চ্যাটজিপিটি সেনসেশন ও স্পুনফিডের শঙ্কা ঠেকাবে কে?
চ্যাটজিপিটি (জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইন্ড ট্রান্সফার) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্দেশিত এটি এমন একটি চ্যাটবট যা সংরক্ষিত ডেটাভিত্তিক সফটওয়্যার দ্বারা পরিচালিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোতে অবস্থিত কৃত্রিম প্রযুক্তি তৈরীকারী প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই এই চ্যাটবট তৈরী করেছে।
খোলা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গল্পকরার প্রবণতা অল্পদিন আগে শুরু হয়েছে। এর সার্চ ইঞ্জিন গুগলের মতো চিত্র ও লিঙ্কভিত্তিক উত্তর প্রদানের পরিবর্তে টেক্সটভিত্তিক উত্তর দেয়। এই লেখাগুলো পান্ডুলিপি আকারে সংযুক্ত করে অতিদ্রুত উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, বই, ক্লাশের এ্যসাইনমেন্ট, হোমওয়ার্ক, চিকিৎসা রিপোর্ট, গবেষণাপত্র এমনকি পিএইচডি থিসিসও তৈরী করা যায়। সেগুলো পৃথিবীর সকল জনপ্রিয় ভাষায় সংগে সংগে অনুবাদ করা যায়। তাই এটা এখন একটা সেনসেশন, একটা বিস্ময় ও করোনার মতো একটা মহামারী। যা নিয়ে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারী মানুষেরা উন্মুখ হয়ে উঠেছে। এই হঠাৎ বিস্ময় থেকে নানা শঙ্কার উন্মেষ ঘটছে।
কারণ, চ্যাটজিপিটি-কে বলা হচ্ছে সর্বজ্ঞানী, করিৎকর্মা ও সর্বজ্ঞান পিপাসু একটি নকল মগজের আড়তদারী। তাকে যা বলা যায় তর-ই একটা উত্তর লিখে দেয় অতি ঝটপট করে। প্রতিবার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয় নতুন আঙ্গিকে। উত্তর দিতে অপারগ হলে তার এথিকাল সীমাবদ্ধতার কথা বলতে দেরী করে না।
প্রতিটি মুহূর্তে ব্যবহারকারীরা যে যেটা জিজ্ঞাসা করুক না কেন জিপিটি অতিদ্রুত তার ব্যাখ্যাসহ উত্তর নিয়ে হাজির হচ্ছে পর্দায়। কেউ কিছু বললেই সে সেটা ক নতুন হিসেবে গ্রহণ করে। সেটাই তার শিক্ষা। সবার জিজ্ঞাসাকে সে উত্তর দিয়ে সেই তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। ওর শেখার শেষ নেই। এভাবে সে তার জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। সে দারুণ স্মার্ট, কিন্তু এখনও সুপারস্মার্ট হয়নি। কারণ, সে কোথাও থমকে গেলে এথিকাল সীমাবদ্ধতার কথা প্রকাশ করে পিছু হটেতে চায়।
গুগল বা অন্যান্য অনলাইন প্লাটফরমগুলো জনপ্রিয়তা পেতে যে সময় নিয়েছিল চ্যাটজিপিটি সেসময় খুব দ্রুত জয় করেছে। এতে নানা প্রিট্রেইন্ড মডেল ব্যবহৃত হয়। এখানে বিলিয়ন ডলার ফান্ড দামী মেশিন লার্নিং প্লাটফরম ব্যবহার করা হয়েছে তাই অনেকে এটাকে এপ্লিকেশন ডেভলপমেন্টের জন্য যথার্থ মডেলে হিসেবে মনে করছেন। চ্যাটজিপিটি টেক্সটভিত্তিক প্রোগ্রাম হওয়ায় গবেষণা ও শিক্ষাখাতে এটা অনেকের নিকট আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
তবে অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। কৌতুহলী মানুষ হঠাৎ করে যা ভাবছে তাই জিজ্ঞেস করে চলেছে। ফলে চ্যাটের ভড়কে যাবার ঘটনাও ঘটছে। এর ফলে ওর বক্তব্যে বেশী যান্ত্রিকতার ছাপ লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে। তাই অনেকে মনে করছেন গুগল স্ট্রীটের মতো এটাকে অন্ধের মতো অনুসরণ করতে থাকলে রাস্তা হারিয়ে খাদের মধ্যে ডুবে হারিয়ে যেতে পারে।
সে মুহূর্তেই কোন কিছুর হাজার হাজার উত্তরের কপি তৈরী করে দিতে পারে। সে নিজেই যেহেতু সবসময় নতুন কিছু শিখছে সেহেতু তার জন্য এক্সকিউজ চাওয়া একটা বড় ব্যাপার। সেজন্য তাকে দোষী করার উপায় নেই।
আরেকটি বিষয় হলো সে যেসব উত্ত্র দিচ্ছে সেগুলো নিয়ে এখনও কোন গবেষণা হয়নি। কারণ, এর উথ্থান খুব নতুন হওয়ায় এখনও সেসব বিষয়ে গবেষণা করার সময় সৃষ্টি হয়নি। তাই এর উপর ভাল-মšদ যাচাই বা সমালোচনা করার সময় এখনও হয়নি। তবু আশেপাশের পরিবেশ থেকে কিছু বিষয় আঁচ করে কিছু কথা বলা যায়।
গতমাসে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ক্লাশে পড়ানোর সময় কিছু শিক্ষার্থীকে দীর্ঘক্ষণ বার বার মাথা নিচু করে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। এব্যাপারে একটু সজাগ করলে তারা হতচকিত হয়ে তাকিয়ে উঠতো। কিন্তু মার্চে এসে দেখলাম তাদের মাথা নিচু করে অমনোযোগী হবার প্রবণতার সংখ্যা ও সময় উভয়ই বেড়ে গেছে। এর কারণ তখনও জানতে চাওয়া হয়নি।
কিন্তু পরদিন এমএসএস এমনকি ইএমএসএস শিক্ষার্থীদের মধ্যে একই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। কৌতুহল বশত: এর কারণ কি জিজ্ঞেসা করতেই তারা আমতা আমতা করে উঠলো। তখন তাদেরকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই মাথা নিচুকারীরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। পড়ার বিষয়ে ততটা আগ্রহ না থাকলেও চ্যাটজিপিটি বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও উৎকন্ঠা খুব বেশী। শিক্ষক কোন বিষয় পড়াতে থাকলে তারা অতিদ্রুত সেটার উত্তর চ্যাট করে মোবাইলের পর্দায় এনে শিক্ষককে পাল্টা প্রশ্ন করতে দ্বিধা করছে না। আপাতদৃষ্টিতে তাদের এই জিজ্ঞাসা কারার প্রবণতা বেশ ভাল লাগলেও শিক্ষকের উত্তরের পর তাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন।
একটি কনসেপ্ট সম্পর্কে একজনের নিকট জানতে চাইলাম তোমার মতামত কি? সে একটু সময় নিয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্ট করলো। ইতোমধ্যে আরেকজন সেটার উত্তর চ্যাটের মাধ্যমে বের করে উত্তর দিয়ে ফেলল। তবে ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন সেটার উত্তর চ্যাট করে নতুন উত্তর দিতে গিয়ে ক্লাসে বড় গুঞ্জন সৃষ্টি করে ফেলল। সবার কাছে নতুন নতুন উত্তর। বললাম, বাহ্ খুব ভাল। কিন্তু উত্তরগুলোর মর্মার্থ শুনতে গিয়ে দেখা গেল একই কথা বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ, একই মেশিন লার্নিং প্লাটফরর্মের মধ্যে মডেল অভিন্ন হওয়ায় উত্তরের মধ্যে সমজাতীয়তা ও যান্ত্রিকতার ছোঁয়া বেড়ে গেছে। এটা হলো লিখিত আলাপচারিতার বেলায়।
তবে কিছুদিন পর মেশিন লার্নিং প্লাটফরমকে যদি গান গাইতে বলা হয় তাহলে কি কন্ঠস্বর ভেদে মানুষের মতো আলাদা আলাদা করে শোনাতে পারবে অথবা সুরের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয়? সেটা করতে না পারলে সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা কিভাবে এই প্লাটফরমকে নিত্যনতুন বলে ব্যবহারে আগ্রহী হবে? বিষয়টা বায়োলজিক্যাল ও আবেগীয় তাই আপাতত: সমাধানহীন।
এখন আপাতত: খোলা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটোমেশন খুব দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। কারখানার উৎপাদন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংকিং, ক্রয়-বিক্রয়, হোটেল ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ইত্যাদিতে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হতে পারে। তবে খোলা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ ব্যবহারের দিকটি সবাই যদি শুরু করে তাহলে সিকিউরিটি নিশ্চিত হবে কীভাবে? এর তথ্য গোপনীয়তা ও তথ্য স্বচ্ছতা নিরুপণ করবে কে?
ইতোমধ্যে চ্যাটজিপিটিতে ত্রুটির কারণে একজনের চ্যাট আরেকজন ব্যবহারকারী পড়তে পেছেন। এই তখ্য প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নিজেই স্বীকার করেছেন। একজন ব্যবহারকারী তার চ্যাটে একটি ছবি শেযার করেছেন যার শিরোনাম চীনের সমাজতন্ত্র উন্নয়ন। পুরো কথোপকথনটি ম্যান্ডারিন ভাষায় করা হয়েছিল। এ ত্রুটি থেকে ইঙ্গিত মেলে চ্যাটজিপিটিতে ব্যবহারকারীর তথ্যে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা গড়ে উঠেনি। এছাড়া চ্যাটজিপিটির আলাপ দ্বারা কাজ ও তথ্য প্রতিবার প্রতিজনের নিকট নতুন হিসেবে প্রতীয়মান বলে ধরে নেয়া হলে এ্যান্টি প্লেজারিম সফট্ওয়্যার এখানে কেমন হবে এবং সেটা কিভাবে ব্যবহৃত হবে? এর জন্য বিশাল খরচের বহর কে বহন করতে আসবে?
চাকুরী হারানোর কখা অনেকই বলছেন। ইতোমধ্যে অনলাইন ম্যাগাজিন এমনকি ছাপানো কাগজের লেখাও বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে জাপানে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত একটি দারুণ বই পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে লেখা ও মানুষের লেখা নয় এমন বই নয় পুরস্কার পেলেও বাতিল করা হয়েছে। দেশে দেশে শিক্ষাজগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবাধ ব্যবহারের ফলে বড় সংকট তৈরী হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং গবেষক সবাই যদি নিজস্ব মগজের ব্যবহার বন্ধ করে চ্যাটজিপিটি-র কাছে উত্তর চেয়ে ধর্ণা দিতে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা কি ঘটবে?
কিন্তু এর ভুল ধরবে কে? এগুলো ঠেকাবে কে? বলা হচ্ছে- চ্যাটজিপিটি সবার কাছ থেকে সবকিছু শুনে শুনে সবজান্তা হয়ে নিজেই এডিটর হচ্ছে। নিজেই নিজের একাডেমিক ও সার্বিক তথ্যভান্ডার দেখভাল ও যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। সেটা ভাল মনে হলেও আরো ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে। কারণ কোন সফটওয়্যার সবজান্তার ভূমিকা পালন শুরু করলে রক্ত-মাংসের মানুষের পৃথিবীতে আর কোথাও ঠাঁই হবে বলে মনে হয় না।
মানুষ বিষ আবিষ্কার করেছে ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ দমন করে নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য। তবুও কেউ কেউ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে থামানোর চেষ্টা করেও পারে না। উল্টো প্রতিদিন নিজেদেরকে হত্যা করে। ভয়ংকর কিছু সৃষ্টি করাটাই মানুষের জন্য অতি ভয়ংকর। এই মূহুর্তে কোথায় পারমাণবিক বোমা ছোঁড়া হবে তা-কি কৃত্রিম বুদ্ধিমান যন্ত্ররা বলে দিতে পারবে- নিশ্চয়ই না। এজন্য সিদ্ধান্তটা মানুষকেই নিতে হবে।
এতদিন যেসব আধুনিক প্রযুক্তির আবিস্কার হয়েছে সেগুলো এই কৃত্রিম মগজের মতো এতদ্রুত সাড়া ফেলেনি। কৃত্রিম মগজের অনৈতিক ব্যবহার যদি মানুষের আসল মগজে ও মননে গেঁথে গিয়ে মানুষকে অলস, কর্মবিমুখ ও অথর্ব করে দেয় ও স্বচ্ছ চিন্তা করতে বাধা দেয় তাহলে সভ্যতার ধ্বংস অতি সামনে। তাই পৃথিবীকে দীর্ঘসময় বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদেরকে অন্তত: জ্ঞানবুদ্ধি চর্চ্চার ক্ষেত্রে কৃত্রিম মগজের স্পুনফিডের উপর বেশী নির্ভরশীল না হয়ে সাবধানে পদক্ষেপ নেবার সময় এসে গেছে।
*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]