কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রয়োজন সহযোগিতা, সমালোচনা নয়
গত সাড়ে তিন মাসে বিশ্বব্যাপী কোভিড -১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াই প্রমাণ করেছে যে এই মহামারিটির একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান হলো সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব। বাড়িতে থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা মেনে চলা হলে এর সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। ফলস্বরূপ, বিশ্বজুড়ে সরকারগুলি কোভিড-১৯ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য তাদেরকে ঘরে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি, যা সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে পারে এবং মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে পারে। দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষেরা যেন সামাজিক দূরত্ব কার্যকরভাবে মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকটি দেশের সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে এত বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ কিভাবে সম্পূর্ণ লকডাউন মেনে তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করবে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার ডুফ্লো ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে তাদের একটি লেখায় উল্লেখ করছেন, ভারতের প্রেক্ষাপটে মহামারি মোকাবেলার জন্য ঘোষিত লকডাউন সফল করতে হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে শক্তিশালী আর্থিক প্রণোদনা পৌঁছে দিতে হবে। এই দম্পতি প্রস্তাব করেছিলেন, ভারত সরকারের উচিত জনগণের অ্যাকাউন্টে সরাসরি আর্থিক প্রণোদনা পৌঁছে দেওয়া। কারণ এটি না করতে পারলে বিশাল সংখ্যার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ লকডাউন মেনে ঘরে রাখা সম্ভব নয়। ভারত সরকার ইতোমধ্যে ২১ দিনের লকআউট সম্পন্ন করে দ্বিতীয় দফায় ৩ মে পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেছে। তারা আশাবাদী এই দ্বিতীয় দফা লকডাউনের শেষের দিকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর উর্ধ্বমুখী গ্রাফটি নিম্নমুখী হয়ে সমতলের দিকে যাবে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে রাজ্য সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিশেষ বরাদ্দের পাশাপাশি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
ভারতের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপক সংখ্যার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। ফলে, অনেকে মনে করছেন, ডাফ্লো ও ব্যানার্জির সুপারিশটি বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য। বাংলাদেশ সরকারের উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে সরাসরি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া। সরকার কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে বাচাঁনোর জন্য প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে যা দেশের মোট জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। মহামারির সময় এই পদক্ষেপগুলো মূলত অর্থনীতি ও শিল্পকে বাঁচাতে গ্রহণ করা হয়েছে।
দরিদ্র জনগণের সহায়তার জন্য আরো কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ভিজিএফ এবং ভিজিডির সংখ্যা বৃদ্ধি। ওএমএস-এর মাধ্যমে নিন্ম আয়ের মানুষদের জন্য বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের প্রায় ১ কোটি দরিদ্র জনগণকে কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠী, এনজিও এবং ব্যক্তগত পর্যায়েও অনেকে এগিয়ে এসেছেন শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবেলায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের সহায়তার জন্য। সরকার দরিদ্র পরিবারের বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরাসরি অর্থ সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত সম্প্রদায় হচ্ছে কৃষকরা। কোভিড-১৯ এর সম্ভাব্য অর্থনেতিক ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের আরা কোনো বিকল্প নেই। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বল্প সুদে কৃষকদের ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তটিকে দেশের বিশেষজ্ঞরা প্রশংসা করেছেন।
একথা বলা যায় যে, বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে দেশের জনগণকে এই মহামারি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালু আছে। এখন এই সহায়তাগুলো সঠিকভাবে বণ্টন করা সম্ভব হলে দরিদ্র জনগণ উপকৃত হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে, এই ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নিউজ মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ চুরির ঘটনা সরকারকে বিব্রত করছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, সরকারের এই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে যদি না আমরা সকলে মিলে সরকারকে সমর্থন করি। আগেই বলেছি সামাজিক দূরত্ব হচ্ছে এই রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র ব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনো বিভিন্ন এলাকার জনগণ এই মহামারির ভয়াবহতা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। ফলে, কাজ না থাকলেও তারা বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরা করছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এ সমস্ত মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আরো কঠোর হওয়া উচিত। এটাও জানি, তারা কঠোর হলে বিভিন্ন সংস্থা তাদের কাজের সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তবে, তাদের সমালোচনার জবাব দেওয়ার সঠিক সময় এটি নয়, কারণ এখন দেশের জনগণকে বাচাঁনোর জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাদের তা-ই করা উচিত। আমরা ইতোমধ্যে কোভিড -১৯ সংক্রমণ পর্বের তিন নম্বর গ্রেডে প্রবেশ করেছি। মানুষের অসচেতনতার এই ধারা যদি আরো এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকে, তবে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে আমাদের মূল্য দিতে হবে।
একদল মানুষ আছে যাদের মধ্যে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করার প্রবণতা রয়েছে। তারা সরকারের বাধ্যবাধকতা বোঝার চেষ্টা করে না। বর্তমানে সরকার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তবে, এই উদ্যোগগুলি সফল করতে হলে সমাজের প্রতিটি মানুষের সর্বাত্মক সহায়তা প্রয়োজন। সরকার অফিস-আদালত ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টসহ সকল কিছু বন্ধ করেছে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে।
দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা এই মহামারি চলাকালীন কিছু ব্যক্তিবর্গকে, যারা জাতির বিবেক হিসাবে পরিচিত, দেখতে পাচ্ছি না। তারা সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা করলেও এখন নিজেরা অভাবী মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসছেন না। তারা যদি কোনো সহযোগিতা না করেন তাহলে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় গৃহীত সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে সমালোচনা করার নৈতিক অধিকারও তাদের থাকা উচিত না।
আমরা বিশ্বব্যাপী অনেক ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রকে দেখেছি যারা এই মহামারি মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সুতরাং, আমাদের বাঁচাতে পারে এমন বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর বিকল্প হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। আর এটি সফল করতে হলে নাগরিকদের সমর্থন প্রয়োজন। ত্রাণ ও সহায়তার অপব্যবহার বন্ধ করতে সরকারের ত্রাণ বিতরণে স্থানীয় সরকারের সাথে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ত্রাণসামগ্রীর অপব্যবহারের প্রবণতা হ্রাস পাবে এবং যাদের প্রয়োজন তারা ত্রাণ পাবেন।
আসুন আমরা এই মহামারি চলাকালীন সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের সমালোচনা না করে আমাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে সরকারকে সহযোগিতা করি। আমরা যদি এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে চাই তবে ঘরে থেকে এবং সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকারের প্রতি আমাদের সহযোগিতা হাত প্রসারিত করতেই হবে।
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর