বাবা’র রিভলবার



মহীবুল আজিজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমার বাবা’র একটা রিভলবার ছিল। পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা আমাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিলে গ্রামে থাকবার আর কোনো পিছুটান বাবা’র রইলো না। যদিও দাদি আর জ্যাঠা বলছিলেন, স্থানীয় কোর্টে প্র্যাকটিস করলে ভালো আয় হবে। কিন্তু বাবা’র ছিল পর্যটক মন। পাকিস্তান আমলে কৃষিব্যাংকের চাকুরি ছিল এক জেলা থেকে আরেক জেলায় কিছুকাল পরপর বদলির। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে সেই ডিসেম্বর মাসেই তিনি রওনা হলেন চট্টগ্রামের দিকে। আগেও আমরা চট্টগ্রামেই ছিলাম কিন্তু সেটা শহরাঞ্চলে না। শঙ্খনদীর পাড়ে দোহাজারির জামিজুরি’তে যেখানে ছিল কৃষিব্যাংকের একটা পুরনো শাখা। বাবা সেখানকার ম্যানেজার ছিলেন। এবারে আমাদের স্বল্পকালের ঠিকানা হবে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে—আন্দরকিল্লা আমার নানাবাড়ি। বাবা, আম্মা এবং দুই ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে আমরা এসে উঠলাম মায়ের বাড়ি।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বাবা একটা চাকুরির ইন্টারভিউ দিলেন এবং নির্বাচিত হলেন। গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানির চিফ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। বিরাট জায়গাজুড়ে সিগ্রেট কোম্পানিটা ছিল এবং সন্নিহিত গোল্ডেন ম্যাচ ফ্যাক্টরি। এর মূল মালিক ছিল পাকিস্তানের হাজি হাশেম। তিনি পাকিস্তান চলে যান এবং পরবর্তীতে সরকার এটির মালিকানা বিষয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাবাই এর সর্বেসর্বা ছিলেন। বাবা’র কাছে শুনেছিলাম। তাঁর দুই বিষয়ে মাস্টার্স (অর্থনীতি ও আইন), বিশেষত দ্বিতীয় মাস্টার্স-এর কারণে তিনি অন্যান্য প্রার্থীদের চাইতে অনেকটাই এগিয়ে থাকেন। এদিক দিয়ে বাবা’র সঙ্গে তাঁর শ্বশুরের মানে আমার নানার দারুণ একটা মিল ছিল। আমার নানাও ছিলেন দুই বিষয়ে মাস্টার্স—দর্শন এবং আরবি। বাবা যখন চাকুরিতে যোগ দেন তখন গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকোতে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না। কিন্তু যেহেতু কেবল শ্রমিক নয় বিরাট পুঁজি পরিচালনা-ব্যবস্থাপনার বিষয় জড়িত ছিল সেহেতু তাঁর নিরাপত্তার দিকটা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। এর পরিণামে একদিন বাবা তাঁর অফিসের রয়েল ব্ল্যু মার্সিডিজ গাড়ি থেকে নামলেন এবং আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে কোটের পকেট থেকে বের করে আনলেন একটা সদ্যকেনা চকচকে রিভলবার। গুলিগুলো আলাদা একটা চামড়ার থলেতে ছিল গুলি এবং রিভলবার দুই আবার একসঙ্গে আরেকটা চামড়ার খোপে রাখার ব্যবস্থা আছে।

দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। খানিকটা ভয়ও আমাদের জেঁকে ধরে কিন্তু পরে যুক্তি দিয়ে বিচার করে আমরা আম্মা এবং ভাইবোনেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে রিভলবারটা বাবা এনেছেন আমাদের সমূহ নিরাপত্তার কথা ভেবে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। বাবা আমাদের প্রত্যেককে শপথ করান, রিভলবার ঘরে আনা হয়েছে ঘরেই থাকুক কিন্তু সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই যেন সংবাদে রূপ না পায়। যদি ঘুণাক্ষরেও কেউ সেটা সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আমরা কেউই বলি না, আমাদের ঘরে একটা অস্ত্র আছে। এখন হলে হয়তো বলতাম, বলে গৌরব বোধ করতাম। যাহোক, আমরা দেখতে এমনই গোবেচারা ছিলাম, বললেও হয়তো লোকে ভাবতো, আষাঢ়ে গল্প। এই রিভলবার নিয়ে প্রথম যে-ঘটনা ঘটে সেটা বেশ মজার। এমনিতে পোশাকে-আশাকে বাবা ছিলেন খুব ধোপদুরস্ত। একদিন শুক্রবারে জুমা’র নামাজ পড়বার জন্য পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছিলেন তিনি। একটা রিক্সায় উঠছিলাম আমরা। হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিভলবারটা ঠাস শব্দে পড়ে গেলে রিক্সাঅলাটা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ভাগ্যিস তখন আশেপাশে আর কেউ ছিল না। রিক্সাঅলা ভাবে, লোকটা হয়তো সিভিল ড্রেসে পুলিশের বড় কর্মকর্তা। ফের ঘরে গিয়ে বাবা রিভলবারটা রেখে আসেন। আম্মা খানিকটা বকুনির সুরে বলেন, সবাইকে বললে, খবরদার কেউ যেন রিভলবারের খবর না জানে আর এখন তোমার পকেট থেকে রিভলবার লাফ দিয়ে পড়ে!

রিভলবার সংক্রান্ত আরও একটি মজার স্মৃতি আছে। এক রাতে আমার সবাই ঘুমে। শীতের দিন ছিল, তখন রাতগুলো বড় হয়। হঠাৎ মাঝরাতে বাবা’র ঘুম ভেঙে যায় কিছু একটা শব্দে। শব্দটা আমাদের কক্ষের দরজার দিক থেকে আসছিল। কক্ষটাতে আমি এবং আমার বড় ভাই থাকতাম। সম্ভবত রাত দুটো বা আড়াইটা হবে। আমাদের দুই ভাইকে ফিসফিস শব্দে জাগিয়ে দেন বাবা। আমরাও তখন নিঃশব্দে কান পেতে শুনতে পাই, দরজার বাইরের দিক থেকে একটা শব্দ হচ্ছে। বাবা বললেন, চুপ করে থাকো, সম্ভবত কেউ বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। একজন না একজনের বেশি বোঝা যাচ্ছে না তবে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। দুই ভাই-ই তখন ভয়ে কাবু যদিও আমাদের মনে থাকা দরকার ছিল, বাবার কাছে একটা রিভলবার আছে। তবে আমাদের ঘরটা তখন আক্ষরিক অর্থেই আলো-আঁধারিতে ঘেরা একটা রহস্যময় কামরার মত লাগছিল। বাইরে থেকে মরা আলো এসে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকলে সেই আলোর প্রতিক্রিয়ায় ঘরের ভেতরকার দেয়ালে ছায়া পড়ে বাবা’র। তাতে দেখতে পাই একটা ছায়ামূর্তি যার হাতে একটা অস্ত্র এবং তাকে বাবা নয়, সম্পূর্ণ অন্য একজনই মনে হয়। ফলে সামনে দাঁড়ানো বাবা এবং দেয়ালে বাবা’র প্রতিফলনে আসলে বাবা’রই আরেকটা রেপ্লিকা কিন্তু আমদের মনে হয় যেন অন্য কেউ, এই দুইয়ের সংমিশ্রিত ধন্দে আমরা যারপরনাই সংকুচিত হতে থাকলে সহসা আমার মনে হলো দরজার ধাক্কাটা খানিকটা ছন্দময়। মানে বিশেষ একটা প্রক্রিয়ায় সংগীতের মীড়ের উপস্থিতির মত একটা ছান্দিক বিন্যাসে দরজায় ধাক্কার ঘটনা ঘটছিল। বাবা ফিসফিস করে বলেন, কি ব্যাপার তোমরা দুই ভাই কি বিষয়ে কথা বলো? আমি বলি (চাপাস্বরে অবশ্যই), এত সুন্দর করে তাল মিলিয়ে কেউ দরজা ধাক্কায় নাকি। বাবা পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন, কী বলতে চাও? তখন আমি যুক্তি দেখাই, ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, ধাক্কাটা দরজার ঠিক মাঝ-বরাবর নয়, ভেসে আসছিল নিচের দিকটা থেকে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে শব্দ হচ্ছিল দরজায়, ঠিক এলোমেলো নয়।

আচমকা সাহসে ভর করে, যেহেতু হাতে শক্তিশালী ধাতব অস্ত্র, বাবা এগিয়ে যান দরজার দিকে। যেন খুলেই সামনে থাকা শত্রুকে তাক করবেন সেটা। বাবাই শেষে আবিষ্কার করলেন, সিটকিনি আটকানো হলেও দরজার নিচের দিকটাতে খানিকটা ফাঁকা থেকে যায়। সেই ফাঁকা সরু পথ দিয়ে বাইরের দিক থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিল একটা ধেড়ে ইঁদুর কিন্তু সফল হচ্ছিল না কোনোভাবেই। ইঁদুরটা যদি শীর্ণকায় হতো তাহলে এতক্ষণে হয়তোবা ঢুকে পড়তো। আমরা যতই ফিসফিসিয়ে কথা বলি না কেন তিনজনের ফিসফিসানি মিলে যে জোরালো ফিসফিস সৃষ্টি হয় তাতেই আম্মার ঘুম ভেঙে যায়। সব শুনে তিনি ব্যঙ্গ করেন বাবাকে, তিনজনে মিলে মাঝরাতে একটা ইঁদুরের মোকাবেলা করছে, তাও আবার পিস্তল দিয়ে। আম্মা কখনও রিভলবার বলতেন না। যাহোক রিভলবার এবং সেটির গুলি সবই শেষ পর্যন্ত অব্যবহৃত থেকে যায়। আমরা দুই ভাই প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসে বসে গল্প করতাম, আচ্ছা কবে দেখবো বাবা এই রিভলবার থেকে গুলি করছেন! সেটা যে মোটেও প্রীতিপ্রদ বা সুখকর অভিজ্ঞতা নয় তখন সেটা আমাদের খেয়ালেই থাকে না। মাঝে-মাঝে ভাবতাম এই বুঝি রিভলবার ব্যবহারের উপলক্ষ্য তৈরি হচ্ছে। যখন লোকেরা বাবা’র সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করবার জন্য আসতো এবং ড্রয়িংরুমে সম্মিলিত হতো আমরা পর্দার ফাঁক দিয়ে কিংবা কান পেতে শুনতাম, আলাপীদের কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে পৌঁছায় কিনা। কেননা সেটা হলেই হয়তো লোকেরা বাবার ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে এবং তখন তিনি গোপন জায়গা থেকে অস্ত্র বের করে মুহূর্তেই ঠাস করে গুলি ছুঁড়ে দেবেন। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, বাস্তবে সেটা ঘটা একদম সম্ভব নয়। কেননা, রিভলবারটা থাকে স্টিলের আলমারিতে একটা গোপন কুঠুরিতে এবং সেটা হস্তগত করতে হলে বাবাকে প্রথমে খুলতে হবে আলমারি, তারপরে ড্রয়ার এবং সবশেষে সেই ড্রয়ারের পাশে থাকা ছোট্ট প্রকোষ্ঠটা। সেটা করবার আগেই কী শত্রুর লক্ষ্য হয়ে তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়বেন না! আমরা হয়তো অহেতুকই এইসব আশঙ্কায় ভুগি। বাস্তবে তেমন কোনো ঘটনা ঘটে না। তবে একদিন আমরা সত্যি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমাদের একটা টেলিফোন সেট ছিল কালো রংয়ের, জবরজং ধরনের। অনেকবার শেল্ফের ওপর থেকে পড়ে গেলেও জার্মান সেই টেলিফোন-সেটটি বহাল তবিয়তেই থেকে যায়। বেশ কয়েকবারই নম্বর বদলেছিল সেটটির। দু’টো নম্বর আজও মনে আছে-৮২৪৪৮ এবং ২০২৪৪৮। বোঝাই যাচ্ছে গ্রাহক-সংখ্যা বাড়ার ফলে প্রাক্তন ‘৮’-এর বদলে এসেছিল ‘২০’।

বাবা কার সঙ্গে কথা বলছিলেন জানি না কিন্তু বিষয়বস্তু অনুমান করতে পারি। আলোচনা এবং উত্তেজনার বিষয় ছিল তামাক। বাবা তো সিগারেট কোম্পানির প্রধানই ছিলেন। অনেকেই অবশ্য বাবাকে নিয়ে খানিকটা রঙ্গ-রস করতো: জীবনে যে ধূমপান করে নি তিনি হলেন গিয়ে সিগ্রেট কোম্পানির এ্যাডমিনিস্ট্রেটর! ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী দেশ ভারতে যে তামাক-প্রতিনিধিদল পাঠায় সেখানে অন্যতম সদস্য ছিলেন আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ। মাদ্রাজের (তখন চেন্নাই বলা হতো না) গুন্টুর নামক জায়গায় হয়েছিল সম্মেলন। সে যে কী উত্তেজনা আমাদের। সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিক আমার পিতা একদিন অফিস থেকে ফিরে এলেন পাসপোর্ট হাতে করে। আমাদের বোঝান, এটা হলো পাসপোর্ট, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হলে এই ছোট্ট বইটা তোমার লাগবেই। আর কী যে গর্ব তাঁর—পাকিস্তান আমলে কোনো পাসপোর্ট ছিল না তাঁর। স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং একটা পাসপোর্ট সেটির স্বীকৃতি। কী যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে কতবার কত উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলেন, সেইসব সত্য গল্প। ভারত থেকে আসবার সময় আমাদের জন্যে নিয়ে আসেন মজার চকোলেট ‘ক্যাডবেরি’। সেই ১৯৭২ সালে আমরা খেলাম ক্যাডবেরি চকোলেট। একটা ছিল বিঘৎখানেক লম্বা একটা টিনের কৌটায়—দেখতে লিচুর বিচির মত কিন্তু চকোলেট। জিভে দিতেই এমন এক অভূতপূর্ব স্বাদ যেন অন্য কোনো লোক থেকে বয়ে আসে সেই স্বাদ। আরও এক অহংকারের কাহিনী শোনান তিনি। যে-ক’দিন মাদ্রাজে থাকেন ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর মনে পড়ে ১৯৫৪-৫৬ সালের কথা। তাঁর প্রিয় দু’জন শিক্ষক ছিলেন—একজন এম এন হুদা এবং আরেকজন তামিল প্রফেসর আয়াঙ্গার। তিনি তাঁর খোঁজ করেন এবং তাঁকে খুঁজে পান মাদ্রাজ শহরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এককালের  অধ্যাপক আয়াঙ্গারের বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি। প্রাক্তন ছাত্রকে পেয়ে তিনিও খুব অভিভূত বোধ করেন।

তো টেলিফোনে কেউ বাবাকে ফন করেন এবং নিশ্চয়ই তাঁরা আলাপ করেন তামাক বিষয়েই। সম্ভবত কোনো একটি বিদেশি জাহাজে তামাক এসেছিল গোল্ডেন টোব্যাকোর জন্যে। কিন্তু শিপিং কোম্পানির কোনো এক ব্যক্তি বাবা’র সঙ্গে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধায়। পরিণামে জেটিতে জাহাজ থেকে মাল খালাসে বিলম্ব ঘটে এবং তাতে ডেমারেজ বাড়তে থাকে। ফোনে দু’জনেই উত্তেজিত এবং অপর পক্ষ নিশ্চয়ই বাবাকে হুমকি বা তেমন কোনো সংকেত দেয় যেজন্যে বাবা’র চড়া গলা শুনতে পাই, ঠিক আছে দেখা যাবে আপনি আমার কী করতে পারেন! তখন আমরা আশঙ্কা করি, রিভলবারের ব্যবহার বুঝি অত্যাসন্ন। কিন্তু না আমাদের হতাশ করে দিয়ে সেই হুমকিদাতা আর দেখা দিতে আসে না। ফলে আমাদেরও রিভলবার সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্যে অপেক্ষার কাল হতে থাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।

আসে ভয়ংকর ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু’র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিদারুণ মুষড়ে পড়েন বাবা। বলতে থাকেন, আর চাকুরি করবেন না। স্বাধীন আইন-পেশাতেই যোগ দেবেন। কেননা, গণতান্ত্রিক সরকারের জবাবদিহিতা সামরিক সরকারের নিকটে প্রত্যাশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা’র অনুমান সত্যি হয়। তাঁকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় পদস্থ হওয়ার লোভে উঠেপড়ে লাগে লোকেরা এবং একটা অশনির আভাস অনুভব করে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দেন। তাঁর চাকুরিকালীন অনেকগুলো গাড়ি ছিল আমাদের। আমরা স্কুলপড়ুয়া দুই ভাই এমনও বাজি ধরতাম, আজ কোন্ গাড়িটা আমাদের নিতে আসবে স্কুলে—মার্সিডিজ, প্রিন্স, টয়োটা, ডাটসান, হুইল জিপগাড়ি, মাইক্রো! ১৯৭৪ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। তাঁকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙ্গামাটি যান। সেই সফরটিতে ব্যবহৃত হয় বাবা’র গোল্ডেন টোব্যাকো কোম্পানির মার্সিডিজ গাড়িটা। রিক্যুইজিশন নেওয়া গাড়িটি সরকার ফেরত দেওয়ার কথা। তখন দেশে মার্সিডিজ গাড়ি খুব বেশি ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারা ক্ষমতা দখল করে তারা আর সেই গাড়ি ফেরত দেয় না।

যাহোক, বাবা আমাদের প্রতিশ্রুতি দেন, একদিন নিশ্চয়ই আমরা গাড়ি কিনবো। গোল্ডেন টোব্যাকো’র চাকুরি ছেড়ে স্বাধীন আইনপেশায় যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা কিছুদিন আগ্রাবাদে একটা বেসরকারি  শিপিং কর্পোরেশনে কর্মকর্তার চাকুরি নেন। সকাল-সন্ধ্যার চাকুরিতে আগের মতই তাঁর ব্যস্ততা বহাল। ছুটির দিন ছাড়া তাঁর দেখা পাওয়া ছিল দুরূহ। ছুটির দিনগুলিতে সারাদিন আমরা তাঁকে কাছে পেতাম। বাবা খুব ভালোবাসতেন তাঁর শৈশব, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো তাঁর দিনগুলি সম্পর্কে আলাপ করতে। একদিন আচমকা তাঁর খেয়াল হলো, আগের চাকুরিতে যে ঝুঁকির দিক ছিল এবং যে-ঝুঁকির কারণে তাঁকে কিনতে হয়েছিল একটা নিরাপত্তা-রিভলবার বর্তমান চাকুরিতে সেই ঝুঁকি একদম নেই। কাজেই একটা অস্ত্র এবং সেটির ৬টা গুলি (সবই অব্যবহৃত) বেকার ঘরে রেখে কী লাভ। যেই কথা সেই কাজ। এসব কাজে উদ্যোক্তা বাবা’র সঙ্গী থাকতাম আমি। আমার বড় ভাইকে বাবা এসব কাজে সঙ্গে নিতেন না। রিভলবারটা কেনা হয়েছিল নিকটস্থ বক্শিরহাট পুলিশবিটের উল্টোদিককার চিটাগাং আর্মস নামক একটা অস্ত্রের দোকান থেকে। আলমারি থেকে গোপন প্রকোষ্ঠের সেই অস্ত্র বের করে আনা হলো। গুলিগুলো আগেই খুলে রাখা ছিল। আমি এবং বড় ভাই শেষবারের মত স্পর্শ করে দেখলাম সেটি। ধাতব ঠাণ্ডা ছোট দেখালেও মনে হলো ভারি সেই রিভলবার হাতে নিয়ে আমাদের সে কী বিস্ময়। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো আমরাও পুলিশ।

আগে তো অফিসের গাড়ি ছিল আর এখন শিপিং কোম্পানির গাড়ি আসে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কাজেই বাবা বললেন, আমরা একটা রিক্সা নেবো। তখন সেইসব দিনে পলিথিন ছিল না। একটা মোটা চটের থলেতে বাবা রিভলবারটা একটা পুরনো খবরের কাগজের পাতা দিয়ে মুড়িয়ে ঢুকিয়ে নিলেন। ব্যাগগুলো যেহেতু মূলত বাজারের সেগুলো বারবার ধোওয়া হতো। তারপরেও সেই ব্যাগ থেকে মাছ এবং মাংসের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো হাতে নেওয়ামাত্র। দেখে আম্মা ফোড়ন কাটেন, বাজারের ব্যাগের মাছের আর মাংসের গন্ধ পিস্তলে লেগে গেলে দেইখো আবার তোমার পিস্তলের দাম কমে যাবে! বাবা হাসেন, কী যে বলো না, গন্ধে কিসসু যায়-আসে না, গুলি বেরোয় কিনা সেটাই হলো মূল কথা। আসলে বাজারের ব্যাগে করে রিভলবার নেওয়ার অর্থ হলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে একটা মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আমরা বাপবেটা রওনা দিয়েছি, যদিও অস্ত্রের লাইসেন্সটা বাবা পকেটস্থ করে নেন আগেই। রিক্সায় ওঠার মুহূর্তে আমি বেঁকে বসি। বাবা জিজ্ঞ্যেস করেন, কী হলো, রিক্সায় ওঠ। বললাম, আমাকে টাকা দিতে হবে। ঐটা বিক্রি করে যে টাকা পাবা সেখান থেকে আমাকেও দিতে হবে টাকা। শুনে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে যান তিনি। তারপর মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা দেবো, ওঠ। আমি উঠে পড়ি।

রিক্সা গন্তব্যমুখী। আমার মনে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আমি একবার তাকাই বাবা’র হাতে ধরা বাজারের ব্যাগটার দিকে। চটের সেই থলে থেকে মাছ-মাংসের গন্ধ ভেসে এলেও এর ভেতরে রয়েছে লৌহনির্মিত অস্ত্র। আরেকবার তাকাই আশেপাশে। মনে হতে থাকে লোকেরা যদি বুঝতে পারে বাবা আর আমি রিভলবার নিয়ে যাচ্ছি রিক্সায় করে তাহলে! সেদিনটার কথা মনে পড়ে, যেদিন বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল রিভলবারটা। ত্রস্তে তাকাই, না ব্যাগটাতে কোনো ছিদ্র নেই। মোটা চটের থলে, বড়-বড় চালের বস্তা কেটে বানানো সেসব থলে। ডাক্তার চিনু নন্দীর চেম্বার, রমনা সিগারেট কোম্পানি, ওয়ার্সি প্রেস, দত্ত জুয়েলার্স, বদরুদ্দিন মিষ্টির দোকান এইসব অতিক্রম করে রিক্সা এসে দাঁড়ায় বক্শিরহাট পুলিশবিটের উল্টো দিককার চিটাগাং আর্মস নামক দোকানটার সামনে। মাঝবয়েসী লোকটা সম্ভবত বাবাকে চিনতে পারেন। অস্ত্রটা কেনার পর আরও কয়েকবার নানা কাজে বাবাকে আসতে হয়েছিল সেখানে। একথা-সেকথার পর, একটি গুলিও ব্যবহৃত না হলেও রিভলবারটা সেকেন্ডহ্যান্ড-ই। কাজেই সেটির মূল্য সেভাবেই ধার্য হওয়া চাই। নানা কথার পর, যেহেতু মনে হলো, বাবা’র নিকটে সেটার সংরক্ষণ এক ধরনের বিড়ম্বনা মাত্র, তিনি মোটামুটি কিছু কম হলেও একটা দাম দিয়ে ঘরে চলে আসতে পারলে বাঁচেন। মাঝবয়েসী লোকটা বললো, ঠিক আছে ১৩৩০ টাকাই দিচ্ছি। আমার মাথায় সেটা চট্ করে গেঁথে গেলো। আমি ভাবলাম, আমার পাওনাটা এই তেরশোতিরিশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আবার রিক্সা ঠিক করা হলো। পার্থক্য হলো, এবারে চটের থলেটা ভাঁজ করা। রিক্সায় ওঠার মুহূর্তে আমি বেঁকে বসি আবারও, আমার টাকা কই! বাবা বলেন, ওমা, তোমাকে দেবো বলেছি তো, ঘরে চলো, নিশ্চয়ই দেবো।  আমি বললাম,না এখনই দিতে হবে নইলে আমি রিক্সায় উঠবো না। আমি উকিলের বা ডাক্তারের ফি’জ্ নেওয়ার মত করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি, তুমি তো ১৩৩০ টাকা পেয়েছো, আমাকে ৩০ টাকা দিতে হবে। শুনে বাবা বলেন, মাগো, কী বলে ব্যাটা! (আদর করে ব্যাটাই বলতেন।) এত্তগুলো টাকা! তুমি আমার সঙ্গে আসছো আবার যাচ্ছো, তাও হেঁটে না, রিক্সায়। তাই বলে তিরিশ টাকা? আমিও কম যাই না। বললাম, তুমি তো বলেছো দেবে, এখন দাও, ৩০ টাকা দাও। আমার মাথার মধ্যে কেন জানি ৩০ সংখ্যাটা ঢুকে পড়েছিল। আমি ভাবছিলাম ১৩০০ টাকা তো একটা সুন্দর পূর্ণ সংখ্যা। ভাবতেও ভালো লাগে। আর এর সঙ্গে লাগোয়া ৩০-কে অতিরিক্তই তো মনে হয়। ১৯৭৫ সালে ৩০ টাকা আসলে অনেক টাকা। যাহোক বাবা আমাকে ১০ টাকা দিলেন। বললেন, কালকে মিষ্টি কিনে আনবো তোমাদের সবার জন্য। এখন ঘরে চলো। আমরা ঘরে ফিরে আসি। আর কখনও অস্ত্রের সংস্পর্শে আসতে হয় নি বাবাকে। সেই প্রথম এবং সেই-ই শেষ।

চট্টগ্রাম: ০৪-০৪-২০২৩

ড. মহীবুল আজিজ, অধ্যাপক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।

   

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ 'যেনতেন উপায়ে' নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।' তিনি বলেন, 'বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।'

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ''মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?" জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।' এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত 'দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য' স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।' বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় 'অসারের তর্জন গর্জন সার'? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী



অঞ্জনা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল... হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। '৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এক অম্লান মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কয়েক দশকের নিপীড়ন, প্রান্তিকতা এবং শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বুঝতে হলে প্রথমেই এর জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা আবশ্যক। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিলনা। যাই হোক, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এর দুই অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয় ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয় ও শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অংশ অস্বীকার করে। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করা বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভাষাগত অধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য নিরলস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একটি ফেডারেল ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। যাই হোক, সামরিক ও স্বার্থান্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারগুলো বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষা দেখায় যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের অনুভূতি তীব্রতর করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালি জনগণের দাবি মেনে নিতে অনড় এবং অনিচ্ছুক ছিলেন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এবং অন্যায়ের বোধকে গভীরতর করে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগকে যে অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা ছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট, যেখানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য বিলম্বিত কৌশল ও অপকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মুখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জনগণকে ঐক্য, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে এবং ভিন্নমতের যে কোনো চিহ্নকে চূর্ণ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ এবং নৃশংসতা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও আতঙ্কের পথ রেখে যায়, যা বঙ্গবন্ধুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তির শিখা জ্বালিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন জাতির জন্মের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিছক প্রতীকী বিষয় ছিল না। এটি ছিল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল, যে সময়ে বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) নেতৃত্বে, ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যেমনটা ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে ছিল।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমর ঘটনা। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের অধিকার, মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার এক সাহসী প্রকাশ। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই দেননি, বরং একটি নতুন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এই ঘোষণা বাঙালিদেরকে একত্রিত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘোষণা ছিল একটি নতুন সূচনার প্রতীক, একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে বাঙালিরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী অর্জন করেছি এবং আমাদের কী অর্জন করতে হবে। এই ঘোষণা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানায়।

২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি একটি স্মরণীয় দিন যা আমরা চিরকাল গর্বের সাথে উদযাপন করব। কয়েক দশকের নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার অটল সংকল্প, নিরলস নেতৃত্ব, অসীম ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রাম মুক্তির সূচনা করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতির।

ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার আদর্শের আলোয় আজও বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;