ছাত্ররাজনীতির বর্তমান বাস্তবতা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শ
রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছি যথেষ্ট। ইতিহাসের পাতায় ছাত্ররাজনীতি রাজনৈতিক নেতা তৈরির সূতিকাগার হলেও বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। ইদানীং ছাত্ররাজনীতি নিয়ে জনমনে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে ছাত্ররাজনীতি ও বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে কিছু না লিখলেই নয়।
দীর্ঘদিন থেকেই বর্তমান সরকারকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বড় বড় রাজনৈতিক ইস্যুর পাশাপাশি ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের গ্রুপিং কিংবা আধিপত্যের লড়াই সামাল দিতেও সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের বহু সহিংস কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিব্রত হয়েছেন। সর্বশেষ নিজের পছন্দে দেওয়া ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের সরিয়ে দিয়েছেন।
তবে ছাত্ররাজনীতিতে আধিপত্য চর্চার নামে নানা অপকর্মের ঘটনা অনেক আগে থেকেই আমরা দেখছি। বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের মহাতাণ্ডবে জনজীবন বিপর্যস্ত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রশিবিরের কোনো নেতাকে সালাম না দেয়ার অভিযোগে কিংবা বিনয়ী ব্যবহার না করার অভিযোগে হল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটতো। ওই সময়ে ছাত্রশিবির না করতে চাইলে কিংবা তাদের মতের বাইরে অবস্থান করলে হাত-পায়ের রগ কেটে নেয়ার নৃশংস কর্মকাণ্ড ঘটেছে। ইয়ানত (চাঁদা) সংগ্রহের নাম করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা প্রতিনিয়ত তাদের পকেটে যেত। ছাত্রদলের নেতাকর্মীরাও কোনো অংশে কম ছিল না। সে আলোচনা থাক। আজকের বিশ্লেষণটা একটু ভিন্নভাবে করতে চাই।
আমরা বুঝতে পারি, ইদানীং বেশিরভাগ সাধারণ শিক্ষার্থীই মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুকে পছন্দ করে, এমনকি শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে। সকল শিক্ষার্থীই যে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির সাথে থাকবে, আবার সকলেই যে মিছিল মিটিংয়ে যাবে এমনটি প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের দ্বারা লাঞ্ছিত হয় তখন এর প্রভাব কেমন হতে পারে কিংবা কতদূর পৌঁছাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে চান। আর এই সুযোগে কতিপয় সুযোগসন্ধানীরা অন্যায়-অপকর্মের মাধ্যমে বেকায়দায় ফেলতে চায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে।
বিশেষ করে ক্ষমতার আধিপত্য, বড়াই-লড়াই, হল দখল, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাটুকারিতা, পকেট নেতা তৈরি, প্রশাসনের অন্যায্য সমর্থন প্রভৃতি কারণে ছাত্ররাজনীতির যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না। ছাত্র সংগঠনগুলোর কমিটি গঠনের জন্য এখন যোগ্যতার পাশাপশি চলে লাখ লাখ টাকার রাজনৈতিক বাণিজ্য। এই অপরাজনীতির দাপটে ক্রমেই ছাত্ররাজনীতি হয়ে উঠছে অসৎ ও অশুভ। আর এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর।
নেতা নির্বাচনে যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতের কোনো মূল্য নেই, সেহেতু অপতৎপরতা বন্ধ হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। আর এ কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ন্যায্য দাবি কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো সময়ে তাদের (সাধারণ শিক্ষার্থী) ওপর চলে জুলুম-অত্যাচারও। এসব নানাবিধ কারণে বর্তমান সময়ে মেধাবীরা ছাত্ররাজনীতি পরিহার করছে। ফলে ক্রমেই মেধাশূন্য হয়ে উঠছে ছাত্ররাজনীতি।
বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র রাজনীতির ধরন ও পরিণতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটু ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণ করতে চাই।
শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখে, পড়াশোনা করে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু অনেক ছাত্রনেতা নামের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতির নামে চাঁদাবাজি করে। এরা আদর্শের কথা বলে, আবার স্বার্থে আঘাত লাগলে আদর্শ পরিবর্তন করে, অথবা আদর্শের আড়ালে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থেকে আদর্শে থাকার অভিনয় করে।
আমি মাঝে মাঝে ক্লাসে ছাত্রদের সাথে বিতর্কে চলে যাই যে, আদর্শের রাজনীতি হলো এক ধরনের অভিনয়। সেজন্য যেকোনো সময়ই চরিত্র বদলে অন্য কোনো চরিত্রে অভিনয় করাটা খুব বেশি কষ্টের হয় না। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকেই আছে যারা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছিল তাদের অনেকেই স্বার্থের কারণে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নাম ভুল করেও উচ্চারণ করেনি। বরং সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কলুষিত করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বোধ করেনি।
আজ যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে আদর্শের রাজনীতি না করে ক্ষমতা ও আধিপত্যের রাজনীতি করছে তাদের ভবিষ্যত কী? তাদের স্বপ্নই বা কী? তারা কী দেশের বড় রাজনীতিবিদ হতে চায় নাকি মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে চায়? অবশ্যই আজকের তরুণদের মধ্যে আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি রয়েছে। ইদানীং দেখা যায় হাজার হাজার ছাত্রনেতা যারা রাজনীতি নামের এই মহান ‘পেশা’কে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে যাদের হাতে রয়েছে দামী দামী বিদেশি অস্ত্র কিংবা বড় রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্ন। অথচ তাদের হাতে থাকা উচিত পাঠ্যবই। কারণ তারাই হলো আগামী দিনের পথপ্রদর্শক।
বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতির প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ কেমন তা দু-একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষক সরকারি দলীয় ছাত্রসংগঠনের অস্ত্রধারী ক্যাডার কর্তৃক অন্যায়ভাবে লাঞ্চিত হলে উপাচার্য বরাবর এসব ছাত্রের শাস্তির দাবি জানালে উল্টো তাদের অপরাধীদের পুরষ্কৃত করার নজির রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সম্প্রতি আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে অথচ বিনা দ্বিধায় ওইসব অপরাধীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা উচিত।
ছাত্ররাজনীতির বাস্তবতা নিয়ে আরো দু’একটি কথা না বললেই নয়। এ বছরের শুরুর দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক বিভাগের অ্যালামনাই পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বর্তমান পরিচয়পর্বে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মন্ত্রণালয়ের সচিব, বড় পুলিশ অফিসার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক কেউ বা বড় ব্যবসায়ী এবং কেউ দীর্ঘদিন রাজনীতি শেষে (ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত) ইউনিয়ন, উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত অথবা বিজয়ী প্রার্থী। এদের মধ্যে বেশিরভাগই পরাজিত যারা রাজনীতির মাঠে থেকে কোটি টাকা ঋণী হয়ে গেছেন, এমন একটি বাস্তব উদাহরণ থেকেই স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে ছাত্ররাজনীতির মাঠ থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ অতঃপর জাতীয় নেতা কিংবা ঋণগ্রস্ত নেতা।
এখানে ধারণা করতে খুব কেশি কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে যারা সাধারণ শিক্ষার্থী হয়ে পড়ালেখা শেষে সাধারণ জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখেছে তারা আজ দেশের বড় কর্মকর্তা কিংবা মানুষের মতো মানুষ কিন্তু যারা রাজনীতির মাঠে থেকে আদর্শ রক্ষার নামে অভিনয় করেছে তাদের বেশিরভাগই বাস্তব রাজনীতি জীবনে ব্যর্থ হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন।
কাজেই ছাত্রনেতা নামে যেসব প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যেই বলতে চাই যে, অভিভাবকের স্বপ্নকে বড় করে তুলতে আধিপত্যের রাজনীতি পরিহার করে গঠনমূলক রাজনীতির পাশপাশি পড়ালেখা এবং অধ্যবসয়মুখী হও।
আজ এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা রাজনীতি করতে এসে নিজের ছাত্রত্বকে বলি দিয়ে সার্টিফিকেট না নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আবার কেউ কেউ নিজের জীবন উৎসর্গ করে লাশ হয়ে ঘরে ফিরে বাবা-মায়ের কোল ফাঁকা করেছে।
ছাত্ররাজনীতি অনেকের জীবনেই হয়েছে অভিশাপ। কিন্তু আশীর্বাদ হয়েছে কয়জনের সেটা আমার জানা নেই। আর এই অভিশাপকে মুক্ত করতে ক্ষমতাসীন সরকারসহ সকল রাজনৈতিক দলকে ছাত্ররাজনীতির সুফল-কুফল বিশ্লেষণ সাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর প্রয়োগ নিয়ে সুবিবেচনার প্রয়োজন এসেছে। এমন সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তই বাঁচাতে পারে একজন অভিভাবকের স্বপ্ন, একজন শিক্ষার্থীর জীবন এবং সুন্দর স্বপ্নময় ভবিষ্যতকে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।