করোনা ও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। করোনা আমাদের চিকিৎসা কাঠামোয় এমন কিছু ইস্যু নিয়ে এসেছে যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব ইস্যু নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে এবং উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্যও আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে অনৈতিকতা ও অনিয়ম বিরাজ করছে, সেগুলোও দূর করতে হবে করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে জয় লাভ তথা আগামী দিনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজনে।
উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়গুলো স্পষ্ট করা যেতে পারে। প্রথমে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের প্রথম চিকিৎসক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বীরোচিত লড়াই করেছেন। যদিও তিনি মৃত্যুর কাছে হেরেছেন, তথাপি চিকিৎসক সমাজের সামনে রেখে গেছেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারতেন। আগের দিনের সম্মুখযুদ্ধে প্রধান সেনাপতি নিহত হলে তার অধীনস্থ সৈনিকদের মনোবল সহজেই ভেঙে যেত এবং তারা পরাজয় বরণ করতো। করোনাভাইরাসও টার্গেট করেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালের এরকম একজন প্রধান সেনাপতিকে। তার মৃত্যুতে তার সহযোদ্ধাদের মনোবল কেমন থাকতে পারে তা আমরা অনুমান করতে পারছি।
এই সেনাপতির যোগ্যতা কেমন ছিল? একটি মফঃস্বল শহরের সাধারণ পরিবারের ছেলে হয়েও তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এফসিপিএস পাশ করেছিলেন। এখানেই থেমে থাকেননি। কার্ডিওলজিতে এমডি ডিগ্রিও তিনি অর্জন করেন।
ব্যবহারিক জীবনে তিনি ছিলেন পরিশ্রমী ও সত, মানবিক, সমাজসেবক, আদর্শ শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক। তার বন্ধুদের মত আরও উন্নত জীবনের সন্ধানে তিনি বিদেশে পাড়ি দেননি।
কিন্তু করোনা যুদ্ধে এরকম আহত সেনাপতির সাথে কেমন আচরণ করা হল? সিলেটের মত একটি বিভাগীয় শহরে একটি ভেন্টিলেটরেরও ব্যবস্থা করা গেল না তার জীবন বাঁচানোর জন্য। তাকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্স তো দূরে কথা, প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাকে একটি সরকারি এ্যাম্বুলেন্সও দেওয়া হল না। অথচ কিছুদিন আগে যশোর থেকে একজন এসি ল্যান্ডকে পায়ের হাড় ভাঙার জন্য (Closed fracture TIBIA) হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়েছে, যদিও এ চিকিৎসা ওখানেই করা যেত। তাহলে দুইজন সরকারি কর্মকর্তাদের চিকিৎসার মধ্যে এত বৈষম্য কেন? চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার সমান।
ডাক্তাররা সমস্ত মানবতাকেই সমানভাবে চিকিৎসা দিয়ে থাকে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদেরকে যুদ্ধবন্দি করা হয় না। কারণ তাদেরকে শত্রু হোক মিত্র হোক সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে।
অতীত ইতিহাসে এরকম অনেক উদাহরণ আছে। আরব চিকিৎসক হারিস বিন কালাদা পারস্যের জুনদিসপুরে চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। তিনি একজন অমুসলিম হয়েও রাসুল (সা:) ও সাহাবীদের চিকিৎসা করেছেন। জেরুজালেম বিজয়ী গাজি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন ইহুদী, মোসেস মাইমোনাইডস। এটা ঐ সময়ের কথা যখন ইবনে সিনা, আল রাজী, আবুল কাসিম আল জাহরাবি, ইবন জুহর, ইবন নাফিসের মত জগত বিখ্যাত শত শত মুসলিম চিকিৎসক বর্তমান ছিলেন।
ক্রুসেড যুদ্ধে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির প্রতিপক্ষ প্রাণের শত্রু রাজা রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পরেন। সুলতান তার ইহুদী চিকিৎসককে খ্রিস্টান রাজার কাছে পাঠান। তার চিকিৎসায় রাজা সুস্থ হয়ে ওঠেন। সুলতানের উদারতায় রাজা মুগ্ধ হয়ে সন্ধি করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এভাবেই ইতিহাসে চিকিৎসকদেরকে ধর্ম জাতি দল সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হতো।
উদারতা দিয়েই মানুষের মন জয় করা যায়, সংকীর্ণতা দিয়ে নয়। ডা. মঈনের চিকিৎসার সাথে জড়িত সিলেটের কর্তাব্যক্তিরা যে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন তার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর পড়তে বাধ্য। তারা শিখবে যে আদর্শ, সৎ, মেধাবী, ভাল ডাক্তার হওয়ার দরকার নেই।
পৃথিবীর আর কোন দেশে দলীয় রাজনীতির সাথে ডাক্তারদের এভাবে জড়িত থাকা উদাহরণ নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে সেখানে ভর্তি পরীক্ষা থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ, চাকরি প্রমোশন, পোস্টিং সব ক্ষেত্রে মেধাই বিবেচ্য বিষয়। আমার এক ইহুদী প্রফেসর বলতেন, 'আমি ভাল ও খারাপ ডাক্তার বলতে কিছু বুঝি না। আমি বুঝি ডাক্তার বা ডাক্তার নয়'। অর্থাৎ ডাক্তারকে অবশ্যই ভাল হতে হবে। কারণ তাকে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করতে হয়।
অথচ গত আট-নয় বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এমনকি মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায়ও। এতে শিক্ষার মান অবনতি হতে বাধ্য। এছাড়া একটি হাসপাতালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত দুর্নীতি সবকিছুর সাথে দলীয় ডাক্তাররা জড়িত থাকেন।
করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিল এসব অনিয়মের ফল কি হতে পারে। অপর্যাপ্ত বা মানসম্মত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষা সামগ্রীর অভাবে সারা দেশে ১৭০ জন ডাক্তার আক্রান্ত এবং ৩০০ জন ডাক্তার সঙ্গরোধে আছে এই লেখা পর্যন্ত। ডা. আব্দুন নুর তুষার জোরালো ভাষায় কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, ঢাল তলোয়ার ছাড়া চিকিৎসকদেরকে করোনা যুদ্ধে পাঠানোর ব্যাপারে।
এই উদাহরণগুলোর উদ্দেশ্য কাউকে ছোট করা নয় বরং চিকিৎসকদেরকে অনৈতিকতায় ডুবিয়ে দিলে ও দলীয়করণ করলে কী কুফল হতে পারে তা তুলে ধরা এবং চিকিৎসকদের নৈতিকতার বিষয়ে আলোকপাত করা।
কারণ, করোনা এসেছে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একটি জোরালো ঝাঁকুনি দিতে। জানি না আমাদের কতটুকু শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তবে এভাবে যদি চিকিৎসা ব্যবস্থা চলতে থাকে তাহলে আগামী কুড়ি বছর পর বাংলাদেশে কোন ভাল ডাক্তার পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। সান্ত্বনা শুধু এতটুকু যে, অনেকেই ঐ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার সঙ্গে লড়াই করছেন। করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন ত্রুটির বিরুদ্ধেও লড়তে হবে এবং বিরাজমান অসঙ্গতিগুলোকে নির্মূল করতে হবে।
প্রফেসর কর্নেল (অব.) ডা. জেহাদ খান, মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ভাইস প্রিন্সিপাল, প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ।