গ্রামীণ চট্টগ্রামে শীতের সংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও রূপান্তর



মোহাম্মদ আলম চৌধুরী
গ্রামীণ চট্টগ্রামে শীতের সংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও রূপান্তর

গ্রামীণ চট্টগ্রামে শীতের সংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও রূপান্তর

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দেখা যায়। এ পরিবর্তন শুধু পোশাক-পরিচ্ছদে নয় খাবার, খেলাধূলা আর উৎসবেও থাকে। তাই প্রত্যেক ঋতুতেই প্রকৃতির খেয়ালের প্রতি খেয়াল রেখে প্রস্তুতি নিতে হয় ঋতু বরণের, যা গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের জনসমাজের চিরায়ত ঐতিহ্যে পরম্পরায় এবং সমাজ প্রগতির রূপান্তরের ধারাবাহিকতায়।

পৌষ আর মাঘ মাস নিয়েই শীতকাল। কিন্তু আমার নানী বলতেন ‘শীতের জন্মের মাস হচ্ছে ভাদ্র মাস’। ভাদ্র মাসের শেষের দিকেই শীত অনুভূত হতে থাকে। বাঙালির সংস্কৃতিতে শীত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শীতকে কেন্দ্র করে পুরো জাতি মেতে উঠে নানা রকম উৎসবে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হয় পিঠা উৎসব। হরেক রকমের পিঠা দিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর অতিথি আপ্যায়নের চল রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয় আবার ক্ষেত্রবিশেষে আত্মীয়ের বাড়িতেও পাঠানো হয়।
কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে শীতকালে পিঠা মেলার আয়োজনও হচ্ছে। রসনাবিলাসী হিসেবে বাঙালির তো সুনামই রয়েছে। বিচিত্র রকমের পিঠা মনে যেমন আনন্দের সূচনা করে ঠিক তেমনি রসনার পূর্ণতাও দেয়। শুধু তাই নয়, পিঠা এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ারও একটি উপকরণে পরিণত হয়েছে। তাই বাণিজ্যিকভাবে এখন পিঠা বানানো হয়। হাতের সাহায্যে যেমন পিঠা বানানো হয় তেমনি মেশিনের মাধ্যমেও এখন পিঠা বানানো হচ্ছে। বিভিন্ন রঙ আর নকশায় খচিত পিঠা দৃষ্টিনন্দন আর রুচির পরিচায়ক, যা বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতির নান্দনিক উপমা।

শীতের সকালে গাঁছি কাঁধে করে খেঁজুরের রস বিক্রি করে। সামর্থ্যানুযায়ী যে যতটুকু পারে সংগ্রহ করে রসনা তৃপ্ত করে। শুধু তাই নয় আঁখের গুড় দিয়েও শীতকালে বিভিন্ন রকমের পিঠা বানানো হয়। খেঁজুরের রস দিয়ে রাফ বানানো হয় আর সেই রাফে ভাপা পিঠা ও চিতল পিঠা চুবিয়ে খেতে দারুণ লাগে।

শীতকালে চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি বড়ই বৈচিত্র্যময়। বাচ্চারা আমপারা বুকে জড়িয়ে মক্তবে ছুটে আর রাখাল গরু-ছাগলের পাল নিয়ে মাঠে যায়। কাঠুরিয়া কাঠ কাটতে যায় বনে। বিভিন্ন ধাচের পেশাজীবিরা পেশানুযায়ী কাজে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার আগে-ভাগেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা থাকে শীতের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার্থে। পাহাড় ও সমুদ্রের রাখিবন্ধনে চটগ্রামে দৃশ্যমান হয় বহুবিচিত্র এক সাংস্কৃতিক প্রভা, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনন্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রোজ্জ্বল।

কুয়াশামাখা ভোরেই চিড়া আর মুড়ির মোয়া কাঁধে বেপারি পাড়ায় পাড়ায় ডাক হাঁকে। গুড়ের জিলাপী মাটির হাঁড়িতে করে গ্রামের আনাচে-কানাচে ছুটে বেপারি। কনকনে শীতে তাজা মচমচে মোয়া আর গরম জিলাপীতে রসনা তৃপ্ত হয়।

টাকা অথবা ধান-চালের বিনিময়ে নগদ কিংবা বাকিতে বিকিকিনি হয়। বয়স্করা কাঁথা-কম্বল, শাল জড়িয়ে আর জাম্পার ও সোয়েটার গায়ে কম বয়স্করা রাস্তার দিকে খেয়াল রাখে কখন বেপারি আসে।

শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফুলপিঠা, পাটিসাপটা, চিতলপিঠা, পাকনপিঠা, গুরাপিঠা, ভাপাপিঠা (ধুঁইপিঠা) বেশ জনপ্রিয়। দিন পরিবর্তনের পালায় এখন আরও বহু রকমের পিঠা বানানো হয়। এখন অবশ্য নানামাত্রিক ব্যস্ততার কারণে আগের সেই উৎসবমুখরতা নেই গ্রামীণ জীবনে।

গ্রামীণ জনপদে শীতের সকালে আগুন পোহানোর সংস্কৃতি বেশ পুরনো। উঠানের এককোণে লতাপাতা আর লাকড়ি দিয়ে আগুনের উত্তাপ নিতে সবাই গোল হয়ে বসে পড়ে। আগুন পোহানোর কালে নানা রকমের গল্প চলে আর লাল টুকটুকে কয়লায় ভাপাপিঠা পুঁড়ে খাওয়ার ধুম চলে। সত্যি বলতে কি এ সংস্কৃতি এখন অনেকাংশে সচরাচর গোচরীভূত হয় না। নগরায়নের আছরে গ্রামীণ সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন আর বিদায় নিয়েছে ইতোমধ্যে অনেক কিছু। পালাবদলের প্রহরে গ্রামীণ সংস্কৃতিও নানা রূপান্তরের সম্মুখীন।

ছোটবেলায় দেখেছি পাশ্ববর্তী কুমোরপাড়া থেকে মাটির তৈরি নানা রকমের তৈজসপত্র কাঁধে করে কুমোর ফেরি করতো প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে। নানা রঙের নকশা করা মাটির ব্যাংক আর ছোট আকারের হাড়ি যেগুলোকে আমরা কুয়াশা বলতাম তা কিনে খুশিতে আত্মহারা হতাম। মাটির ব্যাংকে পয়সা জমানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা ছিল। এখন কুমোর পাড়া আছে কিন্তু কুমোরের পেশা নেই। তাঁরা পূর্ব-পুরুষের পেশা ছেড়ে বিভিন্ন রকমের কর্মে যোগ দিয়েছে।

স্কুল ও মক্তব বন্ধের দিন শীতের সকালে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিলে সদ্য ধানকাটা সারা হওয়ার পর ইদুরের গর্তে ধান কুড়োতে যেত। আইলের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে কিংবা কোদাল দিয়ে ইদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করতো আর সেই ধান দিয়ে নিজের পছন্দ মতো কিছু কেনাকাটা করতো কিংবা মোয়া ও জিলাপী খেত। এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে এ সংস্কৃতি রয়েছে।

শীতকালে গ্রামে বিয়ের ধুমধামও বেশি হয়। আগে গ্রামের বাড়ির উঠানে বড় তাঁবু দিয়ে পাটি ও ছফ (বিশেষ ধরনের পাটি) বিছিয়ে আপ্যায়ন করা হতো এখন যেটা অতি নগন্য পরিমাণে হয় আর এখন সেটা কমিউনিটি ক্লাবে সম্পন্ন হয়।

মাঘ মাসে শীতের বেশ তীব্রতার কারণে মাঘের শীত নিয়ে বচনও রয়েছে যা আমি আমার নানীর মুখ শুনেছিলাম আর আঞ্চলিক প্রবচনে তা হচ্ছে ‘মাঘের শীতে বাঘ গুজুরে (কাঁদে)’। তাই মাঘ মাসের শীতে থাকে কামড়যন্ত্রনা। মাঘ মাসে পুকুরের পানিও কমতে থাকে আর এ সময় পুকুরের মাছ দিয়ে নানা পদের রেসিপি তৈরি করা হয়। শীতকালীন সবজি দিয়েও নানা প্রকার ভর্তা বানানো হয়।

শীতের সন্ধ্যায় আমরা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে শিয়ালের ডাক শুনতাম। শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকের সাথে সাথে আমাদের কুকুর টাইগার আর রাজুইল্যাও ঘেউ ঘেউ ডাকে কানফাটা আওয়াজ তুলতো। দুই বিরোধী শিবিরের চিৎকার চেচাঁমেচিতে ছাগল আর মুরগীর ঘরে খিল দিতো আমাদের রাখাল মন্তাজ মিয়া। হালে চারপাশের অসভ্য মানুষের কুৎসিত চিৎকারের কাছে হার মেনেছে পশুদের প্রাকৃতিক কোলাহল!

জলবায়ু পরিবর্তনের এবং সামাজিক বিন্যাসের অধঃপতনের কারণে শীতের সেই আমেজ, অনুষঙ্গ ও তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে বহুলাংশে। ইতোমধ্যে ঋতুচক্রে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা যারা প্রত্যন্ত গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শীতের যে অমোঘ স্মৃতি তা ভবিষ্যতে 'রূপকথার গল্পে' রূপ নেবে। শীতের রাতে উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলা, খড়ের গাদায় লাফালাফি, প্রতিবেশির বাড়িতে ওয়াজ মাহফিলে যাওয়া, কিচ্ছা-কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া, মুয়াজ্জিনের আজানের পর আস-সালাতু খায়রুম মিনান নাউম বলে নামাজের দিকে আহ্বান জানিয়ে মসজিদে যেতাম।

আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন পাল্টে গেছে। বৈশ্বিক প্রভাবে গ্রাম এখন আর শাশ্বত-গ্রাম নেই। শীতের রাতে এখন আগের মতো প্রাকৃতিক কোলাহলও নেই। শীত মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে শীতের আগমনের আগে-ভাগেই কাঁথা সেলাইয়ের ধূম পড়ে যেত। এখন এসব আর চোখে পড়ে না।

ঘন গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ গ্রাম এখন বিরান ভূমি। বন উজাড় করে ইটের ভাটায় লাকড়ি জ্বালানোর কারণে বাড়ির ফলদবৃক্ষও রক্ষা পাচ্ছে না। গ্রামীণ খেলাধূলায়ও ব্যাঘাত হচ্ছে মাঠ সঙ্কট ও রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে। শীতকালে রোদের তেজ কম থাকার কারণে দুপুরের পরেই বিলে ডাংগুলি, ফুটবল হা ডু ডু আর ভলিবল খেলার আয়োজন হতো। রাস্তার সরুপথে চলতো মার্বেল খেলা। এসব ক্রমশ চলে যাচ্ছে স্মৃতির অতল গর্ভে।

শীতকাল চট্টগ্রামবাসীর, বিশেষত লোকায়ত গ্রামীণ সমাজের কাছে শুধু একটি ঋতুর নাম নয়- সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যা নানা পরিবর্তন ও রূপান্তরের আঘাতে ক্রমেই অপসৃত।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

স্মৃতিতে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শামীম শিকদার



সামিয়া মহসীন
একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২১ মার্চ রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিশিষ্ট ভাস্কর শামীম শিকদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান এই গুণী শিল্পী ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ৭০ বছর বয়সী এই ভাস্কর কার্ডিওভাসকুলার, শ্বাসতন্ত্র এবং কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে শামীম শিকদার ২ সন্তান রেখে গেছেন। চারুকলা প্রাঙ্গণে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে ।

অসম্পূর্ণ কিছু কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যেই কয়েক মাস আগে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। ঢাবির চারুকলা অনুষদে জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যটি আবার নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুয়ের্নিকা ভাস্কর্যও নতুন করে করার পরিকল্পনা ছিল শামীম শিকদারের।


ঢাবির চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা' এবং ফুলার রোডে 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' নির্মাণ করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদীতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়। এই ভাস্কর্য টি যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সিমেন্ট, ব্রোঞ্জ, কাঠ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাদা, কাগজ স্টিল ও গ্লাস ফাইভার মাধ্যমে কাজ করেছেন। প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদার শামীম শিকদারের আপন বড় ভাই।


শামীম শিকদার যখন ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন কখনো তাঁর পরণে থাকতো জিন্স আর সাদা টি শার্ট। আবার কখনো সাদা শার্ট প্যান্ট । সাদা রঙ; তাঁর প্রিয় রঙ ছিল বলেই মনে হত। কপালে কখনো কখনো  ব্যান্ডানা বাঁধতেন। সেই আশির দশকে এমন একজন ভাস্কর শিল্পীর পোশাক সেই সময়ের মানুষকে ভীষণভাবে অবাক করতো। দু’হাতে যতো  কাজই করুন না কেন, ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরাই থাকতো। তখন তো এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলে উনার কাজ করার মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখা যেত। তাঁর সেই কাজগুলো যেগুলো তিল তিল করে ভালোবাসা আর শ্রম দিয়ে তিনি করেছিলেন সেই ভাস্কর্যগুলো ঠাঁই পেয়েছে ফুলার রোডের সড়ক দ্বীপে। ফুলার রোড এলাকায় ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’-এ  তাঁর করা ১১৬টি ভাস্কর্য ঠাঁই পেয়েছে। এই ভাস্কর্য পার্ক টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে অলঙ্করণ করেছে। এখানে তিনি আরও ১৩৪টি ভাস্কর্য তৈরির কাজের উদ্দেশ্য নিয়েই দেশে আসেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।


শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ১৯৯৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনার স্টাইল এবং কাজের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার তো মনে হয় আশির দশক থেকে আজ অবধি কেউ তাঁকে ছুঁতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একজন নারী স্রোতের বিপরীতে চলেও তাঁর রুচি, শিক্ষা ও কর্ম দিয়ে কিভাবে স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন। শামীম শিকদার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নারী বিদ্বেষীরা সেদিনও ছিলো, আজও আছে। তবে তাঁর মতো সাহসী নারী শত বছরে হয়তো একবারই জন্মে। বেশিরভাগ সময়েই মোটরবাইক চালিয়ে চলাচল করতেন। সেই সত্তর আশির দশকে এমনটা ঘটনা আসলেই বিরল ছিল। শখের বশে জুডো শিখেছিলেন।

এমন দেশপ্রেমী শামীম শিকদারদের কখনোই মৃত্যু হয়না। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালির মননে, বাঙালির চেতনায়। এই কিংবদন্তীর প্রতি রইল শত সহস্র সালাম।

সামিয়া মহসীন‚ লেখক,নাট্যশিল্পী, তে কথামালা সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলন নেতা।

;

যাত্রীরাই ইউএস-বাংলার এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এশিয়ার আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো বাংলার গর্ব ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে শুনতে হয় না ‘নয়টার প্লেন কয়টায় যাবে’। শুনতে হয় না যাত্রীদের কাছ থেকে ‘ফ্লাইট কি অন-টাইম’? শুনতে হয় না ‘আপনাদের প্লেন পৌছানোর পর লাগেজ পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়’? এই প্রশ্নগুলো না শুনতে পারাই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পরিচালনার স্বার্থকতা।

সুনামের সাথে দশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে ইউএস-বাংলা। ঢাকা থেকে যশোর রুটে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরু করার পর আজ অবধি শতকরা ৯০ ভাগের অধিক ফ্লাইটই অন-টাইম। আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালুর পর থেকেই ফ্লাইট গন্তব্যে পৌঁছানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারী এক অনন্য উদাহরন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রথমবারের মতো ইউএস-বাংলা ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বৈশ্বিক এভিয়েশনের মানচিত্রে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো শুনলে মনে হয় দেশের এভিয়েশনের কি করুন দশাই না ছিলো এয়ারলাইন্সগুলোর। প্রশ্নগুলোর সত্যতা কতটুকু বাস্তব হলেই স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দিনের পর দিন যাত্রীদের মনে বাসা বেঁধে আছে। প্রশ্নগুলোর সত্যতা প্রমান করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। একটি যাত্রীবান্ধব এয়ারলাইন্স হিসেবে নানা পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা।

বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যাকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ এভিয়েশনে অগ্রসর হতে চেয়েছে। অবকাঠামোগত সমস্যা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পরিবহননীতির অস্বামঞ্জস্যতা, জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা, বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত অ্যারোনোটিক্যাল ও নন-অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ।

এছাড়া বিশ্ব মার্কেটের সাথে জেট ফুয়েল প্রাইসের প্রার্থক্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচলের ক্ষেত্রে দ্বিমূখী নীতি, এয়ারক্রাফট কিংবা এয়ারক্রাফট পার্টসের অতিরিক্ত কাস্টমস্ ডিউটি নির্ধারন, যা বাংলাদেশ এভিয়েশনে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলেই প্রতীয়মান।

নানাবিধ অস্বামঞ্জস্যতা থাকার পরও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলার আকাশে তথা বিশ্বের আকাশে উদীয়মান সূর্য হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছে। মাত্র দশ বছর সময়ে বিশাল জনগোষ্টির বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনের যাত্রীরা পূর্ণ আস্থা রেখেছে ইউএস-বাংলার উপর। দু’টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলায় এখন ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৮টি এটিআর৭২-৬০০ এয়ারক্রাফটসহ মোট উনিশটি এয়ারক্রাফট রয়েছে বিমান বহরে।

ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্বপ্নযাত্রার স্বপ্ন যেন আকাশ সমান, স্বপ্নের বিস্তৃতি আর বাস্তবায়ন চলছে সমান্তরালে। দেশের এভিয়েশনকে নিয়ে যেতে চান সুউচ্চ মর্যাদায়। আজ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিযোগিতা করছে এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এর মতো বিশ্ববিখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে।

স্বল্পতম সময়ে ইউএস-বাংলা বাংলাদেশী যাত্রীদের সেবা দেয়ার মানসে দুবাই, শারজাহ, মাস্কাট, দোহা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, গুয়াংজু, মালে, চেন্নাই ও কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আগামী মে –জুনে ইউএস-বাংলা দু’টি ৪৩৯ সিটের এয়ারবাস ৩৩০ এয়ারক্রাফট বিমান বহরে যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। যা দিয়ে এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য আর বাংলাদেশী যাত্রীদের আকর্ষণ সৌদি আরবের জেদ্দা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে ইউএস-বাংলা।

ইউএস-বাংলা এয়ারলা্ইন্সে ২৫০০ এর অধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ব্যবস্থাপনা পরিষদের সুচিন্তিত দিক নির্দেশনা এবং যাত্রীদের আস্থা ইউএস-বাংলাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে।

ইউএস-বাংলা পরিবারের সকল সদস্য আর যাত্রীরাই এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। যাত্রীদের আস্থাই ইউএস-বাংলার অগ্রযাত্রার মূল পাথেয়।

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

ফলস এলার্ম ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়া



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বসন্তের ‘হানামি’বা চেরিফুল ফোঁটার মৌসুমে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মজা করা হয়েছিল। রাতে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। সারাদিন লম্বা ড্রাইভ করে চেরি বাগান ঘুরে ঘুরে বহুদূরের ওপেন লেকে মাছ ধরে সবাই ক্লান্ত। মাছের বারবিকিউ রাতের খাবারের একটি মেন্যু। কিন্তু বাইরে হঠাৎ ঝির ঝির বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ক্যাম্পাসের চেরিতলার স্পট পরিত্যাগ করে সবাই আমাদের ডর্মের দ্বিতীয় তলার হলঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ফ্রি চুলায় রান্নাসহ সব ব্যবস্থা ছিল।

সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না-বান্নার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশের ওসব পার্টিতে কারো বাবুগিরি করা চলে না। সবাই খুশীমনে সবকাজে অংশ নেয়ার নিয়ম। রান্না শেষে খাবার সাজানো হয়েছে। এমন সময় ডর্মের ‘ফায়ার এলার্ম’ বেজে উঠলো। বেশ কর্কশ স্বরে একবার, দুইবার নয়- তিনবার বাজতে লাগলো। উপরের তলায় কোথাও আগুন লেগেছে এই ভেবে সবাই অতি দ্রুত হলঘর থেকে বের হয়ে বাইরের পার্কিং লটে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর জানা গেল আমাদের ভবনে আগুন লাগেনি। আমাদের মাছ বারবিকিউ করার চারকোলের অতিরিক্ত ধোঁয়ায় এক্সজস্টর চালু করে না দেয়ায় বদ্ধ কিচেনের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন আগুনের ধোঁয়া আঁচ করে গোটা ভবনে জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে আগুনের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সবাই জরুরি নির্গমণ পথ অনুসরণ করে নিরাপদে নিচে চলে গেছে।

তখন মনে হয়েছিল- কত সেন্সেটিভ ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন! একটু বেশিমাত্রার ধোঁয়ার সন্ধান পেলে আর রক্ষা নেই। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলার্ম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। এই মেশিন জাপানের সব ভবনের সবঘরেই লাগানো থাকে। শুধু দাউ দাউ আগুন নয়, ধোঁয়ার সূত্রপাত হলেই সেগুলো বেজে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। যাহোক, যারা সেবছর নতুন গিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পাসে তারা এলার্ম শুনে অনেকটা ভয় পেয়েছিল। আমরা যারা পুরনো বাসিন্দা ছিলাম তারা এরকম ফায়ার এলার্ম অনেকবার শুনেছি। যেগুলো ছিল সতর্কতামূলক মহড়া মাত্র। পরে সে রাতে আমাদের পার্টি ঠিকমতোই শেষ হয়েছিল।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের এক আধুনিক বহুতল আবাসিক ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে গেলে ১২ তলা থেকে দুজন লাফিয়ে নিচে পড়লে মারা যান। ঐ অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ২২ জন আহত হয়।

জানা গেছে, সেই ভবনটিতে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। জরুরি নির্গমণ পথ ছিল। ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন প্রতিটি ফ্লোরে লাগানো ছিল। তবে অনেকে ফায়ার এলার্ম শোনেননি। যারা শুনেছিল তারা ভেবেছে সেটা ছিল ‘ফলস্ ফায়ার এলার্ম’! অথবা রাস্তা দিয়ে অ্যম্বুলেন্স জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সব সময় যাতায়ত করে। সেরকম কিছু একটার শব্দ হতে পারে। তাই তারা এলার্মের গা করেননি। আর এরকম একটি আধুনিক ভবন যেখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অগ্ন্কিান্ডের সময় বাইরে না বেরিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকই ভাল!

অর্থ্যাৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো হলেও সেগুলোর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান তাদের সবার মধ্যে ছিল না। তাইতো একজন বাবুর্চি ও একজন গৃহকর্মী জরুরি নির্গমণ পথ দিয়ে বের হবার চেষ্টা না করে আতঙ্কে ১২ তলার বেলকুনি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রতি মানুষের ভয় বেড়েছে। কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। পুরাতন বড় বড় ভবনে এত আধুনিক মানের ফায়ার ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো যন্ত্রপাতি বসানো না হলেও অধূনা এব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বিল্ডিং কোডের মধ্যে ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার প্রয়োজনীয় যথপোযুক্ত ব্যবস্থা রাখার আইনী বিধান রয়েছে। এটা অমান্য করলে ভবন মালিকের শাস্তি অবধারিত।

তবে বিল্ডিং কোডের এথিকস্ মেনে আংশিক কাজ করে পুরো কাজের জন্য সনদ তুলে নিয়ে ঘরে রাখলেই মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো কঠিন। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ভবনে বিল্ডিং কোডের এথিকস শতভাগ মেনে আধুনিক ফায়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন।

পাশাপাশি এলার্ম বাজলো আর আমি শুনেও ঘুমিয়ে থাকলাম সেট করা হলে বিপদ অনিবার্য। অনেক অলস ব্যক্তি জরুরি কাজের জন্য ঘড়িতে জেগে ওঠার সময় এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এলার্ম ঠিকসময় বেজে উঠলে রাগ করে ঘড়িকে থাপ্পর দিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পরিণতি সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবেন না। এমন বদঅভ্যাস থাকলে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে না ঘুমানোই শ্রেয়।

যেটা ঘটতে শোনা গেছে গুলশানের বাড়ির বাসিন্দাদের মুখ থেকে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের জরুরি ফায়ার এলার্ম শুনেছেন কিন্তু সেটাকে তারা ‘ফলস এলার্ম’ ভেবেছেন। তাই ভবনের বাইরে যেতে চাননি। এরূপ বিপদের সময় এটা শুধু নিতান্ত অবহেলাই নয়- চরম হেঁয়ালীপনার নামান্তর। এরকম হেঁয়ালীপনা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

তাই এই অবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ঘন ঘন সতর্কতামূলক মহড়ার আয়োজন করা। আমাদের দেশে যে হারে সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে এবং যেভাবে মানুষ বহুতল ভবনে বসবাস করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে সেই হারে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি।

আজকাল বহুতল ভবনে ফায়ার প্রতিরোধী স্প্রে, ফায়ার প্রতিরোধী গ্যাস সিলিন্ডার, পানির পাইপ, মুখোশ, পোশাক ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। অনেক অফিসের বিভিন্ন তলার কোণায় কোণায় এসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাজানো থাকে।

কিন্তু কথা হলো সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। কারণ, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা বেশি পুরনো হয়ে গেলে সেগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রতি তিন বা ছয় মাস পর পর সেসব জিনিষ ব্যবহার উপযোগী আছে কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য জরুরি মহড়ার আয়োজন কার উচিত। বিপদের সময় সেগুলো ঠিকমতো সেবা দেয় না। আবার অনেকেই সেসব নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করতে জানেন না। এসব জিনিষের মেয়াদ পার হলে সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নিরাপত্তা কিট্স কেনা উচিত।

এজন্য প্রতিটি ভবনে অফিসে, কারখানায় বাধ্যতামূলক বাজেট রাখার নির্দেশনা বস্তবায়ন করা উচিত। উঁচু অফিস, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বসত ঘরের প্রতিটি কক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যারা একটু ধোঁয়া পেলেই জরুরি সংকেত দিবে।

এছাড়া হাসপাতাল, তেলের ডিপো, পাম্প, গুদাম, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এমনকি পল্লী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া গ্রহণ করে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে সচেতন করার পদক্ষেপ হাতে নেয়া উচিত।

সেসব মহড়ায় বাড়ির বা অফিসের ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক করা উচিত। কারণ প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে বিপদের সময় একটি শিশুও অনেক মূল্যবান জান-মাল রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিটি বিপর্যয় ঘটে যাবার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, বোর্ডসভা করা হয়। কিন্তু যেসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলো নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক দায়িত্ব পালন বা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় কি-না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ও পুরনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরখ করতে ঘন ঘন অগ্নি-নির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করা খুব জরুরি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাপানের কার্যকরী সহায়তা



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। জাপান সরকার ২০১৭ সালে এই সংকট শুরুর পর পরই রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসাবে ৪মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। একই বছর রোহিঙ্গা শিশু, নারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানীয়দের জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য জাপান১৫.৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। সংকটের প্রথম ৬ মাসে অতি প্রয়োজনীয় এই সহায়তা পাওয়ায় ইউনিসেফ তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পেরেছিল এবং এজন্য সংস্থাটি জাপান সরকার ও জনগণের কাছে সেসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো মিয়ানমারকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরকে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানায় ।জাপান সে সময় মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে জন্য ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জাপান মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত। জাপান সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাবে। ২০১৯ সালে জাপান রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে ৯৯.২মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল।

জাপান সরকার সঙ্কট সমাধানে সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে এবং জাপান বিশ্বাস করে যে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন রাজ্যে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা মিয়ানমারের জন্য অপরিহার্য। জাপান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে ‘আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানায় এবং এই সনসজা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাপান সরকার মিয়ানমারকে এই অনুরোধ জানিয়ে যাবে। ২০১৯ সালে, জাপান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং দুই দেশের মধ্যে সংলাপ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছিল। জাপান রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান চায় তাদের দীর্ঘস্থায়ি অবস্থান উদ্বেগজনক বলে মনে করে। জাপান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চলমান আলোচনায় সহায়তা করতে আগ্রহী যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হয়।

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। জাপান এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। জাপান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে এই সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। উভয় দেশে জাপানের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। ৩১০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে করছে। দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতাবোধ থেকে জাপান রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর সমাধানের জন্য তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশে কর্মরত জাপানের রাষ্ট্রদূতগণ বিভিন্ন সময়ে বহুবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। জাপানিরা ব্যক্তি, সাংগাঠনিক ও সরকারি ইত্যাদি নানা পর্যায়ে সমস্যাটির একটি স্থায়ী ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপানের জনগণ, নানা সংগঠন ও জাপান সরকার অবিরত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সহায়তা চলমান রেখেছে। কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, প্রত্যাবাসনও বাস্তু সমস্যা সমাধানকল্পে জাপান সরকার মিয়ানমার সরকার, আসিয়ান ও জি-৭ ইত্যাদি নানা আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। জাপান প্রলম্বিত রোহিঙ্গা সমস্যার একটি টেকসই সমাধান চায় এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশকে যেকোন ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে জাপান। ‘অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ বাস্তবায়ন করা গেলে এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাপান বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করে যাবে।

২০২২ সালের ২২ নভেম্বর, ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য জাপান ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) মধ্যে ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন বয়সী নারীদের নিরাপত্তা এবং কিশোর ও যুবকদের ক্ষমতায়নের জন্য এই অর্থ ব্যয় করা হবে। জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাকেই শুনসুকে জানিয়েছে যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্যাম্পে নতুন শিশুর জন্মের ফলে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই মাদক ও অস্ত্র পাচারের সাথে জড়িত।

গত পাঁচ বছরে কোনো রোহিঙ্গাই দেশে ফিরে যেতে পারেননি। প্রত্যাবাসন চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হলেও সরকার উন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদেরকে তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের আহ্বান জানিয়ে আসছে। জাপান কিছু রোহিঙ্গাকে সেদেশে পুনর্বাসনের কথা ভাবছে বলে জানিয়েছে জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। জাপান ২০২২ সালে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য ২ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার দিয়েছে, ২০২১ সালে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। জাপান, কক্সবাজার ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার সংকট নিরসনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।

রাখাইনের পরিস্থিতি নিরাপদ না হওয়াতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না। জাপানের ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ নিপ্পন ফাউন্ডেশন ও সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানইউহেই সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় রাখাইনে ২০২২ সালের জুলাই থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ বন্ধে রাজি হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী, এরপর যুদ্ধরত দুইপক্ষ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। এর ফলে রাখাইন অঞ্চলে এখন আপাত শান্তি বিরাজ করছে। ইউহেই সাসাকাওয়া মিয়ানমার সরকার ও সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘জাতীয় ঐক্যের’ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।২০১৯ সালেও সাসাকাওয়ার মাধ্যমেআরাকানে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল।২০২০ সালে জাপান সরকার তাকে মিয়ামারে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান করে পাঠায়।সে সময় এনএলডির সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল, তবে সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় আরাকানে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বোঝা যায় যে রাখাইনের রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে সাসাকাওয়ার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে জাপান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রেখে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে বলে জানিয়েছে।

বাংলাদেশে নবনিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাপানের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।২০১৭ সালের পর থেকে, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলোর মাধ্যমে কক্সবাজারের পাশাপাশি ভাসান চরে বিভিন্ন সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে জাপান। এর মধ্যে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, পানি স্যানিটেশন স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ), আশ্রয়, সুরক্ষা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহায়তা রয়েছে।বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে জাপান সরকার ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি ৪.৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। এ সহায়তা কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বাড়বে এর ফলে রোহিঙ্গারা ক্রমহ্রাসমান মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্ষম হবে। এর পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ঝুঁকিতে থাকা নারীরা বিভিন্ন কারুশিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ ও নতুন আয়ের সুযোগ পাবে। ভাসানচরে জাপানের এই সহায়তায় ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও জীবিকামূলক কার্যক্রম সম্প্রসারণে কাজ করবে। জাপান সরকার ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের অন্য সংস্থা ও এনজিওগুলোকে এ পর্যন্ত ২০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসান চরে রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়ন এবং আশ্রয়কেন্দ্রের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম) ৫.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান সরকার। জাপান রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে আইওএমসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করবে। জাপান সরকারের অব্যাহত সহায়তা আইওএমকে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং ভাসান চরের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা দিতে সাহায্য করবে। এই সহায়তা আরও ভালো বসতি, সুরক্ষা এবং জীবিকার সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করবে। সাইট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাইট ডেভেলপমেন্ট (এসএমএসডি) প্রকল্পের মাধ্যমে ভাসান চরের রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নয়ন হবে এবং উন্নত জীবিকার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা নারী ও যুবকদের আত্মনির্ভরশীল করবে। জাপান আইওএম ও অন্যান্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশে এনজিওগুলোতে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা করেছে। জাপান রাখাইনের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি উন্নয়নে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে দারিদ্র পীড়িত রাখাইনের জনগণের জীবনমান উন্নত হবে এবং ফলশ্রুতিতে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে চলমান বৈষম্যে কমে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে।জাপানের নিপ্পন ফাউন্ডেশন রাখাইনে সাফল্যের সাথে মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভুমিকা রেখেছে। চিন ও রাখাইনদের কাছে এই সংস্থাটি এবং এর চেয়ারম্যানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে তারা রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে চলমান পরিস্থিতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।রাখাইনে উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরকে আত্মকর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ দিলে তারা ফিরে গিয়ে রাখাইনের উন্নয়নেও ভুমিকা রাখতে পারবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘয়িত হলে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ক্রম অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জাপান রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তরে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে পারে।

আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা ভাসান চরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে জাপান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একত্রে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর উপর থেকে চাপ কমিয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে চলছে, চলমান বৈশ্বিক সমস্যার কারনে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীঅনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি, তাই জাপানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখা উচিত। এ যাবতকাল জাপানের গৃহীত কার্যক্রম প্রশংসনীয় এবং ভবিষ্যতে জাপানের সক্রিয় অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;