বাবার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা
আজ ১৯ জুন। বিশ্ব বাবা দিবস। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে প্রথম বাবা দিবস উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন।
আসলে বাবা-মার জন্য ভালোবাসার কোন নিদৃষ্ট দিন বা সময় নেই। বাবা-মার জন্য ভালোবাসা প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। যদিও বাবা-মার জন্য বিশেষ দিন হিসেবে প্রতি বছর নির্দিষ্ট করে একটি দিন পালিত হয়ে আসছে। আসলে বাবা-মার জন্য ভালোবাসার কোন নিদৃষ্ট দিন নেই। সন্তানের জন্য প্রতিদিন বাবা দিবস এবং প্রতিদিনই মা দিবস।
প্রতিটি সন্তানের কাছেই বাবা মানে শক্তি আর সাহস। বাবার প্রতি সন্তানের চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। এই ভালোবাসা বিশেষ কোন একদিনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না।
বাবা মানে একটু শাসন, অনেক ভালোবাসা। প্রতিটি মানুষের জীবনে বাবা ছাদ হয়ে থাকেন। আমাদের বাবাও আমাদের জন্য বটবৃক্ষের ছায়া। ছোট বেলায় বাবা যখন শাসন করতেন তখন খারাপ লাগতো কিন্তু এখন বুঝি বাবার সেই শাসন আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজন ছিল আর আজো কোন ভুল করলে বাবা ঠিক করে দেন।
আমাদের বাড়ির সামনেই বয়েগেছে আঁকা বাঁকা করতোয়া নদী। ছোট বেলায় মন চাইত নদীতে গিয়ে ঝাপাঝাপি করি কিন্তু বাবা সব সময় বারণ করতেন, তাই যেতাম না। নদীতে গোসল করতে যাওয়াটা বাবা ভয় পেতেন আর এজন্যই ভয় পেতেন যে আমাদের না আবার কিছু হয়ে যায়। শরীর খারাপ করবে বলে বৃষ্টিতে কখনো ভিজতেও দিতেন না।
ছোট বেলায় তিনটি বিষয়ে বাবার কঠিন বারণ ছিল। এই তিনটি বিষয় কোনভাবেই বাবা সহ্য করতেন না। প্রথমত নদীতে গোসল করা, দ্বিতীয়ত বৃষ্টিতে ভেজা এবং রোদে বাইরে বেড়ানো। তাই চেষ্টা করতাম এই তিনটি কাজ না করার।
বাবা যদিও বাহিরে একটু কঠিন মনে হয় কিন্তু বাবার ভেতরটায় আমাদের জন্য নিখাঁদ ভালোবাসায় পূর্ণ আর তা সব সময়ই আমরা প্রত্যক্ষ করি। আজো এই তিনটি কাজ আমার দ্বারা হয়না বলেই চলে।
একবার ছোট বেলায় বাবার সাথে আমাদের পুরনো বাড়িতে গিয়েছিলাম গাছের আম পারতে। আবদার করলাম, বাবা আমিও গাছে উঠব। বাবা না করলেন কিন্তু আমার চাপাচাপিতে বললেন ঠিক আছে, সাবধানে উঠবি। আামি আম পারতে লাফিয়ে গাছে উঠলাম, যেই না এক ডাল থেকে অন্য ডালে পা দিলাম ঠিক তখনই ডাল ভেঙ্গে আমি মাটিতে। যদিও বেশি একটু উঁচু থেকে পরিনি, তারপরও আমি ভয়ে চুপ ছিলাম, আমাকে গাছ থেকে পরতে দেখে বাবা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আর বলছিলেন বাবা তোর কিছু হয়নি তো। বাবা সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন, ডাক্তার দেখে বললেন আপনার ছেলের কিছুই হয়নি। এরপর বাবাও হাসছিলেন আর আমি তো মিটমিট করে হাসছিলামই।
বাবা আমাদেরকে শাসন করেছেন ঠিকই কিন্তু কখনও গায়ে হাত তুলেন নি। আমার মনে পড়ে, আমার জীবনে একবারই বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন। তখন আমি ৪র্থ বা ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। গ্রামের এক দুষ্ট প্রকৃতির ছেলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। যদিও তারই দোষ ছিল কিন্তু তার পক্ষ থেকে বাড়িতে বিচার আসে। এ বিষয়ে বাবা অনেক রাগ করেন এবং কঠোরভাবে আমাকে শাসন করে বলেন আর কোন দিন যেন তার সাথে আমি খেলাধুলা না করি। বখাটেদের সাথে মেলামেশা কোনভাবেই বাবা পছন্দ করতেন না। এ বিষয়ে বাবার কঠোর বারণ ছিল। যার ফলে ছোটবেলা থেকেই সঙ্গী হিসেবে ভালো বন্ধুই পেয়েছি। আজ হারে হারে উপলব্ধি করছি বাবার সে দিনের শাসন আমার কতটা উপকার হয়েছে। তাই তো ভাবি, বাবা তুমি আজো আছো বলেই মাথার ওপর ছায়া আছে, তুমি মানে নির্ভরতার আকাশ, তুমি আছো বলে চোখ বুজে নিজেকে নিরাপদ মনে করি।
বাবার বয়স এখন প্রায় আশি। আমার বাবা অতি মেধাবী কিন্তু অতি সাধারণ একজন ভালো মানুষ। সততা আর ন্যায়ের ওপর তিনি প্রতিষ্ঠিত। বাবাকে কখনও দেখিনি নামাজ পরিত্যাগ করতে। ফজরের পর উচুঁ আওয়াজ করে কুরআন তেলাওয়াত করা তার প্রতিদিনের অভ্যাস। বাবার কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজে আমাদের ঘুম ভাঙে। আশি বছর বয়সেও প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাবা ৩০টি রোজা রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি ফোনে বলেছিলাম, বাবা রোজা রাখতে কষ্ট হবে, রোজা না রেখে ফিদিয়া দিয়ে দিব। বাবা বললেন, নারে বাবা, রোজা রাখলেই আমি ভাল এবং সুস্থ থাকি।
প্রায় প্রতিদিন মোবাইলে বাবার সাথে কথা বলি। বাবা অপেক্ষায় থাকেন কখন ফোন দিব। ফোন রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করেন বাবা কেমন আছো। বাবা আমাকে নাম ধরে ডাকেন না বরং বাবা বলেই ডাকেন। করোনার এ দিনগুলোতে বাবা আমাদের জন্য আরো বেশি চিন্তিত থাকেন এবং দোয়া করেন নিরাপদ থাকার জন্য।
করোনাকালীন ঈদুল আজহায় গেলো বছর ঈদের নামাজ শেষে সবাই কোলাকুলি ছাড়াই যার যার মত ঈদ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন কিন্তু এতে কোনভাবেই যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। সামনেই দেখলাম বাবা। কোন কথা না বলে সালাম দিয়ে বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। আহ্! কী প্রশান্তি। বাবার সাথে কোলাকুলি করে যে প্রশান্তি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
বাবাই আমাদের আদর্শ। বাবার আদর্শ, সততা আমাকে মুগ্ধ করে। জনগণের দাবিতে বাবা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করেছেন এবং কয়েকবার নির্বাচিতও হয়েছেন। জনপ্রতিনিধি ছিলেন কিন্তু কখনও আমাদের ঘরে চাউল বা আটার বস্তা আসতে দেখিনি। নির্বাচনের সময় আমাদের পরিবারের কাউকে ভোট চাইতে করো কাছে যেতে দেন নি। তিনি বলতেন, লোকেরা যদি আমাকে পছন্দ করে তাহলে তারা ভোট দিবে আর তাই হয়েছে, কয়েকবার জনগণের সেবা করার সুযোগও পেয়েছেন। নিজের ঘর থেকে খাবার নিয়ে অসহায়দের মাঝে বিতরণ করেছেন। তাই তো এখনও সবার কাছে তিনি একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। আমার বাবা আমার কাছে নির্ভরতার আকাশ আর নিঃসীম নিরাপত্তার চাদর।
আসলে প্রতিটি বাবাই সন্তানের নির্ভরতার ছাদ। বাবা শাশ্বত, চিরন্তন। সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় বাবাকে। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তান বাবার ঋণ কখনো পরিমাপ করতেও পারে না।
সংসারের জন্য কত কষ্টই না করতে হয় একজন বাবাকে। অথচ সেই বাবাকে আমরা অনেকেই কষ্ট দিতেও দ্বিধা করি না। সংসারে বাবা যে কি অমূল্য সম্পদ তা বুঝানো কঠিন।
আসলে বাবার ছায়া বট গাছের ছায়ার চাইতেও বড়। সে তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন।
সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের প্রিয় বাবা-মাকে দীর্ঘায়ূ দান করেন এবং সুস্থ রাখেন।
বাবা দিবসে সকল বাবার প্রতি রইল শুভকামনা ও শ্রদ্ধা। বিশ্বের সকল বাবা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক-এটাই প্রত্যাশা।