ডা. মঈনের মৃত্যু ও আমাদের দূরদৃষ্টি!
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসফোরশাইট শব্দটিই বারবার মনে আসছে। ইংরেজি Foresight শব্দটির অর্থ জানাতে গিয়ে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি লিখেছে—‘the ability to judge correctly what is going to happen in the future and plan your actions based on this knowledge’—অর্থাৎ, ভবিষ্যতে কী হবে কিংবা হতে যাচ্ছে তা সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নেওয়া। শব্দটির একক বাংলা অর্থ হচ্ছে দূরদৃষ্টি। বেশ ভারিক্কি শোনায়। কেউ যদি তেমনটা হয়, বা করতে পারে—তাকে আমরা সম্মান করি, বাহবা দিই। জাতিগতভাবে বাঙালি কখনোই এই যোগ্যতার ধারে কাছে পৌঁছায়নি সে কথা একজন বাঙালি হিসেবে বলার অধিকার রাখি। আমাদের অ্যাটিটিউডের সঙ্গে বরং ‘দেখিনা শালা কী করে!’ বিষয়ক চোর আর গৃহস্থের গল্পেরই মিলটা সবচেয়ে বেশি। গল্পের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কারণ বোধকরি পাঠকমাত্রই সেটা জানা, আর বুঝেও নিয়েছেন কেন বলছি।
করোনার মহামারি কালে যে চিত্র এখন আমরা চাক্ষুস করছি, এবং নিকট অতীতে আমরা যা কিছু করেছি, যেসব ঘটনা ঘটিয়েছি, যেসব কাণ্ড-কারখানার জন্ম দিয়েছি এবং সর্বপোরি যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছি, যেসব ব্যবস্থাদি নিয়েছি তাতে আর যাইহোক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কিছু করতে পেরেছি এমনটা বলার কোনো জো নেই।
বুধবার (১৫ এপ্রিল) সকালে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুর খবরের পর এমনটা দাবি করার কোনো সুযোগ রইল না। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে নিজে আক্রান্ত হন ডা. মঈন। এবং দশ দিন লড়াই করে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এর ঠিক একমাস আগের কথা। দিনটি ছিল ১৬ মার্চ। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছিলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। দেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কোনো রোগী সনাক্ত হয়নি। তাই এটি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এরপর একমাসে যা কিছু হয়েছে এই ক্ষুদ্র কোভিড-১৯ এর মরণকামড়ে তা কারো অজানা নেই। ১৫ এপ্রিল আমরা দেশে প্রথম একজন চিকিৎসককে হারালাম। তাঁকে নিয়ে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হলো ৫০টি নাম। আক্রান্ত ১২৩১ জন। সরকারের দেওয়া হিসাব তুলে ধরেই সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে—এখন পুরো রাজধানীতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীর অর্ধশতাধিক এলাকায় সংক্রমণ পাওয়া গেছে। দেশে চিহ্নিত মোট রোগীর ৫৬ শতাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। ঢাকা মহানগরীর বাইরে ঢাকা জেলাসহ মোট ২২টি জেলায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
আমরা যদি বার্তা২৪.কম-এ প্রকাশিত সবশেষ গ্রাফটি দেখি, তাতে বাংলাদেশের কার্ভটি খাড়া উপরের দিকেই উঠছে। গত ২ এপ্রিল নতুন আক্রান্ত হয় ২ জন, ৪ এপ্রিল তা হয়ে যায় ৯ জন, ৫ এপ্রিল ১৮ জন, ৬ এপ্রিল ৩৫ জন, ৮ এপ্রিলে তা ছিল ৫৪ জন। আর ৯ এপ্রিল বেড়ে ১১২ জন। যা আগের দিনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ১০ ও ১১ এপ্রিল নতুন আক্রান্তের সংখ্যাটি কিছুটা কমে যথাক্রমে ৯০ ও ৫৮-এ নেমে এলেও ১২ এপ্রিল এক ধাক্কায় নতুন আক্রান্ত হয় একদিনের সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৩৯ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত। এরপর যেন আর পেছনে ফিরেই তাকাচ্ছে না। প্রতিদিনই গড়ছে নতুন রেকর্ড। ১৩ এপ্রিল নতুন আক্রান্ত হয় ১৮২ জন। নববর্ষের দিনে ২০০’র কোটা পার হয়ে আক্রান্ত বাড়ে ২০৯ জন। আর ১৫ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১৯ জনে।
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার এই ঊর্ধ্বগতিই বলে দেয়, মার্চে আমাদের ধারণা ছিল না, এপ্রিলে কী ভয়াবহতা আসতে চলেছে।
এখানে আমরা নিউজিল্যান্ডের উদারহণটি দেখতে পারি। দেশটি কিন্তু সেভাবে আক্রান্ত হয়নি। উচ্চমাত্রার পর্যটননির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও এই দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১ জনের। আক্রান্তু এক হাজারের কিছু বেশি। মারাত্মক অবস্থায় রয়েছে ৪ জন। কিউই জনগণের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী জসিন্ডা অর্ড্রানের বক্তব্যটি ছিল এমন—“মনে করুন আপনি নিজে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত সেটা ভেবে নিজেকে ঘরে বন্দি রাখুন, আর অন্যকে আপনার ছোঁয়া থেকে দূরে রাখুন।”
আর ভিয়েতনাম? সেটি তো আমাদের মতোই একটি দেশ। সেখানে কিন্তু এই ভাইরাসে মারা যায়নি একজনও। আক্রান্ত হয়েছে ২৫৫ জন। নতুন আক্রান্ত নেই বললেই চলে। কিভাবে? কারণ দেশটি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি নেয় ২ ফেব্রুয়ারি। সে সপ্তাহেই ১৪ দিনের আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করা হয় বিদেশ থেকে আসা যেকোনো ব্যক্তির জন্য। তা হোক চীন কিংবা জিবুতি কিংবা পাপুয়ানিউগিনি। তার দুই সপ্তাহ পরে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে রাজধানী হ্যানয়সহ দেশের বেশকিছু অংশের মানুষকে ২১ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এতে দেশটিতে প্রাথমিক সাফল্য আসে। বিশ্বের কাছে প্রশংসা পায় দেশটি। এত ভালো অবস্থানে থাকার পরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ এর মহামারি বাড়তে থাকায় ৩১ মার্চ থেকে দেশকে টোটাল লকডাউনে পাঠায় ভিয়েতনাম সরকার।
ভিয়েতনাম যেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করল, তার ঠিক একমাস দুই সপ্তাহ পরেও আমাদের শিক্ষাঙ্গনের দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রী বললেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি। তবুও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মতো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরে পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে হয়ে এলে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুই দফা বন্ধ করে, এখন অনির্দিষ্টকালের জন্যই বন্ধ করলাম।
বিদেশ থেকে আগতদের ব্যাপারে ভিয়েতনাম সেই ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ১৪ দিনের আইসোলেশন বাধ্যতামূলক করল, আর বাংলাদেশ তখন আটকে থাকল শুধুই চীনে। পরে ইতালিতে যখন ভয়াবহ অবস্থা আর দল বেঁধে সেদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ফিরতে শুরু করল, তখন একটু কড়াকডি হলো বটে, কিন্তু খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলো না। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেও বিদেশ থেকে আগতদের হাতে একটি আইসোলেশনের অনুরোধপত্র ধরিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আর চতুর্থ সপ্তাহে এসে হাতে সিল মারা শুরু হয়।
তখনও চীন, ইতালি থেকেও আসতে থাকে একের পর এক ফ্লাইট। তারা দেশে পৌঁছেই বিমানবন্দরে মারামারি, ধস্তাধস্তি করে। এদিক সেদিক পালিয়ে যেতে থাকে। গিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। কেউ বিয়ে ফেঁদে বসে, কেউ কেউ সামাজিক আয়োজনের সবকিছুতেই অংশ নিতে থাকে। মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া, মিলাদ, খতনা কিছুই বাদ দেয়নি।
অথচ ভিয়েতনাম সামাজিকভাবেই এর প্রতিরোধ করে। আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রাখে প্রতিবেশি কেউ যদি বিদেশ থেকে আসে তার আইসোলেশন হচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব প্রতিবেশিকেই দেওয়া হয়। তাতে কাজ হয়।
এছাড়াও, মার্চে এসেও আমরা যেদিন বললাম ভয়ের কিছু নেই। ঠিক সেদিনটাতেই ফ্লান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ তার দেশে যুদ্ধাবস্থা জারি করলেন। প্রতিটি নাগরিককে বলে দিলেন, আপাতত ১৫ দিনের জন্য ঘরে অন্তরিন হতে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বললেন, আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। আরো বলেছিলেন, শত্রুপক্ষ অদৃশ্য। যার বিরুদ্ধে সবাইকে মিলে সাধারণ লড়াইয়ে নামতে হবে।
ফরাসি প্রতিটি নাগরিকের চলাফেরা থাকবে চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত। সবাই ঘরে থাকবে। কেবল জরুরি সার্ভিস ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষই বাইরে চলাফেরা করবে। এবং যদি কেউ এই নির্দেশনা অমান্য করে, শাস্তি পাবে।
বিশ্বের যখন এই চেহারা আমরা তখনও কি সত্যিকারের লকডাউন করতে পেরেছি? পারিনি। এখন আমরা অংশ বিশেষ লকডাউনের ঘোষণা দিচ্ছি। কারণে-অকারণে মানুষ বাইরে ঘোরাফেরা করছে। রাজধানীতে কিছুটা সম্ভব হলেও দেশের অন্যত্র অবস্থা বেজায় অনিয়ন্ত্রিত। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই তৈরি পোশাক কর্মীদের দলে দলে ঢাকায় এনে আবার ফেরত পাঠানো হলো। ত্রাণ দেওয়ার নামে জনসমাবেশ ঘটানো হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। নারায়ণগঞ্জে তো রীতিমতো বিক্ষোভ মিছিল হয়ে গেল।
এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা, আর দূরদৃষ্টিহীনতার পরিণাম ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা জানা নেই।