পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, আমাদের আত্মমর্যাদা
‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’, মন্তব্যের আলোচনা থামেনি এখনও। এবার নতুন এবং আরও স্পর্শকাতর বক্তব্য এসেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছ থেকে। সরাসরি বলেছেন তিনি, ভারতকে বলেছি শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে। জন্মাষ্টমী উপলক্ষে চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমনটাই বলেছেন তিনি। তার এই বক্তব্যে দেশবাসী স্বভাবত ক্ষুব্ধ হবে, রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আসবে, বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন রকমের আলোচনা-সমালোচনা হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। ...শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। আটাশ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ভারতে বেড়াতে যায়, ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। ...শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।” বক্তব্যটি প্রায় প্রত্যেকটি গণমাধ্যমে এসেছে।
মন্ত্রী যেখানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন সেটা দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী গোপন কোন বৈঠক ছিল না। প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। এমন প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে এমন তিতা সত্য প্রকাশে দল ও সরকার যে বিব্রত হবে তা সন্দেহ নেই। এমনিতেই দেশে আছে ভারতবিরোধী নগ্ন প্রচারণা। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কথাটি সর্বজনবিদিত। আছে সরকারে ভারতের হস্তক্ষেপ বিষয়ক অপ্রমাণিত প্রচারণাও। এই প্রচারণা চলমান থাকাকালে মন্ত্রীর বক্তব্যে প্রচারণাকে শক্ত ভিত্তি দেবে নিশ্চিত।
মন্ত্রীদের বিদেশ সফরের পর সাধারণত আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায় না। কী ধরনের আলোচনা, দ্বিপাক্ষিক অনিষ্পন্ন নানা বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি সে খবরও জানা যায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যেটুকু আসে সেটা নানা অনুষ্ঠানে অথবা অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে। ওটা যথেষ্ট না হলেও এটাই মেনে নিয়েছি আমরা। এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্রে আমরা জানতে পারল সবশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতবর্ষের সরকারকে অনুরোধ করার কথাটাই। মন্ত্রী সবশেষ যখন ভারত সফর করছিলেন তখন সিলেট ভাসছিল বানের জলে। ওই সফর শেষ করে তিনি দেশে ফিরেছিলেন এবং এরপর বন্যার্তদের কাছাকাছি গিয়েছিলেন। উচ্চপর্যায়ের ওই বৈঠকের আর কিছু না জানলেও এবার আমরা ‘সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধের’ যে কথাটা আমরা জানলাম সেটা আর যাই হোক দেশবাসীর জন্যে সম্মানের নয়। একই সঙ্গে সরকারের জন্যেও বিব্রতকর।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোজাসাপ্টা কথাগুলো বলে তোপের মুখে পড়েছেন। ব্যক্তিগত ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন ঠিক, কিন্তু এরমাধ্যমে তিনি কি আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দীনতা সামনে আনলেন না? এজন্যে তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। হতে পারে তিনি সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছেন, বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছেন নিজেও; তবু এর মাধ্যমে দেশবাসী অন্তত জানল কোন পথে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি! এমন নতজানু বক্তব্যের কারণে এতবড় দায়িত্বে থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে নানা আলোচনা হতে পারে, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই তার ব্যক্তিগত অবস্থান নয়; এটাই কি সরকারের অবস্থান নয়? সরকার যদি এমন পররাষ্ট্রনীতির পথ ধরে এগোয় তবে আমাদের প্রতিবাদের দরকার আছে। আমরা প্রতিবাদ করি।
এ কে আব্দুল মোমেন আগেও একবার বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো।’ সম্পর্কের গভীরতা বুঝাতে বক্তব্যের অন্তর্গত ভাব ধরতে অক্ষম অনেকেই সে সময় সমালোচনা করেছিল, এখনও করেন। এনিয়ে আলোচনা নয়। তবে কোথায় কী বলতে হবে এটা বুঝা উচিত রাজনীতিক, বিশেষত মন্ত্রীদের। রাজনীতির মাঠ ও জনগণ উচ্চাঙ্গ সংগীতের শ্রোতা নয় যে অন্তর্গত ভাব ধরতে বসবে। এই মাঠ সবসময়ই উত্তপ্ত এবং অপেক্ষায় অন্যের বক্তব্যের ফাঁকফোকর ধরতে। মন্ত্রী কেন তাদের সুযোগ দিচ্ছেন? এরইমধ্যে সপ্তাহ পেরোয়নি আগের মন্তব্যের রেশ কাটতে যেখানে তিনি বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে’।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন তিনি সিলেট-১ আসনে। এই আসনে আওয়ামী লীগ দলের কোন রাজনীতিককে মনোনয়ন দেয় না। নির্বাচনে জিততে রাজনীতির বাইরের মানুষদেরও মনোনয়ন দিয়ে আসছে। ওখানে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উত্তরসূরি খুঁজতে দুইবছর আগে দীর্ঘদিন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করা এ কে আব্দুল মোমেনকে আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা হয়। এই সময়ে তিনি নানা নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন নানা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে। নির্বাচনের সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের এক কলোনিতে এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘এখানে নির্বাচন যারাই করছে তারা প্রত্যেকেই যোগ্য। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী (বিএনপির মনোনীত প্রার্থী) তিনিও যোগ্য, আমিও যোগ্য। তবে তার চাইতে আমি বেশি যোগ্য’। তার ওই বক্তব্যে অনেকেই নানা কথা বলছিল সত্য, কিন্তু এটা ছিল সারল্যের প্রকাশের সঙ্গে অন্যকে ছোট না করে না দেখার বড় ভাবনাও। সচেতন মানুষমাত্র এমন বক্তব্য পছন্দ করবে ঠিক, কিন্তু রাজনীতির মাঠ...সে ভিন্ন গল্প!
এসব ‘সরল বিশ্বাসে’ বলা কথা জানি। জানি তিনি তার ক্ষেত্রে সৎ ও পরিশ্রমী। তবু বারবার খেই হারিয়ে ফেলছেন। কারণ একটাই রাজনীতি না করা, রাজনীতির নানামুখী চরিত্রের খবর না জানা, না রাখা। পিতামহের কাল থেকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উচ্চশ্রেণির তারা, যাদের সুযোগ ছিল না মানুষের ভাষা রপ্তের, মানুষের নানামুখী চিন্তার সঙ্গে ছিল না পরিচিতি। তাই সব কথা হড়হড় করে বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে। তার অগ্রজ প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজে যা ভেবেছেন সেটাই সরাসরি বলে দিয়ে একাধিকবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন, কিন্তু দিনশেষে তিনি সফল জীবনের অধিকারী, তিনি সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন বলে পার পেয়ে গেছেন। কিন্তু এ কে আব্দুল মোমেনের সফল হতে ঢের বাকি। এখনই তাই সব কথা বলা প্রকাশ্যে বলা উচিত নয় তার। জায়গা বুঝে কথা বলতে পারাটাও বিশেষ যোগ্যতা! এখানে এখনও সফল নন তিনি।
‘ভারতকে অনুরোধ করেছি শেখ হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে’; পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সরকারপক্ষ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সত্য, তবে দেশের নাগরিক অন্তত এই বক্তব্যে বুঝতে পারছে দিন-দিন আমরা আত্মমর্যাদা হারাতে বসেছি। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, দেশের অর্থায়নে আমরা পদ্মাসেতুর মতো মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, এছাড়াও বৈশ্বিক নানা সূচকে আছে বাংলাদেশের নানা অগ্রগতি। কিন্তু এই অগ্রগতির বিপরীতে আত্মমর্যাদার এই অধোগতি আমরা মেনে নিতে পারছি না। টিকিয়ে রাখতে প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপের আবদারের বিষয়ে তাই সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করি। এটা আত্মমর্যাদার প্রশ্ন, ছোটখাটো কোন বিষয় নয়!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।