করোনাভাইরাসের উৎস কোথায়?
আচরণের মতোই রহস্যজনক করোনাভাইরাসের উৎসস্থল। কেউ সঠিকভাবে বলতে পারছেন না, ঠিক কোন জায়গা থেকে এবং ঠিক কোন কারণে বা কার দ্বারা ভাইরাসটি উৎপন্ন হয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস নিয়ে পুঞ্জিভূত অনেক রহস্যেরই জট খুলছেই না। কোথা থেকে এবং কীভাবে এলো এ ভয়াবহ ভাইরাসটি তা নিয়ে অন্ধকারে গোটা বিশ্ব। অনুমানভিত্তিক নানা কথায় এ পর্যন্ত চীনকেই অকুস্থল মনে করে আসছিল সবাই। এমনকি আমেরিকাসহ অনেক দেশ চীনকে তাদের ল্যাবে তৈরি ভাইরাস বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার অভিযোগও করেছিল। যদিও চীন প্রথম থেকেই এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার বলে আসছে, ভাইরাসটি যে মানবসৃষ্ট, এমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তাদের কাছে নেই। এতে অবশ্য চীনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অনেকটা দুর্বল হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আক্রমণ করা থেকে সরে আসে নি। বিশেষ করে, আমেরিকায় সংক্রমণ এবং প্রাণহানির ব্যাপকতার প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিযোগের গলা ছিল বেশ উঁচুতে।
চীনের পর প্রথম কোনো দেশ হিসেবে কোভিডে কাবু হয় ইতালি। সাড়ে ৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা চব্বিশ লাখের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার। জনসংখ্যা আনুপাতিক সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনার বিরূপ পরিস্থিতি পেরিয়েও ইতালি এখন স্বস্তিতে।
আরও পড়ুন➥ করোনাকালে মানবিকতা, অমানবিকতা
সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল লোম্বার্ডি অঞ্চলের কোডোগনো শহরে। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি ওই শহরটি লকডাউন করে ‘রেড জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে পার্শ্ববর্তী ভেনেতোসহ লোম্বার্ডি অঞ্চলের নয়টি শহর লকডাউন করা হয়। আর মার্চের প্রথম দিকে গোটা দেশে লকডাউনের আওতায় আনা হয়।
তখন এই মর্মে খবর রটে যায় যে, ইতালির পানিতে চীনের আগে থেকেই করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। দ্যা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (আইএসএস) বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছিল, ইতালিতে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার অনেক আগেই গত ১৮ ডিসেম্বরপ দেশটির মিলান ও তুরিন শহরের বর্জ্য পানিতে ভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
ফলে এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছিল বলে মনে করা হচ্ছে, তার আগে থেকেই এটি পরিভ্রমণ করছিল। চীনা কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আর ইতালিতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
প্রায় একই সময়ে আক্রান্ত হয়ে ফ্রান্স হারায় দেশের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। আর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ফ্রান্সের এক লাখ ৭০ হাজারের বেশি। এদিকে ফরাসি বিজ্ঞানীরা নমুনা পরীক্ষা করে জানান, গত বছর ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে প্যারিসের কাছে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগির চিকিৎসা করা হয়েছিল, যিনি মূলত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।
অপরদিকে আরেক গবেষণায় জানা যায়, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বার্সেলোনা থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য পানিতে ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা স্পেনে স্থানীয়ভাবে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রায় ৪০ দিন আগের ঘটনা।
আরও পড়ুন➥ ধর্ষণ ও অপরাধ বন্ধে করণীয়
ইউরোপের আরেক দেশ স্পেনও ভয়াবহভাবে করোনা সংক্রমিত হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী স্পেনে ২ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। যাদের মধ্যে ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। করোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগের উৎস সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে দেশটির ইউনির্ভাসিটি অব বার্সেলোনার গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন, চীনে করোনা শনাক্তের ৯ মাস আগেই স্পেনের বার্সেলোনায় নর্দমার পানিতে করোনাভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটি নর্দমার পানি পরীক্ষার পর গত বছরের (২০১৯) মার্চেই স্পেনে করোনার আগমন নিশ্চিত হয়েছে গবেষকরা। ইউনির্ভাসিটি অব বার্সেলোনার ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা আরও দাবি করেছেন, পানি থেকে করোনা ছড়ায় কিনা তা জানতে চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বিভিন্ন নর্দমা থেকে সংগৃহীত পানি পরীক্ষা করে দেখছিলেন তারা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ করা নর্দমার পানিও পরীক্ষা করে দেখা হয়। এ সময় একটি নমুনায় করোনার উপস্থিতি পান ইউনিভার্সিটি অব বার্সেলোনার গবেষকরা।
সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে করোনাভাইরাসের বিচিত্র গতি-প্রকৃতি ও রহস্যময়তা বুঝা যাচ্ছে এবং এর উৎপত্তি ও কারণ সম্পর্কে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। তবে এক সময় নিশ্চয়ই করোনা সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। ততদিনে কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বকে যে ঝাঁকুনি দিয়েছে, তাতে বিশ্বাবাসী সত্যিই বিপর্যস্ত। তদুপরি এখন শোনা যাচ্ছে দ্বিতীয় হামলার পদধ্বনি, যা বিশ্বে চলমান রোগ বনাম মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য যুদ্ধের জানান দিচ্ছে।
মো: মোসলেহ উদ্দিন: কবি, প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার।