সামাজিক অবক্ষয়: আয়নার নিজের চেহারা দেখুন
যত্ন বা প্রতিরোধ না করা হলে ক্ষয় বা অবক্ষয় হবেই। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। এই সত্য কথাটি শরীর, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যেমন ঠিক, তেমনই সঠিক প্রকৃতি ও সমাজের ক্ষেত্রেও। উদাহরণ দেওয়া যায় দাঁতের। যত্ন, পরিচর্যা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে না তুললে দাঁতের ক্ষয় হবেই। পাহাড়ে বা নদীতেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যেমন বৃক্ষ রোপণ ইত্যাদি না করা হলে ভূমিক্ষয়, ভাঙন হবেই। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
সমাজে কেন অবক্ষয়ের ফলে এত অপরাধ, অন্যায় বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে প্রত্যেককে গভীর চিন্তা করার সময় এসেছে। সবার আগে দরকার নিজের সচেতনতা। সমাজের সদস্য হিসেবে অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা সর্বাগ্রে জরুরি। অন্যকে দোষারোপের আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখা দরকার।
অবক্ষয় প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, শুধুমাত্র শিক্ষা নয়, দরকার নিজেকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা, নিজেকে সৎ ভাবে গড়ে তোলা ও অন্তরে নীচু মানসিকতার পরিবর্তন করে উন্নত মানসিকতা পোষণ করা।
আর বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করাও দরকার। যার মধ্যে হিংসা, হিংস্রতা, পরশ্রীকাতরতা, পরচর্চা অন্যতম। এসব বদঅভ্যাস যতদিন না আমরা বদলাবো, ততদিন সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হবে না। অন্যের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়ের পেছনে মাথা ঘামানোর কুঅভ্যাস যতদিন না বদলাবে ততদিন সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা অসম্ভব।
আমি প্রবাসে বসবাস করি বলে দেশের সঙ্গে বিদেশের তুলনায় এসব বিষয় উত্থাপন করছি, যেগুলো বিদেশের সমাজে একেবারেই নেই। অন্যের বিষয়ে নাক গলানোর সময় ও রুচি তাদের নেই। তারা ব্যস্ত নিজের কল্যাণে, সমাজ ও প্রকৃতির কল্যাণে। যদিও মুষ্টিমেয় প্রবাসী বাঙালির মধ্যে প্রায়শই নানা সঙ্কীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা এবং দলাদলি দেখা যায়।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, নিজের সন্তান, পরিবার কি করছে, কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে কোনো কোনো বাঙালি পরিবার যতটা না সচেতন তার চেয়ে অনেক বেশী সচেতন তার প্রতিবেশী, পরিচিত জন, আত্মীয়-স্বজন বা অন্যের ব্যাপারে। দেশেও এমন কুঅভ্যাস অনেকের মধ্যেই রয়েছে। এসব অবক্ষয়ের নামান্তর।
কাউকে কাউকে এমনও দেখেছি, নিজের ঘরে আইবুড়ো মেয়ে আছে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা ভাবনা থাকা উচিত তার চেয়ে বেশী ভাবনা প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের মেয়ের বয়স নিয়ে।আবার নিজের ছেলে বখাটেদের সাথে মেলামেশা করে বিপথগামী হচ্ছে সে বিষয়ে দৃষ্টি না দিয়ে অপরের সন্তান কি করছে সে বিষয়ে বেশী মনোযোগী হয়ে পড়াটা বাঙালি পরিবারের কুঅভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এমনকি, নিজেরা প্রত্যেকে দু চারটে কঠিন অসুখে ভুগলেও অপরের অসুস্থতা ও ভালমন্দ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে বাঙালিরা খুব বেশী অভ্যস্ত।
আশ্চর্যের কথা হলো এটাই য়য়ে, নিজেকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে, নিজের যেকোনো সময় ভয়ানক অসুস্থতা আসতে পারে, তা ভুলে অপরের দুঃসংবাদে উল্লাসিত হওয়া এবং অপরের ভাল সংবাদে দুঃখী হওয়া চরম নীচু মানসিকতার পরিচয় বহন করতেও অনেকে পিছপা হয় না। । দুঃখের বিষয়, এই জাতীয় মনোভাব পোষনকারীর সংখ্যা সমাজে অনেক। অবক্ষয়ের উৎপত্তি সমাজের এই শ্রেণির মানুষদের দ্বারাই প্রথমে সূচিত হয়।
আরও পরিতাপের বিষয় এই জাতীয় মূর্খ ব্যক্তিগণ নিজেদের অতি চালাক এবং জ্ঞানী ভাবে আর সমাজের বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তিদের বোকা ভাবতে শুরু করে। নিজের কুকীর্তিগুলো দাপটের সাথে চালিয়ে যেতে পছন্দ করে আর অন্যের ভালোকে মন্দ দ্বারা কালিমা লেপটে বিকৃত সুখ লাভ করে।
অথচ সবারই মনে রাখা জরুরি, মহান আল্লাহ্ তায়ালা এই জাতীয় ভয়ঙ্কর মানুষদের দীর্ঘ আয়ু দান করেন নিজেকে সংশোধন করতে। যেমন ইতিহাসের সেই ভয়ঙ্কর বাদশা শাদ্দাদের আয়ু দিয়েছিলেন হাজার বছরের, তার জীবনের চরম পরিণতির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অপরাধীগণ সুস্থভাবে বেঁচে থাকাকে আল্লাহ্ তায়ালার নিয়ামত ও দয়া না ভেবে নিজের শক্তি, দম্ভ, দাপট ও বাহাদুরির সাথে চলতে পছন্দ করে এবং অন্যায়, জুলুম করে যেতেই থাকে। নিজে একদিন মারা যাবে, এ চিন্তা ভুলে চালবাজির সীমা অতিক্রম করে অপরকে জ্ঞান বিলিয়ে যাওয়া বেশীর ভাগ নির্বোধ মানুষের বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় তাদের কারণেই ঘটছে।
সমাজে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার বদলে আত্মম্ভরিতা ও কুৎসা সুযোগ দিচ্ছে ধর্ষক, উশৃঙ্খল, প্রতারক, ভণ্ডদের আর তৈরি করছে সামাজিক অবক্ষয়ের কৃষ্ণ বলয়। সমাজে নারী, শিশু অত্যাচারিত হলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, অথচ এর কোনো প্রতিকারে কেউ করতে এগিয়ে আসে না। বিপদগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে হাসি, ঠাট্টা, গাল-গল্প করেই মজা নেয় অধিকাংশ মানুষ। ফলে দিনকে দিন অপরাধ ও অবক্ষয় বেড়েই চলেছে।
শালীনতা, রুচিহীনতা, হিংসা ও পরচর্চা যতদিন ব্যক্তির মনে থাকবে, ততদিন সমাজে অবক্ষয় চলবেই। ধর্ষণ সহ সব রকম সামাজিক অন্যায়, অপরাধ ঘটতেই থাকবে। অতএব নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। নিজেকে সংশোধন করা বা নিজের দায়িত্ব পালনের বদলে অপরকে শিক্ষা দেওয়া বা বড় বড় কথা বলা পরিত্যাগ করতে হবে। প্রথমে নিজেকে সংশোধন ও পরচর্চা বা পরের বিষয়ে নিকৃষ্টভাবে অংশ নেওয়া বন্ধ করতে হবে। অপরকে চর্চা না করে নিজের সন্তানদের ছোটকাল থেকে সৎ ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সব সময় আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে হবে আর বাংলার সেই প্রাচীন প্রবাদ বাক্যটি সব সময় মনে রাখতে হবে। যাতে বলা হয়েছে, 'আপনি আচরি ধর্ম, পরেরে শিখাইও'।
নিজের মন ও মানসিকতার সঠিক যত্ন করা হলে আপনি যেমন সুস্থ থাকবেন, সমাজও অবক্ষয় মুক্ত হয়ে সুস্থ থাকবে, এই সত্যটি মনে রাখলেই কমবে সামাজিক অবক্ষয় ও নানাবিধ অন্যায়।
কণা ইসলাম, জার্মান প্রবাসী বিশিষ্ট শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।