বিপ্লব কোনো নৈশভোজের পার্টি নয়, জানতেন ফজলে হাসান আবেদ
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশেষে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে (বিআইডিএস) চাকরিতে যোগ দিয়ে বছরপূর্তির আগেই ইস্তাফা দিয়ে কিছুদিন বেকার থাকার পর ব্র্যাকের প্রধান ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে দেখা করি। সম্ভবত ১৯৯৯ সালে। তিনি পূর্বপরিচিত ছিলেন। ব্র্যাকে আমাকে কাজ করতে বললে ঢাকার বাইরে থাকতে হবে বলে তাকে ‘হ্যাঁ বা না’ কিছু না জানিয়েই বিদায় নিই। সেদিন তার সঙ্গে আলাপ হয় খুব ক্যাজুয়ালি। জানতাম তিনি ব্রিটেনে পড়াশোনার সময় ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন। মার্কসবাদ তার আত্মস্থ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ত্রাণকর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য লন্ডনের নিজের ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে এসেছিলেন। ওই টাকাটা দিয়ে উত্তর-পূর্ব সিলেটের প্রত্যন্ত থানা শাল্লার পুরো এলাকায় মানুষের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। পরে একটা বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থ সাহায্য পান এবং সেই অর্থ দিয়েই পাশের দিরাই ও বানিয়াচং থানার কয়েকটি ইউনিয়নে ব্র্যাকের কার্যক্রম শুরু করেন।
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে এনজিও করা কি কমিউনিস্ট মতাদর্শ বিরোধী নয়? এমন প্রশ্ন তখনই করতে পেরেছিলাম। অনেক পরে বুঝেছি এ প্রশ্ন কতটা শিশুতোষ ছিল তার বা আমার কাছেই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, আমি ফুকো-দেরিদা পড়েছি কি না? তখনও পড়িনি। একটু হাসলেন। এরপর বললেন, “বিপ্লব মানে নৈশভোজের পার্টি নয়। একটা কন্টিনিউ প্রসেস। আধুনিক পুঁজিবাদী (এবং প্রথাগত সমাজতন্ত্র) দেশে ব্যক্তিসত্তা আর ব্যক্তির অধীনে নেই। এটি প্রায় পুরোপুরি ক্ষমতার অধীন Subjugated সত্তায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তির শরীর, তথাকথিত নিজস্ব স্টাইল, প্রেম-অপ্রেম, দেহভঙ্গি-মনোভঙ্গি, ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, তর্কালাপ, দর্শন, তার লেখার বিষয়বস্তু, আড্ডাস্থল, আড্ডার ধরন-ধারণা, উপন্যাসের ফর্ম, কবিতার চিত্রকল্প; এমনকি তার স্বপ্ন, ঘুমের ভেতরে হিজিবিজি প্রলাপ, নিদ্রা ও অনিদ্রার কাল, জাগরণের মুহূর্ত ও জীবিকা অন্বেষণ আজ ‘ক্ষমতার চক্ষু’র অধীনে। ফলে এ সমাজ বা রাষ্ট্রে থেকেই কিভাবে ভেতরে ভেতরে সমাজ পরিবর্তনের শর্তাবলি তৈরি করা যায় এটাই হচ্ছে বড় বৈপ্লবিক কাজ।”
তার এ ব্যাখ্যা আমাকে কনভিন্স করে। এরপর দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। সর্বশেষ নাইডহুড খেতাব পাওয়ার পর আমি মুক্তিযোদ্ধা গবেষক ও অধ্যাপক আফসান চৌধুরীকে ফোন করি একটা তথ্যের ব্যাপারে। তো, আফসান চৌধুরী জানান তিনি এখন আর ব্র্যাকে নেই। এরপর আফসান চৌধুরীর সঙ্গে আমার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে বেশ কিছু আলাপ হয়। আফসান চৌধুরী কথাপ্রসঙ্গে বলেন, “ফজলে হাসান আবেদ, ডা জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা অন্যকেস। তারা বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন সেটার মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। আমাদের দেশে তাদের ভাত নেই। তারা চাইলেই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবন কাটাতে পারতেন। কাটাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়তে তারা লড়েছেন। নারী অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লড়েছেন।”
আরো অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দেন সেগুলো এখানে না বলি। দিন পনের আগে বাংলাদেশে নারীবাদের চিত্র কেমন এ বিষয়ে একটা বই পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি সেখানে ফজলে হাসান আবেদের একটা ইন্টারভিউ। এর এটি অংশ তুলে ধরছি নিচে, তার বয়ানে—“আমি আমার জীবনকালে হয়তো এটা দেখে যেতে পারব না। সম্ভবত এটি আমার জীবনের অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডা হিসেবে থেকে যাবে। আমি অত্যন্ত দুঃখ বোধ করি, যখন দেখি আজও নারীর ওপর পীড়ন ও নির্যাতনের অবসান হয়নি। এখন পর্যন্ত নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরির বিনিময়ে বেশি কাজ করেন এবং এখনো কিছু নির্দিষ্ট পেশা ও কার্যক্রম থেকে পদ্ধতিগতভাবে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এখনো দেশে বহু মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় এবং তাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। অথচ সমাজের উন্নয়ন ও পারিবারিক সুখ–শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নারী-পুরুষের সমতা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশ অবশ্যই নারী-পুরুষ সমতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হবে এবং সমাজ প্রগতির পথে আমাদের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।”
তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। রাজনীতির বিষয়ে খুব কমই কথা বলেছেন। এতে অনেকেই মনে করেন, তার মতো মানুষেরা ‘সুবিধাভোগী এলিট যারা দারিদ্রকে বিক্রি করেন’। আমার ধারণা এমন ধারণা ভুল। সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, “গণরা যেখানে গণ (ফিলিস্তিন, এখানে ফিলিস্তিনের অর্থ যে গণ নিজেকে ‘গণ’ হিসেবে চেনেন না) সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।” ঠিক একই রকম কথা বলেছিলেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছিলেন, “যেমন জনগণ তেমন সরকার।”
এবার দেখা যাক ফজলে হাসান আবেদ রাজনীতিমনস্ক কেমন ছিলেন, তার একটি সাক্ষাৎকারের বক্তব্য দিয়ে। তার বয়ানে—“আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু মানুষের ক্ষমতায়ন না হলে তো গণতন্ত্র হবে না, গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। সুতরাং মানুষের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিতে হবে। এই কাজটা তো কেউ করে না। অনেক রাজনীতিবিদও তো করেন না, তাঁরা নিজেদের ক্ষমতায়ন করেন। আমাদের কাজের ধারা হলো নিজেদের ক্ষমতায়ন না করে জনগণের ক্ষমতায়ন করা। আমরা যদি সত্যিকারের সাফল্য পেতে চাই, তাহলে মানুষ এ কথা ভাববে যে আমার ক্ষমতা আছে, আমিই আমার দেশের নিয়ন্তা, আমার ভোটটা আমি কাজে লাগাব। তাহলে সমাজের, দেশের, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তিটা মজবুত হবে।”
আমাদের রাজনীতিবিদরা কেমন ক্ষমতার চর্চা করেন, আমরা জানি তো নাকি, আমাদের কতটুকু ক্ষমতা আছে, আমরা জানি তো নাকি? গুডবাই ফজলে হাসান আবেদ।
দেবদুলাল মুন্না
কথাসাহিত্যিক ও সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়