হাসপাতাল হোক, তবে শিরিষতলায় নয়
চট্টগ্রাম আমার শৈশবের শহর। বলা ভালো প্রথম শহর। আমার জন্ম দাউদকান্দির রঘুনাথপুরের মামাবাড়িতে। বাবার চাকরির সুবাদে প্রথম যে শহর দেখেছি, যে শহরে থেকেছি; সেটি চট্টগ্রাম। আমার বাবা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্ধ স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমরা থাকতাম মুরাদপুরের অন্ধ ও মুক বধির বিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে। স্কুলের পেছনে মোহাম্মদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়েছিও। সে অনেক আগের কথা।
জীবনে প্রথম সিনেমা দেখেছি গুলজার সিনেমা হলে। আলমাস নামে একটি হলে সিনেমা দেখেছিলাম বলে মনে পরে। বহদ্দারহাট, ষোলশহর, টাইগার পাস, ফয়েস লেক, বাটালি হিল, পতেঙ্গা- নামগুলো এখনও স্মৃতিতে ঝিলিক মারে। সত্তরের দশকের চট্টগ্রাম আমার স্মৃতিতে শহরের যে ছবি এঁকে দেয়, তা পরে অন্য শহরের সাথে মেলাতে পারিনি। শহরের মধ্যেই পাহাড়, টিলা, ঘন সবুজ, লেক থাকবে; চট্টগ্রাম আমাকে এটাই বুঝিয়েছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা শহর বলতে উচু উচু ভবন, ফ্লাইওভার, ইট-কাঠের জঙ্গলকেই যেন বোঝেন। ঢাকায় এসে বুঝেছি, যে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা চট্টগ্রাম শহর দেখেছি; সেটাই শুধু শহর নয়। পরে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে পেশাগত কাজে চট্টগ্রাম গিয়ে বুঝেছি সত্তরের দশকের চট্টগ্রামও আর নেই। ‘শহর’র আছর লেগেছে তার গায়েও। যতবার চট্টগ্রামে গেছি, ততবারই আগের চেয়ে সবুজ কমে যায়। আগের মত ছায়া নেই আর, পাখির ডাকও আর আগের মত শোনা যায় না। আমিই বোধহয় বোকা। শৈশবে যে চট্টগ্রাম দেখেছি, সেটি বোধহয় পুরো শহর ছিল না। এখন বুঝি আস্তে আস্তে চট্টগ্রাম শহর হচ্ছে। সবুজের জায়গা নিচ্ছে আকাশ ছোয়া ভবন, একের পর এক ফ্লাইওভার হচ্ছে, যানজট বাড়ছে, দেশের প্রথম টানেল হচ্ছে কর্নফুলির নিচে।
পুরো লায়েক শহর পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি’র আওতায় চট্টগ্রামে একটি আধুনিক হাসপাতাল হচ্ছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরে একটি আধুনিক হাসপাতাল হচ্ছে, এটি সুখের খবর। কিন্তু সমস্যা হলো এই আধুনিক হাসপাতালটি বানানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক হাসপাতালকে ধ্বংস করে।
শুধু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বলেই নয়, নানা কারণে চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। সাগর এবং নদীর মিলিত অবস্থান চট্টগ্রামকে করে তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। সঙ্গীত, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলায়ও রয়েছে চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র অবস্থান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের ভূমিকা গর্ব করার মত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও চট্টগ্রামের অবস্থান আমাদের গর্বিত করে। বাংলাদেশ রেলওয়ের বড় স্থাপনা রয়েছে চট্টগ্রামে। বৃটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল চট্টগ্রামে। এখনও সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে সিআরবি, মানে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। এখন আর চট্টগ্রাম রেলওয়ে কেন্দ্র নয়, তবু সিআরবি রয়ে গেছে আগের মতই। এই সিআরবি ভবনের পাশেই আছে শিরিষতলা। যেখানে অনেকগুলো শতবর্ষী গাছ সৃষ্টি করেছে এক প্রাকৃতিক হাসপাতাল, অক্সিজেনের কারখানা। সিআরবি পরিচিত চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে। এখন চট্টগ্রামকে যারা শহর বানাতে চান, তাদের কু-নজর পরেছে নগরের ফুসফুস সিআরবির দিকে। আসল কাজে দিনের পর দিন লস দেয়া রেলওয়ে এখন হাসপাতাল বানিয়ে লাভ করতে চায়।
রেলওয়ে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে হাসপাতাল বানাতে চায় ভালো কথা, রেলওয়ে হাসপাতাল বানিয়ে লাভ করতে চায়; তাতেও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু সিআরবি এলাকার শতবর্ষী গাছ কেটে হাসপাতাল বানাতে চাওয়ায়। চট্টগ্রামে রেলওয়ের আরো অনেক জমি আছে। সেখানে বানাক। সিআরবির শিরিষতলা শুধু চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবেই পরিচিত নয়, এটি এখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রও। বছরব্যাপী এখানে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সিআরবি মাঠে শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলা করে, সকাল-বিকাল হাটার জন্যও সবার প্রিয় জায়গা সিআরবি।
একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢোকে না; যাদের মাথায় উন্নয়ন, তাদের মাথায় পরিবেশটা থাকে না কেন। যশোর রোড চওড়া করতে হবে, গাছ কেটে ফেলো; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হল বানাতে হবে, গাছ কেটে ফেলো; রমনা পার্কে ওয়াকওয়ে বানাতে হবে, গাছ কেটে ফেলো; হাসপাতাল বানাতে হবে, গাছ কেটে ফেলো।
ভাব দেখে মনে হচ্ছে, পরিবেশ বুঝি উন্নয়নের প্রধান শত্রু। অথচ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই গাছ বাঁচিয়ে উন্নয়ন করা সম্ভব। অনেকে বলেন, একটি গাছ কাটলে ১০টি গাছ লাগানো হবে। কিন্তু ভাই, একটি শতবর্ষী গাছ বানাতে আপনার কিন্তু ঠিক একশো বছরই লাগবে। তাই শতবর্ষী গাছ কাটার যে ক্ষতি তার কোনো পূরণ নেই আসলে। আর বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাসের তান্ডবের সময় আমরা আবার অক্সিজেনের গুরুত্বটা টের পেয়েছি। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ হাসফাস করে মরে যাচ্ছে। এত এত উন্নয়ন সেই অসহায় মানুষটির কাছে তখন অর্থহীন মনে হয়। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। যেভাবে আমরা গাছ কেটে উন্নয়ন করছি, গোটা দেশকেই শহর বানিয়ে ফেলতে চাইছি, তাতে একদিন ঘরে ঘরে গ্যাসি সিলিন্ডারের মত অক্সিজেন সিলিন্ডারও রাখতে হবে।
উন্নয়ন নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে উন্নয়ন করতে হবে পরিবেশ বাঁচিয়েই। পরিবেশকে যেন আমরা উন্নয়নের শত্রু না বানাই। চট্টগ্রামে একটি আধুনিক হাসপাতাল হোক, তবে সেটা সিআরবির শিরিষতলায় নয়, গাছ কেটে নয়।
লেখক: প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ