বঙ্গবাজারে ভস্মীভূত সম্পদ, নবজন্মের স্বপ্ন ও সতর্কতা
বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের জায়গায় অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীদের বসানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইট বিছিয়ে মেরামত করে নতুনভাবে গড়ে ওঠা অস্থায়ী এই মার্কেট এখন দৃশ্যমান। দোকানিরা বুধবার (১২ এপ্রিল) এখানে বসে বেচাকেনা শুরু করতে পারবেন। বাংলা নববর্ষের প্রাক্কালে ভস্মীভূত সম্পদ ও নবজন্মের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হবে বঙ্গবাজারের আরেক ইতিহাস।
উল্লেখ্য, বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ব্যবসায়ীরা সেখানে খোলা জায়গায়ই চৌকি বসিয়ে বেচাকেনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি পুড়ে যাওয়া মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। যদিও তাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা কম। মার্কেটের পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
মার্কেটটির লক্ষ লক্ষ ক্রেতা ছিল নিম্ন আয়ের সাধারণ গরিব জনগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের শপিং স্বর্গের নাম ছিল বঙ্গবাজার, যা নারকীয় আগুনে ছাইভস্মে পরিণত হয়। মার্কেটের বিক্রেতারাও ছিলেন মাঝারি ব্যবসায়ী। মার্কেটে ছিল মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের প্রয়োজনীয় অঢেল কাপড়চোপড়। অকস্মাৎ আগুনে সবই পুড়ে ছাই। ভস্মীভূত হয়েছে সহায়, সম্পদ ও স্বপ্ন। আহাজারি আর হাহাকারের ভারী বাতাস ও উড়ন্ত ছাইভস্ম থেকে সঞ্চারিত হয়েছে নতুন জীবনসংগ্রাম। ফিনিক্স পাখির মতো মাথা তুলছে বঙ্গবাজার।
বঙ্গবাজার একটি নাম হলেও সেখানে রয়েছে মোট ৬টি মার্কেট আর দোকানের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সবই ছিল জামাকাপড়ের দোকান। ৬ ঘণ্টার লেলিহান আগুনে পুড়ে সব শেষ। ধ্বংসস্তূপ পরিণত হলো রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের আস্ত একটি জীবন্ত মার্কেটপ্লেস।
প্রলয়ঙ্করী অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয় কোটি কোটি টাকার কাপড়। নগদ টাকা। যাবতীয় আসবাব। সেইসঙ্গে পুড়েছে কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর কপাল। এই চৈত্রের শেষ-পর্যায়ে এবং সংযমের মাস রমজানের পটভূমিতে অগ্নি-দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে সম্পন্ন ব্যবসায়ী থেকে পথের ফকিরে পরিণত হয়েছেন কয়েক শত মানুষ। হাজার হাজার কর্মচারী আর মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল লোকজনও জীবিকার অবলম্বন হারিয়ে প্রায়-সর্বহারা।
ঢাকার বড় পাইকারি ও খুচরা কাপড়ের মার্কেট বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটিপতি থেকে নিঃস্ব হয়েছেন শ’ শ’ ব্যবসায়ী। চোখের সামনে নিজের স্বপ্ন-সম্বল পুড়তে দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫ হাজার দোকানের মালিক-কর্মচারী মিলিয়ে অন্তত অর্ধলাখ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আনুমানিক ২ হাজার কোটি টাকা।
এই হলো ঘটনার একদিক। আরেক দিকের তথ্য বলছে, যখন ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছিল মার্কেটটি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’, তখন কেউ তা আমলে নেয়নি। বার বার ঘোষণা করার পরেও সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হয়নি। ব্যবসায়ীদের ১০ বার নোটিশ দিলেও কেউ তা গ্রাহ্য করেনি।
বঙ্গবাজারের আগুন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালো, নাগরিক সুরক্ষার মৌলিক বিষয়গুলোকে এদেশে কী ভয়ংকরভাবে অবজ্ঞা করা হয়! সবাই মিলেই যেন মানুষকে মৃত্যুমুখে ফেলে রাখা হয়। উদাসীনতা কার কতটুকু, সে বিচার করার আগে এ সত্য স্পষ্ট হয়, নাগরিক সুরক্ষার বিষয়ে কেউ কারো চেয়ে কম দায়ী নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ যেমন নোটিশ দিয়ে খালাস, ব্যবসায়ীরাও তেমনিভাবে ঔদাস্যের মাধ্যমে অবহেলা দেখিয়েছেন। শুধু বঙ্গবাজার নয়, পুরনো ঢাকার বহু বিপদজনক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এমনই অসংখ্য সীমাবদ্ধতার নজির পাওয়া গিয়েছে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের তরফ থেকে।
নগরজীবনে আগুন বিষয়ক এই বিপর্যয় নতুন নয়। শুধু এই বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটেই এর আগে কমপক্ষে তিনবার আগুন ধরেছিল। ১৯৯৫ সালে দুইবার আর ২০১৮ সালে একবার। এরপর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন লাগার ঝুঁকির কথা লেখা ব্যানার টানিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, কিন্তু তাতে হুঁশ হয়নি কারও। যেমনভাবে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দাহ্য পদার্থের কারখানা ও বিপদসঙ্কুল কেমিকেল ফ্যাক্টরিগুলো প্রায়শই অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় এবং এ নিয়ে পূর্ব-সতর্কতা কেবলমাত্র 'মুখে-মুখে' বা 'কাগজেকলমে' ছাড়া বাস্তবে কেউই দেখান না।
সন্দেহ নেই, রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসায়ীদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। ঈদের আগে এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে দোকানিরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ঈদের অপেক্ষায় থাকেন তারা সারা বছর ধরেই। যে ঈদে তাদের 'বড় ব্যবসা' হওয়ার কথা, তার বদলে নেমে এসেছে 'ভয়ঙ্কর বিপদ'। বিপদ শুধু আগুনেই শেষ হয়নি। গণমাধ্যমের ভাষ্য মতে, আগুনের ক্ষতির সঙ্গে তাঁদের মনে আরেক শঙ্কা ভর করেছে। তা হলো পুড়ে যাওয়া দোকানের জায়গায় তাঁরা নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে।
অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন ব্যবসায়ীদের মতে, আগে বিভিন্ন মার্কেটে আগুন লাগার পর এমন দেখা গেছে যে যাঁরা প্রকৃত দোকানি, তাঁরা আর দোকান ফেরত পাননি। অন্য কেউ তা দখল করে নিয়েছেন। এমন হলে তো সব-হারানো মানুষগুলোর ঠাঁই-ঠিকানাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যাকে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' বলতেও কম বলা হয়।
প্রকৃত ব্যবসায়ীরা জীবন-জীবিকার তাগিদে কীভাবে দ্রুত ব্যবসা শুরু করা যায়, সেটা নিয়েই চিন্তিত। আনুষ্ঠানিক সমবেদনার বদলে তাঁরা দ্রুত পুনর্বাসন চান। আসলে যথোপযুক্ত পুনর্বাসনই তাঁদেরকে নতুন জীবনের দিশা দেখাতে পারে। তাঁদের ভস্মীভূত সহায়, সম্পদ ও স্বপ্নের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে।
বলা বাহুল্য, অভাবনীয় আগুনে পুড়ে ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তাঁদের সম্পদ বলতে মনোবল ছাড়া অবশিষ্ট আর কিছু নেই। এখন উচিত হবে, সরকারি পর্যায় থেকে দ্রুত বরাদ্দ দিয়ে এসব ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা। ব্যবসায়ীদের মনে সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে এই জায়গা তাঁরা আবার ফিরে পাবেন কি না। এই জায়গা ফিরে না পেলে তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে অবিলম্বে তাঁদের এইসব ভীতি নিরসনে দৃশ্যমানভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই তাদের বিপদের বোঝা লাঘব ও ভয়-ভীতি দূর হবে এবং তাঁরা আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন ও তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন সফল হবে।
উপরন্তু, বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সবাইকেই আবশ্যিকভাবে নাগরিক সুরক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো ও নিরাপত্তা বিষয়ে দায়িত্বশীলতার দীক্ষা নিতে হবে। বিশেষত প্রযুক্তি ব্যবহার ও আগুনের ক্ষেত্রে অবলম্ব
করতে হয় বাড়তি সতর্কতা। কারণ, ইতিহাসের ভাষ্য মতে, আগুনের আবিষ্কার সবকিছু বদলে দিয়েছিল। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ খাবার সিদ্ধ করে খেতে শেখে। আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করতে শেখে, বন্য প্রাণীকে ভয় দেখাতে আগুন ব্যবহার করতে শেখে। সর্বোপরি আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রাই পুরো পাল্টে গিয়েছিল।
কিন্তু, সভ্যতার প্রতিটি আবিষ্কারেই আশীর্বাদের পাশাপাশি কিছু অভিশাপ থাকে। আগুন এমন একটি পদার্থ যার সাধারণ ধর্ম হলো দহন। ভুল করে আগুনে হাত দিলেও আগুন পোড়াতে ভুল করবে না। আগুনের কাছে ধর্মস্থান, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট সবই সমান। আমাদের সমাজ জীবনেও আগুনের মতো কিছু ধ্বংসাত্মক জিনিস রয়েছে। সমাজে যখন কোনো অপরাধ দানা বাঁধে তখন তা গোটা সমাজকেই গ্রাস করে। সমাজে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষই থাকে। তথাপি অন্যায়ের জোরই বেশি। আগুন ও অপরাধ এ দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। উভয়ই ছোট থেকে বড় হতে থাকে এবং ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগুনের যেমন দহন ছাড়া কোনো ধর্ম নেই, তেমনি অপরাধেরও ধ্বংস ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আগুন রূপে অপরাধকে বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে। আগুনের মতোই অপরাধ ভালো-মন্দ সব কিছুকেই গ্রাস করে। কারো প্রতি তার পক্ষপাত নেই।
অতএব, আগুন ও অপরাধ অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন যেমন ভাল-মন্দ সবকিছু পোড়ায়, তেমনি অন্যায় পাপকে গ্রহণ করে ভালোকে ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ করতে হবে। বিশেষ করে নগরজীবনের সুস্থ ও নিরাপদ বসবাসের জন্য আগুনের বিপদকে মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে ঢাকার মার্কেটগুলোর যে চালচিত্র বেরিয়ে এসেছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। কেবল বঙ্গবাজার নয়, নতুন-পুরোনো অনেক মার্কেটই ঝুঁকিপূর্ণ।
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর জানা গেল, রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেটও ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিস ঢাকার সাত-আটটি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ফায়ার সার্ভিস অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিটাই চিহ্নিত করে থাকে। অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইনের ঝুঁকি চিহ্নিত করার জন্য আলাদা সংস্থা আছে। পুরান ঢাকার অনেক ভবনের অবস্থা, তা মার্কেট হোক আর বসতবাড়ি—মাথার ওপর বাড়ি পড়ো পড়ো। সম্প্রতি সিদ্দিকবাজারের একটি ভবনে দুর্ঘটনা ঘটেছে মেঝের নিচের গ্যাসলাইন থেকে।
দেশের কলকারখানাগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের গঠিত বহুপক্ষীয় জাতীয় কমিটি সারা দেশে পাঁচ হাজারের বেশি কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠানকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে। এসব তথ্য জানাই যথেষ্ট নয়, প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই জরুরি। বঙ্গবাজারে যে অগ্নিকাণ্ড ঘটল, তার তিক্ত ও করুণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, সিটি করপোরেশন ও রাজউকের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের দায়ও কম ছিল না। মার্কেট কর্তৃপক্ষকে ১০ বার নোটিশ দেওয়ার পরও নির্বিকার থাকা দুর্ঘটনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো ছাড়া কিছু নয়।
ড. মাহফুজ পারভেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।