ক্লিকবাজির কারসাজিতে পড়বেন না, করোনায় বাড়ুক মিডিয়া লিটরেসি
আমার আইসোলেশনের দুই মাস পুরো হতে আর দুই দিন বাকি আছে। ঘরে থেকে কাজ করছি। এবং ড্রয়িংরুমেই বসেছে ওয়ার্ক স্টেশন। মাঝে তিন দিন বের হয়েছি-সাংসারিক প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য সামগ্রী কিনতে। সব ধরনের সতর্কতামূলক ও ভাইরাস প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই কাজগুলো সেরেছি। পেশায় সংবাদকর্মী হিসেবে কোভিড-১৯ এর প্রতিটি আপডেট সম্পর্কেও সচেতন থাকতে চেষ্টা করেছি। দেশের ও বিদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কোভিড-১৯ এর খবর যথার্থই দিতে পেরেছে, এমন মন্তব্যে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, আমারও নেই। কিন্তু এরই মাঝে আমাদের সামনে এমন অনেক তথ্য এসেছে, যা ঢাহা মিথ্যা কিংবা বানোয়াট। সামাজিক মাধ্যমেই সেসব তথ্য বেশি ছড়িয়েছে। এবং সেসব তথ্য নিয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যেটুকু চোখে পড়েছে, তাতে অসংখ্য মানুষকেই দেখা গেছে এসব তথ্য কেবল নিজে বিশ্বাসই করেনি, তা আরো বেশি করে ছড়িয়েও দিয়েছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের চেয়ে বোধহয় একটু বেশি গতিতেই ছড়িয়েছে এসব ভূয়া তথ্য। সবশেষ সুরাইয়া তারা থেকে শুরু করে ভাইরাসের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, জীবাণু অস্ত্র, ব্রিটেনের রাণীর মৃত্যু কিবাং টেক জায়ান্ট বিল গেটসকে এই ভাইরাসের জন্য দায়ী করা পর্যন্ত।
নিজের কিংবা অপরের সুরক্ষায় আমাদের তথ্য জানাটা জরুরি। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থায়, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সঠিক তথ্য বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কিন্তু সে তথ্য যদি হয় বানোয়াট কিংবা অতিরঞ্জিত তাহলে সুরক্ষা দেওয়ার চেয়ে ক্ষতিই বেশি ডেকে আনে। বিকৃত তথ্য ছড়ানোর এই বিষয়টি নিয়েই এখন কথা বলতে হচ্ছে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা একে ইনফোডেমিক বলতেও ছাড়েননি। বলা হচ্ছে বিকৃত তথ্যের কিংবা ভুল তথ্যেরও মহামারি চলছে এখন বিশ্বজুড়ে। চলছে ক্লিকবাজির কারসাজি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই ভূয়া তথ্যের সবচেয়ে বড় আধারে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কড ইন মিথ্যা ও ভূয়া তথ্যের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য জোটবদ্ধ হয়েছে বটে। একটি যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছিলো বানোয়াট তথ্যের বিরুদ্ধে তারা লড়বে একসাথে। কিন্তু হলে কি হবে। ফেসবুক সয়লাব হয়ে থেকেছে সুরাইয়া তারা বিষয়ক খবরে। আর সকল ভূয়া খবরই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। সেখান থেকে হয়তো কোনও কোনও মিডিয়া পিক করেছে। অতি উৎসাহে, কিংবা অতি অজ্ঞতায়।
এই সময়ে সবচেয়ে বেশি যে বানোয়াট খবর যখন তখন ভাইরাল করে তোলা হচ্ছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলো ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে বানানো খবরগুলো। ফেক মেশিন ফ্যাক্টরিতে বানানো অসংখ্য খবর করোনা মহামারিকে নিয়ে অনেক মশকরাও আমাদের চোখে পড়েছে। তার মধ্যে ভ্যাকসিন কার্যকারিতা যাচাইয়ে যে নারীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে, তার মৃত্যুর গুজবটি ছড়িয়েছে ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে।
ভাইরাল হওয়ার উদ্দেশে তৈরি বানোয়াট খবরগুলো ভাইরালিটি পেয়েছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। মানুষ গোগ্রাসে গিলেছে সেসব খবর। সেসব কারণেই মিডিয়া লিটরেসি (গণমাধ্যম স্বাক্ষরজ্ঞান) নিয়ে আলোচনা আবারও সামনে এসেছে। বাংলাদেশ এই মিডিয়া লিটরেসির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা দেশ তাতে সন্দেহমাত্র নেই। চাঁদে এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে দেখা গেছে এমন খবরে বিশ্বাস করে এদেশের মানুষই পুলিশের ওপর হামলে পড়েছে, থানা জ্বালিয়েছে। সামান্য যাচাই করে দেখার তোয়াক্কা না করে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে শুনে, সামাজিক মাধ্যমে লাইভে গিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে জেল খাটতে হয়েছে চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে। করোনার সময়েও এমন অনেক ঘটনা আমরা ঘটতে দেখছি দেশে ও বিদেশে। আর এর সব কিছুই ঘটছে মিডিয়া লিটরেসির অভাবে। কোন খবরটি পড়বো, কোনটি পড়বো না, কোন সংবাদমাধ্যমে আস্থা রাখবো, কোনটি এড়িয়ে চলবো, তা মূলত পাঠককেই বুঝতে হবে। বিশেষ করে, বিষয়টির সঙ্গে যখন জীবন-মরণের সম্পৃক্ততা। এতদিন আমরা মিডিয়া লিটরেসিকে কেবল জ্ঞান কিংবা শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাবতাম। কিন্তু এখন এর সাথে জনমানুষের নিরাপত্তাও যুক্ত হয়েছে। সুতরাং জাতি যত মিডিয়ার বিষয়ে অজ্ঞ কিংবা স্বাক্ষরজ্ঞানহীন থাকবে, ক্ষতি ততই বাড়বে।
এই মিডিয়া লিটরেসি নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছে। মিডিয়া ডায়েটের কথাও বলা হচ্ছে নানাভাবে। কিন্তু খুব একটা কাজের কাজ কিছু হয়নি। বরং যারা মিডিয়া লিটরেট তারা পড়ছেন বিপাকে।
বেশ কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা কার্টুন বেশ ভাইরাল হয়েছিলো। মার্কিন কার্টুনিস্ট ডেভিড সাইপ্রেসের আঁকা সে কার্টুনে দেখানো হয়- এক বয়ঃবৃদ্ধ যুগল পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছেন আর তাদের মধ্যে নারীটি বলছেন, ‘সবকিছু জেনে আপডেটেড থাকার ইচ্ছা এখন সুস্থ মস্তিষ্কে বেঁচে থাকার ইচ্ছাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’ (মাই ডিজায়ার টু বি ওয়েল ইনফর্মড ইজ কারেন্টলি এট অডস উইথ মাই ডিজায়ার টু রিমেইন সেইন।)
করোনাভাইরাসের সময়ে এসে খবর, তথ্য আর কনটেন্টের বন্যায় আজ সবারই বুঝি ত্রাহি দশা।
মনে হচ্ছে আমরা খবরের এক ঘূর্ণাবর্তে বাস করছি আর তথ্যরাজি সারাটিক্ষণ আমাদের সদা ঘূর্ণমান মস্তিষ্কে অবিরাম আঘাত হেনে চলছে। খবরের শিরোনামে শিরোনামে আমরা জর্জরিত। এতে এমনই দশা হয়েছে যে কিছু কিছু মানুষ এখন নিজেকে খবরের জগত থেকেই গুটিয়ে নিতে চাইছেন। বলে দিচ্ছেন- আর যাই হোক বাবা খবরের কাছেধারে ঘেঁষছি না। কিন্তু তথ্য না জেনে, খবর না শুনে, না দেখে কিংবা না পড়ে এই করোনার ক্রান্তিতে নিজেকে স্থির রাখাও অসম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- তথ্য কিংবা খবরের ভোক্তারা তাদের অভ্যাস যে খুব একটা বদলেছে তা নয়, কিন্তু খবর পরিবেশনের পদ্ধতিগত পরিবর্তন পাঁচবছরে পর্যাপ্তই ঘটেছে, আর তার ফল দাঁড়িয়েছে- মানুষ এখন খবরের ভারে আক্রান্ত। তার উপরে এসে পড়েছে এইসব মিথ্যা আর ভূয়া খবরের খাড়া।
প্রধানত সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণে। সেতো এক বড় জ্বালা। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমের বিপুল তথ্যস্রোত সবাইকে হিমশিম খাইয়ে ছাড়ছে। আপনি যদি একবার ঢুকে পড়েছেন, আর কোনও কিছুতে মনোযোগ দিয়েছেন তো মরেছেন। একটা কিছু পড়ছেন তো আরও হাজারো কিছু হাজির হয়ে যাবে আর আপনাকে পড়িয়েই ছাড়বে। অ্যালগরিদমে ওরা হিসাব কষে নেবে আপনার আগ্রহের কথা আর সে মোতাবেক স্ক্রলডাউনে হাজির করে দেবে রাজ্যের সব পোস্ট।
ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস গ্রাহাম সি এল ড্যাভিও এ নিয়ে বলেছেন- অনেক মানুষ খবর পড়ে জানে, কারণ তারা অসচেতন কিংবা অজ্ঞ থাকতে চায় না। কিন্তু তাদের ধৈর্য্যের সীমা বুঝি আজ ভেঙে গেছে, আজ তারা হয়তো মহা বিরক্তও। বিশেষ করে নেতিবাচক খবরগুলোতো মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে। এতে তাদের ব্যক্তিগত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাও বেড়ে যায়। ফলে এটা তাদের ক্ষতিরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর একটি ভূয়া খবর, কিংবা একটি বানোয়াট ভিডিও আরেকটি বানোয়াট ভিডিওকেই ডেকে আনছে। ফলে মিথ্যার আবর্তেও ঘুরপাক খেতে হচ্ছে মানুষকে।
এটা চব্বিশ ঘণ্টার নিউজ সাইকেলের যুগ। তথ্যই এখন আপনার জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। আঙুলের সামান্য চাপেই খবর আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এ অবস্থায় কি পড়বেন আর কি পড়বেন না, কখন পড়বেন আর কখন পড়বেন না তা নির্ধারণ করতে পারাও একটি যোগ্যতা। ফলে আমরা এখন আবারও মিডিয়া লিটরেসির ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। আপনার নিউজ লিটরেসি দক্ষতা কতটুকু তার ওপরই নির্ভর করবে আপনার ভালো খবর, সঠিক খবর পড়া ও জানা।
একটি বিষয় প্রায়শই শুনতে বা জানতে পাই… অনেকে আপাতদৃষ্টে সচেতন, শিক্ষিত মানুষও এমন সব সংবাদের কিংবা সংবাদমাধ্যমের রেফারেন্স টানেন যে সংবাদকর্মী হিসেবে ভিরমি খেতে হয়। কারণ আমরা জানি এগুলো স্রেফ গুজব কিংবা স্রেফই সেই সব ভূইফোঁড় মাধ্যম, যার নেই কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। যেমন- ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড যখন একটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালালো এলিসা গ্র্যানাটো নামের এক নারীর দেহে। তার পরপরই খবর বের হলো তিনি মারা গেছেন। আর সে খবর বাংলায় অনুদিত হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হতে লাগলো। আর যায় কোথা মানুষ সে খবর বিশ্বাস করে হা-হুতাশ করতে লাগলো। কিন্তু পরে জানা গেলো মৃত্যুর তথ্য স্রেফ বানোয়াট।
এএফপি খবর দিয়েছে, ফ্রান্সের সংবাদ সংস্থাটি ফেসবুকের সঙ্গে মিডিয়া লিটরেসি বাড়ানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। কোভিড-১৯ এর সময়ে ব্যাপকহারে ভূয়া খবর ছড়িয়ে পড়ার কারণেই সে উদ্যোগ। নেওয়া হয়েছে ডিজিটাল ভেরিফিকেশনেরও ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে হয়তো এখনই তা সম্ভব নয়। এখানে নিজেকে তৈরি করতে হবে নিজেকেই।
মনে রাখতে হবে, যখন আপনি আপনার কম্পিউটার খুলে বসেন, কিংবা মিনিস্ক্রিনে চোখ রাখেন, আপনি নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রক। কোনটি খবর, কোনটি খবর নয়, কোনটি সঠিক, কোনটি বানোয়াট, কোন মিডিয়া সঠিক তথ্য দেয়, কোন মিডিয়া সত্য-মিথ্যার ধার ধারে না, এসব কিছু আপনাকেই জানতে হবে। নিজেকে বাছাই করে নিতে হবে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও খবরটি। তা না হলে- সুরাইয়া তারা দেখতে রাতভর আকাশপানে তাকিয়ে থাকতে হবে। আপনি জানতেও পারবেন না এসব স্রেফ ক্লিকবাজির কারসাজি। মনে রাখবেন- সোশ্যাল মিডিয়ায় কোভিড-১৯ নিয়ে ভূয়া তথ্যের ছড়াছড়ি রয়েছে। ফলে যখনই কোনও তথ্য পাবেন বিশ্বাস না করে, তথ্যের সরকারি উৎসগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিন। ব্যক্তিগত পোস্টে নয়, নির্ভরযোগ্য মিডিয়াগুলোর পোস্ট থেকে খবর জানুন। যেসব খবর আপনাকে আতঙ্কিত করে তোলে, সে খবরে চোখ না রেখে, তথ্যভিত্তিক খবরগুলো দেখুন, যা আপনাকে সুরক্ষা দেবে। আরও দশজনে করছে বলে, আপনিও করে বসবেন না যেনো। আপনার নিজের বিবেচনা কাজে লাগান। কোভিড-১৯ নিয়ে এক ধরনের নোংরা রাজনীতিও কিন্তু চলছে, সেসব ব্যাপারেও সচেতন থাকুন। এতে নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি আপনার মিডিয়া লিটরেসিও বাড়বে। ঘরে থাকার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সেটুকু নিশ্চিত করা গেলে, তাও কম অর্জনের হবে না।