সৌদির পর্যটন ভিসা, বাদ পড়ল মুসলিম প্রধান দেশগুলো
বেশ কয়েক বছর ধরেই পর্যটন থেকে সৌদি আরব আয়ের চেষ্টা করে আসছে। অবশেষে দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রচলিত ধারা ভেঙে পর্যটকদের জন্য দুয়ার খুলে দিলো দেশটি। শুক্রবার সৌদি সরকার প্রথমবারের মতো বিশ্বের ৪৯টি দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
সৌদিতে টুরিস্ট ভিসা পাবে এমন দেশের তালিকা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। ৪৯টি দেশের মধ্যে সাকূল্যে ৩টি মুসলিম দেশ রয়েছে। সবচেয়ে মুসলিম জনবহুল ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবের অন্যতম বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখযোগ্য কোনো মুসলিম দেশ স্থান পায়নি এই তালিকায়।
যেকোনো দেশের অধিকার আছে, দেশটিতে কাকে প্রবেশ করতে দেবেন, আর কাকে দেবেন না- সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের পেছনে যদি, পক্ষপাত, বৈষম্য, অন্যায্য ও নীতিবিরুদ্ধ কিছু থাকে- তাহলে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে; ওঠাটাই স্বাভাবিক। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, টুরিস্ট হিসেবে সৌদি আরব যেসব দেশকে নির্বাচন করেছে সেসব দেশের তালিকা দেখে।
সৌদি আরবে ভ্রমণ ভিসা পাবে এমন দেশগুলো হলো- (ইউরোপ) সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, লিচেন্সটাইন, লিথুনিয়া, মোনাকো, এ্যান্ডোরা, রাশিয়া, মাল্টা, মন্টেনিগ্রো, সান মারিও, ইউক্রেন, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, স্পেন, সুইডেন, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, স্লোভেনিয়া, হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, আইসল্যান্ড, ইতালি ও লাটভিয়া।
এশিয়ার সাতটি দেশ- ব্রুনাই, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কাজাকিস্তান ও চীন (হংকং, ম্যানাকো ও তাইয়ানসহ)। অন্য দেশগুলো হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
সৌদি টুরিস্ট ভিসা চালুর খবর বিশ্ব মিডিয়া বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। টুরিস্টরা কী কী সুবিধা পাবেন, সৌদি আরবে দেখার মতো কী কী আছে এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। সঙ্গত কারণেই তালিকা থেকে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো বাদ পড়ায় সমালোচনা হচ্ছে।
সৌদি আরব নবীর স্মৃতি বিজড়িত দেশ। অর্থনৈতিকভাবেও তারা স্বাবলম্বী। মুসলিম বিশ্বের কাছে সৌদি আরব বেশ সম্মানিত। অতীতে দেখা গেছে, বিভিন্ন মুসলিম দেশের নানা সংকটে তারা পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার প্রচার-প্রসার, গবেষণামূলক কাজে বৃত্তি, কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরবে ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু নিকট অতীতকাল থেকে দেখা যাচ্ছে, আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে সৌদি আরব পাশ্চাত্যের তোষণ নীতি অবলম্বন করেছে। এটা নিয়ে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজমান। এছাড়া সৌদি আরবের নানামুখি অকার্যকর নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের উদাসীনতায় ওআইসি অকার্যকার সংস্থায় পরিণত হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সংকটে তারা নেতৃত্ব তো দূরের কথা, পাশে দাঁড়াতেও পারে না। উল্টো মুসলিম বিশ্বের জন্য যারা ক্ষতিকারক তারা সৌদি আরবে সম্মানিত হয়। এমতাবস্থায় পর্যটক ভিসা ওইসব দেশের জন্য খুলে দেওয়া মুসলিম দেশগুলোর জন্য আরেকটি দুঃসংবাদই বটে।
নানা কারণে সৌদি আরবের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপগুলো যথার্থ বলার সুযোগ নেই। মক্কা-মদিনার গুরুত্ব ছাড়া সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে নেতৃত্বের আসন হারিয়েছে অনেক আগেই। তারপরও যেহেতু ইসলামের অন্যতম ফরজ বিধান হজপালনের জন্য মুসলমানদের সৌদি আরব যেতে হয়; তাই এখনও সৌদিকে সমীহের চোখে দেখেন অনেকেই। কিন্তু তারা তাদের আচার-আচরণে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের এই সম্মানকে গুরুত্ব দেন কিনা, সেটা বলা মুশকিল।
মুসলিম দেশ কিংবা মুসলমানদের একটা প্রত্যাশা থাকে, সৌদি আরব পূর্ণ ইসলামের অনুসরণ করে চলবে। নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু না, ক্ষমতা ধরে রাখতে তারা মুসলমানদের সারথি হওয়ার বদলে মুসলিম নির্যাতকদের পরীক্ষিত সারথিতে পরিণত হয়েছে। এটা অবশ্যই লজ্জার বিষয়। মুসলমানদের কাছে সৌদি আরবের এমন ভূমিকা কাম্য নয়।
২০১৯ সালে হজপালন করেছেন ২৪ লাখ ৮৯ হাজার ৪০৬ জন। হজযাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় এশিয়া মহাদেশ শীর্ষে। আর দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া। এবার ইন্দোনেশিয়া থেকে হজ পালন করছেন ২ লাখ ২১ হাজার হজযাত্রী। হজযাত্রীর সংখ্যা হিসেবে শীর্ষ দশের অন্য দেশগুলো হলো- পাকিস্তান (১ লাখ ৭৯ হাজার ২১০), ভারত (১ লাখ ৭০ হাজার), বাংলাদেশ (১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮), মিসর (১ লাখ ৮ হাজার), ইরান (৮৬ হাজার ৫০০), তুরস্ক (৭৯ হাজার), নাইজেরিয়া (৭৯ হাজার), আলজেরিয়া (৩৬ হাজার) ও মরক্কো (৩১ হাজার)।
হজ ছাড়াও এসব দেশের লাখ লাখ মুসল্লি প্রতি বছর উমরা পালন করতে সৌদি আরব যান। সৌদি গেজেটের দেওয়া তথ্যমতে, ১৪৪০ হিজরিতে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ৭৫ লাখ যাত্রী উমরা পালন করেছেন। আর চলতি বছর (১৪৪১ হিজরি) সৌদি সরকার এক কোটি উমরাযাত্রীর ভিসা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
এত দিন প্রবাসী শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং হজ-উমরা যাত্রীদের কেবল সৌদি আরবের ভিসা দেওয়া হতো। এবার ভ্রমণ ভিসা উন্মুক্ত করা হলেও মুসলিম দেশগুলোকে সৌদি আরব ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ দেওয়া থেকে বঞ্চিত করার এমন হীন মানসিকতা অবশ্যই নিন্দনীয়। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন, উমরা কিংবা হজে এসে অনেকে থেকে যায়; এ কারণে কিছু দেশকে তারা ভিসা দিতে নারাজ। কিন্তু এ কথাও ধোপে টেকে না। সৌদিতে টুরিস্ট ভিসা উন্মুক্ত করা পেছনে রয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। খাদেমুল হারামাইনের এমন সিদ্ধান্ত ভ্রমণ পিপাসু মুসলিম দেশের নাগরিকদের মারাত্মকভাবে আহত করেছে।
মূলত পশ্চিমা ও উন্নত বিশ্বের জন্য ভ্রমণ ভিসা দেওয়া হয়েছে এটা স্পষ্ট। বিশ্ব গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, সৌদি প্রিন্স মুহাম্মদ বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে যে নতুন বিপদে পড়তে যাচ্ছিলেন, তা থেকে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি সরাতে টুরিস্ট ভিসার কার্ডটি এই সময়ে ছেড়েছেন।
বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে গেছে, আর ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে সৌদি আরবের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। বিভিন্ন দেশের নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের দায়ে তারা চরমভাবে সামলোচিত। এমতাবস্থায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল উৎপাদনকারী এই দেশটির শাসকদের বাধ্য করছে পরিবর্তনের গতি বাড়াতে। এজন্য সৌদি আরবকে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
২০১৭ সালে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সংস্কারের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ দশকে সৌদি আরবে সিনেমা হল থাকলেও পরবর্তীতে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে সেই সিনেমা হলও খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্রথমবারের মতো উমরার ফি নির্ধারণ সর্বশেষ মুসলিম দেশগুলোকে বাদ দিয়ে টুরিস্ট ভিসা প্রবর্তনের মতো সিদ্ধান্তগুলো নেয়।
যদিও সৌদি আরব বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১৯টি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এসব বিধিনিষেধের মধ্যে পর্যটকদের পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে শিথিলতার কথা বলা হলেও জনসমক্ষে অশালীন ও আকর্ষণীয় পোশাক পরিধানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
অন্য বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে, যত্রতত্র মূত্রত্যাগ, থুথু ফেলা, দড়ি লাফ, বিনা অনুমতিতে মানুষের ছবি তোলা এবং নামাজের সময় সঙ্গীত বাজানো নিষেধ। আর অমুসলিমরা টুরিস্ট ভিসায় পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীতে যেতে পারবেন না। তাছাড়া মদ্যপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। তবে অবিবাহিত বিদেশি পুরুষ ও নারী পর্যটক হোটেলে একই রুমে অবস্থান করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, বিদেশি নারী পর্যটকদের পুরো শরীর ঢাকা আবায়া পরতে হবে না, তবে অবশ্যই সংযত-শালীন পোশাক পরতে হবে।
উল্লিখিত বিধি-নিষেধের বেশিরভাগই মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আর যত্রতত্র মূত্রত্যাগ কিংবা থুথু ফেলার মতো আচরণের বিষয়ে বলা যায়, আবহমান কাল থেকে মুসলমানরা এসব রীতি মেনেই হজপালন করে আসছেন। হজের মতো শারীরিক শ্রমসাধ্য ইবাদত নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের ভেতর দিয়ে পালন করতে হয়। সেটা তারা করতে পারছেন।
পর্যটকদের তুলনায় হজের সফরে অর্থও খরচ হচ্ছে বেশি। তার পরও তারা সৌদি আরবকে ঘুরে ফিরে দেখতে পারবেন না নিয়মের বেড়াজালে, এটা তো হতে পারে না। বিশ্বের উন্নত সব দেশেই প্রায় সব দেশের নাগরিকদের ভিসা পাওয়ার অধিকার আছে। এক্ষেত্রে ভিসাপ্রার্থীর নানাবিধ ডকুমেন্ট জমা রাখতে হয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ সেটা করতে পারে, তা না করে ভিসা দেওয়াই যাবে না- এমন মনোভাব পরিত্যাজ্য। আর যাই হোক এ আচরণ, ভ্রাতৃত্বসুলভ নয়। অন্তত সৌদি আরবের কাছ থেকে আমরা এটা আশা করিনি।
মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম