নিত্যপণ্য নিয়ে যেন না ভুগে মানুষ
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের বেশ বড় একটা অংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনেক কিছু ভারত থেকে আমদানি করা সম্ভব না হলে বাজারমূল্য আকাশ ছুঁই ছুঁই করে। এর মধ্যে আলোচনায় আসে কেবল পেঁয়াজ। মাঝে মাঝে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় বলে নাজুক বাজার পরিস্থিতিতে পড়ে দেশের মানুষ।
জনধারণা যে, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের মধুর সম্পর্ক। বিষয়টি সর্বাংশে মিথ্যা নয়। তবে বিষয়টি যতটা না ব্যক্তি পর্যায় ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তারচেয়ে বেশি সম্পর্ক রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে। ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে, এবং এই ভিত্তির সবচেয়ে বড় স্মারক একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। এছাড়া দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ককে দৃঢ় করে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ রুখতে বাংলাদেশের সহায়তা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ জঙ্গিবাদীদের রুখে দিয়ে নিজেরা যেমন নিরাপদ থাকতে চেয়েছে, তেমনি ওই সেভেন সিস্টার্সে স্থিতিশীলতা রাখতে রেখেছে ভূমিকা।
তবু ভারত অনেকবারই বাংলাদেশে পণ্য, বিশেষ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে। এজন্যে তারা তাদের নিজেদের চাহিদার বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে, এবং ওই রপ্তানি বন্ধের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশে। পেঁয়াজের দাম চড়া হওয়ায় এবং এনিয়ে টানা আলোচনা থাকায় অন্য পণ্যগুলোরও দাম চড়েছে আকাশে। এরপর একটা সময়ে পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল হলেও অন্য পণ্যগুলোর দাম ঠিকই জায়গায় রয়ে গেছে। আমরা তখন এবং যখনই এমন অবস্থায় পড়ি তখন কেবলই পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনা করি বলে বাকি সব থাকছে আলোচনার বাইরে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন আলোচিত হচ্ছে ভারত থেকে পণ্য আমদানির সুযোগ থাকা, না থাকা নিয়ে। অনেকের আশঙ্কা আগের মতো সেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকবে না। বিষয়টিকে আমরা এখনো একপাক্ষিকভাবে দেখছি। আমরা দেখছি ওখান থেকে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য আমদানি করতে না পারলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বাজারের নিয়ন্ত্রণ কখনই আসবে না। একই কথা কি প্রযোজ্য নয় ভারতের ক্ষেত্রেও? বাংলাদেশে রপ্তানি না করলে ভারত কি বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে না?
বাণিজ্য মূলত দ্বিপাক্ষিক বিষয়ক, এখানে এক পক্ষ যেমন আমদানি করে নিজেদের চাহিদা মেটায়, অন্য পক্ষও রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করে। আমরা নিকট প্রতিবেশী থেকে কম মূল্যে আমদানি করতে না পারলে আমাদের বাজার যেমন স্থিতিশীল থাকবে না, তেমনি রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করলে ভারতও একইভাবে তাদের নিশ্চিত বাজার হারাবে। কোন দেশ কি চাইবে একটা নিশ্চিত বাজার হাতছাড়া করতে? এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দুর্বল হলে তাদেরকেও নতুন বাজার দেখতে হবে।
ভারত থেকে পণ্যের আমদানি সহজ না হলে বাংলাদেশ কি এক্ষেত্রে বসে থাকব? নিশ্চয় না, বাংলাদেশ নিজেদের চাহিদা মেটাতে আরও বাজার খুঁজবে। এক্ষেত্রে খরচ বাড়বে ঠিক, কিন্তু খরচ বাড়ার ভয়ে নিশ্চয় না খেয়ে থাকার মতো অবস্থায় পৌঁছাবে না। এক্ষেত্রে অনেকের আশঙ্কা দূর দেশ থেকে পণ্য আমদানির আর্থিক সংগতি নাই বাংলাদেশের। এটা সত্য নয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় রেখে গেছে সেখান থেকে কয়েক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের সকলেই আওয়ামী লীগের আমলের দুর্নীতি ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে যতই সমালোচনা করুন না কেন, আর্থিক সংগতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। গত ১৩ আগস্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, অর্থনীতির অবস্থা খারাপ নয়, সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এটি কেবল ধীর হয়েছে। উপদেষ্টার আশাবাদ ধীরে ধীরে গতির সঞ্চার হবে।
সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কোণঠাসা। গ্রেফতার ও মারধরের ভয়ে অনেকেই আত্মগোপনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আস্তে আস্তে ফিরতে শুরু করেছেন অনেকেই। তাদের একাংশের যে প্রচারণা তাতে মনে হচ্ছে ভারত এবার বুঝি পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেবে! এসব প্রচারণায় আবেগ আছে, ভয় দেখানোর উপকরণ আছে, কিন্তু এসবের পেছনে যুক্তি নেই। কারণ বাণিজ্যের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় লাভালাভের বিষয়। এছাড়া প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে অনেকেই এটা দেখতে চাইছেনও। এটা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো ঘটনা।
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মার সঙ্গে বৈঠককালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এখানে আছে যেমন বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তেমনি আছে নিরাপত্তার দিক, এবং আছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান বিষয়ও। এইধরনের আলোচনার ফল কী সেটা তাৎক্ষণিক দৃশ্যমান হয় না। এসব রুটিন ওয়ার্ক যেকোনো সরকারের। এটা সম্পর্কের মধ্যে থাকা যেকোনো সন্দেহ দূর করতে সহায়ক হয়ে থাকে। দোদুল্যমান সম্পর্ককে শক্ত ভিত্তি দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছেন। গত শুক্রবার এক্স হ্যান্ডলে শেয়ার করা এক বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূসের ফোন করার তথ্য। মোদি বলেছেন, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ফোন পেয়েছি। বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের জন্য ভারতের সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ড. ইউনূস বাংলাদেশে হিন্দু ও সব সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানিয়েছে, বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে সহায়তা করতে ভারতের অঙ্গীকারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীসহ সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের জনধারণার যে টানাপড়েন, সেটা দূর করতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। আমরা আশা করি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এই সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার ও বেনিফিসিয়ারি যারা তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার অংশ। রাজনৈতিক চরিত্রের এই প্রচারণাকে পাশ কাটিয়ে দুই দেশের মধ্যে অব্যাহত থাকুক সুসম্পর্ক, কারণ সুসম্পর্ক ব্যতিরেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুদেশেরই মানুষ।