অপার সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কেনার কথা ৪৫-৫০ টাকায়। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি। দেখা যায় দেড় লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরুটির চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। অপর দিকে খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু খাসি-বকরির চামড়া অধিকাংশ স্থানে বিক্রি হয়নি।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত শিরোনাম ছিলে ‘পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে চামড়া।’ বলা হয় ২ লিটার বোতলজাত পানির দাম ৩০ টাকা। গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ৩০ টাকায়। ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা উপজেলা সদরসহ ভাবকির মোড়, চেচুয়া বাজার, কুমারগাতা,গাবতলি বাজার, বনবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে, অনেকেই বাড়ির সামনে, রাস্তায় বা আবর্জনার স্তূপের ভিতর ফেলে রাখতে দেখা গেছে।’
এমনই ছিল আরো কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম। ‘ধামইরহাটে পানির দামে পশুর চামড়া বিক্রি।’ নওগাঁর ধামইরহাটে নাম মাত্র দামে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি হয়েছে। দাম না পেয়ে যারা কোরবানি দিয়েছেন তাদের অনেককেই চামড়া ফেলে দিতে দেখা গেছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
‘ময়লার ভাগাড় ও রাস্তায় পড়ে আছে চামড়া।’ সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশিতে চামড়া কেনার কথা বলেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তবে তারা মুখে বেশি দামে চামড়া কেনার কথা বললেও, এখন উল্টোটা বলছেন সাধারণ জনগণ। এর মধ্যে গরুর চামড়ার মূল্য কিছুটা থাকলেও ছাগলের চামড়া বিক্রির পরিমাণ একেবারেই নেই। তাই এসব চামড়ার স্থান হয়েছে ময়লার ভাগাড় ও রাস্তার ধারে।
একটু ভেবে দেখুন, একটি মহল চমড়ার মূল্যকে কোথায় নিয়ে ঠেকিয়েছে।
গত পাঁচ বছরে চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। যদিও এ বছর চামড়ার দাম কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে কিন্তু নির্ধারিত মূল্যে ক্রেতারা চামড়া ক্রয় করতে দেখা যায়নি। ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যেই চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে। ক্রেতাদের কাছে শুনতে হয় চামড়া কিনে নাকি তাদের লাভ হয়না বরং ক্ষতি হয়। তাই ১০০-২০০ টাকার বেশি তারা কোনভাবেই কিনবে না।
অপর দিকে চামড়া এবং চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কাঁচা চামড়ার দাম কমছে কেন, সেই উত্তর মিলছে না কোথাও। এবারে ঈদুল আজহার চামড়া নিয়ে যে কাণ্ডকীর্তি হয়েছে তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এত মূল্যবান একটি জিনিসকে ফেলনা হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় যাচ্ছে বাংলাদেশের জুতা ও চামড়াজাত পণ্য। এতে সামান্যতম সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জন্য চামড়া শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি খাত, যা সুষ্ঠু পরিচালনা ও যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এ খাতের বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না। দেখা যায় গত বছর ঈদুল আজহায় চামড়ার তেমন কোনো মূল্যই ছিল না।
আমরা মনে করি এই অপার সম্ভাবনাময় শিল্পকে ধ্বংসের জন্য একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। এমনটি না হলে গত বছর চামড়ার মূল্য কমিয়ে এটিকে মাটিতে পুঁতে ফেলার বা নষ্ট করার জন্য উৎসাহ জোগানোর সংবাদ পাওয়া যেত না। একটি জাতীয় সম্পদ রাস্তা-ঘাটে ফেলে নষ্ট করা হচ্ছে। যা কোনভাবেই আমরা মেনে নিতে পারছি না।
বাংলাদেশে সারাবছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন ট্যানারিতে। এ সময়ই সবচেয়ে বেশি চামড়া সংগ্রহ করেন ট্যানারি মালিকরা। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগে চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য ন্যূনতম দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে ট্যানারি মালিকদের দাবিতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে ওই দাম কমতির দিকে।
এবারও পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। এ বছর রাজধানীর জন্য লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা, বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাস্তবে কি সরকার কতৃক নির্ধারিত এ মূল্য কেউ পেয়েছেন? আমরা মনে হয় তা কেউ পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে যতজনকে জিজ্ঞেস করেছি তারা ১০০ থেকে ২০০টাকার বেশি চামড়া বিক্রি করেছেন এমন পাইনি।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১১০টি রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার পাদুকা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি।
দেশ-বিদেশে আমাদের চামড়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও একটি মহল এ শিল্পকে ধ্বংসের জন্য উঠে পরে লেগেছে।
এক ধরনের অসাধু ব্যক্তিদের কারসাজিতে দাম না থাকায় গত বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে কাঁচা চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার দৃশ্য দেখেছি। এবছরও এমনটি করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। যা কখনোই একটা দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক নয়। এগুলো দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। অথচ দেশের চামড়া শিল্পে উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।
চমড়ার অর্থ গরীব-দুঃস্থদের প্রাপ্য। গরীবদের পেটে যারা লাথি মারে এবং তাদের হক নষ্ট করে তারা যাই হোক না কেন, তারা কখনই আপনার আমার শুভাকাঙ্খি হতে পারে না।
আমরা চাই এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার প্রয়োজন সে বিষয়ে কতৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থ গ্রহণ করা এবং প্রতিবছর চামড়া নিয়ে যারা সমস্যা সৃষ্টি করে তাদেরকে চিহিৃত করে বিচারের আওতায় আনা। এছাড়া ব্যবসায়ীরা সরকার কতৃক নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় করছেন কিনা এ বিষয়েও নজরদারি করা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট