জানাজা, শেষকৃত্য ও করোনাভাইরাস
খবর দুটি পাশাপাশি রাখা যেতে পারে। একটি বাংলাদেশের, আরেকটি ভারতের। দুটি খবরই শেষকৃত্যের।
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লকডাউন উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ জানাজার নামাজে অংশ নিয়েছেন। মানুষের ভিড় ও ঠেলাঠেলির চাপ ছিল অসহনীয়, যা জানাজাস্থল ছাড়িয়ে পাশের মহাসড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
অন্যদিকে, লকডাউন সফল করতে ভারতে যখন নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ঠিক সেই সময়ে দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুর মুধুবারাপট্টির গ্রামে এক ষাঁড়ের শেষকৃত্যে জমায়েত হয়েছেন শয়ে শয়ে মানুষ।
এই দুটি ঘটনাই বাংলাদেশ, ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের। এতে এই অঞ্চলের সামাজিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক মান, ধর্মীয় সচেতনতা ও আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনবোধের চরম পশ্চাৎপদ অবস্থাটি উন্মোচিত হয় এবং এই একবিংশ শতকেও প্রায়-শতাব্দী প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন দেখা যায়।
যে চিত্র 'লাল সালু' উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেখিয়েছেন বা 'বিরিঞ্চি বাবা' আখ্যানে পরশুরাম উপস্থাপন করেছেন, তার কথাও প্রসঙ্গত মনে পড়ে। সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' চলচ্চিত্রে ধর্মের নামে অধর্মের তঞ্চকতার চিত্রটিও আবার স্পষ্ট হয়।
তথাপি স্বীকার করতে হবে যে, দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে ধর্ম ও অধর্মের মিশেল যেমন হয়েছে, তেমনিভাবে ধর্মীয় বিষয়গুলো এক ধরনের ভয়ের ও স্পর্শকাতরতার ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে ও উন্মাদনার ভয়ে সচরাচর কেউ এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না। ফলে ধর্ম একচেটিয়া ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মোল্লাতন্ত্রের কব্জায় জিম্মি।
আশার কথা হলো, তরুণ, শিক্ষিত আলেমরা ধর্মীয় জ্ঞান ও আধুনিক শিক্ষার আলোয় সমাজে বিদ্যমান অনেক কুসংস্কার এবং ধর্মের নামে অধর্মকে বিদূরিত করতে প্রচেষ্টারত। তারপরও অনেক সময় এমন অনেক কাজ ধর্মের নামে হচ্ছে, যা প্রকৃতার্থে ধর্মের নির্দেশ নয়। অন্যভাবে বললে, পরিস্থিতিগত কারণে যা জরুরি ও সাওয়াবের বিষয় নয়, তা করে বিরূপতা ও বিপদ বাড়ানোর ঝুঁকি নেওয়া মোটেও সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ নয় এবং ধর্মের দিক দিয়েও লাভজনক নয়।
যেমন জানাজার নামাজ। এটি অবশ্য পালনীয় ইবাদত এবং মৃত ব্যক্তির হক ও সমাজের দায়িত্ব। সমাজের কিছু মানুষ এটি আদায় করলে তা সম্পন্ন হবে। ব্যক্তিগতভাবে ফরজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো নয় এটি। এটি সামাজিক ফরজ।
করোনাভাইরাস ঠেকানোর জন্য যেখানে মসজিদে জামাত সীমিত রাখা হয়েছে, সেখানে জানাজার নামাজে উপচানো ভিড় কেন? এতে অতিরিক্ত সাওয়াব হাসিল করার মতো তো কিছু নেই!
একইভাবে ফরজ, ওয়াজিব পালন না করে অন্যত্র ভিড় করার মধ্যেও বিশেষ কোনো ফায়দা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এভাবেই বহু মানুষ ভুল কাজে ও ভুল জায়গায় ফায়দা খোঁজেন।
ঔষধ ও প্রতিষেধক না থাকায় করোনাভাইরাস প্রতিহতের একমাত্র উপায় হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সঙ্গরোধ পালন করা। যে কারণে খোদ আরব দেশে মুসলমানদের সর্বসম্মানিত মক্কা ও মদিনার মসজিদুল হারামে নামাজ সীমিত করা হয়েছে। ভিড় জনসমাগম এড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশে বাসায় নামাজ পড়তে বলা হয়েছে। হজ্ব সীমিত ও ওমরাহ স্থগিত এবং আসন্ন রমজানে ঘরে তারাবির নামাজ পড়তে বলা হয়েছে।
এসব নির্দেশ পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। ফলে তা মান্য করা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যের জন্য কর্তব্য। বরং এটা মান্য না করে বিভ্রান্তি, বিভেদ বা অরাজকতা তথা ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা হলে তা হবে গর্হিত। এতে ধর্মীয় অপরাধের পাশাপাশি সামাজিক বিধান লঙ্ঘনের অপরাধও যুক্ত হয়।
ইসলামি স্কলাররা এসব বিষয়ে আরও বিস্তৃতভাবে নিশ্চয় বলবেন। মুসলমানদের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শরিয়ত সম্মত পন্থায় ইবাদত করার যে নির্দেশনা রয়েছে, তা অবশ্যই সঠিকভাবে উপস্থাপনের দরকার আছে এবং করোনার ঘোরতর বিপদে মানুষকে ইবাদতমুখী করার মাধ্যমে উত্তরণের পথে পরিচালিত করারও প্রয়োজন আছে।
বিশেষত, মানুষের কুকর্মের ফলে যে বিপদ নেমে আসে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য অধিক পরিমাণে তওবা, এস্তেগফার করা এই সঙ্কুল পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য জরুরি, যেমন জরুরি স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা মেনে চলা। অধিকন্তু ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং রোমহর্ষক হত্যা, ধর্ষণ, নারী ও শিশুদের হিংস্রতা ও লোলুপতার কবল থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করাও অতীব জরুরি।
কারণ, সীমাহীন অন্যায়, অপরাধ, জুলুমের ফলে মানবতার চরম অপমান হয়েছে। যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলো পাখির মতো নিরীহ মানুষ মেরেছে। শক্তিমানরা সমাজে অবলা ও দুর্বলদের নিগৃহীত করেছে। পৃথিবীর চারিদিকে, দেশে দেশে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে। আজাব ও গজব মানুষই নিজের সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে ঢেকে এনেছে।
এজন্য তওবা যেমন দরকার, তেমনি সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজের নিষেধ দেওয়া বা প্রতিহত করা অবশ্য কর্তব্য। এই কাজ না করা হলে মানব সম্প্রদায় আজাব ও গজবে নিপতিত হবে। অতএব, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমল, তওবা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে অবিরামভাবে করে যেতে হবে।
পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ধর্মীয় বিধান ও প্রশাসনিক-সামাজিক নিয়ম ভূলুণ্ঠিত না হয়। এমনটি হলে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের তরফে সমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং মুসলমানদের সম্পর্কে ভুল বার্তা প্রচারিত হবে। দিল্লির নিজামুদ্দিন তবলিগি মারকাজ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় তা হয়েছে, যা দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপজ্জনক। এসব ক্ষেত্রে সবাইকে আরও সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম, প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।