ধর্ষণ ও অপরাধ বন্ধে করণীয়
জাতীয় জীবনে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত হবার মতো ইতিবাচক ঘটনা ম্লান হয় নানা নেতিবাচক ও অপরাধমূলক ঘটনার কারণে। সাধারণ মানুষও নেতিবাচক ঘটনাবলিতে তাৎক্ষণিক আন্দোলিত হয়। ভালো দৃষ্টান্ত চাপা পড়ে খারাপ উদাহরণের তলে। এখন যেমন ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার সিরিজ ঘটনায় নিরাপত্তা ও ইমেজ ক্ষতি হচ্ছে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে সমাজের মানুষ।
সম্প্রতিক বছরগুলোতে কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন, বুয়েট মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকারিদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন জাতীয় জীবনের বড় ঘটনা। এর বাইরে কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে এলাকায় সোহাগী আক্তার তনু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের দোষীদের খুঁজে বের করে বিচারের দাবিতে আন্দোলনও ছিল সর্বব্যাপী।
তবে সবসময় চোখ কান খোলা রেখে চলার অভ্যেস আমাদের নেই। বিশেষ করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোতে যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণও করা হয় না। ফলে কখনো নীরবে আবার কখনো সরবে সমাজে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব কায়েম হয়ে যায়, যার বিরুদ্ধে তৈরি হয় আন্দোলন।
আমাদের সামাজিক কাঠামোতে সুযোগ পেলেই দুর্বৃত্তরা দৌরাত্ম্য দেখাতে প্রবৃত্ত হয় । দুর্বৃত্তরা কখনো আবার নিজদের সুশীল আলখেল্লায় মুড়িয়ে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় হাজির হয়। যেমন সাহেদ ও সাবরিনা। কতিপয় মিডিয়ার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে নিজেদের কাটতি এব ওয়েট বাড়ায়। রাজনৈতিক পদপদবী জোরে কিংবা কৌশলে পদবীধারিদের ছত্রছায়া ব্যবহার করেও এরা সকলের অগোচরে অপকর্ম চালায়। যখন ধরা পড়ে তখন বের হয় আসল চেহারা।
এই প্রবণতায় বেশি নষ্ট হয়েছে ‘‘মানুষ তৈরির কারখানা” শিক্ষাঙ্গণগুলো। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যার পর শিক্ষাঙ্গণের যে কদর্য চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত হয় তাতে চিন্তাশীল মানুষমাত্রই বিচলিত। মেধাবী সহাপাঠীদের পৈশাচিক নির্যাতনে আরেক মেধাবীর মৃত্যুর ঘটনায় তখন পুরো দেশ আন্দোলিত হয়। প্রথমে পুরো ঘটনা ধামাচাপা কিংবা হজম করার চেষ্টা করা হলেও অবস্থার চাপে সবকিছুই আলোতে আসে। বাধ্য হয়ে বুয়েট প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের সব দাবি মানার আশ্বাসে আন্দোলন স্থিমিত হয়। কিন্তু যে অমানবিক র্যাগিং কালচারের বলি হলেন আবরার তা যে সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ হয়েছে তাও কিন্তু নয়।
তবে আবরার হত্যার ঘটনার বিচার শুরু হবার আগেই ক্যাসিনো কাণ্ড আমাদের সব ভুলিয়ে দেয়। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক যুব সংগঠনের নাম পদবী ব্যবহার করে ভেতরে ভেতরে জুয়া এবং ক্যাসিনোবাজির রাজত্বের নায়ক কেউ সম্রাট, কেউ বা রাজা, আবার কেউ চেয়ারম্যান! বাইরে আপাত ভদ্রগোছের ভারিক্ক কিংবা হাস্যোজ্জল চেহারার মানুষের দেখা মুখগুলো যে শুধুই মুখোশ সেটাও জানা গেলো সেই ঘটনায়। ক্যাসিনো-কাণ্ডে আমরা বুঝলাম কোথায় ওদের খুঁটির জোর? আরো বুঝলাম সামাজিক দুর্বৃত্তরা কতটা সংগঠিত এবং সমাজের জন্য কতটা ভয়ংকর।
দেশজুড়ে ক্যাসিনো-কাণ্ডের আলোচনা এবং সমালোচনার মাঝেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। সাথে সাথেই অতীতের সব ভুলে গোটা জাতি হয়ে পড়ে করোনা কেন্দ্রিক। ব্যক্তিক এবং ব্যাষ্টিক পর্যায়ে অন্য সব বিষয় গুরুত্ব হারায়। সবার কাছে একইসাথে আগ্রহ এবং শঙ্কার বিষয় হয়ে ওঠে করোনা। তবে এই ভয় এবং শংকার মাঝেই সুযোগ সন্ধানী এবং স্বার্থান্ধ এক শ্রেণীর লোকের অপতৎপরতা চোখে পড়ে।
মার্চে প্রথম সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর পর্যায়ক্রমিক বর্ধিতকরণের প্রেক্ষাপটে সমাজের সাময়িক কর্মহীনদের সহযোগিতার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত ত্রাণ তৎপরতায়ও দুর্বৃত্ত শ্রেণি বাগড়া বসায়। দুঃস্থ এবং অসহায়দের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, ডাল এবং তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড ঘটে যায়। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নেতা-নেত্রী এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়।
এসব অপরাধের ঘটনা আলোতে আসার পর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার কৌশল অবলম্বন করে। চাল-ডালে যেহেতু দুর্নীতি হয় তাই সরকার সিদ্ধান্তে নেয় সহায়তার অর্থ সরাসরি যাবে গ্রাহকের মোবাইলে। কিন্তু দুর্নীতির ট্যালেন্টরা এখানেও বাগড়া বসায়। বিশেষ ব্যক্তি এবং পরিবার কেন্দ্রিক মোবাইল নম্বর দিয়ে অন্যের টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেখিয়ে দেয় তারাও পারে।
পরীক্ষা ছাড়াই করোনা টেস্ট বাণিজ্যের হোতা সাহেদ এবং সাবরিনারাও কি পারে তা তো জাতির চোখের সমানেই দৃশ্যমান। স্যাম্পল নিয়ে তা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে রোগির চাহিদা মাফিক কিংবা মনগড়া টেস্ট রিপোর্ট রোগীর হাতে দিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্যও করা হয়। দুর্নীতিতে সংযোগ মিলে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। অভিযোগের দায় নিয়ে পদও ছাড়তে হয় অনেককে। এর অব্যববহতি পরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত গাড়ি চালকের দুর্নীতির রাজত্ব সম্পর্কে জানতে পারে দেশবাসী।
শুধুমাত্র দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া ডিজির গাড়ি চালক মালেকের কুকর্মের ঢামাডোলের মাঝেই সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলে ধরে নিয়ে গিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে তথাকথিত ছাত্র এবং ছাত্রনেতাদের কর্তৃক গৃহবধু গণধর্ষণের ঘটনায় আরো একবার আলোড়িত হয় দেশ। এ নিয়ে দেশময় শুরু হওয়া প্রতিবাদ, ক্ষোভ এবং বিক্ষোভের । এরই মাঝে আলোতে আসে নোয়াখালিতে বিবস্র করে পৈশাচিক কায়দায় আরেক নারী নির্যাতনের খবর। মজার ব্যাপার হলো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা দুর্বৃত্তচক্র সে নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে ঘটনার বত্রিশ দিন পর নিজেরাই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার পরই দেশবাসী জানতে পারে সেই অমানবিক ঘটনার কথা।
এ দু’টি ঘটনায় দেশব্যাপী প্রতিবাদ বিক্ষাভ জোরালো হয়েছে। ধর্ষকদের ফাঁসি দাবি করা হচ্ছে প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে। ফাঁসির বিধান রেখে আইনও সংশোধন হচ্ছে মর্মে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এ দাবি পূরণ হলে প্রতিবাদকারীরা ঘরে ফিরে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু শুধু ফাঁসির আইন হলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে? খুনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকার পরও যখন দেশে খুন থেমে নেই তখন শুধুমাত্র আইন দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। বরং ধর্ষণ বন্ধে আইনের পাশাপাশি প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ধর্মীয় ও নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন মানবিক তরুণ প্রজন্ম তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়া। প্রয়োজন মূল ধারার শিক্ষায় বাধ্যমূলক পূর্নাঙ্গ ধর্মীয়, নৈতিক, মানবিক শিক্ষার ব্যবস্থা রেখে পাঠ্যক্রম ঢেলে সাজানো।
পাশাপাশি প্রয়োজন মাধ্যমিক , উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাঙ্গণগুলোতে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। কারণ অন্তত: প্রাথমিকে ধর্ম শিক্ষা এবং চর্চার সুযোগ পেলে আর শিক্ষাঙ্গণগুলোতে শিক্ষার প্রকৃত পরিবেশ নিশ্চিত হলে আর যাই হোক তরুণদের বিপদগামিতার ব্যাপকতা থাকবে না।
ফলে আইনের পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রকৃত মর্মবাণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সমাজে সঞ্চারিত করে অপরাধমূলক প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি। ধর্ষণ ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বন্ধে করণীয় বিষয়ের মধ্যে আইনের কঠোর প্রয়োগ, শিক্ষায় নৈতিকতা আনয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হলেই আসবে সাফল্য। কমবে অপরাধ ও নেতিবাচক বিষয়, বাড়বে ইতিবাচক অর্জন এবং উজ্জল হবে দেশ ও জাতির ইমেজ।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার