শ্বেতপত্র ও ইতিবাচক পরিবর্তনের দিশা
জুলাই বিপ্লবের পর অনেক পরিবর্তন এসেছে। নানা সেক্টরে সংস্কার বিষয়ক চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন কমিটি প্রণীত শ্বেতপত্র ইতিবাচক পরিবর্তনের দিশা জাগাবে যদি অতীতের মতো এসব রিপোর্ট বস্তাবন্দী করে হিমঘরে ফেলে রাখা না হয়।
এমন আশঙ্কার কারণ আছে বৈকি! বাংলাদেশে অতীতে নানা কিসিমের তদন্ত ও অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। এগুলোর অধিকাংশই আলোর মুখ দেখে নি। কিছু কিছু রিপোর্ট প্রণয়ন করা সম্ভব হলেও জনসমক্ষে প্রকাশ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। এ কারণেই শঙ্কা জাগে, এবারের রিপোর্ট বা শ্বেতপত্রগুলোও অতীতের মতো শূন্যগর্ভ না হয়ে যায়!
আশার কথা হলো, এরই মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি খুব অল্প সময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এটা একটি বড় কাজ হয়েচে। কমিটির মতে, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
এই কমিটি দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা শ্রেণি ও পেশার অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত শ্বেতপত্র নামক দলিলটি নিঃসন্দেহে দেশের আর্থিক খাতের একটি বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা স্বরূপ। এতে আর্থিক খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান সমস্যাগুলো উন্মোচিত হয়েছে এবং বিগত সরকারের দুর্নীতি সম্পর্কে দেশে-বিদেশে যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, তার আদ্যোপান্ত বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে। এখন দায়িত্ব হলো এই রিপোর্ট এবং আরও যেসব রিপোর্ট প্রকাশ পাবে, সেগুলো অভিমত ও সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করা। নচেৎ কাগুজে রিপোর্ট বাস্তবে প্রতিফলিত না হলে প্রকৃত সংস্কার বা পরিবর্তনের কাজ হবে না।
উল্লেখ্য, গত পাঁচই অগাস্ট সরকার পতনের পর ২৮শে অগাস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’। যে কমিটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছে দেশে গত পনের বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিলো, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে- এমনটা বলা হচ্ছে শ্বেতপত্রে। এসব তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতিবিধান নিশ্চিত করা হলেও অতীতের দুর্নীতির ধারা ভবিষ্যতের জন্য প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।
বলা দরকার যে, কারা বেশি দুর্নীতিবাজ ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন কমিটি বিষয়টি নিয়ে যেসব শুনানি করেছে সেখানে এমন মত এসেছে যে ‘চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ছিল আমলারা, সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই’। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য এদেরকে রোখা খুবই জরুরি।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলেছে, “আমাদের কাজ চোর ধরা না, চুরির বর্ণনা দেয়া। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং চুরির প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কারও কিছু বলার থাকলে দুদক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে যাওয়াই শ্রেয়।” তাহলে চোর ধরার দায়িত্ব কার? নিশ্চয় সরকারের। সরকার যদি এই দায়িত্ব পালন না করে তাহলে চোরদের বাড়-বাড়ন্ত হতে থাকবে এবং দুর্নীতিও চলতেই থাকবে, যা মোটেই কাম্য হতে পারে না।
শ্বেতপত্রে গত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সীমাহীন দুর্নীতি, পাচার কিংবা লুটপাটের দৃষ্টি আকর্ষক তথ্য উপাত্ত দেয়া হলেও কমিটি বলছে তাদের হাতে এর কোনো প্রমাণ নেই। তবে তাদের ধারণা যেসব খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে থাকবে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত। অতএব, এ ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্রহ ও অনুসন্ধান চালানো যেতে পারে। মোদ্দা কথায়, শ্বেতপত্রের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ, সংস্কার ও ইতিবাচক পরিবর্তনের যে দিশা দেখা যাচ্ছে, তাকে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নিলেই বিপ্লব-স্পন্দিত আমজনতার আশা পূরণ হতে পারে। তা না হলে, পরিস্থিতির কোনও গুণগত পরিবর্তন হবে না এবং পরিস্থিতি পুরনো সমস্যার দুষ্টচক্রে আবর্তিত হতে থাকবে।