ইসলামে কোরবানির শিক্ষা
বিশ্বময় মহামারি করোনার এ ভয়াবহ দিনেও মুসলিম উম্মাহ যথাযথভাবে ইসলামি নিয়মনীতি অনুসরণ করেই কোরবানির ঈদ উদযাপন করছে। আমাদের দেশে ইনশাল্লাহ ২১ জুলাই পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদুল আজহা উদযাপন করব।
ইসলামে কোরবানির গুরুত্ব অতি ব্যাপক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন “এরপর সেই পুত্র (ইসমাইল) যখন তার সাথে দৌড়াবার বয়সে উপনীত হলো, তখন সে (ইব্রাহিম) বললো, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখছি, আমি যেন তোমাকে জবাহ করছি। অতএব তুমি চিন্তা কর, তোমার কি অভিমত? সে বলল, হে আমার পিতা! তুমি যে আদেশ পেয়েছ, তা-ই কর, ইনশায়াল্লাহ তুমি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মাঝে দেখতে পাবে। এরপর তারা যখন উভয়েই আল্লাহ্র সমীপে আত্মসমর্পণ করলো এবং সে তাকে জবাহ করার জন্য কপালের ওপর উপুর করে শোয়ালো, তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছো।’ আমরা এরূপেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা” (সুরা সাফ্ফাত)।
হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির অনুসরণে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ১০ই যিলহাজ তারিখে পশু কোরবানি করে থাকে। ইসলামে এই যে কোরবানির শিক্ষা তা কি কেবল একটি পশু কোরবানির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়ে যায়? আসলে পশু কোরবানি করাটা হচ্ছে একটা প্রতিকি মাত্র। আল্লাহতায়ালা চান মানুষ যেন তার পশুসূলভ হৃদয়কে কোরবানি করে, তার আমিত্বকে কোরবানি করে আর সেই সাথে তার নিজের সমস্ত চাওয়া-পাওয়াকে আল্লাহর খাতিরে কোরবানি করে দেয়।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তার পুরো পরিবারের কোরবানি এমনই ছিল। তারা ব্যক্তি সার্থকে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করেছিলেন। আল্লাহর সাথে প্রেমবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি কোরবানি চান আর এ কোরবানির অর্থ কেবল পশু জবেহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ কোরবানি কারো জন্য নিজ প্রাণের কোরবানিও হতে পারে আবার কারো নিজ পশুত্বের কোরবানিও হতে পারে। আমরা যদি মনের পশুকে কোরবানি করতে পারি তাহলেই আমরা আল্লাহতায়ালার প্রিয়দের অন্তর্ভূক্ত হতে পারব। এছাড়া যত বাহ্যিকভাবে যত বড় পশুই কোরবানি দেই না কেন তা তার কাছে মূল্য রাখে না।
কোরবানি সম্পর্কে মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময় তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, ‘হে লোক সকল! জেনে রাখ, প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানি করা আবশ্যক’ (আবু দাউদ ও নাসাঈ)। ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য লাভ করে অথচ কোরবানির আয়োজন করেনি, সে যেন আমাদের ঈদ গাহের কাছে না আসে’ (ইবনে মাজাহ)। তাই কেউ যদি মনে করে যে, প্রতি বছরই তো কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি এবার এ করোনার সময় না দিলে কি হবে, এমনটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ কোরবানি শুধু একবারের জন্য নয় বরং তা সারা জীবনের জন্য।
কোরবানির মাংসকে তিন ভাগ করাই উত্তম। এক ভাগ নিজেদের, এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের এবং এক ভাগ গরিবদের মাঝে বণ্টন করতে হয়। সামর্থ্য ও বিত্ত বানরাই কোরবানি দিয়ে থাকেন। অনেকে আছেন কোরবানি করার পর আশে পাশের গরিব ও প্রতিবেশিদের মাঝে তা বন্টন করেন। আবার অনেকের লক্ষ্য থাকে এই মাংস কাউকে না দিয়ে ফ্রিজে ভরে রাখার যাতে সারা বছর চলে যায়। গরিবদের ২/১ টুকরা মাংস দিয়ে ফ্রিজ ভরে রাখার প্রবণতা গৃহীণিদেরই একটু বেশি থাকে। কিন্তু এটা মোটেও কোরবানির উদ্দেশ্য নয়।
কোরআন হাদিস এবং বুযুর্গানে দ্বীনের ভাষ্য থেকে যতটুকু জানা যায়, কোরবানির পেছনে যে উদ্দেশ্যটি কাজ করা আবশ্যক তা হলো তাকওয়া বা খোদার সন্তুষ্টি। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার একমাত্র পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কেবল মাত্র খোদার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জবাহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। যে কোরবানির পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি কাজ করে না সে কোরবানি, কোরবানির আওতায় পড়ে না।
আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো কোরবানির চামড়া। কেননা কোরবানির চামড়া এটি জাতীয় সম্পদ। তাই সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে চামড়া যেন কোনভাবেই নষ্ট না হয়। চামড়া যাতে নিখুঁত থাকে সেজন্য চামড়া ছাড়ানোর সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যেন তা কেটে বা ছিঁড়ে না যায়। এটিও জানা প্রয়োজন যে, কোবরানির চামড়ার বিক্রিত অর্থ গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে হয়।
তারপর রয়েছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। ইসলাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। বলা হয়েছে এটি ঈমানের অংশ। ঢাকা শহরে দেখা যায় কোরবানির সময় অনেকেই কোরবানির পশুগুলোকে রাস্তাতেই জবাহ করেন। যার ফলে জনগণের চলা ফেরার যেমন সমস্য হয় তেমনি রাস্তা-ঘাটও নোংরা হয়। একটি শান্তির ধর্মের নাম ইসলাম, কারো কষ্ট হোক এটা ইসলাম কখনই চায় না। তাই যারা রাস্তায় পশু কোরবানি করেন তাদের মনে রাখতে হবে কোনভাবেই যেন অপরের কষ্ট না হয়। পশু জবাইয়ের সাথে সাথে সেই স্থান পরিস্কার করার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।
এবছর করোনার কারণে হয়তো অনেকেরই ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও কোরবানি দিতে পারছেন না। তাই আমার আশে-পাশে কারা কোরবানি দিচ্ছেন না তাদের খোঁজও আমাদের রাখতে হবে। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি তাই গরিব অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েও আমরা তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। আসুন, ঈদুল আজহা গরিব-দুঃখী সবাইকে সাথে নিয়ে করি।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করার তৌফিক দিন।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট, ই-মেইল- [email protected]