তবুও কি খাসলত বদলাবে মিয়ানমারের
কথা দিয়ে কথা না রাখার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মিয়ানমার। দেশটির বেশিরভাগ জনগণও সরকারপন্থী। অন্তত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে সরকার ও জনগণ এক কাতারে। তাদের নিয়ে মিয়ানমারবাসীর রয়েছে নাক উঁচু মনোভাব। ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্টে গণহত্যা শুরুর আগে পরোক্ষভাবে হত্যার ইন্ধন তো মিয়ানমারবাসীও দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক রাখাইন ও উগ্র বৌদ্ধ ছড়িয়েছেন রোহিঙ্গাবিরোধী প্রচারণা। যার তথ্য খোদ ফেসবুক কর্তৃপক্ষ হাজির করেছে বিশ্বের সামনে। বিশেষ করে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। সর্বোপরি রোহিঙ্গাদের চেষ্টা করা হয় বাঙালি সাজানোর। আর রাখাইন রাজ্যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, হত্যাযজ্ঞ, নারীদের ধর্ষণ, শিশুদের নির্মমভাবে মা-বাবার চোখের সামনে মেরে ফেলার মতো কাজ তো করেছেই কিছু নরপশু।
প্রায় আড়াই বছর পর ভালো লাগছে এই ভেবে যে সেই নরপশুদের বিচারের ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক আদেশ এসেছে। ভালো লাগছে এই ভেবে যে রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলে সম্মান নিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত-আইসিজে। বাঙালি বলে তাদের বাংলাদেশের প্রমাণ করার অচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ভালো লাগছে এই ভেবে যে গণহত্যার সব তথ্য-প্রমাণ মিলেছে অক্ষরে অক্ষরে, রাখাইনের পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং কথা না রাখা মিয়ানমারকে কথা রাখার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এবার তারা পালাবে কোথায়! জবাব তাদের দিতেই হবে চার মাস পর পর। সেই জবাবের ভিত্তিতে বসবে আবার আদালত। সে হিসেবে জুনে ফের আদালত বসার সম্ভাবনা দেখছি।
এদিকে মিয়ানমার যতই অস্বীকার করুক না কেন, গণহত্যা হয়নি, কিন্তু জবাবদিহির আওতায় তাদের সে ভ্রান্ত বক্তব্য প্রমাণ করার জো নেই। গণহত্যার জায়গায় তারা সামান্য যুদ্ধাপরাধের কথা মেনেছে। তাহলে এই যুদ্ধাপরাধই বা কম কিসে? রাখাইনে যুদ্ধাপরাধ হয়েছে, লাখ লাখ বাসিন্দা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, এটা তো সত্য। তাহলে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের ফিরিয়ে নিন। আইসিজে বলেছে, রাখাইনের পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে। ফের যেন কোনো গণহত্যা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে। সব রকম উন্নতি ঘটিয়ে মিয়ানমার প্রমাণ করুক তারা আদালতের আদেশকে মানতে পেরেছে। আর মেনে চললে বিশ্ব সম্প্রদায় জোর দিক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিকে। শেষ অব্দি মানতে না পারলে আরও বড় পরিসরে বিচার হতে হবে এই মিয়ানমারের।
আরেকটা ভালো লাগার কথা বলি, ২০১৯ সালের ১০ থেকে ১২ই ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে শুনানিতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন নিজ দেশের পক্ষে, তাকে স্রেফ মিথ্যাচার হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন আদালত। সু চি যে মিথ্যাবাদী তাও এবার আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী প্রমাণিত। শান্তিতে নোবেল পাওয়া সু চি, অশান্তির দূত সেটি বিশ্ব প্রমাণ-সহিত জানলো।
আদালতের কিছু ইতিবাচক পর্যবেক্ষণের মাঝেও শঙ্কাটা থেকে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েই। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। তাদের ঠাঁই দিয়েছিল বাংলাদেশ মানবতার খাতিরে, কিন্তু এখন তো তাদের যাওয়ার পালা। বাংলাদেশ নিজের ক্ষতি করে আর কতদিন মানবতার কাজ করবে? রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার হবে আজ বা কাল। ভালোভাবে চেপে ধরলে হয়ত পার পাওয়ার সুযোগ ক্ষীণ। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, এর প্রমাণ বিশ্ব জানবে কবে? এর ক্ষতিপূরণ দেবে কে? মিয়ানমার কি এর ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নয়?
প্রত্যাবাসন করি করি করে, পাক্কা দুইবার ভেস্তে গেছে উদ্যোগ। এবার কি কিছু হবে? রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার যেমন জরুরি, ঠিক তেমনই জরুরি লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া। কিন্তু কথা থেকে যায়, তবুও কি খাসলত বদলাবে মিয়ানমারের! বিশ্বাস করি, দেশটির চরিত্র বদলাতে কঠোর হতে হবে বাংলাদেশকেই। আইসিজে’র বিচারপতি আব্দুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ বলেছেন, গাম্বিয়ার মামলা যৌক্তিক। দোষ মিয়ানমারের। যার বিচার চেয়ে আগামীতে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) কাছেও গাম্বিয়া বিচার চাইতে পারবে। যেতে পারে অন্য কোনো ফোরামেও।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় হওয়া উচিত:
(ক.) গাম্বিয়ার প্রতি সহযোগিতা আরও বাড়ানো। দেশটির সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা। (খ.) রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, রাখাইন তাদের অধিকার। সেই অধিকার যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়, সে বিষয়ে গাম্বিয়াকে পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ অনুরোধ করতে পারে, আহ্বান জানাতে পারে। (গ.) আইসিজে বলেছেন, মিয়ানমারের আশ্বাস রোহিঙ্গাদের অপূরণীয় ক্ষতির ঝুঁকি থেকে সুরক্ষায় এবং গাম্বিয়ার আবেদন অযৌক্তিক প্রমাণে যথেষ্ট নয়। এটিকে মূল বিষয় ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ চালাতে পারে প্রচারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইসিজের আদেশকে স্বাগত জানিয়েছে, তাই এই সংস্থাটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ নতুনভাবে সহযোগিতা চাইতে পারে। (ঘ.) ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ঢাকায় আয়োজন করা যেতে পারে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও নিরাপদ প্রত্যাবান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার। যা অবশ্যই দুই থেকে তিনদিন ব্যাপী হতে হবে।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আদেশের মাধ্যমে নেইপিদোর শুভবুদ্ধি উদয়ের কথা। কিন্তু যারা কূটবুদ্ধি নিয়ে চলে, কুটিলতা ও ছলনাই যাদের কাজ, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় সহজে হওয়ার নয়। কথায় আছে ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু চোখ খুলেও যারা ঘুমোচ্ছে তাদের জাগানোর সাধ্য কার! মিয়ানমারের বিষয়টিও তাই, সেজন্যে দেশটিতে আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল চাপের মধ্যে রাখতে হবে। আইসিজের আদেশ একটা চাপ বটে, কিন্তু এটাই চূড়ান্ত নয়- একথা ভুলে গেলে চলবে না। এর ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত যেমন আগেও হয়েছে, তেমনি আগামীতেও হতে থাকবে।
চীন-রাশিয়া বিশ্ব শক্তি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তারা বিশ্ব নেতৃত্বে যেতে পারবে না, যদি না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে তারা কিছু বলে। খোদ জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার মতামত এটি। এই দুই শক্তিধর দেশকে বাগে আনার কথা বলা হচ্ছে না, অন্তত প্রত্যাবাস ইস্যুতে ইতিবাচক মনোভাবে নিয়ে আসতে হবে তাদের মাঝে। পাশাপাশি ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। এসব কিছু করতে বাড়াতে হবে চীন-রাশিয়া ও ভারত সফর। বিদেশ যাওয়া ছাড়াও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনেক কিছুই করার আছে। এই কাজগুলো করতে, মন্ত্রণালয়ে আলাদা বিশেষজ্ঞ ইউনিট প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। এতে শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই থাকবেন এমন নয়, নেতৃত্বে থাকবেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরাও। থাকতে পারেন সাংবাদিক, উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরাও।
ঢাকাকে নতুন করে হাল ধরতে হবে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। অন্তত বাংলাদেশকে সন্ত্রাসীমুক্ত করা, চোরাচালনমুক্ত করা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে, কক্সবাজারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সেখানকার মানুষের নিরাপত্তায় এবং সেখানকার মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। প্রমাণ করতে হবে, আমরা যেমন মানবিকতায় এগিয়ে- ঠিক তেমনি আমাদের দক্ষতা রয়েছে কূটনীতিতেও।
সৈয়দ ইফতেখার: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।