বাবা’র রিভলবার
আমার বাবা’র একটা রিভলবার ছিল। পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা আমাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিলে গ্রামে থাকবার আর কোনো পিছুটান বাবা’র রইলো না। যদিও দাদি আর জ্যাঠা বলছিলেন, স্থানীয় কোর্টে প্র্যাকটিস করলে ভালো আয় হবে। কিন্তু বাবা’র ছিল পর্যটক মন। পাকিস্তান আমলে কৃষিব্যাংকের চাকুরি ছিল এক জেলা থেকে আরেক জেলায় কিছুকাল পরপর বদলির। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে সেই ডিসেম্বর মাসেই তিনি রওনা হলেন চট্টগ্রামের দিকে। আগেও আমরা চট্টগ্রামেই ছিলাম কিন্তু সেটা শহরাঞ্চলে না। শঙ্খনদীর পাড়ে দোহাজারির জামিজুরি’তে যেখানে ছিল কৃষিব্যাংকের একটা পুরনো শাখা। বাবা সেখানকার ম্যানেজার ছিলেন। এবারে আমাদের স্বল্পকালের ঠিকানা হবে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে—আন্দরকিল্লা আমার নানাবাড়ি। বাবা, আম্মা এবং দুই ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে আমরা এসে উঠলাম মায়ের বাড়ি।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বাবা একটা চাকুরির ইন্টারভিউ দিলেন এবং নির্বাচিত হলেন। গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকো কোম্পানির চিফ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। বিরাট জায়গাজুড়ে সিগ্রেট কোম্পানিটা ছিল এবং সন্নিহিত গোল্ডেন ম্যাচ ফ্যাক্টরি। এর মূল মালিক ছিল পাকিস্তানের হাজি হাশেম। তিনি পাকিস্তান চলে যান এবং পরবর্তীতে সরকার এটির মালিকানা বিষয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বাবাই এর সর্বেসর্বা ছিলেন। বাবা’র কাছে শুনেছিলাম। তাঁর দুই বিষয়ে মাস্টার্স (অর্থনীতি ও আইন), বিশেষত দ্বিতীয় মাস্টার্স-এর কারণে তিনি অন্যান্য প্রার্থীদের চাইতে অনেকটাই এগিয়ে থাকেন। এদিক দিয়ে বাবা’র সঙ্গে তাঁর শ্বশুরের মানে আমার নানার দারুণ একটা মিল ছিল। আমার নানাও ছিলেন দুই বিষয়ে মাস্টার্স—দর্শন এবং আরবি। বাবা যখন চাকুরিতে যোগ দেন তখন গোল্ডেন বেঙ্গল টোব্যাকোতে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না। কিন্তু যেহেতু কেবল শ্রমিক নয় বিরাট পুঁজি পরিচালনা-ব্যবস্থাপনার বিষয় জড়িত ছিল সেহেতু তাঁর নিরাপত্তার দিকটা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল। এর পরিণামে একদিন বাবা তাঁর অফিসের রয়েল ব্ল্যু মার্সিডিজ গাড়ি থেকে নামলেন এবং আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে কোটের পকেট থেকে বের করে আনলেন একটা সদ্যকেনা চকচকে রিভলবার। গুলিগুলো আলাদা একটা চামড়ার থলেতে ছিল গুলি এবং রিভলবার দুই আবার একসঙ্গে আরেকটা চামড়ার খোপে রাখার ব্যবস্থা আছে।
দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। খানিকটা ভয়ও আমাদের জেঁকে ধরে কিন্তু পরে যুক্তি দিয়ে বিচার করে আমরা আম্মা এবং ভাইবোনেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে রিভলবারটা বাবা এনেছেন আমাদের সমূহ নিরাপত্তার কথা ভেবে। কাজেই ভয়ের কোনো কারণ নেই। বাবা আমাদের প্রত্যেককে শপথ করান, রিভলবার ঘরে আনা হয়েছে ঘরেই থাকুক কিন্তু সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই যেন সংবাদে রূপ না পায়। যদি ঘুণাক্ষরেও কেউ সেটা সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আমরা কেউই বলি না, আমাদের ঘরে একটা অস্ত্র আছে। এখন হলে হয়তো বলতাম, বলে গৌরব বোধ করতাম। যাহোক, আমরা দেখতে এমনই গোবেচারা ছিলাম, বললেও হয়তো লোকে ভাবতো, আষাঢ়ে গল্প। এই রিভলবার নিয়ে প্রথম যে-ঘটনা ঘটে সেটা বেশ মজার। এমনিতে পোশাকে-আশাকে বাবা ছিলেন খুব ধোপদুরস্ত। একদিন শুক্রবারে জুমা’র নামাজ পড়বার জন্য পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছিলেন তিনি। একটা রিক্সায় উঠছিলাম আমরা। হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিভলবারটা ঠাস শব্দে পড়ে গেলে রিক্সাঅলাটা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ভাগ্যিস তখন আশেপাশে আর কেউ ছিল না। রিক্সাঅলা ভাবে, লোকটা হয়তো সিভিল ড্রেসে পুলিশের বড় কর্মকর্তা। ফের ঘরে গিয়ে বাবা রিভলবারটা রেখে আসেন। আম্মা খানিকটা বকুনির সুরে বলেন, সবাইকে বললে, খবরদার কেউ যেন রিভলবারের খবর না জানে আর এখন তোমার পকেট থেকে রিভলবার লাফ দিয়ে পড়ে!
রিভলবার সংক্রান্ত আরও একটি মজার স্মৃতি আছে। এক রাতে আমার সবাই ঘুমে। শীতের দিন ছিল, তখন রাতগুলো বড় হয়। হঠাৎ মাঝরাতে বাবা’র ঘুম ভেঙে যায় কিছু একটা শব্দে। শব্দটা আমাদের কক্ষের দরজার দিক থেকে আসছিল। কক্ষটাতে আমি এবং আমার বড় ভাই থাকতাম। সম্ভবত রাত দুটো বা আড়াইটা হবে। আমাদের দুই ভাইকে ফিসফিস শব্দে জাগিয়ে দেন বাবা। আমরাও তখন নিঃশব্দে কান পেতে শুনতে পাই, দরজার বাইরের দিক থেকে একটা শব্দ হচ্ছে। বাবা বললেন, চুপ করে থাকো, সম্ভবত কেউ বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। একজন না একজনের বেশি বোঝা যাচ্ছে না তবে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। দুই ভাই-ই তখন ভয়ে কাবু যদিও আমাদের মনে থাকা দরকার ছিল, বাবার কাছে একটা রিভলবার আছে। তবে আমাদের ঘরটা তখন আক্ষরিক অর্থেই আলো-আঁধারিতে ঘেরা একটা রহস্যময় কামরার মত লাগছিল। বাইরে থেকে মরা আলো এসে জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকলে সেই আলোর প্রতিক্রিয়ায় ঘরের ভেতরকার দেয়ালে ছায়া পড়ে বাবা’র। তাতে দেখতে পাই একটা ছায়ামূর্তি যার হাতে একটা অস্ত্র এবং তাকে বাবা নয়, সম্পূর্ণ অন্য একজনই মনে হয়। ফলে সামনে দাঁড়ানো বাবা এবং দেয়ালে বাবা’র প্রতিফলনে আসলে বাবা’রই আরেকটা রেপ্লিকা কিন্তু আমদের মনে হয় যেন অন্য কেউ, এই দুইয়ের সংমিশ্রিত ধন্দে আমরা যারপরনাই সংকুচিত হতে থাকলে সহসা আমার মনে হলো দরজার ধাক্কাটা খানিকটা ছন্দময়। মানে বিশেষ একটা প্রক্রিয়ায় সংগীতের মীড়ের উপস্থিতির মত একটা ছান্দিক বিন্যাসে দরজায় ধাক্কার ঘটনা ঘটছিল। বাবা ফিসফিস করে বলেন, কি ব্যাপার তোমরা দুই ভাই কি বিষয়ে কথা বলো? আমি বলি (চাপাস্বরে অবশ্যই), এত সুন্দর করে তাল মিলিয়ে কেউ দরজা ধাক্কায় নাকি। বাবা পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়েন, কী বলতে চাও? তখন আমি যুক্তি দেখাই, ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, ধাক্কাটা দরজার ঠিক মাঝ-বরাবর নয়, ভেসে আসছিল নিচের দিকটা থেকে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে শব্দ হচ্ছিল দরজায়, ঠিক এলোমেলো নয়।
আচমকা সাহসে ভর করে, যেহেতু হাতে শক্তিশালী ধাতব অস্ত্র, বাবা এগিয়ে যান দরজার দিকে। যেন খুলেই সামনে থাকা শত্রুকে তাক করবেন সেটা। বাবাই শেষে আবিষ্কার করলেন, সিটকিনি আটকানো হলেও দরজার নিচের দিকটাতে খানিকটা ফাঁকা থেকে যায়। সেই ফাঁকা সরু পথ দিয়ে বাইরের দিক থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিল একটা ধেড়ে ইঁদুর কিন্তু সফল হচ্ছিল না কোনোভাবেই। ইঁদুরটা যদি শীর্ণকায় হতো তাহলে এতক্ষণে হয়তোবা ঢুকে পড়তো। আমরা যতই ফিসফিসিয়ে কথা বলি না কেন তিনজনের ফিসফিসানি মিলে যে জোরালো ফিসফিস সৃষ্টি হয় তাতেই আম্মার ঘুম ভেঙে যায়। সব শুনে তিনি ব্যঙ্গ করেন বাবাকে, তিনজনে মিলে মাঝরাতে একটা ইঁদুরের মোকাবেলা করছে, তাও আবার পিস্তল দিয়ে। আম্মা কখনও রিভলবার বলতেন না। যাহোক রিভলবার এবং সেটির গুলি সবই শেষ পর্যন্ত অব্যবহৃত থেকে যায়। আমরা দুই ভাই প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসে বসে গল্প করতাম, আচ্ছা কবে দেখবো বাবা এই রিভলবার থেকে গুলি করছেন! সেটা যে মোটেও প্রীতিপ্রদ বা সুখকর অভিজ্ঞতা নয় তখন সেটা আমাদের খেয়ালেই থাকে না। মাঝে-মাঝে ভাবতাম এই বুঝি রিভলবার ব্যবহারের উপলক্ষ্য তৈরি হচ্ছে। যখন লোকেরা বাবা’র সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করবার জন্য আসতো এবং ড্রয়িংরুমে সম্মিলিত হতো আমরা পর্দার ফাঁক দিয়ে কিংবা কান পেতে শুনতাম, আলাপীদের কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে পৌঁছায় কিনা। কেননা সেটা হলেই হয়তো লোকেরা বাবার ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে এবং তখন তিনি গোপন জায়গা থেকে অস্ত্র বের করে মুহূর্তেই ঠাস করে গুলি ছুঁড়ে দেবেন। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, বাস্তবে সেটা ঘটা একদম সম্ভব নয়। কেননা, রিভলবারটা থাকে স্টিলের আলমারিতে একটা গোপন কুঠুরিতে এবং সেটা হস্তগত করতে হলে বাবাকে প্রথমে খুলতে হবে আলমারি, তারপরে ড্রয়ার এবং সবশেষে সেই ড্রয়ারের পাশে থাকা ছোট্ট প্রকোষ্ঠটা। সেটা করবার আগেই কী শত্রুর লক্ষ্য হয়ে তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়বেন না! আমরা হয়তো অহেতুকই এইসব আশঙ্কায় ভুগি। বাস্তবে তেমন কোনো ঘটনা ঘটে না। তবে একদিন আমরা সত্যি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমাদের একটা টেলিফোন সেট ছিল কালো রংয়ের, জবরজং ধরনের। অনেকবার শেল্ফের ওপর থেকে পড়ে গেলেও জার্মান সেই টেলিফোন-সেটটি বহাল তবিয়তেই থেকে যায়। বেশ কয়েকবারই নম্বর বদলেছিল সেটটির। দু’টো নম্বর আজও মনে আছে-৮২৪৪৮ এবং ২০২৪৪৮। বোঝাই যাচ্ছে গ্রাহক-সংখ্যা বাড়ার ফলে প্রাক্তন ‘৮’-এর বদলে এসেছিল ‘২০’।
বাবা কার সঙ্গে কথা বলছিলেন জানি না কিন্তু বিষয়বস্তু অনুমান করতে পারি। আলোচনা এবং উত্তেজনার বিষয় ছিল তামাক। বাবা তো সিগারেট কোম্পানির প্রধানই ছিলেন। অনেকেই অবশ্য বাবাকে নিয়ে খানিকটা রঙ্গ-রস করতো: জীবনে যে ধূমপান করে নি তিনি হলেন গিয়ে সিগ্রেট কোম্পানির এ্যাডমিনিস্ট্রেটর! ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবেশী দেশ ভারতে যে তামাক-প্রতিনিধিদল পাঠায় সেখানে অন্যতম সদস্য ছিলেন আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ। মাদ্রাজের (তখন চেন্নাই বলা হতো না) গুন্টুর নামক জায়গায় হয়েছিল সম্মেলন। সে যে কী উত্তেজনা আমাদের। সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিক আমার পিতা একদিন অফিস থেকে ফিরে এলেন পাসপোর্ট হাতে করে। আমাদের বোঝান, এটা হলো পাসপোর্ট, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হলে এই ছোট্ট বইটা তোমার লাগবেই। আর কী যে গর্ব তাঁর—পাকিস্তান আমলে কোনো পাসপোর্ট ছিল না তাঁর। স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং একটা পাসপোর্ট সেটির স্বীকৃতি। কী যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে কতবার কত উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলেন, সেইসব সত্য গল্প। ভারত থেকে আসবার সময় আমাদের জন্যে নিয়ে আসেন মজার চকোলেট ‘ক্যাডবেরি’। সেই ১৯৭২ সালে আমরা খেলাম ক্যাডবেরি চকোলেট। একটা ছিল বিঘৎখানেক লম্বা একটা টিনের কৌটায়—দেখতে লিচুর বিচির মত কিন্তু চকোলেট। জিভে দিতেই এমন এক অভূতপূর্ব স্বাদ যেন অন্য কোনো লোক থেকে বয়ে আসে সেই স্বাদ। আরও এক অহংকারের কাহিনী শোনান তিনি। যে-ক’দিন মাদ্রাজে থাকেন ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর মনে পড়ে ১৯৫৪-৫৬ সালের কথা। তাঁর প্রিয় দু’জন শিক্ষক ছিলেন—একজন এম এন হুদা এবং আরেকজন তামিল প্রফেসর আয়াঙ্গার। তিনি তাঁর খোঁজ করেন এবং তাঁকে খুঁজে পান মাদ্রাজ শহরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এককালের অধ্যাপক আয়াঙ্গারের বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি। প্রাক্তন ছাত্রকে পেয়ে তিনিও খুব অভিভূত বোধ করেন।
তো টেলিফোনে কেউ বাবাকে ফন করেন এবং নিশ্চয়ই তাঁরা আলাপ করেন তামাক বিষয়েই। সম্ভবত কোনো একটি বিদেশি জাহাজে তামাক এসেছিল গোল্ডেন টোব্যাকোর জন্যে। কিন্তু শিপিং কোম্পানির কোনো এক ব্যক্তি বাবা’র সঙ্গে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া বাধায়। পরিণামে জেটিতে জাহাজ থেকে মাল খালাসে বিলম্ব ঘটে এবং তাতে ডেমারেজ বাড়তে থাকে। ফোনে দু’জনেই উত্তেজিত এবং অপর পক্ষ নিশ্চয়ই বাবাকে হুমকি বা তেমন কোনো সংকেত দেয় যেজন্যে বাবা’র চড়া গলা শুনতে পাই, ঠিক আছে দেখা যাবে আপনি আমার কী করতে পারেন! তখন আমরা আশঙ্কা করি, রিভলবারের ব্যবহার বুঝি অত্যাসন্ন। কিন্তু না আমাদের হতাশ করে দিয়ে সেই হুমকিদাতা আর দেখা দিতে আসে না। ফলে আমাদেরও রিভলবার সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জন্যে অপেক্ষার কাল হতে থাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
আসে ভয়ংকর ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু’র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিদারুণ মুষড়ে পড়েন বাবা। বলতে থাকেন, আর চাকুরি করবেন না। স্বাধীন আইন-পেশাতেই যোগ দেবেন। কেননা, গণতান্ত্রিক সরকারের জবাবদিহিতা সামরিক সরকারের নিকটে প্রত্যাশা করা অরণ্যে রোদন মাত্র। কিছুদিনের মধ্যেই বাবা’র অনুমান সত্যি হয়। তাঁকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় পদস্থ হওয়ার লোভে উঠেপড়ে লাগে লোকেরা এবং একটা অশনির আভাস অনুভব করে তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দেন। তাঁর চাকুরিকালীন অনেকগুলো গাড়ি ছিল আমাদের। আমরা স্কুলপড়ুয়া দুই ভাই এমনও বাজি ধরতাম, আজ কোন্ গাড়িটা আমাদের নিতে আসবে স্কুলে—মার্সিডিজ, প্রিন্স, টয়োটা, ডাটসান, হুইল জিপগাড়ি, মাইক্রো! ১৯৭৪ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। তাঁকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম শহর থেকে রাঙ্গামাটি যান। সেই সফরটিতে ব্যবহৃত হয় বাবা’র গোল্ডেন টোব্যাকো কোম্পানির মার্সিডিজ গাড়িটা। রিক্যুইজিশন নেওয়া গাড়িটি সরকার ফেরত দেওয়ার কথা। তখন দেশে মার্সিডিজ গাড়ি খুব বেশি ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারা ক্ষমতা দখল করে তারা আর সেই গাড়ি ফেরত দেয় না।
যাহোক, বাবা আমাদের প্রতিশ্রুতি দেন, একদিন নিশ্চয়ই আমরা গাড়ি কিনবো। গোল্ডেন টোব্যাকো’র চাকুরি ছেড়ে স্বাধীন আইনপেশায় যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা কিছুদিন আগ্রাবাদে একটা বেসরকারি শিপিং কর্পোরেশনে কর্মকর্তার চাকুরি নেন। সকাল-সন্ধ্যার চাকুরিতে আগের মতই তাঁর ব্যস্ততা বহাল। ছুটির দিন ছাড়া তাঁর দেখা পাওয়া ছিল দুরূহ। ছুটির দিনগুলিতে সারাদিন আমরা তাঁকে কাছে পেতাম। বাবা খুব ভালোবাসতেন তাঁর শৈশব, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো তাঁর দিনগুলি সম্পর্কে আলাপ করতে। একদিন আচমকা তাঁর খেয়াল হলো, আগের চাকুরিতে যে ঝুঁকির দিক ছিল এবং যে-ঝুঁকির কারণে তাঁকে কিনতে হয়েছিল একটা নিরাপত্তা-রিভলবার বর্তমান চাকুরিতে সেই ঝুঁকি একদম নেই। কাজেই একটা অস্ত্র এবং সেটির ৬টা গুলি (সবই অব্যবহৃত) বেকার ঘরে রেখে কী লাভ। যেই কথা সেই কাজ। এসব কাজে উদ্যোক্তা বাবা’র সঙ্গী থাকতাম আমি। আমার বড় ভাইকে বাবা এসব কাজে সঙ্গে নিতেন না। রিভলবারটা কেনা হয়েছিল নিকটস্থ বক্শিরহাট পুলিশবিটের উল্টোদিককার চিটাগাং আর্মস নামক একটা অস্ত্রের দোকান থেকে। আলমারি থেকে গোপন প্রকোষ্ঠের সেই অস্ত্র বের করে আনা হলো। গুলিগুলো আগেই খুলে রাখা ছিল। আমি এবং বড় ভাই শেষবারের মত স্পর্শ করে দেখলাম সেটি। ধাতব ঠাণ্ডা ছোট দেখালেও মনে হলো ভারি সেই রিভলবার হাতে নিয়ে আমাদের সে কী বিস্ময়। মুহূর্তের জন্যে মনে হলো আমরাও পুলিশ।
আগে তো অফিসের গাড়ি ছিল আর এখন শিপিং কোম্পানির গাড়ি আসে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কাজেই বাবা বললেন, আমরা একটা রিক্সা নেবো। তখন সেইসব দিনে পলিথিন ছিল না। একটা মোটা চটের থলেতে বাবা রিভলবারটা একটা পুরনো খবরের কাগজের পাতা দিয়ে মুড়িয়ে ঢুকিয়ে নিলেন। ব্যাগগুলো যেহেতু মূলত বাজারের সেগুলো বারবার ধোওয়া হতো। তারপরেও সেই ব্যাগ থেকে মাছ এবং মাংসের আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো হাতে নেওয়ামাত্র। দেখে আম্মা ফোড়ন কাটেন, বাজারের ব্যাগের মাছের আর মাংসের গন্ধ পিস্তলে লেগে গেলে দেইখো আবার তোমার পিস্তলের দাম কমে যাবে! বাবা হাসেন, কী যে বলো না, গন্ধে কিসসু যায়-আসে না, গুলি বেরোয় কিনা সেটাই হলো মূল কথা। আসলে বাজারের ব্যাগে করে রিভলবার নেওয়ার অর্থ হলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে একটা মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আমরা বাপবেটা রওনা দিয়েছি, যদিও অস্ত্রের লাইসেন্সটা বাবা পকেটস্থ করে নেন আগেই। রিক্সায় ওঠার মুহূর্তে আমি বেঁকে বসি। বাবা জিজ্ঞ্যেস করেন, কী হলো, রিক্সায় ওঠ। বললাম, আমাকে টাকা দিতে হবে। ঐটা বিক্রি করে যে টাকা পাবা সেখান থেকে আমাকেও দিতে হবে টাকা। শুনে প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে যান তিনি। তারপর মৃদু হেসে বলেন, আচ্ছা দেবো, ওঠ। আমি উঠে পড়ি।
রিক্সা গন্তব্যমুখী। আমার মনে তখন এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আমি একবার তাকাই বাবা’র হাতে ধরা বাজারের ব্যাগটার দিকে। চটের সেই থলে থেকে মাছ-মাংসের গন্ধ ভেসে এলেও এর ভেতরে রয়েছে লৌহনির্মিত অস্ত্র। আরেকবার তাকাই আশেপাশে। মনে হতে থাকে লোকেরা যদি বুঝতে পারে বাবা আর আমি রিভলবার নিয়ে যাচ্ছি রিক্সায় করে তাহলে! সেদিনটার কথা মনে পড়ে, যেদিন বাবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গিয়েছিল রিভলবারটা। ত্রস্তে তাকাই, না ব্যাগটাতে কোনো ছিদ্র নেই। মোটা চটের থলে, বড়-বড় চালের বস্তা কেটে বানানো সেসব থলে। ডাক্তার চিনু নন্দীর চেম্বার, রমনা সিগারেট কোম্পানি, ওয়ার্সি প্রেস, দত্ত জুয়েলার্স, বদরুদ্দিন মিষ্টির দোকান এইসব অতিক্রম করে রিক্সা এসে দাঁড়ায় বক্শিরহাট পুলিশবিটের উল্টো দিককার চিটাগাং আর্মস নামক দোকানটার সামনে। মাঝবয়েসী লোকটা সম্ভবত বাবাকে চিনতে পারেন। অস্ত্রটা কেনার পর আরও কয়েকবার নানা কাজে বাবাকে আসতে হয়েছিল সেখানে। একথা-সেকথার পর, একটি গুলিও ব্যবহৃত না হলেও রিভলবারটা সেকেন্ডহ্যান্ড-ই। কাজেই সেটির মূল্য সেভাবেই ধার্য হওয়া চাই। নানা কথার পর, যেহেতু মনে হলো, বাবা’র নিকটে সেটার সংরক্ষণ এক ধরনের বিড়ম্বনা মাত্র, তিনি মোটামুটি কিছু কম হলেও একটা দাম দিয়ে ঘরে চলে আসতে পারলে বাঁচেন। মাঝবয়েসী লোকটা বললো, ঠিক আছে ১৩৩০ টাকাই দিচ্ছি। আমার মাথায় সেটা চট্ করে গেঁথে গেলো। আমি ভাবলাম, আমার পাওনাটা এই তেরশোতিরিশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আবার রিক্সা ঠিক করা হলো। পার্থক্য হলো, এবারে চটের থলেটা ভাঁজ করা। রিক্সায় ওঠার মুহূর্তে আমি বেঁকে বসি আবারও, আমার টাকা কই! বাবা বলেন, ওমা, তোমাকে দেবো বলেছি তো, ঘরে চলো, নিশ্চয়ই দেবো। আমি বললাম,না এখনই দিতে হবে নইলে আমি রিক্সায় উঠবো না। আমি উকিলের বা ডাক্তারের ফি’জ্ নেওয়ার মত করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি, তুমি তো ১৩৩০ টাকা পেয়েছো, আমাকে ৩০ টাকা দিতে হবে। শুনে বাবা বলেন, মাগো, কী বলে ব্যাটা! (আদর করে ব্যাটাই বলতেন।) এত্তগুলো টাকা! তুমি আমার সঙ্গে আসছো আবার যাচ্ছো, তাও হেঁটে না, রিক্সায়। তাই বলে তিরিশ টাকা? আমিও কম যাই না। বললাম, তুমি তো বলেছো দেবে, এখন দাও, ৩০ টাকা দাও। আমার মাথার মধ্যে কেন জানি ৩০ সংখ্যাটা ঢুকে পড়েছিল। আমি ভাবছিলাম ১৩০০ টাকা তো একটা সুন্দর পূর্ণ সংখ্যা। ভাবতেও ভালো লাগে। আর এর সঙ্গে লাগোয়া ৩০-কে অতিরিক্তই তো মনে হয়। ১৯৭৫ সালে ৩০ টাকা আসলে অনেক টাকা। যাহোক বাবা আমাকে ১০ টাকা দিলেন। বললেন, কালকে মিষ্টি কিনে আনবো তোমাদের সবার জন্য। এখন ঘরে চলো। আমরা ঘরে ফিরে আসি। আর কখনও অস্ত্রের সংস্পর্শে আসতে হয় নি বাবাকে। সেই প্রথম এবং সেই-ই শেষ।
চট্টগ্রাম: ০৪-০৪-২০২৩
ড. মহীবুল আজিজ, অধ্যাপক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।