অবক্ষয়ে অস্থির সমাজ, সহিংসতায় বিপন্ন মানবতা!
পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত মিন্নির পিতাই মনে হয় একমাত্র পিতা, যিনি নিজে মোটরসাইকেলে করে কোর্টে নিয়ে সন্তানকে তার ফাঁসির রায় শোনালেন। নিজে শুনলেন। এবং সন্তানকে রেখে এলেন ফাঁসির সেলে।
ঘটনাটি বেদনাদায়ক হলেও এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। সন্তান বেপরোয়া হয়ে উঠার আগেই শাসন করুন, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করুন। কারণ অবক্ষয়ে অস্থির সমাজ, সহিংসতায় বিপন্ন মানবতা। বরগুনা, সিলেট এবং বাংলাদেশের সর্বত্রই অবক্ষয়ের ঢেউ লেগেছে। সহিংসতা ও সন্ত্রাসের বিস্তার হচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে কিশোর, তরুণ, যুবক বয়সের ছেলেমেয়েরা।
সন্দেহ নেই, অবক্ষয়ে অস্থির সমাজে সহিংসতার বিস্তার মানবিকতার জন্য লজ্জার ও পরাজয়ের, যা একই সঙ্গে তীব্র সামাজিক সমস্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত। মানুষের কাছ থেকে এবং মানুষের সমাজে এমন অস্থিরতা, সহিংসতা ও বিপর্যয় মোটেই কাম্য হতে পারেনা।
কারণ, মানুষের জীববৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি দুটোই আছে এবং মানুষ এতে ভারসাম্য বজায় রাখে। আবহমান কাল থেকে মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে তার জৈবিক তাড়নাকে শৃংখলিত করে পরিশীলিন ও আদর্শিক কাঠামোতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনে সক্ষম। আর এ জন্যই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে উন্নত এবং তাকে আশরাফুল মাকলুকাত বা সৃষ্টির সেরাজীব বলা হয়।
যেহেতু মানুষের মাঝে জীববৃত্তি বিদ্যমান তাই অনুকুল পরিবেশ, পরিবার, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার অভাব তাকে অস্থির, সহিংস ও বেপরোয়া জৈবিক আচরণে প্ররোচিত করে এবং তার মানবিক বিপর্যয় ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়।
সিলেটে কলেজ ছাত্রবাসের সামনে স্বামীকে তার নিজ গাড়িতে আটকে রেখে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ছাত্রাবাসে তথাকথিত ছাত্রদের দ্বারা সদলবলে ধর্ষণ এমনই এক অবক্ষয়ের ঘটনা। বাবা মার সামনে নিজ গৃহে গণধর্ষিত চাকমা মেয়েকে দুদিক থেকে দুবাহু ধরে তার বাবা মা কর্তৃক হাসপাতালে ল হেঁটে যাওয়ার সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল ছবি এই নৈতিক অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে উত্তরবঙ্গে গির্জায় আদিবাসী তরুণী ধর্ষণ এবখ বরগুনায় কিশোর গ্যাং কর্তৃক রিফাত হত্যায় স্ত্রী মিন্নির জড়িত থাকার ঘটনাও উল্লেখ করা যায়। বাংলাদেশে এমন অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত অসংখ্য।
আজ কোন স্বামী কিংবা পিতা-মাতার জন্যই পরিস্থিতি স্বস্তির নয়। এসব তথাকথিত শিক্ষিত ধর্ষকের সাথে রাস্তায় নির্লজ্জ পশু কিংবা আমাজনের হিংস্র প্রাণীর কোন পার্থক্য নেই। এরা প্রত্যেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক আদর্শহীন, জৈবতাড়িত ও কেবল মাত্র জীববৃত্তিতে গ্রাস করা পতিত প্রাণী।
আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে সত্যি, উন্নয়নের পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে হারিয়ে গেছে আমাদের পূর্বপূরুষের আচার, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, মত-ধর্ম নির্বিশেষে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সৌজন্যতা নৈতিকতা, সততা, ভদ্রতা ও বিনয় আর পরোপকারের প্রথা।
মানুষ ক্রমেই প্রলুব্ধ হচ্ছে কেবল নিজের আর্থিক উন্নয়ন ও ক্ষমতাবান হওয়ার লক্ষে, সে যে করেই হোক। ঘুষ, চুরি, ছিনতাই, লুট,
প্রতারণা কিংবা সহিংসতা, কোনো পন্থাই অব্যবহৃত থাকছে না স্বার্থ হাসিলের মাতাল প্রতিযোগিতায়।
নৈতিকতা বিবর্জিত এ সকল মানুষের সাথে জীববৃত্তি সম্পন্ন হিস্র পশুর কোন পার্থক্য নেই। এদের সংখ্যা প্রতিদিন গাণিতিক হারে বাড়ছে, এ জন্যই সমাজের অধিকাংশ মানুষ আজ চোখের সামনে এসব অপকর্ম ঘটতে দেখেও তারা বহুলাংশে নির্বিকার। বরং পেশীশক্তি সম্পন্ন এসব অপরাধীদের প্রশ্রয় কিংবা তাদের অপরাধ আড়াল করার অনভিপ্রেত হস্থক্ষেপ করতে তারা কোন লজ্জাবোধ করেন না।
অথচ এক সময় এ জাতির ইতিহাস ছিলো ভিন্ন। শিশু, কিশোর ও যুবকদের ছিলো সাহিত্য, ক্রীড়া, ও জনহিতকর ক্লাব বা সংঘ। সাহিত্যচর্চা, শরীরচর্চা, ও চরিত্রগঠন ও পরোপকারে কাজ করার জন্য তারা সংগঠিত হতো। দরিদ্র পিতার কণ্যার বিয়ের আয়োজন করতো স্থানীয় যুবসমাজ, তারা নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াতো। অথচ আজ তারা সংগঠিত হচ্ছে ধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতার অভিপ্রায়ে। অপ্রতিরোধ্য দুর্বৃত্তায়নের জন্য তারা সংগ্রহ করছে রাজনৈতিক পরিচয়।
এ দেশ আমাদের। কিশোর, যুবক মুক্তিযোদ্ধার জীবন দেয়া স্বাধীন সার্বভৌম এ দেশ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। তাই নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ স্বদেশ গড়া সবারই পবিত্র লক্ষ হওয়া উচিত। এখনি ফিরে আসার সময় পূর্বপুরুষের সমৃদ্ধ ইতিহাস চর্চায়। আজকের ডিজিটাল উন্নয়নের সাথে সুস্থ্য মননের সমন্বয় সাধনের এখনি সময়, পূর্বপুরুষের পঠিত কবিতাখানি উপলব্ধি করারও সময়, যাতে বলা হয়েছে, 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন যেনো আমি ভালো হয়ে চলি।'
শুধু অন্যের দিকে আঙুল তুললে হবেনা। ভালো হওয়ার প্রত্যয়ে দীপ্ত হতে হবে সবাইকে। নইলে অবক্ষয়ে অস্থির সমাজ বাঁচবে না।সহিংসতায় বিপন্ন মানবতা টিকবে না।
লেখক, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক।