পশ্চিমবঙ্গে ভোট ও উত্তেজনার পারদ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ভোটের দামামা বাজতেই উত্তেজনার পারদ উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। আট দফায় অনুষ্ঠিতব্য রাজ্যের ২৯৪ আসনের বিধানসভার ভোটের ফল বের হবে ২ মে। তখনই জানা যাবে, রাজ্য শাসনের ভার পাবে কোন দল।
কয়েক টার্ম ধরে রাজ্য শাসন করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। আর ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতা দখলের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে এগুচ্ছে। বাম ও কংগ্রেস, যারা একদা রাজ্য শাসন করেছিল, তারাও পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে একজোট হয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করেছে।
ফলে ভোটের লড়াইটি প্রধানত তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে দ্বিমুখী হলেও ক্ষেত্র বিশেষে তা ত্রিমুখী রূপ পরিগ্রহ করবে। তিনটি পক্ষই বলতে গেলে সর্বশক্তি নিয়ে ভোটের মাঠে-ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে।
তৃণমূলের মূল শক্তি মমতার ইমেজ ও নেতৃত্ব। তা নিয়েই দল সরব। বিজেপি প্রধানমন্ত্রী মোদী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতাদের প্রচারে শামিল করেছে। সংযুক্ত মোর্চা কাজ করছে দলীয় ক্যাডার, কর্মী ও সমর্থকদের শক্তিতে।
এসব চিরাচরিত প্রচারের বাইরে চলছে দলবদল আর ফিল্মস্টারদের দলে ভিড়ানোর খেলা। এসব ক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপি একে অপরকে পাল্লা দিচ্ছে। সবশেষে, একদা বাম থেকে তৃণমূল হয়ে বিজেপিতে এসেছেন নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী। বিজেপিতে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর উপস্থিতিতে কলকাতার প্যারেড গ্রাউন্ড ময়দানের জনসভায় তিনি বলেছেন, 'আমি জলোসাপ নই, কোবরা, এক ছোবলে শেষ করে দেবো।'
এমন আক্রমণাত্মক ও উত্তেজন বক্তব্যে সবাই বিস্মিত হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সুনজরে আসতে এবং মামলা মোকদ্দমার কবল থেকে বাঁচতে শুধু মিঠুন নন, বহুজনই বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। যাদের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী, রাজিব বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশালী ডালমিয়া প্রমুখ বহু জনের নাম করা হয়।
রাজনৈতিক ও অন্যবিধ কারণে দলবদল নতুন কোনো বিষয় নয়। নতুন হলো, দলবদলের সঙ্গে সঙ্গে উগ্রতা ও উত্তেজনার বিস্তার। পশ্চিমবঙ্গের সুশীল ও সুসংস্কৃত রাজনীতিতে যা অশনি সঙ্কেত স্বরূপ। জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, বহিরাগত-স্থানীয় দ্বন্দ্ব, সংখ্যালঘু-নারী-দলিতদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি আসন্ন নির্বাচনী পরিবেশকে আচ্ছন্ন করেছে। কোথাও কোথাও মারদাঙ্গা ও রক্তপাতের ঘটনাও ঘটেছে।
ভারতের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের একটি সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের কারণে। উগ্রতা ও হিংসার জন্য বিহার, উত্তর প্রদেশ ও গুজরাতের যে দুর্নাম, তা পশ্চিমবঙ্গকে কখনোই স্পর্শ করেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে অতীতের সুনাম বিনষ্টের আলামত দেখা যাচ্ছে, যা বঙ্গের শুভ্র ঐতিহ্যকে কালিমা লিপ্ত করবে।
ভোট সাধারণত জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যেমন কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হওয়ার কথা। তার বদলে জাত, পাত, হিংসা, দাঙ্গা, হামলা, মামলা, ছোবল প্রাধান্য পেলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিপদই বাড়ে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের এই সত্য নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আশা করা যায় যে, গণতন্ত্র ও সৌহার্দ্যের শক্তি অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে সমর্থ হবে পশ্চিমবঙ্গে। বঙ্গের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও স্বকীয়তা রক্ষার প্রয়োজনেই অপতৎপরতার অবসান জরুরি।
এ কথা সত্য যে, ভারতের নানা রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গেরও কিছু সমস্যা আছে। এমন বলা যাবে না যে বঙ্গে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা অনেক, কিন্তু গত দশ বছরে রাজ্যের প্রশাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে অনেক কাজ করেছেন, এও স্বীকার করতেই হবে। তাঁর উদ্যোগেই ‘কন্যাশ্রী’, ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল দেওয়া, প্রথমে অতি অল্প দামে এবং পরে বিনামূল্যে চাল দেওয়া, ‘দুয়ারে সরকার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিশ্চয়ই এখনও হাজারো সমস্যা, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদে এসেই দশ বছর আগে তিনি হাসপাতালগুলোতে নিজে উপস্থিত হয়ে, সেগুলো পরিদর্শন করে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিলেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের ডেকে বৈঠক করে সতর্কবার্তা দিয়েছেন, তাঁরা যেন সামান্য চিকিৎসায় রোগীদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ দাবি না করেন।
সবজি ও আনাজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে নিজে চলে যাচ্ছেন বাজার পরিদর্শন করতে, এমন মুখ্যমন্ত্রী ভারতে আজও কম। কোথাও ব্রিজ ভেঙে পড়লে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধারকার্য তদারক করছেন। আমপানের সময় কোমর বেঁধে নিজে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, করোনা-সঙ্কটে সবাই যখন ঘরে, তিনি রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মানুষকে সতর্ক করেছেন। পথে নেমে কাজ করার এমন ক্ষমতা আজকের ভারতে খুব কম নেতারই আছে।
এজন্য তৃণমূল মমতাকে সামনে রেখে নির্বাচনী স্লোগান দিয়েছে, 'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়।' বিজেপি মোদীর ইমেজকে তুলে ধরছে। আর সংযুক্ত মোর্চা ভাত-কাপড় ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের ডাক দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এসবই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। তবে এর মধ্যে সাপের ছোবল, জাত-পাত, হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতার আমদানি হলে আখেরে মানুষের ন্যায্য অধিকারের দাবিগুলো তলিয়ে যাবে এবং সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিলয়প্রাপ্ত হবে। এই সার সত্যটি মানুষের কাছে যতই স্পষ্টতর অবয়বে গৃহীত হবে, ততই উত্তেজনার পারদ নামবে।
ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজেকে নানা আগ্রাসনের কবল থেকে বাঁচিয়ে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আসন্ন নির্বাচনে ভোটারদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা শান্তিপূর্ণ পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, নাকি রক্ত-হিংসা-হানাহানির পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবেন?
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।