শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন: আবুল বারকাতের গবেষণা এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা
গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত ও ২০২০ সালে প্রকাশিত “বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয়
থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে” শীর্ষক মাস্টারপিস গ্রন্থে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে কোভিড-১৯ ও সংশ্লিষ্ট লকডাউন বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছিলেন ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক ঘোষিত লকডাউনের আগের শ্রেণি কাঠামো ছিল এ রকম: (দেশের মোট খানার মধ্যে) দরিদ্র ২০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৭০ শতাংশ, ধনী ১০ শতাংশ। আর লকডাউনের পরে শ্রেণি কাঠামো সম্পূর্ণ পাল্টে হয়েছে এ রকম: দরিদ্র ৪০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ, ধনী ১০ শতাংশ। সুতরাং নিশ্চিত যে কোভিড-১৯-এর কারণে মাত্র দুই মাসের মধ্যে ব্যাপক মানুষের শ্রেণিগত অবস্থান পাল্টে গেছে নিম্নগামী হয়েছে, অবনতি হয়েছে।
ড. বারকাত হিসেব করে দেখিয়েছেন, গত বছরের (২০২০ সালের) লকডাউনের আগে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ আর (ঠিক দুই মাস পরে) কোভিড-১৯-এ লকডাউন করার দুই মাস পরে ৩১ মে (২০২০) নাগাদ এক লাফে ওই দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখে। অর্থাৎ কোভিড-১৯-এর কারণে মাত্র দুই মাসে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ।
আবার দরিদ্রদের মধ্যে যারা হতদরিদ্র “যারা দিন আনে দিন খায়” (অথবা যাদের সরকারি পরিসংখ্যানে খানার আয়ের সর্বনিম্ন ১০ ডিসাইল হিসেবে ধরা হয়) তাদের সংখ্যা ছিল লকডাউনের আগে মোট খানার ১০ শতাংশ কিন্তু লকডাউনের ২ মাস পরে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫ শতাংশ অর্থাৎ লকডাউনের আগে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যা ছিল যেখানে মোট ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ, সেখানে লকডাউনের পরে (মাত্র ২ মাসের মধ্যে) সে মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৫ লাখ অর্থাৎ হতদরিদ্র গ্রুপে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ২ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ। এরা লকডাউনের আগে ‘দরিদ্র’ শ্রেণিতে ছিলেন, ৬৬ দিনে ‘হতদরিদ্র’ গ্রুপে নেমে গেছেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেছিলেন, কোভিড-১৯-এ ‘মধ্যবিত্ত’ শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপক এবং বহুধা। লকডাউনের আগে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে মোট মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা ছিল (মোট খানার ৭০ শতাংশ) ১১ কোটি ৯০ লাখ, যা লকডাউনের পর (মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে) কমে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৫০ লাখ। অর্থাৎ মাত্র ২ মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ অতীতের ৩ কোটি ৪০ লাখ মধ্যবিত্ত গ্রুপের মানুষকে টেনে নিচে নামিয়ে ছেড়েছে।
তিঁনি এই বইয়ে সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির’ সবাই একইরকম মধ্যবিত্ত নয়। মধ্যবিত্তদের মধ্যে বড় তিনটি উপ-শ্রেণি আছে: নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত।
অধ্যাপক বারকাত আরো বলেন যে, কোভিড-১৯ (ও সংশ্লিষ্ট লকডাউন) এই তিন ধরনের মধ্যবিত্তের (মধ্যবিত্তের উপ-শ্রেণির) ওপর একই রকম প্রভাব ফেলেনি। তাঁর হিসেবে, লকডাউন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে নিম্ন-মধ্যবিত্তের: লকডাউনের আগে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ছিলেন মোট ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ, যাদের সংখ্যা লকডাউনের ৬৬ দিনের মাথায় হয়েছে ৩ কোটি ৯১ লাখ অর্থাৎ মাত্র ২ মাসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ১ কোটি ১৯ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ আসলে হারিয়ে যাননি, তারা দরিদ্র শ্রেণিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। মধ্য-মধ্যবিত্তের মানুষের অবস্থাও নাকাল। লকডাউনের আগে তারা ছিলেন মোট খানার ২০ শতাংশ আর লকডাউনের (২ মাস) পরে নেমে এসেছেন ১৪ শতাংশে অর্থাৎ ৩ কোটি ৪০ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তের সাইজ সংকুচিত হয়ে এখন তা ২ কোটি ৩৮ লাখ হয়েছে। অর্থাৎ ১ কোটি ২ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্তদের ৮০ শতাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্রুপে আর ২০ শতাংশ দরিদ্র গ্রুপে যোগ দিয়েছেন। তার হিসেবে উচ্চ-মধ্যবিত্তরাও কিন্তু আগের জায়গায় নেই। লকডাউনের আগে দেশে উচ্চ-মধ্যবিত্তরা (মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে সবচেয়ে ওপরে যাদের অবস্থান) ছিলেন মোট খানার ২০ শতাংশ লকডাউনের পরে যা নেমে এসেছে ১৩ শতাংশে।অর্থাৎ লকডাউনের আগে উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ, যা লকডাউনের পরে নেমে এসেছে ২ কোটি ২১ লাখে। অর্থাৎ উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ শ্রেণি মইয়ে নিচের দিকে চলে গেছেন, সম্ভবত যোগদান করেছেন মধ্য-মধ্যবিত্ত গ্রুপে। তবে এদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক শ্রেণি মইয়ে উঠে ধনীও হয়ে যেতে পারেন (কারণ মহামারি অবস্থায় বিভিন্ন কারণে কিছু মানুষের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়)।
তিঁনি দেখিয়েছেন, শ্রেণি মইয়ের সবচেয়ে ওপরে বসবাসকারী ধনীদের (অতি ধনীসহ) অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি বরং তাদের কারো কারো অবস্থা আরো ভালো হয়েছে।
প্রখ্যাত গবেষক আবুল বারকাত দেখিয়েছিলেন যে, কোভিড-১৯-এর ফলে মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামো পুরো পাল্টে গেছে। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে লকডাউনের আগের তুলনায় লকডাউনের পরে (মাত্র ৬৬ দিনের মধ্যে) কমপক্ষে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ শ্রেণি মইয়ে নিচের দিকে নেমে গেছেন। এই যে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ লকডাউন থাকার মাত্র ২ মাসের মধ্যে শ্রেণি মইয়ে ওপর থেকে নিচের দিকে নামতে বাধ্য হলেন তাদের শ্রেণিগত অবস্থানও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। লকডাউনের আগের মাসেও, ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ছিলেন ‘দরিদ্র’, যারা ‘হতদরিদ্র’ গ্রুপে নেমে গেছেন (‘দরিদ্র’ শ্রেণিতেই আছেন তবে ‘দরিদ্রতর’ হয়েছেন), ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ ছিলেন ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’ যারা ‘দরিদ্র’ শ্রেণিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, ১ কোটি ২ লাখ মানুষ ছিলেন ‘মধ্যবিত্ত’ যারা প্রধানত ‘নিম্ন-মধ্যবিত্ত’ গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন, আর ১ কোটি ১৯ লাখ ‘উচ্চ-মধ্যবিত্ত’ যারা ‘মধ্য-মধ্যবিত্তে’ যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। লকডাউনের ৬৬ দিনে শ্রেণি মইয়ের ওপর থেকে নিচে নামতে বাধ্য হওয়া মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ১০ লাখ নয়, আসলে সে সংখ্যা হবে ৬ কোটি ৮০ লাখ। এ দুই সংখ্যার যে পার্থক্য ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ তারা আসলে হতদরিদ্র ছিলেন, আর লকডাউনে হয়েছেন নিঃস্ব-ভিক্ষুক।
কল্যাণকামী অর্থনীতিবিদ ড. বারকাতের ওই গবেষণার ফলাফল এখন দৃশ্যমান। প্রায় দেড় বছর আগে গবেষিত তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের বাস্তবতা আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের খবরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে। হতদরিদ্র ও ভিক্ষুক মানুষের সংখ্যা যে প্রশ্নাতীত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমরা ঢাকা শহরসহ অন্যান্য বড় বড় শহরে বেরোলেই দেখতে পাই। একাধিক বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক রাতের বেলা খাবার বিতরণের চিত্র দেখে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাক থেকে টিসিবির চাল, ডাল, তেল, লবণ কেনার চিত্র দেখে, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপকতা প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক লকডাউন-শাটডাউন ঘোষণা সত্ত্বেও জীবিকার তাগিদে লাখ লাখ মানুষের রাস্তায় নেমে আসা এসবই প্রমাণ করে যে, অধ্যাপক বারকাত শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট যে পরিসংখ্যান গবেষণার মাধ্যমে তার বইয়ে তুলে ধরেছেন ক্রমান্বয়ে তা দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনে হয়ত আরো বেশি করে এ দৃশ্য আমাদের চোখে পড়বে।
ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি), ঢাকা।