করোনাই বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসুক!
করোনাভাইরাস আবার ভয়ঙ্কর আতঙ্ক নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে। প্রতিদিনই সংক্রমণের রেকর্ড হচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। করোনা যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে নিছক পরিসংখ্যান নয়, প্রতিদিনই আশপাশের পরিচিত কেউ না কেউ আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে। আমার দিনের বড় একটা সময় কাটছে পরিচিতদের করোনা টেস্ট, করোনা টিকা বা হাসপাতাল ম্যানেজ করার কাজে। দিন যত যাচ্ছে, হাসপাতালে সিট পাওয়া, ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মার্চের শুরুর দিকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগমনবার্তা টের পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু নানা কাজে ব্যস্ত সরকারের টনক নড়েছে মার্চের শেষে। করোনা মোকাবিলায় সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। সরকার যে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছে, তার সবগুলোই দরকারি। কিন্তু সমস্যা হলো করোনা এবার যতটা ভয়ঙ্কর, সরকারের সুর ততটাই নরম। 'সীমিত করতে হবে', 'পালন করতে হবে' ধরনের সফট শব্দের নির্দেশনা দিয়েই যেন সরকারের দায়িত্ব শেষ। সেই নির্দেশনা কে পালন করবে, কে মনিটর করবে; তার কোনো নির্দেশনা নেই।
নির্দেশনা জারির ঠিক আগে আগে শিক্ষার্থীদের প্রবল প্রতিবাদ, আন্দোলনের পরও করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের মধ্যেই বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে আমি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছি, বিসিএস পরীক্ষার সময় তো সরকারের নির্দেশনা ছিল না। নির্দেশনার পর নিশ্চয়ই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু শুক্রবার ছুটির দিনের সকালে আমার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও ফুরিয়ে গেল। বাবা-মার পছন্দের তালিকায় সন্তানকে ডাক্তার বানানোটা থাকে সবার আগে। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষাটা তাই বাংলাদেশে উৎসব। কিন্তু এখন উৎসবের সময় নয়, করোনা আটকে দিয়েছে সবকিছু। তবে আগেই প্রমাণ করেছি, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী। তাই তো যথারীতি উৎসবমুখর পরিবেশেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৫টি কেন্দ্রে পরীক্ষা চলে ১১টা পর্যন্ত।
দেশের ৪৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ৪ হাজার ৩৫০টি। আর ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আরও ৬ হাজার ৩৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবেন। তারমানে সব মিলে প্রায় ১১ হাজার আসন। আর এবার ভর্তির জন্য আবেদন করেছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৭৬১ জন। পরীক্ষার হলে ঢোকা থেকে শুরু করে ভেতরের আসন ব্যবস্থাটাও ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনেই। কিন্তু সমস্যা হলো বাইরে। প্রতিটি কেন্দ্রের সামনেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। কলেজ পাশ করে মেডিকেলের ভর্তি হতে যাওয়া সন্তানের সাথে বাবা-মা তো বটেই, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, কারো কারো গোপন প্রেমিক-প্রেমিকাও যেন এসেছেন। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্রের বাইরে তিলধারণের ঠাই নেই, স্বাস্থবিধি তো অনেক পরের কথা। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন যাদের চোখে, সেই তরুণরা প্রথমদিনেই একটা শিক্ষা পেলো, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিধি বলে কিছু নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। সমস্যাটা হলো, আমরা সহজে সরকারকে গালি দেই বটে, কিন্তু নিজের কাজটা করি না। সরকার হলের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করলেও বাইরে পারেনি। এই না পারাটা যতটা সরকারের ব্যর্থতা, ততটাই আমাদের খামখেয়ালি, আদিখ্যেতা। পরীক্ষার্থী যদি একাই হলে আসতেন, তাহলে কিন্তু এই অবস্থা হতো না। তবে সরকার চাইলে হলের বাইরে ১৪৪ ধারা দিয়ে দিতে পারতো। প্রবেশপত্র ছাড়া কাউকে কেন্দ্রের আশেপাশে যেতে না দিলেই এই ৫৫টি কেন্দ্র উর্বর করোনাভূমিতে পরিণত হতো না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরীক্ষা না নেয়ার নির্দেশনা দেয়। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নেয়। এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেই যদি করোনার চেয়ে পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে প্রতিদিন লাশ গোনা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। তবে শুধু মেডিকেল পরীক্ষাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বইমেলা চলছে, সব শপিং মল খোলা, আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, ভাঙচুর- সবই চলছে সমানতালে। ছুটির দিনে নাকি একাধিক সরকারি চাকরির পরীক্ষাও হয়েছে। বাহ বাহ।
মেডিকেল পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে ছবি দেখে সকালেই আমার বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা মরে গিয়েছিল। তাই দুপুরে জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররমে হেফাজতে ইসলামের ডাকে বিক্ষোভ দেখে একদম অবাক হইনি। হাজার হাজার মানুষ। সবার মাথায় টুপি, কিন্তু কারো মুখে মাস্ক নেই। আমরা ধর্মটা যত সহজে বুঝি, জীবনের মূল্যটা তত বুঝি না। নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়ে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা তো আমার নিজের স্বার্থেই। করোনা আমাদেরকে নতুন এক জীবনে এনে ফেলেছে। মসজিদ বা বাজার, সিনেমা হল বা পরীক্ষা কেন্দ্র; যেখানেই যাই না কেন আমাদের মুখে যেন মাস্ক থাকে। সকালে যেমন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে ১৪৪ ধারা জারি করা উচিত ছিল, দুপুরেও তেমনি বায়তুল মোকাররমের চারপাশে বিক্ষোভ সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিত ছিল।
করোনা যেভাবে ধেয়ে আসছে, তাতে নরম-সরম নির্দেশনা আর তার ঢিলেঢালা বাস্তবায়নে করোনা ঠেকানো যাবে না। করোনা নিয়ন্ত্রণে এক্ষুণি কঠোরভাবে ১৮ দফা বাস্তবায়ন করতে হবে, নইলে পরে কঠোর লকডাউনেও কাজ হবে না।
লেখা শেষ করছি, ফেসবুকে একজনের মন্তব্য উদ্ধৃত করে। ছুটির দিনে সকাল-দুপুর উপচেপড়া জনসমাগম দেখে তিনি লিখেছেন, আমাদের পক্ষে আর স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। করোনাই বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাংলাদেশে আসতে পারে।
লেখক: প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ