সিরিয়ায় আসাদ শাসনের পতন আরব অঞ্চলকে যে বার্তা দিল
সিরিয়ায় জর্জরিত ব্যর্থ শাসনব্যবস্থা কোনোভাবেই অনন্য ছিল না। নিঃসন্দেহে এটি একটি পাওয়ার মডেল যা পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করেছে।
৮ ডিসেম্বর, দুই সপ্তাহেরও কম সময় ধরে চলা একটি দ্রুত আক্রমণের পর, সিরিয়ার সরকার বিরোধী বিদ্রোহী বাহিনী দামেস্কে প্রবেশ করে এবং বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা রাজধানীতে ঢোকার ঠিক আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার অজ্ঞাত গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আল-আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর শাসনের অবসান ঘটিয়ে সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে এই সফল বিদ্রোহকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং ১৯৪৮ সালে ইসরাইল সৃষ্টির পর থেকে আধুনিক আরব অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মোড় হিসাবে দেখা উচিত। এটি ১৯৫০-এর দশক থেকে আরব স্বৈরশাসক ও তাদের উত্তরাধিকারদের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা সামরিক শক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলে চালানো আধিপত্যে এক সুনির্দিষ্ট সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।
অনেকেই এখন বাশার আল-আসাদের উৎখাতকে উদযাপন করছেন বটে, তবে এও ভাবছেন যে সিরিয়ায় বিভিন্ন স্থানীয় এবং বহিরাগত শক্তির জড়িত থাকার কারণে পরবর্তীতে আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে।
সিরিয়ার শাসন ও গৃহযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক সময়ের অভিজ্ঞতা জনজীবনে কি তাৎপর্য বয়ে এনেছে তা এখন গুরুত্বপূর্ণ। আসাদের অধীনে সিরিয়া অনন্য ছিল না এবং কিছুতেই তা স্থানীয়দের নৃশংসতার মধ্যেই সীমিতও ছিল না। বরং এটি প্রায়শই এ অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় উত্তরাধিকারদের দ্বারা কুক্ষিগত শক্তির সঙ্গে বিভিন্ন বৈদেশিক ও বেসরকারি গোষ্ঠীর মিলিত শক্তির মাধ্যমে অর্ধ শতাব্দী ধরে সিরিয়াকে ধ্বংস করেছে। জনগনের মর্যাদাকে করেছে ভূলুণ্ঠিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাশার আল-আসাদের সরকার ছিল আরব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শক্তিনির্ভর ও বিদেশি-সমর্থিত স্বৈরাচারী সরকার, যা এর জনগণ, অর্থনীতি এবং জাতীয় অখণ্ডতাকে ধ্বংস করেছিল।
সিরিয়ার কলঙ্কজনক অভিজ্ঞতা ভাগ করা মানে আরব স্বৈরাচারদের সমস্ত দুর্বল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা, যা এখনও ব্যাপকভাবে অব্যাহত রয়েছে। অবশ্যই আমাদের সমাজ থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর মূলোৎপাটন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকৃত বহুত্ববাদের অভাব এবং বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের বিরাট ঘাটতি।
সামরিক ও পুলিশি বর্বরতা, ব্যাপক কারাদণ্ড, নির্যাতন; কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা যা উচ্চবিত্তদের মধ্যে দুর্নীতির জন্ম দেয়। সমগ্র ভূমি জুড়ে জীবনমানের গভীর বৈষম্য; নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো কাঠামোগত সংযোগ না থাকার নীতিই ছিল এ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট। এখানে জনগণের সম্মতি এবং ইচ্ছার কোন প্রতিফলন ছিল না।
গামাল আবদেল নাসেরের ১৯৫২ সালের মিশরীয় সামরিক বিপ্লব যা আরব শাসনের ধ্বংসাত্মক উত্তরাধিকারের সূচনা করেছিল। ১৯৬৭ সালে আরব সেনাবাহিনীর কাছে ইসরায়েলের পরাজয়ের পরে আরও দ্রুত প্রসারিত হয়েছিল এটি। বাশার আল-আসাদের পিতা, হাফিজ আল আসাদ আরব অফিসারদের একটি দলের মধ্যে ছিলেন যারা পরবর্তী দুই দশকে বিভিন্ন আরব দেশে ক্ষমতা দখল করে নেয়।
এই স্ব-আরোপিত অফিসাররা তাদের কয়েক দশকের শাসনামলে যুদ্ধ চালাতে বা কার্যকরভাবে শাসন করতে পারেনি। ফলস্বরূপ, ১৯৯০ এর দশক থেকে, কিছু ধনী তেল উৎপাদনকারীর ছাড়া অধিকাংশ আরব অধিবাসীদের উপযুক্ত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি, পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি এবং বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনীয়তার সুযোগ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে।
আঞ্চলিক সমীক্ষায় একাধিবার উঠে এসেছে যে, আরবদের একটি ছোট অংশই (বেশিরভাগই তেল-উৎপাদনকারী রাজ্যে এবং অন্যত্র ছোট অভিজাতদের মধ্যে) আরামদায়ক জীবনযাপন করতেন, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাজনৈতিক অধিকার বা ভদ্রোচিত জীবন উপভোগ থেকে বঞ্চিত হতেন। আরব সমাজে এই বৈষম্য ও দারিদ্র্য ক্রমাগত বৃদ্ধিই পাচ্ছে।
দমন-পীড়নের মাধ্যমে, আরব সরকারগুলি তাদের নাগরিকদের নিষ্ক্রিয়, কণ্ঠহীন, নপুংসক ভোক্তায় রূপান্তরিত করেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই দেশত্যাগ করতে চায় বা করেছেও। দমন-পীড়ন তাদের নাগরিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ, ভয় এবং হতাশার জন্ম দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে তারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে এর দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় যোগদান করে কিংবা বিদেশী শক্তির কাছ থেকে বিপদের মুখে নিজেদের রক্ষা করতে গঠন করে ছোট উপজাতীয়, ধর্মীয় বা মতাদর্শিক গোষ্ঠী।
সামরিকীকরণ ক্ষমতার মডেলকে চ্যালেঞ্জকারী সবচেয়ে শক্তিশালী আরব আন্দোলনগুলেই ছিল ইসলামপন্থী, যা একাধোরে সশস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ, দুই-ই। সিরিয়ায়, যখন একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন নৃশংস সামরিক শক্তির মুখোমুখি হয়েছিল, তখন তাদের ভেতরের বিদ্রোহ দ্রুত একটি গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়, যা জাতীয় ঐক্যকে পুরোপুরি ক্ষুন্ন করেছিল। এর ফলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি ক্রমাগত বিস্তার লাভ করে এবং বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের সূত্রপাতও ঘটে এর মধ্য দিয়েই।
রামি জি খৌরি: আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত এর ফেলো এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাংবাদিক ও লেখক।
আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর: আশরাফুল ইসলাম