এখন পর্যন্ত ভালো বিকল্পের নাম গণতন্ত্র
করোনা কবলিত হয়ে এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নেই। তদুপরি, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভাল নেই মর্মে প্রায়ই খবর রটায় পশ্চিমের নানা গবেষণা সংস্থা। বর্তমান বিশ্বের একশত পঁয়ষট্টিটি দেশে সমীক্ষা করে এমনই ফল প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া, অর্থনীতি বিষয়ক একটি প্রসিদ্ধ ব্রিটিশ পত্রিকা নিয়মিত গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশ করে থাকে। নির্বাচনী পদ্ধতি ও বহুত্ববাদ, সরকারের কর্মরীতি, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নাগরিক স্বাধীনতা— এই পাঁচটি বিষয়ের নিরিখে প্রস্তুত হয় ওই সূচক।
সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে মাত্র বাইশটি দেশে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ বহাল রয়েছে। সেগুলোতে ববসবাসকারী মানুষের সংখ্যা সারা বিশ্বের নিরিখে মাত্র পাঁচ শতাংশের কিছু অধিক। এমনকি, বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বঘোষিত মোড়ল খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালেই পূর্ণতার মর্যাদা হারাইয়া ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে এসেছিল। পরের বছরগুলোতেও দেশটি পূর্বের মর্যাদা ফিরে পায় নি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত বরাবরই ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ নিয়েই চলছে। প্রায়ই দেশটির নম্বর কমে। কখনো তার স্থান হয়েছে পঞ্চাশটি দেশের পরে। গবেষকরা মনে করেন নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষয় ভারতীয় গণতন্ত্রের অবনমনের প্রধান কারণ। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের জেরে নাগরিকের অধিকার খর্ব, আসামে নাগরিক পঞ্জির প্রতিরোধ ভারতে গণতন্ত্রকে ‘পিছিয়ে’ দিয়েছে। বলা হচ্ছে, বিজেপিট মোদী-শাহ জুটি রাজনীতি ও প্রশাসনের যে মুখ ও অভিমুখ নির্মাণ করেছেন, তাতে নাগরিকের প্রত্যাশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাস্তব রাজনীতির চেহারা, সরকারি নীতি এবং পুলিশ-প্রশাসনের কার্যরীতির সংযোগ সামান্যই।
বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের সূচকে যে ক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বরং বলা ভালো, কর্তৃত্ববাদের উল্লম্ফনের পটভূমিতে গণতন্ত্রের এহেন মন্দ দশা সারা বিশ্বেই ঘনীভূত হচ্ছে। গবেষণায় দৃশ্যমান হয়েছে যে, চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোও গণতন্ত্রের নিরিখে বরাবরই পশ্চাতে রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশেও গণতন্ত্রের দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়েছে। নিঃসন্দেহে এর অন্যতম কারণ, সকলের মধ্যে সম্পদের সমবণ্টনে পুঁজিবাদের ব্যর্থতা, বিশেষজ্ঞদের অভিমত এমনই। গত চার দশক পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরাট বৃদ্ধি হয়েছে, পুঁজি বেড়েছে, কিন্তু কর্মীদের পারিশ্রমিক সেই তুলনায় বাড়ে নি এবং বণ্টন সুষম হয় নি। অধিকাংশ সম্পদ কতিপয় ধনীর হস্তগত হয়েছে। তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগই কুক্ষিগত হয়ে আছে বিশ্বের মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কব্জায়।
এমতাবস্থায়, অধিকাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানে উন্নতি থেমে গেছে। আর্থিক ক্ষেত্রের গতিহীন স্তব্ধতা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। উপরন্তু, গণতন্ত্র তার নির্বাচনী রাজনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা বা আইন-আদালত দিয়ে এরূপ অন্যায়-অসাম্য আটকাতে পারে নি। ফলে উদারবাদ ও গণতন্ত্রের মাথায় চড়ে বসছে কর্তৃত্ববাদ।
সন্দেহ নেই, শত বিরূপতার মধ্যেও এখন পর্যন্ত ভালো বিকল্পের নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্রই বিশ্বের সামনে সুশাসনের লক্ষ্যে শেঢ ভরসা স্বরূপ। তত্ত্বগত ভাবে, গণতন্ত্র, নির্বাচন, সুশাসন ও উন্নয়ন, এই প্রত্যয়গুলো পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়তার জন্য এসবের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা গতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার আলোকে বিকশিত হয় । আবার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে একটি অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আবশ্যিকভাবে একটি অপরিহার্য বিষয়। আবার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নিশ্চিত করতে পারে প্রকৃত সুশাসন, যা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়িত্বশীলতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে জনস্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি-মুক্ত জনমুখী ও টেকসই উন্নয়নের গ্যারান্টি দেয়।
অতএব, গণতন্ত্র, নির্বাচন, সুশাসন ও উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বব্যাপীই পলিটিকাল ও সিভিল সোসাইটি, উভয়েই সচেতন। বিশেষত, এসব বিষয়ে নাগরিক ভাবনার স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বার্থেই জরুরি। কেননা, নাগরিক সমাজ তথা জনগণই একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক ধারা, সফল নির্বাচন, লাগসই উন্নয়ন ও কার্যকরী অর্থে প্রকৃত সুশাসন নিশ্চিত করার পেছনে মূল চালিকাশক্তি, যে শক্তির বলেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতিনির্ধারকগণ, প্রশাসকবৃন্দসহ সাংবিধানিকভাবে-অর্পিত দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
এমনই পটভূমিতে বিধিবদ্ধ সাংবিধানিক দিকনির্দেশনার আলোকে সামনের দিনগুলোতে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ অপেক্ষমাণ। বলার অপেক্ষা রাখে যে, নানা কারণে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কেমন হবে তার উপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ধারা, সুশাসনের বিকাশ ও উন্নয়নের বিস্তারসহ আরো অনেককিছুরই ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যানুযায়ী, নির্বাচনকে বলা হয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব। জনগণের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রক্রিয়া তথা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে খুবই আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দাতা দেশ ও সংস্থাসমূহ সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখতে চায়। ফলে আগামীতে একটি অর্থবহ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে সকলেই উৎসুক ও আগ্রহী, যার আভাস এরই মধ্যে বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে আগামী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে নির্বাচনকালে প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে অপরিহার্য। এজন্য, সুষ্ঠুতা নির্বাচন নিশ্চিত করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের রক্ষার্থে আগামী নির্বাচনের নানা অসঙ্গতি দূরীকরণের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়টিও সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য পাচ্ছে।
পাশাপাশি, আগামী জাতীয় নির্বাচন সুুুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক তথা গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে জনমনে যেকোনো ধরনের সন্দেহ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটানোর তাগিদও দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের তরফে। দেশের জনগণের ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার এবং দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনের অস্তিত্ব যেন কোন ধরনের সংকটে আপতিত না হয়, জনগণকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকার বিষয়টিও ক্রমশ সামনে আসছে।
বিশেষত, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে আরও ব্যাপক এবং বৃহত্তর পরিসরে কাজ করে সুষ্ঠু নির্বাচন ও মসৃণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কার্যকরী সহযোগী রূপে এগিয়ে আসার বিষয়টিও বিদ্যমান বাস্তবতায় জরুরি বলে বিবেচিত হচ্ছে। একটি গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করে বাংলাদেশে সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিক ও উন্নয়নের সুফলগুলোকে অর্থবহ করার ক্ষেত্রে সকলের ভূমিকাই মূল্যবান। গণতন্ত্রে শত ফুল প্রস্ফুটিত করতে সকলের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা যাতে সুনিশ্চিত হয় এবং তা নানামুখী চাপ বা বিঘ্নের সম্মুখীন না হয়ে অব্যাহত থাকতে পারে, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রয়োজনে এই সারসত্য মোটেও বিস্মৃত হওয়ার অবকাশ নেই। কারণে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণে শেষ ভরসা যে গণতন্ত্রই, এটাই এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা।
ড. মাহফুজ পারভেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।