ফৌজি শাসনে বিক্ষুব্ধ মিয়ানমারে মৃত্যু ও রক্তস্রোত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী দেশ মিয়ানমার বার বার আবর্তিত হচ্ছে ফৌজি কর্তৃত্বের সরাসরি সামরিক শাসনের দুষ্টচক্রে। দেশটির ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মিশে আছে ফৌজি শাসনের প্রত্যক্ষ ছাপ। ২০২১ সালের শুরুতেই সেখানে আবার ঘটলো সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা। যার ফলে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল আর রক্তস্রোত দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে।
১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ উপনিবেশ মিয়ানমার পরিচিত ছিল বার্মা নামে, যে দেশটি ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ-ভারতের অংশ। ব্রিটিশ ও মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অভিযান চালায় মিয়ানমারে। জাপানে প্রশিক্ষিত বার্মা ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির সহায়তায় দেশটি দখল করে নেয় তারা।
বার্মা ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি পরবর্তীতে অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগে (এএফপিএফএল) রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৫ সালে অং সানের নেতৃত্বাধীন এএফপিএফএল’র সহায়তায় জাপানি দখলদারিত্ব থেকে মিয়ানমারকে মুক্ত করে ব্রিটেন। এর দুই বছর পর মিয়ানমারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অং সান ও ছয় সদস্যকে হত্যা করে অং সানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী উ স’র নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা। জাপানি দখলদারিত্বের সময় মিয়ানমারের বা মও সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ নু’কে এএফপিএফএল ও দেশটির সরকার প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উ নু ক্ষমতায় থাকাকালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালে।
ক্ষমতাসীন এএফপিএফএল-এ ভাঙন দেখা দিলে চিফ অব স্টাফ জেনারেল নে উইন এএফপিএফএল সরকারকে সরিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬০ সালের নির্বাচনে এএফপিএফএল’র উ নু’র নেতৃত্বাধীন অংশ জয়ী হলে তার রাজনৈতিক নীতিমালা সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করে। ফলে ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উ নু’র সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। সেসময় তিনি মিয়ানমারের ফেডারেল ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ‘নিজস্ব ঘরানার সমাজতন্ত্র’ চালু করেন। পাশাপাশি তিনি অর্থনীতিকে জাতীয়করণ ও সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি নামে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। জেনারেল উইন দেশটিতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও নিষিদ্ধ করেন।
সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারে নতুন সংবিধান চালু হয়। সশস্ত্র বাহিনীর হাত থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জেনারেল নে উইন ও অন্যান্য সাবেক সামরিক নেতাদের পরিচালিত পিপলস অ্যাসেম্বলির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮১ সালে জেনারেল নে উইন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সান ইউয়ের কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ছেড়ে দেন। তবে তিনি সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
প্রচ্ছন্ন সামরিক শাসনের মধ্যেই ১৯৮৭ সালে মিয়ানমারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হলে দেশটির জনগণ সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। সেসময় সামরিক সরকারের হাতে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হন। ১৯৮৮ সালে সরকার দ্য স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রেস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি) গঠন করে এবং ১৯৮৯ সালে মিয়ানমারে সামরিক আইন জারি করা হয়। সেসময় বার্মার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার রাখার পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থি কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা অং সানের মেয়ে ও এনএলডি নেতা অং সান সু চিকে গৃহবন্দি করা হয়।
১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের পর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। বিরোধী এনএলডি নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হলে সেনাবাহিনী সে ফল উপেক্ষা করে।মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালানোয় ১৯৯১ সালে সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এদিকে ১৯৯২ সালে সামরিক বাহিনীর থান সুয়ে এসএলওআরসি’র চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে জেনারেল স মাউংকে ক্ষমতায় বসান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ও দীর্ঘদিন পশ্চিমের দেশগুলোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা মিয়ানমার সরকার ১৯৯৫ অং সান সু চিকে ছয় বছর গৃহবন্দি রাখার পর মুক্তি দেয়। এর পরের বছর সু চি তার দলের প্রথম কংগ্রেসে যোগ দিলে সামরিক সরকার ২০০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ২০০০ সালে মিয়ানমারের ওপর ইউরোপ অবরোধ কঠোর করলে সামরিক জান্তা সু চিকে আবারও আটক করে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এর দুই বছর (২০০২ সালে) পর তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার। সেসময় সু চির দেশের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু সু চির গাড়িবহরে হামলার পর নিরাপত্তার কথা বলে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় ২০০৩ সালে।
রাজনীতির মাঠে দাপট দেখাতে থাকে সেনা সমর্থিত রাজনৈতিক মিলিশিয়া ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসডিএ), যা পরবর্তীতে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নাম ধারণ করে। এই দলটিই সেনাবাহিনীর দল হিসেবে পরিচিত। তবে সামরিক সরকার জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি তুলে নিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয় ২০০৭ সালে এবং ২০০৮ সালে মিয়ানমারে সামুদ্রিক ঝড় নার্গিস আঘাত হানলে এর দুই দিন পর দেশটিতে গণভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনার পরিকল্পনা করলে সু চি সামরিক জান্তার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। সেসময় তাকে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করারও অনুমতি দেয় সরকার।
সামরিক সরকার ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনএলডি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিন উ’কে এক দশকের বেশি সময় কারাবন্দির পর মুক্তি দেয়। সে বছরের মার্চে সরকার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন আইন পাশ করে। এনএলডি’র একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে মত দেয়। দীর্ঘ ২০ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি বিজয় দাবি করে। বিরোধীরা সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে।
সরকার নির্বাচনটিকে সামরিক শাসন থেকে বেসামরিক শাসনে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করে। নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর সামরিক জান্তা সু চিকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়। ২০১১ সালের মার্চে থিয়েন সেইন দেশটির নতুন ও বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। সে বছরের আগস্টে তিনি সু চির সঙ্গে দেখা করেন। অক্টোবরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়। নভেম্বরে সু চি ঘোষণা দেন তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী।
২০১২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টের উপ-নির্বাচনে সু চিসহ এনএলডির প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। সেসময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বছরের জন্য মিয়ানমারের ওপর থেকে সব বেসামরিক অবরোধ তুলে নেয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে এপ্রিলে পাঁচটি বেসরকারি দৈনিক পত্রিকার অনুমতি দেয় মিয়ানমার সরকার। প্রায় ৫০ বছর পর দেশটিতে বেসরকারি পত্রিকা অনুমতি পায়। ২০১৪ সালের অক্টোবরে সরকার ঘোষণা দেয় যে, ২০১৫ সালের শেষের দিকে মিয়ানমারে পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেসময় সরকার ৩ হাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়ারও ঘোষণা দেয়। নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বাধীন বিরোধী এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয় পায়।
অবশেষে ২০১৬ সালের মার্চে হতিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে দেশটিতে নতুন যুগের সূচনা হয় বলে আশা করা হয়। প্রায় ৫০ বছরের সেনা আধিপত্যের পর সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। প্রথম মুক্ত নির্বাচনের চার বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে আবার পার্লামেন্টারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন এনএলডি এবং সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল মাত্র ৩৩ আসন।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর দেশটির সামরিক বাহিনী ‘কারচুপি’র অভিযোগ তোলে। সেসময় থেকে সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। তখন থেকে সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন ওঠে। অবশেষে সেই গুঞ্জন বাস্তবে পরিণত হয় ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি প্রতুষ্যে। তবে উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো, অতীতের মতো এবার সামরিক শাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের নাগরিকগণ কোনো সহানুভূতি প্রদর্শন করেননি। ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম দিন থেকেই সূচিত হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, যাতে এক মাসে প্রায় একশ মানুষের মৃত্যু ও হাজার হাজার মানুষের আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
যথারীতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আন্দোলনকারীদের বন্দি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। তারপরেও বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের পাশাপাশি প্রতিদিনই দেশব্যাপী চলছে গণতন্ত্রের জন্য বিক্ষোভ এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা, যা দেশটিকে মৃত্যুর মিছিল আর রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।