ The ESSO Undertaking Acquisition Ordinance 1975-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.-কে অধিগ্রহণ করে এদেশে জ্বালানী তেল মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত এই সকল স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান সমূহই আজও এদেশের তেল সেক্টরের জ্বালানী নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর দৃঢ় মনোবল, মেধা, সাহস ও সুকৌশলের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বহুজাতিক কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনালকে পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র) মাত্র ১৭.৮৬ কোটি টাকায় বাংলাদেশের কাছে বিক্রয় করতে বাধ্য করেছিলেন, যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এটি কেবল আর্থিক মূল্য; এর অর্থনৈতিক মূল্য তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশে গত চার দশকে যতটুকু শিল্পায়ন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, তার মূল চালিকা শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করা গ্যাস ক্ষেত্রগুলো। মোটা দাগে বলতে গেলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী নিরাপত্তারব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশে এ যাবত যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে, তার সবটুকুই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত গ্যাস সম্পদের কারণে। আজ বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতসহ যে কয়েকটি খাতে আমরা বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছি, এর মূল কারণই ছিল জাতির পিতার দেওয়া গ্যাস সম্পদ।

পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তি ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী নিরাপত্তা অবহেলার শিকার হয়। ১৯৯৬-২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় লুটপাটের ফলে আবারও জ্বালানী খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশ আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ (মধ্যম আয়ের দেশ) ও রূপকল্প-২০৪১ (উন্নত দেশের মর্যাদা) অর্জনে জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা উন্নয়নশীল বিশ্বের একমাত্র সরকার প্রধান যিনি জ্বালানী নিরাপত্তার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি সরকার প্রধান হিসেবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগী এই মডেলটির প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার সরকার এক দশকে দেশে ব্যাপক ভিত্তিক শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে অব্যহতভাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং অর্থ—সামাজিক উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করে বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছেন। এক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জ্বালানীর চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানী সরবরাহ অন্যতম প্রধান নিয়মক হিসেবে কাজ করেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নের এই ধারাকে অব্যহত রাখার ক্ষেত্রে এই সময়ে জ্বালানীর সংস্থানই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শেখ হাসিনার সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা, সাহস, কৌশল ও দক্ষতার সাথে কর্মপদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করেছে।

অতীতের সরকারগুলোর জ্বালানী হিসেবে গ্যাসের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার ভ্রান্তনীতি পরিবর্তন করে শেখ হাসিনার সরকার জ্বালানীর বহুমুখীকরণের (Diversification) নীতি গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থায় দেশের জ্বালানী মিশ্রণে দেশীয় গ্যাস সম্পদের পাশাপাশি কয়লা, আমদানীকৃত এলএনজি, পরমাণবিক বিদ্যুৎ, তরল জ্বালানী, আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বাণিজ্যের মাধ্যমে আহরিত জ্বালানী/বিদ্যুৎ, নবায়নযোগ্য জ্বালানী নিয়ে একটি টেকসই ‘জ্বালানী ঝুড়ি’ (Fuel Basket) গড়ে তোলা হচ্ছে। এটিই আন্তর্জাতিক বেস্ট প্র্যাকটিস হিসেবে স্বীকৃত। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ যাতে কয়লা ভিত্তিক বৃহত্তর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে না পারে, সেজন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। এ সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় স্বার্থে বৃহৎ কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পসহ প্রয়োজনীয় সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। জ্বালানী ভিত্তিক এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে একটি এবং পায়রাতে একটি ‘এনার্জি হাব’ গড়ে তুলছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সেক্টরে শেখ হাসিনার সরকার বৈপ্লবিক সাফল্য দেখিয়েছে। পৃথিবীর কম দেশই এত অল্প সময়ে এ রকম সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ২২৮ কিলোওয়াট যা বর্তমানে দাড়িয়েছে ৪৭০ কি:ও: (দ্বিগুণেরও বেশি)। একই সময়ে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল মোট জনসংখ্যার ৪৭% যা বর্তমানে দাড়িয়েছে প্রায় ৯৮%। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ৩২৬৭ মে:ও: বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। বর্তমানে সরকারের বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষমতা ২০ ৮১৩ মে:ও:। শেখ হাসিনা সরকার সমগ্র উন্নয়নশীল বিশ্বকে তাক লাগিয়ে এ বছরের ডিসেম্বর এর মধ্যেই দেশের সকলের জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক জ্বালানী নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘এনার্জি ডিপ্লোমেসি’-কে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক পর্যায়ে প্রধান্য দিয়ে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ভারত থেকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ আনার জন্যে ভেড়ামারায় যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, সেটি শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরার সাথেও ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের মোট সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ৬-৭% (১১৬০ মে:ও:) ভারত থেকে আসছে যা দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের গড় মূল্যের তুলনায় অনেক সাশ্রয়ী। এছাড়া ভারতের ঝাড়খন্ড ও ত্রিপুরা থেকে যথাক্রমে ১৪৯৬ ও ৩৪০ মে:ও: বিদ্যুৎসহ মোট ১৮৩৬ মে:ও: বিদ্যুৎ আমদানীর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যে ক্রসবর্ডার ইন্টারকানেকশন স্থাপিত হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই ইন্টারকানেকশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া , ভুটান ও নেপাল থেকে জল বিদ্যুৎ আনার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগে ভারত অংশীদার বা পার্টনার হিসেবে থাকছে। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে জ্বালানী ভিত্তিক সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ‘সার্ক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর এনার্জি কো-অপারেশন (ইলেকট্রিসিটি)’-তে যুক্ত হয় এবং বিম্সটেক-এর সদস্য দেশগুলোর সাথে গ্রিড ইন্টারকানেকশন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করে। শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের ফলে ২০৪১ সাল নাগাদ আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য ও রিজিওনাল গ্রিড থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদ্যুৎ পাবে।

জাতির পিতা ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৪৩ (১) (খ) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জলসীমার অন্তর্বর্তী মহাসাগর ও বাংলাদেশের মহিসোপানে অবস্থিত সকল খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে ‘The Territorial Waters and Maritime Zones Act’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সমুদ্র ও সমুদ্রসীমা রক্ষায় শেখ হাসিনা ২০০১ সালে জাতিসংঘের ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন (UNCLOS) অনুসমর্থন (Ratification) করেন। এই সমুদ্র আইন অনুসমর্থনের ফলেই বঙ্গোপসাগরে আমাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও সাহসী নেতৃত্ব এবং সফল এনার্জি ডিপ্লোমেসির কারণে আমরা মিয়ানমার ও ভারতের দাবির বিরুদ্ধে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর খুব কম দেশই এত সফলভাবে সমুদ্রের ওপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শেখ হাসিনার এই সমুদ্র জয়ের ফলে ‘দক্ষিণ এশিয়ার নর্থ সী’ (North Sea of South Asia) খ্যাত বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস সম্পদ আহরণের মাধ্যমে দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম কার্যকরী ও সুদক্ষভাবে পরিচালনা করছে। বর্তমানে ৭টি সমুদ্র ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহ একক ও যৌথভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। দেশে তেল-গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ১৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট (২০০৮ সালে) হতে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীতকরণসহ মোট গ্যাস সরবরাহ ৩২৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে (এলএনজিসহ) উন্নীত করেছে। এ সময়ে সরকার ৪টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র (শ্রীকাইল, সুন্দরপুর, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ) আবিষ্কার করেছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১১ সালে ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করে, যার আওতায় দেশের গ্যাস সেক্টরে বর্তমানে ২১টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া গ্যাস সেক্টরকে সার্বিক সহায়তার জন্য ২০১৫ সালে সরকার ‘এনার্জি সিকিউরিটি ফান্ড’ নামে আরেকটি তহবিল গঠন করে।

এটি দুঃখজনক যে, ২০০৪-২০০৫ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের ‘মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন’ প্রকল্প থেকে সরে আসার অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রাপ্ত মিয়ানমারের গ্যাস থেকে বঞ্চিত হলো। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ঐ সময়ে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে অংশগ্রহণ করলে মিয়ানমার পরবর্তীতে রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি প্রকট মানবিক সংকট চাপিয়ে দেওয়ার মতো আচরণ আমাদের সাথে করতে পারত না। কারণ আন্তর্জাতিক জ্বালানী আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদী আন্তঃরাষ্ট্রীয় জ্বালানী বাণিজ্য ভূ-রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। খালেদা জিয়ার সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার থেকে গ্যাস পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করলেও ২০০১ সালে নির্বাচনের পর দেশের সীমিত গ্যাস সম্পদ বিদেশে রপ্তানীর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কারণ নির্বাচনের পূর্বে গ্যাস রপ্তানির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি-জামাত ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ শেখ হাসিনা ২০০০ সালে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সীমিত জাতীয় সম্পদ গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্তের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দেশের স্বার্থে গৃহীত তাঁর এই সিদ্ধান্তের কারণেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৩ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিরোধের মুখে খালেদা জিয়ার সরকার ইতঃপূর্বে তাঁরই গৃহীত গ্যাস রপ্তানীর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

জাতির পিতা যে গ্যাস সম্পদ আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলেন, দেশের জ্বালানী নিরাপত্তা তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য সেই সম্পদ রক্ষা করেছিলেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। এই তথ্য বঙ্গবন্ধুর কাছে অজানা ছিল না যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর ঠান্ডা লড়াইয়ের (Cold War) সময়ে বিশ্বব্যাপী কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা নিজেদের দেশে বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রাকৃতিক ও জ্বালানী সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ হত্যার শিকারও হয়েছিলেন। সেটি জানা সত্ত্বেও, তিনি ঔপনিবেশিক শক্তি ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের অনুকূলে খনিজ ও জ্বালানী সম্পদের ওপর প্রদত্ত ইজারা ভিত্তিক মালিকানা জাতীয় স্বার্থে বাতিল করে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে এ সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ধরনের বিধান সমকালীন সময়ে পৃথিবীর খুব কম দেশই তাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল। জাতির পিতা প্রবর্তিত এই সাংবিধানিক বিধানের আলোকে পরবর্তীতে তিনিই নানামুখী আইনি, নীতিগত, নির্বাহী ও রেগুলেটরি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি আত্মনির্ভরশীল ও শক্তিশালী জ্বালানী খাত তৈরি করে গিয়েছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল এদেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। এটিই ছিল বঙ্গবন্ধু সূচিত বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম মূল লক্ষ্য। জাতির পিতার পরে শেখ হাসিনাই একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও বাধা উপেক্ষা করে জাতির পিতার এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানামুখী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকারণের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু দুটি নাম দেদীপ্যমান—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আর রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা।


ড. সেলিম মাহমুদ
(রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, গবেষক ও জ্বালানী বিশেষজ্ঞ)
তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

   

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ 'যেনতেন উপায়ে' নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।' তিনি বলেন, 'বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।'

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ''মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?" জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।' এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত 'দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য' স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।' বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় 'অসারের তর্জন গর্জন সার'? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী



অঞ্জনা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল... হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। '৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এক অম্লান মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কয়েক দশকের নিপীড়ন, প্রান্তিকতা এবং শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বুঝতে হলে প্রথমেই এর জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা আবশ্যক। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিলনা। যাই হোক, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এর দুই অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয় ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয় ও শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অংশ অস্বীকার করে। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করা বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভাষাগত অধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য নিরলস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একটি ফেডারেল ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। যাই হোক, সামরিক ও স্বার্থান্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারগুলো বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষা দেখায় যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের অনুভূতি তীব্রতর করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালি জনগণের দাবি মেনে নিতে অনড় এবং অনিচ্ছুক ছিলেন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এবং অন্যায়ের বোধকে গভীরতর করে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগকে যে অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা ছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট, যেখানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য বিলম্বিত কৌশল ও অপকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মুখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জনগণকে ঐক্য, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে এবং ভিন্নমতের যে কোনো চিহ্নকে চূর্ণ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ এবং নৃশংসতা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও আতঙ্কের পথ রেখে যায়, যা বঙ্গবন্ধুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তির শিখা জ্বালিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন জাতির জন্মের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিছক প্রতীকী বিষয় ছিল না। এটি ছিল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল, যে সময়ে বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) নেতৃত্বে, ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যেমনটা ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে ছিল।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমর ঘটনা। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের অধিকার, মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার এক সাহসী প্রকাশ। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই দেননি, বরং একটি নতুন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এই ঘোষণা বাঙালিদেরকে একত্রিত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘোষণা ছিল একটি নতুন সূচনার প্রতীক, একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে বাঙালিরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী অর্জন করেছি এবং আমাদের কী অর্জন করতে হবে। এই ঘোষণা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানায়।

২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি একটি স্মরণীয় দিন যা আমরা চিরকাল গর্বের সাথে উদযাপন করব। কয়েক দশকের নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার অটল সংকল্প, নিরলস নেতৃত্ব, অসীম ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রাম মুক্তির সূচনা করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতির।

ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার আদর্শের আলোয় আজও বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;