রোহিঙ্গা ক্যাম্প: সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হতে দেয়া হবে না



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নতুন বছরের শুরু থেকেই রাখাইনে আপাত শান্তি বিরাজ করছে। এর আগের কয়েকমাস রাখাইন ও চীন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলায় সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। নিপ্পন ফাউন্ডেশনের মধ্যস্থতায় আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ বিরতির ফলে বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। কিছুদিন পর রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে আসছে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা। ঠিক এই সময়ে গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে শূন্যরেখার ওপারে রোহিঙ্গা শিবিরে দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা স্যালভেশন অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মধ্যে সংঘর্ষের পর শূন্যরেখার ওপারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিবির জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে এলাকাটা আরএসওর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাখাইনের পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে এবং প্রত্যাবাসন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হলেই সাধারণত মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে ও ক্যাম্পগুলোতে এ ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার, মাদক চোরাচালানের মতো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে।রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের ভূমিকা ও আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এপিবিএনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শিবিরে নির্যাতন, হয়রানিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলেছে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও শক্তি প্রদর্শনের জন্য রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, আশ্রয় শিবিরে আত্মগোপনকারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে যা আশঙ্কাজনক। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে পারে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকার থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। সীমান্তের ওপারে এসব অস্ত্র থাকায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে অভিযান চালিয়ে এগুলো উদ্ধার করতে পারছে না।প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে মাদক ও মানবপাচারের জন্য পরিচিত মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে এসব অস্ত্রের চালান আসে। আরাকান আর্মিও থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়িদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনে, তাদের কাছে চীনের তৈরি অস্ত্র এবং গোলাবারুদও আছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেনবী হোসেনের দল প্রভাবশালী সন্ত্রাসীদল। বলা হয়ে থাকে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এবং তাদের সহযোগিতায় সে এই সন্ত্রাসীদল গঠন করেছে। মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে নবী হোসেন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মাদকের চালান আসে নবী হোসেনের দলের মাধ্যমে, তারা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে গড়ে ওঠা অনেক ইয়াবা ও আইসের কারখানাও নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৯৬ শতাংশ ইয়াবা টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে আসে এবং বহু রোহিঙ্গা এই কাজে জড়িত। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মাদকপাচারের পাশাপাশি নিরাপত্তাঝুঁকি ও নানা ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরসা ও আল-ইয়াকিন বাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছে। এইসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর নেতারা ক্যাম্পগুলোতে বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্তহয়ে উঠেছে। এই দলগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরোধী এবং তাদের নেতারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। এজন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করা সংগঠনগুলোর সাথে তাদের বিরোধ চলমান এবং সুযোগ পেলেই তাদের নেতাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে। নানা ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে আরসা ও আল-ইয়াকিন রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষাকারী পক্ষের শক্তি নয় বরং তারা মিয়ানমারের চলমান পরিকল্পনার পক্ষে। বাংলাদেশের ভেতরে এধরনের সশস্ত্র সংগঠনের অপতৎপরতা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তারা মিয়ানমারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকিয়ে রাখতে চায়।মিয়ানমার একদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা বলছে অন্যদিকে সন্ত্রাসী দলগুলোকে মদদ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পগুলোকে অশান্ত করে রাখছে এবং এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদেরকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসী দলগুলো যে কোন সময় গোলাগুলি, খুন, চাঁদাবাজি, মাদক পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩৫টির বেশি খুনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মাদক, অস্ত্র, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত, অপহরণ, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, সোনা চোরাচালানসহ ১৪ ধরনের অপরাধের অভিযোগে৫ হাজার ২২৯টি মামলা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ব্লকের মাঝি ও জিম্মাদার, এ খুনগুলোর জন্য মিয়ানমারভিত্তিক সংগঠন আরসাকে অভিযুক্ত করা হয়। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোটবড় শতাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপসক্রিয় রয়েছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রাও নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলগুলোর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবাধ যাতায়াত ও সেখানে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে ও এই সমস্যা সমাধান করা বেশ কষ্টসাধ্য। ক্যাম্প এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা শনাক্ত এড়াতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ওয়াকিটকি এবং মিয়ানমার পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনসের (এমপিটি) সিম ব্যবহার করে। এমপিটি ২০১৯ সালের আগস্টের পর বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে ১২টি টাওয়ার স্থাপন করেছে। এর ফলে ক্যাম্পের যেকোনো ঘটনা মিয়ানমার সাথে সাথে জেনে যায় যা রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার জন্য উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে ক্যাম্প ও সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে হবে সেইসাথে জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় শরণার্থীদের মানবিক সেবায় নিয়োজিত দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কে আছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে প্রশাসন কাজ করছে। ক্যাম্প পরিচালনা ও শরণার্থীদের তদারকির জন্য মাঝিদের নেতৃত্বে ‘ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠিত হয়েছে। প্রতিটি ক্যাম্পে ৪০ থেকে ১২০ জন হেড মাঝি ও সাব-মাঝি নিয়ে এই ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে প্রায় আড়াই হাজার হেড মাঝি ও সাব-মাঝি রয়েছে। উখিয়ার ১১টি ক্যাম্প৮ এপিবিএনের অধীনে এবং ১৪ এপিবিএনের অধীনে রয়েছে ১৫টি। প্রায় সোয়া ৯ লাখরোহিঙ্গা এই ২৬ টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। আরও সাড়ে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা টেকনাফের সাতটি ক্যাম্পে থাকে। ক্যাম্পগুলোতে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রাতের বেলায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টসাধ্য হলে ও সামনের দিনগুলোতে ক্যাম্পেসার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আরসা ও আল-ইয়াকিনের সাথে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মিলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ জরুরী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পের চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি চেকপোস্ট ও টহল জোরদার করা হয়েছে। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেফতারের আওতায় আনা হচ্ছে।রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও হতাহত হচ্ছে।ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের দমন ও শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে যৌথ অভিযান চলার পরও সংঘর্ষ চলছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সীমান্তের নিরাপত্তাহীনতা শুধু বাংলাদেশ নয়—গোটা দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বহু প্রতীক্ষিত মিয়ানমারবিষয়ক একটি প্রস্তাব পাস হওয়ার পরও মিয়ানমারের পরিস্থিতির তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যেকোনো ধরনের আলোচনার জন্য প্রস্তুত এবং টেকসই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার প্রতিবছর ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করছে। ২০২১ সালে এই খরচের পরিমান ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার। রেহিঙ্গা সংকটের উৎস মিয়ানমার এবং এর সমাধানও সেখানেই রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চায়।বাংলাদেশ সরকার এরপরও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করে যাচ্ছে। মানবতার ক্ষেত্রে উদারতা দেখালেও নিরাপত্তা ইস্যুতে কোনো ছাড় দেবে না বাংলাদেশ। আরসা ও আরএসওর পারস্পরিক সংঘাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নতুন মাত্রা পাচ্ছে এবং দিন দিন তা আরো জটিলতার দিকে যাচ্ছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠিত বৃহত্তর জোট আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এআরএনএ) আরসা, আরএসও ও অন্যান্য দলগুলোকে সাথে নিয়ে দ্রুত এ ধরনের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ তথা আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে রোহিঙ্গাদের যে কোনো অপরাধমূলক কার্যক্রম শক্ত হাতে দমন করতে হবে এবং কোনভাবেই ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হতে দেয়া হবে না।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের নতুন উদ্যোগ – প্রত্যাশা টেকসই সমাধান



ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্প ও ভাসানচরে অবস্থান করছে। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকে ও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ২০১৭ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নেওয়া প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

চীনের মধ্যস্থতায় ২০১৯ সালে আবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। ফলশ্রুতিতে গত প্রায় ছয় বছরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেমে ছিল। ২০২০ সাল থেকে স্বল্প পরিসরে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু না হওয়ায় চীন মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে আসছিল। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আসিয়ান দেশগুলোও ছোট পরিসরে প্রত্যাবাসন শুরু করার বিষয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।

সম্প্রতি মিয়ানমার পাইলট প্রকল্পের আওতায় এক হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ৮ মার্চ মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও আসিয়ানের কয়েকটি দেশসহ আট দেশের কূটনীতিকদেরকে রাখাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। ৮ দেশের ১১ কূটনীতিককে মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে শহরে অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নেওয়া প্রস্তুতির অগ্রগতি দেখাতে এই কূটনীতিকদের সেখানে পরিদর্শনে নেওয়া হয়েছে।মিয়ানমার দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায় বলে তাদেরকে জানানো হয়েছে।কূটনৈতিক সূত্রগুলোর থেকে জানা যায়, চীনের চাপে মিয়ানমার এ উদ্যোগ নিয়েছে।

কূটনীতিকরা রাখাইন থেকে ফিরে এসে রাখাইনের চলমান পরিস্থিতি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের তুলনায় এখন কিছুটা ভালো বলে জানিয়েছে। মিয়ানমারের সিটওয়ের কাছে অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা এখন সিটওয়ে শহরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, আগে রোহিঙ্গাদেরকে ক্যাম্প থেকে বের হতে দেওয়া হত না।

প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গারা সেখানে স্বল্পপরিসরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে যা এতদিন ছিল না। রাষ্ট্রদূতরা নাফ নদীর পাড়ের নকুইয়া গ্রামে পাঁচ বছর আগে বানানো অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্পের সংস্কার কাজ দেখেন। নাফ নদীপথে যে সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে তাদেরকে প্রথম কিছুদিন এই ক্যাম্পে রাখা হবে। এরপর তারা মংডুর লাপুখা ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হবে। সেখানে তারা মাসখানেক থাকবে এবং সবশেষে তাদেরকে মংডু এবং সিটওয়ের কাছে নির্মাণাধীন ক্যাম্পগুলোতে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হবে।কূটনীতিকদের চকপিউ এলাকায় ২০১২ সাল থেকে বসবাসরত আই ডি পি’দের ক্যাম্প ও দেখানো হয়। এই ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে পাশের গ্রামে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হবে বলে তাদেরকে জানানো হয়। চকপিউ একটা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এখানে চীনের বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত তেল কোম্পানি এবং গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে।

বিভিন্ন মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি ভালো। কয়েক মাস আগে রাখাইনে আরাকান আর্মি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় সেখানে সাময়িক অস্ত্র বিরতি চলছে এবং আপাত শান্তি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন শুরু করা যেতে পারে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা কমবে এবং সামরিক সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা বাড়বে বলে চীন মনে করে। আগামী ২৪ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারকে তাদের যুক্তি পেশ করতে হবে, প্রত্যাবাসনের এই উদ্যোগের সাথে আইসিজে’র সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার আইসিজেকে জানাবে যে তারা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে ৮ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের দেওয়া এই তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছিল মিয়ানমার। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ওই তালিকা থেকে পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমার সম্মতি দেয়। বাকি ৪২৯ জনের ব্যাপারে তাদের আপত্তি থাকায় তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে ১৫ মার্চ মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ’র নেতৃত্বে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। প্রতিনিধি দলটি সাত দিনে ৪২৯ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

মিয়ানমার পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়। প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা যে আন্তরিক এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবে। পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের আওতায় প্রথমে এক হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। মিয়ানমারের তথ্য উপমন্ত্রী মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এপ্রিলের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক পাইলট কর্মসূচি শুরু হতে পারে বলে জানায়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য ৭৫০টি প্লটের ওপর ১৫টি নতুন গ্রাম তৈরি করতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ফেরত নেওয়া রোহিঙ্গাদেরকে প্রথমে দুই মাসের জন্য হ্লা ফো খাউং অন্তর্বর্তী ক্যাম্পে রাখা হবে। সেখান থেকে মংডু শহরের তাউং পিয়ো লেটওয়ে ও নাগার খু ইয়া ক্যাম্পে তাদের যাচাই করার পর তাদেরকে নতুন এই গ্রামগুলোতে পাঠানো হবে। ২৩ মার্চ মিয়ানমার জানিয়েছে যে, এই পাইলট প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে আরও পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে তাদের নিজ গ্রামে ফিরতে ইচ্ছুক। তবে নিজ গ্রামে ফেরত না যেতে পারলে তারা প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। নাগরিক অধিকার, ভ্রমণ স্বাধীনতা কিংবা অন্যান্য জাতিসত্তার সমান অধিকারের নিশ্চয়তা পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে।

ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর সেখানকার পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয় বলে জানায়।বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় পাইলট প্রকল্পের আওতায় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে ইউএনএইচসিআর জানায় যে, রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের এই আলোচনায় তারা জড়িত নয়। ইউএনএইচসিআর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনে অংশ নেয় সেজন্য তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে। ইউএনএইচসিআর, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা অব্যাহত রাখবে ইউএনএইচসিআর।

যেসব রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাই বাছাই করা হয়েছে তাদের অনেকে এখনই মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার ফেরার ব্যাপারে যথেষ্ট ভরসা পাচ্ছেন না। মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গারা সেখানে ভালো আছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার বন্ধ হওয়ার বিষয়ে সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা তাদেরকে আশ্বস্ত করলে তারা নিজেরাই মিয়ানমারে ফিরে যাবে জানায়। মিয়ানমারে ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। চলমান সহিংসতায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো মিয়ানমারে ত্রাণ কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে না পারার কারণে রোহিঙ্গারা সেখানে শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সে সব ক্যাম্পে ত্রাণ কার্যক্রম অবিলম্বে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে।

এই পাইলট প্রকল্পে মিয়ানমার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সাথে রাখেনি। গত ছয় বছর ধরে এই সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে। জাতিসংঘ রাখাইনের পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের সহায়ক নয় বলে জানিয়েছে। ত্রাণ সহায়তা ছাড়া রোহিঙ্গারা আবার মানবিক বিপর্যয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই উদ্যোগে তাই তাদেরকে সাথে রাখার দরকার ছিল বলে অনেকে মনে করে।

বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়ে আসছে যে, নাগরিকত্ব না পেলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়ে কিছু জানায়নি এবং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের মনোভাবের পরিবর্তনের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে অগ্রগতির কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদেরকে তাদের জনগণ মনে করে বলে জানিয়েছে। তবে এই প্রকল্পে তাদেরও কোন সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়নি। একই সাথে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিবর্তন সম্পর্কে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়েও কিছু জানা যায়নি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিবর্তনের ইঙ্গিতও স্পষ্ট নয়।

রোহিঙ্গা অধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে যে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া প্রত্যাবাসন হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি হবে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার পর নতুন বানানো গ্রামে স্থানান্তরিত করবে বলে জানিয়েছে কিন্তু রোহিঙ্গারা তাদের নিজ গ্রামে ফিরতে চায়। মিয়ানমারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তাদের আগের বাড়িঘর ও গ্রামগুলোতে পুনর্বাসন করা শুরু হলে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে ও রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাবে এবং এর ফলে সার্বিক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া টেকসই হবে বলে আশা করা যায়।

রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের ওপর বোঝার মত চেপে আছে। বিরাজমান বৈশ্বিক সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য বাজেট কমানো হয়েছে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। চলমান এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চাইছে, সংখ্যায় কম হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হোক। বাংলাদেশ সরকার টেকসই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়ে তা চলমান রাখার ব্যাপারে আগ্রহী। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সক্রিয় সহযোগিতা আশা করে।রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নেওয়া মিয়ানমারের এই উদ্যোগ ইতিবাচক। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে আশ্বস্ত করে টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে এই কার্যক্রম চলমান রাখবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

বিমানবন্দর দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে



মো. কামরুল ইসলাম
বিমানবন্দর দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে

বিমানবন্দর দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে

  • Font increase
  • Font Decrease

আকাশপথে ভ্রমণ আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম আকর্ষণ। সারাবিশ্বে শতশত বিমানসংস্থা হাজার হাজার বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করে আছে। এই সংযুক্তি শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করছে তা কিন্তু নয়। আকাশ পথের যোগাযোগ বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতির চিত্রকে বদলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

অষ্টম বৃহত্তর জনগোষ্ঠির দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে রয়েছে মাত্র তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়া আছে আরো পাঁচটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর।

মাত্র ৮টি বিমানবন্দর দিয়ে দেশে আকাশপথে সংযোগ স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫১ বছর এর অধিক সময়। দেশের আকাশ পরিবহন সংস্থাও গঠিত হয়েছে প্রায় একই সময় ধরে। স্বাধীনতার পূর্বে দেশে ১২টি বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ উঠা-নামা করতো। কিন্তু বর্তমানে ৮ টি বিমানবন্দর চালু আছে।

ব্যবসায়িকভাবে বর্তমানে চালুকৃত অনেকগুলো বিমানবন্দরে আয়ের সাথে ব্যয়ের একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। বরিশাল, রাজশাহী কিংবা যশোর বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা থেকে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ খুব একটা লাভবান হচ্ছে না। কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকছে বিমানবন্দরগুলো সচল থাকার কারনে।

সারাদেশের প্রায় ৫০টির মতো জেলা ৮টি বিমানবন্দর দিয়ে আকাশপথের সংযোগ স্থাপন করেছে। অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলো চালু হলে দেশের আকাশ পরিবহনে সার্বিক চিত্র আমুল পরিবর্তন সাধিত হবে। বিশেষ করে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, ঈশ্বরদী, শমশেরনগর, বগুড়া, বাগেরহাট, কুমিল্লা বিমানবন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতি তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে।

সারাদেশে ৩১টি এয়ারস্ট্রিপ রয়েছে যেগুলোতে কখনই বিমান চলাচল করেনি। সেইসব এয়ারস্ট্রিপগুলো পুনরুদ্ধার করে স্টল এয়ারপোর্ট কিংবা হেলিপোর্ট নির্মাণ করলে আকাশপথে যোগাযোগ আরো সুসংহত হবে। উল্লেখযোগ্য এয়ারস্ট্রিপগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বাজিতপুর, আড়াইহাজার, ফেনীসহ আরো অনেক।

দেশে ১০ টি হেলিকপ্টার কোম্পানীর প্রায় ৩০টির অধিক হেলিকপ্টার রয়েছে যা দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ক্ষুদ্র পরিসরে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় ভূমিকা রাখছে। দেশে অধিকসংখ্যক হেলিপোর্ট নির্মান করলে হেলিকপ্টার ব্যবসায় সফলতা আসতে পারে।

বন্ধ হওয়া বা অব্যবহৃত বিমানবন্দরগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চালু করার পরিকল্পনা করছে সরকার। ফলে দেশের বেশী সংখ্যক জনগণের আকাশ পরিবহন থেকে সেবা পাওয়ার সুযোগ তৈরী হবে। 

প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি বিমানবন্দর চালু হলে বিমানবন্দরকেন্দ্রিক শহর সৃষ্টি হয়। বেকার সমস্যা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে। শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। গ্রামীণ অর্থনীতি তথা সার্বিক আর্থ সামাজিক উন্নতি দেখা যায়। বিমানবন্দর কেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধিত হয়। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির উপর পজিটিভ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

যাত্রীবান্ধব এয়ারলাইন্স: ইউএস-বাংলা



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি; বার্তা২৪.কম

ছবি; বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে একটি এয়ারলাইন্স যাত্রীদের চলার পথে যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠে। যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠতে অন-টাইম পারফর্মেন্স জরুরী হয়ে উঠে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরুর পর থেকে ৯০ শতাংশের উপর ফ্লাইট অন-টাইম বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে।

এয়ারক্রাফটের পর্যাপ্ততা একটি এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে চলার পথে বড় নিয়ামক। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দু’টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন বহরে যুক্ত করেছে ১৯টি এয়ারক্রাফট। যার মধ্যে ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৮টি এটিআর ৭২-৬০০ ও ৩টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। চলতি বছরের মে-জুন মাসে ৪৩৯ আসনের দু’টি এয়ারবাস ৩৩০ ওয়াইড বডি এয়ারক্রাফট যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইউএস-বাংলা।

অন-টাইম পারফর্মেন্স বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ সকল রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পর আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডু রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যাত্রা শুরু করে। একের পর এক নতুন নতুন আন্তর্জাতিক গন্তব্য শুরু করতে থাকে ইউএস-বাংলা।

যাত্রীদের চাহিদাকে পূর্ণতা দিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট সিডিউল ঘোষণা করছে। নূন্যতম ভাড়ায় ভ্রমণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমণকে আরো বেশী আকর্ষণীয় করতে নানা ধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ ঘোষণা করছে। দেশে কিংবা বিদেশে টিকেট কিনলে হোটেল ফ্রি অফার রাখছে। ইএমআই সুবিধা দিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা পর্যটকদের ভ্রমণ পরিকল্পনাকে সহজতর করে দিচ্ছে। কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করলে এ্যাপোলো হাসপাতালে ডিসকাউন্ট অফার দিচ্ছে ইউএস-বাংলা। 

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য মালদ্বীপের রাজধানী মালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। যার ফলে ভারত মহাসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য দর্শনে পর্যটকরা ঢাকা থেকে মালে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন ধরণের প্যাকেজ সুবিধা নিয়ে মালদ্বীপের আকর্ষণীয় দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করছে।

মধ্যপ্রাচ্যে পর্যটকদের আকর্ষণীয় গন্তব্য দুবাই ভ্রমণে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ঢাকা থেকে দু’টি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এবং শারজাহ-তেও প্রতিদিন একটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশী অধ্যুষিত মাস্কাট ও দোহাতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা।

সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক কিংবা গুয়াংজু রুটে বাংলাদেশী যাত্রীদের পছন্দক্রমে ইউএস-বাংলা অগ্রগণ্য। যাত্রী বিবেচনায় প্রবাসী শ্রমিকবান্ধব এয়ারলাইন্স হওয়ায় ইউএস-বাংলা যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে।

অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে সিলেটে ৬টি, সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৮টি করে ফ্লাইট, যশোরে ৩টি, রাজশাহীতে ২টি, বরিশালে ১টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। যা দেশের অভ্যন্তরে যাত্রীদেরকে সেবা দেয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

দেশের অভ্যন্তরে ব্র্যান্ডনিউ এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে সর্বপ্রথম ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দেশে সর্বপ্রথম সেলফ চেক-ইন করার ব্যবস্থা রেখেছে ইউএস-বাংলা। 

অনলাইন ও অফলাইন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকেট ক্রয়ের সুবিধা থাকার পরও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দেশে এবং দেশের বাহিরে ৪১টি নিজস্ব আউটলেটের মাধ্যমে সরাসরি টিকেট ক্রয়ের সুবিধা রেখেছে যাত্রীদের জন্য।

বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দশ বছর অতিক্রমকালীন সময়টা এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য অনেকটাই নাজুক অবস্থা বিরাজমান সেখানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলাদেশকে ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এয়ারলাইন্স এর বিমান বহরে নতুন নতুন এয়ারক্রাফট যুক্ত করে নতুন নতুন গন্তব্যে নিজেদের পেখম মেলে ধরছে। বর্তমানে ২৫০০ এর অধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে ইউএস-বাংলায়। যা দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে কাজ করছে।

দেশের ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিকে গতিশীল রাখতে ইউএস-বাংলা যাত্রার শুরু থেকেই কাজ করছে। যাত্রীদের আস্থাই ইউএস-বাংলার এগিয়ে চলার পথে পাথেয়।   

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের গুরুত্ব



মাহমুদ আহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আজ ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত।

আমাদের মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখ প্রাণের তাজা রক্ত। আল্লাহপাকের জমিনে তিনি পরাধীনতা পছন্দ করেন না। যেখানে স্বাধীন ভূখণ্ড নেই সেখানে ধর্ম নেই আর যেখানে ধর্ম নেই সেখানে কিছুই নেই। তাই ইসলামে দেশ প্রেম এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব অতি ব্যাপক। সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টাপ্রচেষ্টা করে থাকে। আর এই স্বাধীনতার জন্যই মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন।

ইসলামের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত নবীর আগমণ হয়েছে তারা সবাই সমাজ, দেশ ও জাতির স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। আর এই স্বাধীনতা অত্যাচারী শাসকের দাসত্ব থেকে জাতিকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেই হোক বা ধমীর্য় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হোক। এক কথায় বলা যায়, সব ধরণের দাসত্ব ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত করাই হচ্ছে আল্লাহতায়ালার প্রেরিত নবীদের কাজ।

আমরা জানি, গোলাম মুক্ত করে এবং সর্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য যিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন এবং শতভাগ সফল হয়েছেন তিনি হলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতার উজ্জল সূর্য। যাঁর কিরণ দূরদূরান্তে বিস্তার লাভ করেছে, যিনি নিজের মাঝে সব ধরণের স্বাধীনতাকে ধারণ করেছিলেন। যিনি মানুষকে শুধু বাহ্যিক দাসত্ব থেকেই স্বাধীনতা দেননি, বরং সমাজ ও দেশ থেকে সব ধরণের নৈরাজ্য দূর করে সবাইকে করেছিলেন স্বাধীন। বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অবলোকন করেছে, কিভাবে বিশ্বনবী (সা.) সমাজ, দেশ তথা সর্বত্রে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পরাধীনতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য মহানবী (সা.) যেমন লড়েছেন তেমনি তিনি সকলকে করেছিলেনও স্বাধীন। কিন্তু এটি বড়ই পরিতাপের বিষয়, অনেক জাতি স্বাধীনতার প্রকৃত পতাকাবাহীদের অস্বীকার করে এবং সর্বোত্তম শাসকের (আল্লাহর) শাসনের ওপর জাগতিক শাসকের দাসত্বকে অগ্রাধিকার প্রদান করার ফলে তারা কেবল নিজেরাই প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয় নি বরং বহু জাতি আল্লাহর আজাবগ্রস্থ হয়ে ধ্বংসও হয়েগেছে। একান্তই সত্য যে, বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ার কারণে স্বাধীনতা কেবল তাদের হাতছাড়া হয়নি বরং সে জাতির ইহ ও পরকাল উভয়ই ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহপাক মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আল্লাহতায়ালা সবাইকে বিবেক ও বিশ্বাসেরও স্বাধীনতা দিয়েছেন। কাউকে পরাধীন করেননি। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ‘তোমার প্রভুপ্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই অবশ্যই এক সাথে ঈমান নিয়ে আসত। তবে কি তুমি মোমেন হওয়ার জন্য মানুষের ওপর বল প্রয়োগ করবে?’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৯৯)।

এই আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, আল্লাহ সবার স্বাধীনতা চান। তিনি চাইলে সবাইকে একসাথে মোমেন বানাতে পারেন কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি চেয়েছেন মানুষ যেন স্বাধীনভাবে বুঝেশুনে ঈমান আনে। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম বা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দমননীতি অনুমোদন করে না। মাদানী যুগেও আমরা আল কোরআনের এই বিস্ময়কর প্রকাশ দেখতে পাই, ‘ধর্মের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই’ (সুরা আল বাকারা: ২৫৬)। এই আয়াত থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ইসলাম স্বাধীনতাকে কতটা পবিত্র করেছে এবং একে কতটা মর্যাদা দিয়েছে।

স্বাধীনতাকে ইসলাম যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকেও অতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে ঈমানের অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহানবী (সা.)এর হৃদয়ে স্বদেশ প্রেম যেমন ছিল তেমনি তাঁর সাহাবায়ে কেরামদের মাঝেও বিদ্যমান ছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেমন আন্তরিক ছিলেন, তেমনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায়।

প্রিয় নবী (সা.) মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বাধীনতার চেতনাকে জাগ্রত করে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয়, সম্মান, আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি যেমন অসংখ্য দাসকে নিজ খরচে মুক্ত করেছেন তেমনি সমগ্র বিশ্বকে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ।

মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার (২৬ মার্চ) ‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ উপলক্ষে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিদর্শন বইয়ে প্রত্যয়দীপ্ত এ মন্তব্য করে সই করেন তিনি। আমরাও ইনশাআল্লাহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা পুরণে যার যার স্থান থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিব। 

আসুন, নিজ দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি, সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি আমাদের হৃদয়ে অনেক বেশি ভালোবাসা সৃষ্টি করি আর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলার আন্দলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করি। 

লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক

;