হান্টিংটনের ভবিষ্যৎ বাণীর দিকেই এগোচ্ছে পৃথিবী?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পশ্চিমা শক্তির সাথে সমাজতান্ত্রিক শক্তির একধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়, যা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ নামে অধিক পরিচিত। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ বইয়ে আগামী পৃথিবী নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, দুই পরাশক্তির আধিপত্যের দিন শেষ। দেশগুলো আর পরাশক্তির দিকে নিজেদের মেরুকরণ করবেনা। বরং নিজেদের সংস্কৃতির দিকে নজর দেবে। তখন ‘আপনি কোন পক্ষের সমর্থক?’ প্রশ্নের চেয়ে ‘ আপনি কে?’ এই প্রশ্নই মূখ্য হয়ে উঠবে।
বর্তমান পরিস্থতিতে এই দ্বিতীয় প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। দেশের সাথে দেশের সংঘাত হবেনা! তাহলে প্রশ্ন হলো ভবিষ্যতের সংঘাত বাঁধবে কাদের মধ্যে? হান্টিংটন উত্তর দিয়েছেন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে দেশের সাথে দেশের নয়, বরং সংঘাত শুরু হবে যার যার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়সত্তা টিকিয়ে রাখাকে কেন্দ্র করে। জাতির সঙ্গে জাতির, সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের।
পাঁচটি অংশে বিভক্ত এই বইয়ে তিনি ভবিষ্যৎ বিশ্বরাজনীতির রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। প্রথম অংশে তিনি বলেছেন, বিশ্ব রাজনীতিতে দুই মেরুর পরিবর্তে একাধিক মেরুর ও একাধিক সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটবে। নতুন নতুন শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে। যখন দেশগুলো শিল্পায়নে সমৃদ্ধ হবে, তখন আর পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলা বা অনুসরণ করার প্রয়োজন থাকবে না। এবং পশ্চিমা শক্তিকে এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, সারা বিশ্বে তাদের আধিপত্য ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা অর্থহীন।
দ্বিতীয় অংশে তিনি নজর দিয়েছেন এশিয়ার দেশগুলো ও ধর্মের দিকে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে মানুষ শহরমুখী হবে। প্রচলিত পরিবার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, মানুষ হয়ে পড়বে একা ও বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো ধর্মকে আঁকড়ে ধরবে। অর্থনীতিতে অগ্রসমান দেশ, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চর্চা শুরু করবে।
তৃতীয় অংশে তিনি দেখিয়েছেন, শক্তি ও আকারভেদে কীভাবে একদেশ অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। এবং বিশ্ব রাজনীতিতে একইরকম সংস্কৃতিমনা দেশগুলো একে অপরকে সাহায্য করবে। আর তখন ভিন্নমনা দুই সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাত নিশ্চিত।
চতুর্থ অংশে তিনি পশ্চিমা শক্তির বিশ্ব জয়ের অভীপ্সা ও সম্ভাব্য সংঘাতগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই সংঘাত হবে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধশীল চীন ও ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। কারণ তারা পশ্চিমা শক্তি ও সংস্কৃতি মেনে নেবে না।
শেষ অংশে হান্টিংটন বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই তাদের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা বাদ দিতে হবে। তিনি আরও সর্তক করছেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ ঢুকছে তাতে হয়তো একদিন নিজেদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে হান্টিংটনের ভবিষ্যৎ বাণী সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। পশ্চিমা শক্তি বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আবার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি যেমন চীন পশ্চিমা শক্তির সাথে টেক্কা দিচ্ছে। তারা পশ্চিমা ভাষা, সংস্কৃতি বর্জন করেছে। নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চাইছে অন্যদের মাঝে। ধর্ম নিয়ে সংঘাত লেগে আছে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংঘাত বাড়াচ্ছে। ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, ভিন্ন ধর্মালম্বীদের হত্যা করছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে জাতিগত সংঘাত লেগে আছে। চীনে সংখ্যালঘু মুসলমানরা গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। মিয়ানমার একজাতি গঠন করতে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করেছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি গ্রহণ করে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় আসছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফ্রাস্ট’ নীতি গ্রহণ করে সফল হয়েছে। নরেদ্র মোদি পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন। একজাতি, এক ধর্ম, এক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা চলছে। তাহলে সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী কি হান্টিংটনের ভবিষ্যৎ বাণীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে?
আনিসুর রহমান, প্রাবন্ধিক।