যৌন সহিংসতা রোধে যৌন শিক্ষার প্রয়োজন
যৌন সহিংসতা তখনই ঘটে যখন কেউ অন্য ব্যক্তির সাথে জোরপূর্বক যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। যৌন সহিংসতার ধরণ বহু রকমের। যেমন, ধর্ষণ, কৌশলে বা জোরপূর্বক যৌন স্পর্শ, শিশু যৌন নির্যাতন, ইভ টিজিং বা যৌন হামলা বা আগ্রাসন, ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে, কোনো সমাজে যৌন সহিংসতার উপস্থিতি সে সমাজের মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই, মানব উন্নয়নের জন্য অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি যৌন শিক্ষা খুবই জরুরি। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কার্যকরি কোনো আয়োজন নেই। উন্নত দেশগুলিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। ফলে, সেসব উন্নত সমাজে যৌন সহিংসতা কমে এসেছে। ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা রোধে বাংলাদেশেও যৌন শিক্ষার প্রচলন প্রয়োজন।
‘যৌন’ শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় একেবারেই অনুপস্থিত। এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে চাইলেও তা কানেকানে বা ফিসফিস করে গোপনে বলি। শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও এই শব্দটি ব্যবহারে খুব অনীহা দেখা যায়। কেউ কেউ যৌন শব্দটি ব্যবহার না করে এটির ইংরেজি শব্দ Sex ব্যবহার করেন। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে যৌন বিষয় সম্পর্কে আমরা দৈনন্দিন জীবনে আলোচনা করিনা ও করতে চাইনা। অথচ, আমরা কত বিষয়ে কথা বলি-যেমন, ক্রিকেট, রাজনীতি, দুর্নীতি, অর্থনীতি ও সন্ত্রাস। আমরা মেনে নিতেই পারি না যে অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সমস্যার মতনই ধর্ষণ বা জোরপূর্বক যৌন স্পর্শ একটি গুরুতর সমস্যা।
পত্রিকার পাতায় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন সহিংসতার খবর, ছবি বা ভিডিও দেখে আমরা আতঙ্কিত হই। তারপর কিছুদিন ভুলে থাকি। আবারও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা আবারও আতঙ্কিত হই। আতঙ্কিত হওয়ার বহু কারণ আছে। তন্মধ্যে, আমার মনে হয়, যেটি ভেবে আমরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হই যে, যদি আমাদের কোনো আপনজন (যেমন, মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা) কখনও কারও দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে আমাদের মনের অবস্থা কি হবে? এটি কারো কাছেই কাঙ্খিত নয়। এমনকি কোনো ধর্ষণকারীও আশা করে না যে তার পরিবারের কেউ ধর্ষণের শিকার হবে। কিন্তু, ধর্ষণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখছি। নিশ্চয়ই আইন-আদালত ও ধর্মীয় অনুশাসন যৌন সহিংসতা রোধে বিভিন্ন আদেশ ও নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে স্কুলে, কলেজে ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যৌন শিক্ষার আয়োজন করা প্রয়োজন।
যৌন শিক্ষা কি? যৌন শিক্ষা সে সকল শিক্ষা যা একজন ব্যক্তি (শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক বা বৃদ্ধ) সে তার যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানবে ও বুঝবে। এই শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে একজন ব্যক্তিকে যৌন সম্পর্কের উচিৎ ও অনুচিৎ দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন করা, যৌন রোগ সম্পর্কে সচেতন করা এবং যৌন সম্পর্কের সামাজিক ও অসামাজিক দিকগুলি সম্পর্কে সচেতন করা। আমরা বহু ঘটনা শুনেছি যে বহু শিশু বুঝতেই পারে না যে তার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যৌন নির্যাতনকে সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না কারণ তা বোঝানোর জন্য প্রয়োজনীয় শব্দগুলি সম্পর্কে সে জানে না। যৌন শিক্ষার মাধ্যমে শিশুদেরকে প্রয়োজনীয় শব্দগুলির সাথে পরিচিতি করানো সম্ভব যাতে করে সে যদি কখনও কারো দ্বারা যৌন স্পর্শের বা নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে সে যেন তার মা-বাবার কাছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারে। এ সস্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে শিশুরা খুব কাছের মানুষ দ্বারাই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
যৌন শিক্ষা যে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হয়-তা নয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন, বিলবোর্ডে এইচ. আই. ভি., ইভটিজিং, শিশু নির্যাতন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সচেতনামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় ও টেলিভিশনে সচেতনতামূলক বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যথেষ্ঠ নয়। কারিকুলামে যৌন সম্পর্কিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। কোন বয়সের মানুষদেরকে কোন ধরণের যৌন বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হবে তা বিশেষজ্ঞ (যেমন, শিক্ষাবিদ, নৃবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানী) দ্বারা নির্ধারণ করা যেতে পারে। যৌন শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা প্রশিক্ষণার্থীদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
যৌন আকাঙ্খা কি জৈবিক, সাংস্কৃতিক নাকি মনোজাগতিক? এ প্রশ্নের উত্তরে যৌনবিজ্ঞানী (যিনি মানুষের যৌন আচরণ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন), চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে। যৌন শিক্ষার মাধ্যমে সে সকল সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা মানব উন্নয়নের জন্য কল্যাণকর হবে। নিদেনপক্ষে, ব্যক্তি বুঝতে পারবে যে কোন ধরণের যৌন আচরণ ও আকাঙ্খা স্বাস্থ্যসম্মত, সামাজিক, বৈধ, অসহিংস ও নির্যাতনহীন।
বহু মানুষ (বিশেষ করে পুরুষ) আছেন যারা জ্ঞান রাখে না যে নারী-পুরষের বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে। অর্থাৎ, জোরপূর্বক যৌন ক্রিয়ার মাধ্যমে স্ত্রী তার স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হতে পারে। বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যার মাধ্যমে একজন পুরুষ ও নারী বৈধভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কিন্তু, আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে বিয়ের আগে বর ও কণের জন্য কোনো ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক যৌন শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা নেই। এটিও যৌন শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
যথাযথ যৌন শিক্ষার আয়োজন করা এবং এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো আছে। কিন্তু, আধুনিক মনের মানুষ নেই; আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তৃতি নেই এবং আধুনিক শিক্ষায় সকলের প্রবেশাধিকার নেই। তাহলে, আধুনিক সমাজ কীভাবে গড়ে উঠবে? মানবের উন্নয়ন কীভাবে ঘটবে। যৌন শিক্ষা হতে পারে অন্যতম পদ্ধতি যা দ্বারা যৌন সহিংসতাহীন সমাজ গড়ে উঠবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে উঠবে-সেটাই প্রত্যাশিত।
লেখক: ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।