"রাষ্ট্র ইন্টার্নি চিকিৎসকদের ঠকাচ্ছে না তো"
আমাদের ইন্টার্নি চিকিৎসকদের রাষ্ট্র ঠকাচ্ছে না তো?
চিকিৎসকদের প্রণোদনা নিয়ে আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। নীতিকথার অর্কেস্ট্রা বাজানো ঊর্ধ্বতন মহল এই ইস্যুতে পিন পতন নীরবতায় আবিষ্ট হন।
চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচার সামনে গিয়ে অনেক সময় দর্শনার্থীরা বাদাম ছুঁড়ে মারেন। এতে করে বানরগুলোর লাফালাফি বাড়ে, বানরগুলো কিছু শারীরিক কসরত করে। বানরগুলো যদি একে প্রণোদনা ভেবে নেয়, দর্শানার্থীদের আমি কোন দোষ দেখি না। এই আলাপ এখন থাক।
দেশের অন্যতম টারশিয়ারী-কেয়ার হেলথ সেন্টার হলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো। গুরুত্বপূর্ণ এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাসেবায় একটি বড় অবদান রাখেন ইন্টার্নি চিকিৎসকরা।
দেশের কতিপয় বিজ্ঞ মানুষ মানুক বা না মানুক, একজন ইন্টার্নি চিকিৎসক একজন পরিপূর্ণ চিকিৎসক। ৫ বছরের কষ্টার্জিত জ্ঞান নিয়ে তারা চিকিৎসা শাস্ত্রের সনদ অর্জন করেন এবং বিএমডিসি তাদেরকে একটি প্রোবেশনারী রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে।
কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এই করোনাকালীন মুহূর্তে যে সকল চিকিৎসক তাদের ইন্টার্নিকালীন সময় পার করছেন, তারা একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছেন।
কারণ:
(১) এই সময় রোগী পরীক্ষা করা, রোগের ইতিহাস নেওয়া, রোগীর সার্জারিতে অংশ নেওয়া, রোগীর ফলোয়াপ, সর্বত্রই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। এন-৯৫ মাস্ক, ফেসশিল্ড, পিপিই পড়ে চিকিৎসা জীবনের শুরুর সময়টা কাটানো খুব একটা আরামপ্রদ না।
(২) এই সব দামি এন-৯৫ মাস্ক সব সময় হাসপাতাল থেকে সরবরাহ যে করা হয়, সেটাও ঠিক না। অনেক সময়ই ইন্টার্নি চিকিৎসকরা এই সব দামি সুরক্ষা সামগ্রী নিজেদেরই কিনতে হচ্ছে। একজন ইন্টার্নি চিকিৎসক কতো টাকা ভাতা পায়, সে সম্পর্কে যদি আপনার ধারণা থাকে, আপনি বুঝতে পারবেন নিজের খাবারের খরচ এর পাশাপাশি সুরক্ষা সামগ্রীর খরচ চালানো কতোটা কষ্টসাধ্য।
[অবশ্য অনেক সময় সিনিয়র চিকিৎসকরা মানবিক কারণে ইন্টার্নিদের হাতে এসব সুরক্ষা সামগ্রী উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এটা কোন সমাধান না।]
(৩) হাসপাতালের নন-কোভিড অংশে কাজ করাটা কোভিড অংশের সমান ঝুঁকিপূর্ণ। কখনো কখনো নন-কোভিডে ঝুঁকিটা বেশী। কারণ বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন না। অনেকে মুখে মাস্ক তো পড়েনই না। আবার মাস্ক পড়লেও হাসপাতালে এসে মাস্ক টা তুলে কফ-থুথু-সর্দি ফেলে যান হাসপাতালের বারান্দায়। কোভিড আক্রান্ত রোগীর স্বজনেরা হাসপাতালে পার্কের ঘোরার মতো ঘুরে বেড়ান। কোভিড রোগীদের এক্স-রে, প্যাথলজি, এমনকি ওয়েস্ট ডিসপোজাল এর পৃথক ব্যবস্থা থাকে না অনেক হাসপাতালে। কোভিড নন-কোভিড মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে হাসপাতালগুলো।
আমাদের প্রিয় ইন্টার্নি চিকিৎসকরা এখানেই কাজ করে। রোগী রিসিভ করে, রোগীর জরুরি চিকিৎসা দেয়, এরোসল জেনারেটিং প্রসিডিওর করে, রোগীর খুব কাছেই বেশী সময় কাটায়। চিকিৎসক জীবনের শুরুতেই তারা এসে পড়েছে এই বিষাক্ত পরিবেশে।তাই ডিউটি শেষ করেও তারা তাদের পরিবারের কাছে যেতে পারে না। আপনজনদের নিরাপদ রাখতেই আপনজন থেকে দূরে থাকতে হয়।
এই টুকু বলতে পারি, আমাদের চিকিৎসক জীবনের শুরুতে 'আপনজনদের কাছে যেতে না পারা'র এই কষ্ট টা কিন্তু ছিলো না।
(৪) ইন্টার্নিদের এই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করাকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য নাই কোন আর্থিক প্রণোদনা, নাই কোন দাপ্তরিক কৃতজ্ঞতার নিদর্শন!
(৫) ক্রমাগত এই সকল নবীন চিকিৎসকদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়া, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আক্রান্ত চিকিৎসকদের সবাই যে সকল মহল থেকে সন্তোষজনক সহমর্মিতা পাচ্ছেন, সেটাও কিন্তু না।
সমাধান যাত্রা
আমি সুস্পষ্ট ভাবে চাই রাষ্ট্র যেন তার সম্পদের মূল্য বোজে এবং এই মেধার মূল্যায়ন করে। নাহলে এই বিমাতাসুলভ আচরণে Plab, USMLE এর মিছিল বাড়তেই থাকবে এবং এক সময় চিকিৎসা পেশায় দেশের মেধাবী মুখগুলো আর আসতে চাইবে না।
(১) ইন্টার্নি চিকিৎসকদের স্বাভাবিক ভাতার পাশাপাশি কোভিড কালীন বিশেষ ভাতাও প্রদান করা হোক এবং কোনভাবেই তা একজন গ্রেড-১০ কর্মচারীর (১৬,০০০-৩৮,৬৪০) এর সর্বনিম্ন মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা এর কম হতে পারবে না। সুতরাং ১৫০০০ টাকা + ১৬,১০০ টাকা = ৩১,৫০০ টাকা ন্যায্য ভাবে পাওয়া উচিৎ একজন ইন্টার্নি চিকিৎসকের।
(২) অনেক মেডিকেল কলেজে পৃথক ইন্টার্নি হোস্টেল নাই কিংবা থাকলেও তা মেডিকেল কলেজ এর ছাত্রাবাস এর সাথে সন্নিবেশিত। যেতেতু ইন্টার্নি চিকিৎসকরা শতভাগ 'পেশাগত' দায়িত্ব পালন করছেন, তাই সরকারী নার্স-ডাক্তারদের মতো তাদেরকেও "হোটেল আবাসন সুবিধা" এবং পরিবহন সুবিধা দিতে হবে।
(৩) কোভিড চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত অন্যান্যদের সাথে একজন ইন্টার্নি চিকিৎসককেও প্রণোদনার পাবার জন্য "এলিজিবল" ধরতে হবে। (কারন ট্রায়াজসহ কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার নানা স্তরে এখন ইন্টার্নি চিকিৎসকদের প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে)
আমার এই আশা হয়তো দুরাশা... দিবাস্বপ্ন।
তারপরও আশায় বুক বাঁধি।
কারন করোনা রোগীর চিকিৎসা না দিয়েও পরমাণু শক্তি কমিশনের সুপার ম্যানরা যদি প্রণোদনা পেতে পারেন (নিউজ লিঙ্কঃ https://rb.gy/e37mvo ), কেয়ামতের কয়েক ঘণ্টা আগে হলেও হয়তো চিকিৎসক-নার্সরাও প্রণোদনা পাবেন।
আমরা কিছু না পেলেও যে মানুষগুলো নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, রাষ্ট্র অন্তত ওদেরকে না ঠকাক। রাষ্ট্র ওদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিক...
আর যারা কাজ না করেও প্রণোদনা টাকা ঘরে তুলেছেন, তাদের জন্য ঈশপের ছোট্ট গল্পটা দিয়ে শেষ করি...
শিকার ধরা সহজ করতে এক অতি চালাক নেকড়ে ঠিক করল সে ছদ্মবেশ ধারণ করবে। নিজের চেহারাটা পাল্টে ফেলবে, তাহলে তার আর খাদ্যের ভাবনা থাকবে না। সহজেই শিকার ধরে ধরে খেতে পারবে।
প্ল্যান অনুযায়ী এগিয়ে গেলো সে। নেকড়ে একটা ভেড়ার চামড়া গায়ে মুড়িয়ে ভেড়ার পালের মধ্যে ঢুকে গেল আর তাদের মতোই ঘাস খাওয়ার ভান করতে লাগল।
ক্রমেই সন্ধ্যা হয়ে এল। রাখাল তার ভেড়ার পালকে তাড়িয়ে নিয়ে খোঁয়াড়ে পুরে রাখলো। এদিকে সেদিন রাখালের বাড়িতে বোন আর বোনজামাই বেড়াতে এসেছিল। রাতের ডিনারে Barbeque Lamb Roast এর আয়োজন হলো।
আর প্রয়োজন পড়লো একটা ভেড়া জবাই করার...
গল্পের বাকিটা আপনারা যা ভাবছেন ঠিক তাইই হয়েছিলো!
ডা. রাজীব দে সরকার, রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ৩৩ বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন, পঞ্চদশ ব্যাচ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ।